ইংরেজি ১৯৪৭ সালটিকে ঐতিহাসিক সাল বা ঘটনাবহুল বছর বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। তার কারণ, এই বছরটিতে একইসাথে অনেক স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। তন্মধ্যে প্রধানভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ভারত বিভাগ। ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির কৌশলে, কিংবা জিন্নাহ এবং নেহরুর ক্ষমতা লাভের প্রবল মোহে ১৪ এবং ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান এবং ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই বছরেই।
এছাড়াও আরও কিছু ঘটনা এই বছরটিকে মনে রাখার মতO করার পেছনে প্রভাব রেখেছে। যেমন- ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সূত্রপাত এ বছরেই। নভেম্বরে জাতিসংঘের সুপারিশে ইসরায়েলকে দাপ্তরিক স্বীকৃতি দানের পরবর্তী বছর, মানে ১৯৪৮ সালেই তারা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে এবং ১৯৪৯ সালের মার্চে যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে তারা সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। আবার এ বছরই তাৎক্ষণিকভাবে ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত পোলারয়েড ক্যামেরার সফল প্রদর্শনী হয়।
এখানেই শেষ নয়, এ বছরই বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্ম হয়, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্টিফেন কিং, হিলারি ক্লিনটন, ডেভিড বাওয়ি, টম ক্ল্যান্সি, স্টিভ ফোর্বস, এল্টন জন, আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার প্রমুখ। তাদের প্রত্যেকেই একেকজন একেক দিগন্তের দিকপাল হিসেবে সুপরিচিত। বাংলাদেশের বিবেচনায় এই বছরেই জন্মেছিলেন সাহিত্যাঙ্গনে সাহসী কণ্ঠস্বর হুমায়ূন আজাদ, সেই সাথে তালিকায় আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এত এত নামী দামী মানুষের জন্ম এবং তার সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনায় এ বছরটি খুব স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসের পাতায় শক্ত অবস্থানের দাবিদার। তবে এসব ঘটনার বাইরেও এ বছরের শেষভাগে এসে একটি ঘটনা একে একেবারে পূর্ণতা প্রদান করে। কারণ, এটি যেন-তেন কোনো ঘটনা নয়, এর সাথে বর্তমান বিশ্বের অগ্রযাত্রার সিংহভাগই জড়িত এবং মানুষের বর্তমান জীবনের চলাফেরার প্রতিটি পদক্ষেপ এর প্রতি ঋণী বলা চলে।
নবদিগন্তের পদাবলি রচনার সূচনালগ্নে
ডিসেম্বর ২৩, ১৯৪৭; মঙ্গলবার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে আর ১০টি সাধারণ দিনের মতোই একটি দিন। পার্থক্য শুধু জনমনে উৎসবের আমেজ বিরাজমান, দুদিন পরেই যে বড়দিন আসন্ন। আবার তার সপ্তাহখানেক পরেই নতুন বছরের ডাক কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। কাজেই শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন অনেকে; পরিকল্পনায় মত্ত আছেন কীভাবে উৎসবে মাতবেন, কীভাবে উদযাপন করবেন সামনের দিনগুলো।
উৎসব উৎসব ভাব আকড়ে আছে এই নিউ জার্সিরই আরেকটি জায়গায়। স্থান নিউ প্রোভিডেন্সের মারে হিল, যেখানে আছে একটি গবেষণাগার। এটি সেই গবেষণাগার, যেখানে ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত কর্মরত ছিলেন। নাম বেল ল্যাবরেটরিজ। টেলিফোন উদ্ভাবন করে যিনি জগৎবিখ্যাত হয়ে আছেন, সেই অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিজ্ঞান গবেষণায় এটি রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সেই সাফল্যেরই ধারাবাহিকতায় আজকে আরও একবার সৃজনশীলতার উন্মাদনায় মাততে যাচ্ছে বেল ল্যাবস। সহকর্মীদের সামনে এক প্রদর্শনী দেখাবেন জন বার্ডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন এবং উইলিয়াম শকলি। এটা নিয়ে সবাই খুব উৎফুল্ল।
প্রদর্শনীতে সহকর্মীরা দেখতে পান, অর্ধপরিবাহী স্ফটিকের একটি কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রের একদিকে ইনপুট হিসেবে কণ্ঠস্বর দিলে অন্যদিকে তা অনেক গুণে বিবর্ধিত হয়ে শোনা যাচ্ছে। অসাধারণত্বটা কণ্ঠস্বরের বিবর্ধনে নয়, কারণ লাউডস্পিকার দিয়েই এটা পাওয়া সম্ভব, অসাধারণত্বটা বরং বিবর্ধনের মাত্রায়। পূর্বে তড়িৎ প্রবাহের বিবর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হত ভ্যাকুয়াম টিউব, যা থেকে বিবর্ধনের প্রাপ্তি ছিল এই নতুন যন্ত্রটির তুলনায় অনেক কম। আর ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে উচ্চ বিবর্ধন পেতে গেলে যে পরিমাণ তড়িৎ প্রবাহ প্রয়োজন ছিল, এই নব্য আবিষ্কারে তার থেকে অনেক কম প্রবাহ থেকেই তুলনামূলক উচ্চ বিবর্ধন পাওয়া যাচ্ছে।
তিন বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কার পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তাদেরকে এনে দেয় বিজ্ঞান সাধনায় পরম আরাধ্য সম্মাননা, নোবেল পুরস্কার। আর তাদের গবেষণার এই ফসলের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বর্তমান গতিশীল বিশ্বের কেন্দ্রে থাকা কম্পিউটার এবং কম্পিউটারের প্রধান চআলক ইলেকট্রনিক্স। বৈশিষ্ট্যসূচক আচরণ থেকে এর নাম দেয়া হয় ট্রানজিস্টর।
ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে
উদ্ভাবনের পর শকলি ট্রানজিস্টরের বিশাল সম্ভাবনার বিষয়টি অনুধাবন করতে সমর্থ হন। তিনি এর সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালে বেকম্যান ইনস্ট্রুমেন্টসের একটি অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে স্যান্টা ক্লারা ভ্যালি নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন শকলি সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরি, যেখান থেকেই পরবর্তীতে বর্তমানের সিলিকন ভ্যালির উত্থান। আচরণগত কিছু ত্রুটির কারণে তিনি তার পুরাতন সহকর্মীদের কাউকেই এখানে যোগদানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারেননি। উপায়ান্তর না দেখে তিনি একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন কোম্পানিতে খোঁজখবর করে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডক্টরেট অথবা বিভিন্ন স্বনামধন্য কোম্পানিতে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে চাকরি করা অনন্যসাধারণ মেধাবীদের কাছে তিনি টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন এবং নিজের পরিকল্পনা ব্যক্ত করে তার সাথে কাজ করতে আহ্বান জানান।
ট্রানজিস্টর উদ্ভাবনের পর ১৯৫৪ সালে ট্রানজিস্টর রেডিওর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এবং তার সাথে নোবেল পুরস্কারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করলে শকলি তখন বিজ্ঞান জগতের প্রধান আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বদের একজন। কাজেই তার সাথে কাজ করার আহবান ছিল স্বপ্নের মতো। তার সাথে কাজ করার আহ্বান পাওয়াটা পরবর্তীতে ইন্টেলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট নয়েসের ভাষায়,
It was like talking to God
পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, তড়িৎ প্রকৌশলী ও যন্ত্র প্রকৌশলী, ধাতুবিদ্যা বিশারদসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মানুষদের সমন্বয়ে গড়া এ দলটি আসলেও তৎকালীন সময়ে ইলেকট্রনিক্সের গবেষণা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়া শ্রেষ্ঠ দল, আর তা যদি না-ও হয়, শ্রেষ্ঠত্বের খুব কাছাকাছিই ছিল তাদের অবস্থান। নতুন অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এমআইটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করা জে লাস্ট, জন্স হপকিন্স ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রসায়নবিদ গর্ডন মুর, দুটি ডক্টরাল ডিগ্রীধারী সুইস পদার্থবিদ জন এর্নি, যিনি আবার ক্যাল টেক থেকে চাকরির ব্যাপারে উচ্চ সুপারিশপ্রাপ্ত এবং এমআইটির আরেক নক্ষত্র রবার্ট নয়েস। এদের সকলের মধ্যে শুধুমাত্র রবার্ট নয়েসেরই ট্রানজিস্টর নিয়ে বেশ ভালো জানাশোনা ছিল।
সুখ টিকলো না বেশিদিন
শকলির প্রত্যাশা ছিলো, এই বৈচিত্র্যপূর্ণ দলটি দিয়ে তিনি অর্ধপরিবাহী শিল্পে আনবেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সে পথেই হাঁটছিলেন তারা। কিন্তু, গোল বাঁধলো এক জায়গায়। নিয়োগদাতা হিসেবে বা রত্ন চেনার ক্ষেত্রে শকলি ছিলেন যেমন সিদ্ধহস্ত, ঠিক তেমনটাই নিম্নমানের ছিলেন তিনি ব্যবস্থাপক হিসেবে। তার চারিত্রিক আচার-আচরণ, হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা, নিজের চিন্তাভাবনাকেই সবসময় সঠিক মনে করা ও গুরুত্বের সাথে নেয়া, এসব কারণে তাঁর অধীনে কাজ করার ক্ষেত্রে স্ব স্ব অঙ্গনে পারদর্শী এই কর্মীরা ধীরে ধীরে অসন্তুষ্ট হতে থাকেন। এমনও ঘটনা আছে যে, কোনো একজন হয়তো একটি নতুন ধারণা নিয়ে শকলির কাছে গেলেন, আর শকলি তার কথাকে আমলে না নিয়ে দেখা গেল বেল ল্যাবের পুরাতন কোনো সহকর্মীর কাছে টেলিফোনযোগে সেই ধারণার ব্যাপারে মতামত নিচ্ছেন।
এভাবে চলতে চলতে একসময় অসন্তুষ্টির মাত্রা চরমে পৌঁছলে ৮ জন কর্মী সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা আর শকলির অধীনে কাজ করবেন না। তাদের মাঝে ছিলেন জুলিয়াস ব্ল্যাংক, ভিক্টর গ্রিনিচ, ইউজিন ক্লাইনার, শেলডন রবার্টস সহ পূর্বোক্ত ৪ জন। বিষয়টি তারা বেকম্যানকে অবহিত করলে তার মত ছিল,
Shockley is the boss. Take it, or leave it.
এই ৮ জনের মধ্যে রবার্ট নয়েসের মনে কিঞ্চিৎ দোনোমনা ছিল এই পরিবর্তনের ব্যাপারে। আসলে, দোনোমনা যে কারো মনেই ছিল না, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না একেবারেই। কারণ, আজকাল সারা বিশ্বে চাকরি পরিবর্তন যতটা সাধারণ ঘটনা, ঠিক ততটাই অচিন্ত্যনীয় ঘটনা ছিল এটা তখনকার প্রেক্ষাপটে। ‘এক জীবনে চাকরিতে একবারই যোগদান করা’র ধারণাটি তখনও সর্বসাধারণে গ্রহণযোগ্য এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সহিতই পালিত হত। কিন্তু, এই ধ্রুপদী ৮ জন সেই ধারণার পালে হাওয়া লাগাতে দেননি। এর বাইরেও আরেকটি বিষয় ছিল যে, নয়েসের ট্রানজিস্টর সংক্রান্ত জ্ঞানের কারণে তার ওপর বেশ কিছু দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল শকলি সেমিকন্ডাক্টরের। তাই নয়েস প্রথমে যথেষ্টই অনিচ্ছা পোষণ করেছিলেন এ ব্যাপারে।
অজানার পথে আটজন
পরবর্তীতে নয়েস মত বদলালে তারা আটজন ওয়াল স্ট্রিট ভিত্তিক পুঁজিদাতা প্রতিষ্ঠান হেডেন স্টোনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট) আর্থার রকের পরামর্শ অনুযায়ী কোম্পানি খুঁজতে থাকেন, যারা তাদেরকে সেই সুযোগটা দিতে পারবে। কিন্তু, কোনো কোম্পানিই তাদের নিজস্ব অঙ্গনের পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র অর্ধপরিবাহী বিভাগ খুলতে পক্ষপাতী ছিল না। শেষতক এগিয়ে আসেন ফেয়ারচাইল্ড ক্যামেরা অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টের স্বত্বাধিকারী এবং আইবিএম এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান জর্জ উইনথর্প ফেয়ারচাইল্ডের সন্তান প্রখ্যাত ধনকুবের উদ্যোক্তা শারম্যান ফেয়ারচাইল্ড।
ফেয়ারচাইল্ড তাদেরকে ১.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার দিতে সম্মত হন, বিনিময়ে যেকোনো সময়ে একে টাকা দিয়ে কিনে নেয়ার ক্ষমতা নিজের হাতে রাখেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় ‘ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর’ আর ধ্বসে পড়ে ‘শকলি সেমিকন্ডাক্টর’। তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই একে ভালো চোখে নেয়নি, বারবার সতর্ক করছিল এর ফলাফল নিয়ে। কিন্তু পিছপা হমনি এই ৮ বিশ্বাসঘাতক (Traitorous 8), ‘এক জীবনে এক চাকরি’ ধারণা থেকে বের হয়ে আসার পরে এই নামেই অভিহিত হন তারা, এবং পরবর্তীতে তাদের হাত ধরেই ইলেকট্রনিক্স শিল্পে আসে বসন্ত, যারা সাক্ষী হয় গোটা বিশ্ব।