সময়টা খুব বেশি আগের না। পাঁচশো বছরের একটু বেশি হবে হয়তো। ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদ তখনো ঠিক সেভাবে শুরু হয়নি! তবে ইংরেজদের শত শত বছরের প্রাচীন রাজপরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কারণে তখনো ইংল্যান্ডকে সমীহ করে চলতো আর সব দেশগুলো। তখনকার শান্ত সেই ইংল্যান্ড থেকেই মূলত শুরু হয়েছিল ইতিহাসখ্যাত ইংলিশ রিফর্মেশন মুভমেন্ট! যার শেষ ফলাফল দাঁড়ায় হাজার হাজার নিরীহ প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানের রক্তপাতে! কী হয়েছিল সে সময়টায়? জানতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে যেতে হবে আরো পাঁচশো বছর!
সালটা ১৫০০। তখনও প্রোটেস্ট্যান্টদের উদ্ভব হয়নি। পৃথিবীজুড়ে তখন ছিলো ক্যাথলিক খ্রিস্টানেরা। ক্যাথলিকদের মাঝে ধর্মভীতি ছিলো প্রবল। তখনকার সময়ে রোমের ভ্যাটিকানে থাকা পোপ ছিলেন ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু। একক ক্ষমতাবান পোপ তখনকার খ্রিস্টপ্রধান সব দেশের রাজকীয় গির্জায় আর্চ বিশপ নিয়োগ দিতেন। এ আর্চ বিশপেরা ছিলেন নির্দিষ্ট ওই দেশের প্রধান ধর্মগুরু, যিনি সরাসরিভাবে পোপের অধীনে থাকতেন। অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে গেলে, রোমান পোপ সকল খ্রিস্টান দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ধর্মগুরু ছিলেন ও সকল রাজকীয় সকল গির্জা তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো। এই দেশগুলোর মানুষেরা ক্ষমতাসীন রাজ পরিবারকে যেমন মেনে চলতো, একইভাবে সম্মান করে চলতো রাজকীয় গির্জায় আর্চ বিশপকেও। যে কারণে প্রতিপত্তির দ্বন্দ্বে রাজ পরিবার ও রাজকীয় গির্জার বিশপদের মাঝে সবসময়ই একটা প্রচ্ছন্ন স্নায়ুযুদ্ধ চলমান থাকতো।
তৎকালীন সময়ে বাইবেল শুধুমাত্র পাদ্রীদের জন্যে উন্মুক্ত ছিলো। সাধারণ খ্রিস্টানদের বাইবেল নিয়ে বিস্তারিত জানার অনুমতি ছিলো না। পাশাপাশি বাইবেলের ভাষা ছিলো হিব্রু, যা পাদ্রী ছাড়া অন্য কেউ ভালোভাবে বুঝতো না। খুব স্বাভাবিকভাবেই দুর্বোধ্য বাইবেলের ভার্সগুলোর মর্মোদ্ধারের জন্যে সাধারণ খ্রিস্টানদেরকে ধর্ণা দিতো হতো খিস্টান পাদ্রীদের কাছে।
সমস্যার সূত্রপাত এখানেই। আস্তে আস্তে পাদ্রীরা বাইবেলের অনুবাদে পরিবর্তন আনা শুরু করলেন। নিজেদের সুবিধেমতো ও প্রয়োজন অনুসারে বাইবেলের বিকৃত অনুবাদ শুরু করলেন। হিব্রু না জানা সাধারণ খ্রিস্টানেরা ব্যাপারগুলি বুঝে উঠতে পারতো না। ধর্মীয় প্রবল বিশ্বাস ও ভীতির কারণে কেউ পাদ্রীদের বিরুদ্ধাচারণ তো দূরে থাক, সন্দেহ করার সাহস পর্যন্ত পেতো না। পাদ্রীরা যা বলতেন তা-ই বিশ্বাস করতো সবাই। এভাবেই হয়তো চলতো আরো অনেক বছর, যদি না ক্যাথলিক পাদ্রী মার্টিন লুথার এগিয়ে না আসতেন!
১৫১৭ সাল। জার্মানির ক্যাথলিক ধর্মগুরু মার্টিন লুথার সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে সাধারণ খ্রিস্টানদের ঠকানো উচিত হচ্ছে না৷ তিনি অন্য পাদ্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউই তার কথার প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব দিলো না। মার্টিন লুথার দমে গেলেন না। তিনি খুঁজে বের করলেন তার মতো আরো কয়েকজনকে যারা চার্চের এই ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা পছন্দ করতো না।
চার্চের এ অনৈতিক কার্যাকলাপের হাঁড়ি প্রথমবারের মতো উন্মোচিত হয় ১৫১৭ এর শেষদিকে, যখন মার্টিন লুথার যাবতীয় তথ্য প্রমাণাদিসহ তার নিজের লেখা ‘থিসিস ৯৫‘ বইটি প্রকাশ করেন। সেখানে চার্চের দূর্নীতি, বাইবেলের ভাবার্থ বিকৃতিসহ যাবতীয় অনিয়মের সকল কথা তুলে ধরেন সবার সামনে। এতে টনক নড়ে যায় সকল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মাঝে। ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে কিছু মুক্তমনা খ্রিস্টানদের। তারাও চার্চের সার্বিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে থাকেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রমাণ সহকারে মার্টিন লুথার তার গবেষণা বই বের করলেও বেশিরভাগ গোঁড়া খ্রিস্টানে মার্টিনের পক্ষ নেয়নি। তারা তখনো ধর্মভীরুতার জায়গা থেকে চার্চকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো। এ দ্বন্দ্ব থেকেই খ্রিস্টানদের মাঝে প্রথমবারের মতো জাতিগতভাবে ফাটলের সূচনা হয়। দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। চার্চের পক্ষাবলম্বী গোঁড়া খ্রিস্টানরা ক্যাথলিক আর সংস্কারপন্থীরা প্রোটেস্ট্যান্ট।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- জার্মানিতে শুরু হওয়া এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের নামের সাথে ‘ইংলিশ’ শব্দটি কীভাবে যুক্ত হলো! তা জানতে হলে আমাদের আরেকটু পেছাতে হবে। জানতে হবে ইংল্যান্ডের তখনকার রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপট।
ইংল্যান্ডে তখন রাজা ছিলেন অষ্টম হেনরি! হেনরির স্ত্রী, অর্থাৎ তৎকালীন ইংল্যান্ডের রানীর নাম ছিলো ক্যাথরিন। রাজবংশ রক্ষার্থে হেনরির খুব শখ ছিলো একটি পুত্রসন্তানের, কিন্তু ক্যাথরিনের গর্ভে জন্ম নেয় মেরি নামের এক কন্যাশিশু। মুষড়ে পড়া হেনরি একপর্যায়ে ক্যাথরিনের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে তার সাথে ক্যাথেরিনের এক সখীর সাথে প্রেম হয়। যার নাম ছিলো এনিবোলিন, যিনি ইতিহাসে পরিচিত ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের মা হিসেবে!
হেনরির সাথে সম্পর্ক চলাকালে এনিবোলিন সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। তখন হেনরি ভেবে দেখেন, এনিবোলিনের যে সন্তান হবে সে যদি ছেলে সন্তান হয় তবে তার সিংহাসন রক্ষা হবে। কিন্তু সেই সন্তানের চাই সামাজিক স্বীকৃতি, চাই হেনরি-এনিবোলিনের বৈবাহিক পরিচয়। সব দিক ভেবে হেনরি ঘোষণা দিলেন- তিনি এনিবোলিনকে বিয়ে করবেন। পাশাপাশি তিনিও এটাও বলে দিলেন যে, এনিবোলিনের সন্তান হবে ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার!
কিন্তু হেনরির এ সিদ্ধান্তে বাঁধ সাধলো ইংল্যান্ডের চার্চের আর্চ-বিশপ। কারণ ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের নিয়ম মতে, স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য বিয়ে করা বাইবেল সম্মত নয়। সুতরাং, ধর্মীয় রীতি লঙ্ঘন হবে এই কারণ দেখিয়ে আর্চ বিশপ হেনরির এ বিয়ে অবৈধ ও এনিবোলিনের গর্ভে থাকা সন্তানকেও অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। তবে, এ ঘোষণার পেছনে ধর্মীয় অনুশাসন যতটা না কার্যকর ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক প্ররোচনা।
হেনরির দ্বিতীয় বিয়ে ও এনিবোলিনের সন্তানের সিংহাসন গ্রহণ কোনোভাবেই ক্যাথরিন মেনে নিতে পারেননি। তৎকালীন রোম ছিল স্পেনের অধীনে। ক্যাথলিক মূল ধর্মগুরু পোপ থাকতেন রোমে। আর স্পেনের রাজা তখন ক্যাথরিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, রাজা পঞ্চম ফিলিপ। সুতরাং, অনুমেয়ভাবেই পোপের উপর রাজা ফিলিপের প্রচ্ছন্ন একটি কর্তৃত্ব ছিল। স্বাভাবিকভাবেই পোপ এ বিয়েকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন।
আর্চ-বিশপের এমন সিদ্ধান্তে যারপরনাই রেগে যান হেনরি। তখন ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্টদের রিফর্মেশন আন্দোলন আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। হেনরি এ সুযোগটিকে কাজে লাগালেন। তিনি সুযোগ বুঝে ইংল্যান্ডে থাকা ক্যাথলিক আর্চ-বিশপকে চার্চ থেকে বের করে দেন ও একইসাথে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পাশাপাশি তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের উস্কে দেন চার্চবিরোধী আন্দোলনে। এবার হেনরি নিজের নিয়োগ দেওয়া আর্চ-বিশপের কাছে জানতে চান তিনি এনিবোলিনকে বিয়ে করলে তা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হবে কি না। খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন আর্চ-বিশপের রায় হেনরির পক্ষে যায়। অর্থাৎ নতুন আর্চ বিশপের সিদ্ধান্ত মতে, হেনরি চাইলে এখন এনিবোলিনকে বিয়ে করতে পারবেন এবং তাদের সন্তান ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারবে।
মূলত, হেনরি তার নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে ইউরোপে চলমান রিফর্মেশন আন্দোলনকে ইংল্যান্ডে একপ্রকারে নিজ দায়িত্বে প্রচারণা চালান। যার প্রভাব পড়ে তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহে। আর্চ বিশপকে বের করে দেয়া ও বাইবেলের নির্দেশ অমান্য করে ক্যাথলিকদের সাথে একপ্রকারে প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচারণ করেন রাজা হেনরি।
জার্মানিতে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হওয়া চার্চ রিফর্মেশনের আন্দোলনে যখন ইংল্যান্ডের রাজ পরিবার জড়িয়ে পড়ে, মূলত তখন তা আর বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে না থেকে জাতীয় রূপ নেয়। সংস্কারপন্থীদের এই বিখ্যাত আন্দোলনের সূচনা জার্মানিতে হলেও ইতিহাস একে ইংলিশ রিফর্মেশন মুভমেন্ট হিসেবেই মনে রেখেছে। রাজনৈতিক স্বার্থ হোক বা ধর্মীয়, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের মাঝে বিভাজন তৈরিতে যে ইংলিশ রিফর্মেশন মুভমেন্ট মূল ভূমিকা রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই!
ইংরেজদের সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) পলাশীর এক ইংরেজ সৈনিকের কালপঞ্জি
২) বাংলার ইতিহাস: ভারতে ইংরেজ রাজত্বের সূচনাপর্ব