তাকে নিয়ে মানুষ যতটা বুঁদ হয়েছে ইতিহাস জুড়ে, অন্য কোনো প্রাণী নিয়ে ততটা হয়নি। বিভিন্ন সংস্কৃতির উপকথায় দুর্দান্ত সব আখ্যানের অন্যতম আকর্ষণ এটি। প্রাচীন গ্রীস থেকে ভারত, মেসোপটেমিয়া থেকে চীন- কোথায় আলোচিত হয়নি? এরিস্টটল, টিসিয়াস, প্লিনি, স্ট্র্যাবো কিংবা মার্কো পলোর মতো পণ্ডিতেরা পর্যন্ত তার অস্তিত্বের পক্ষে সাফাই গেয়ে গেছেন।
ইউনিকর্ন, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পৌরাণিক প্রাণী। তার মধ্যে এমন অনেক গুণাবলি বিদ্যমান, যা যে কারো কাছে পরম মূল্যবান। তাদের গতি আলোর গতির সাথে তুলনীয়। সাধারণ সময়ে শান্ত ও পবিত্র হলেও প্রয়োজনে প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী। শক্তিতে কোনো ইউনিকর্নকে আটক করা একেবারেই অসম্ভব।
মোটা দাগে ইউনিকর্ন
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত দেওয়া হয়েছে ইউকর্নকে উপস্থাপন করার জন্য। খুব সাধারণ বর্ণনা মতে, সাদা বড় ঘোড়ার মতো দেখতে এরা। ঠিক কপালের মাঝখানটাতে আছে পেঁচানো লম্বা শিং, যার অগ্রভাগের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গেছে। পৌরাণিক লেখকদের প্রথম দিকের লেখকেরা কেউ কেউ তাকে বেগুনী বর্ণের মাথার অধিকারী বলেছেন। কেউ বলেছেন, সিংহের লেজের মতো লেজের কথা। সেই সাথে ছাগলের দাঁড়ির মতো দাঁড়িও সংযুক্ত করা হয়েছে কারো বর্ণনায়। গ্রীক পণ্ডিত টিসিয়াস বলেছেন- প্রাণীটা গাধার মতো। যার লাল মাথা, নীল চোখ এবং সাদা শরীর। তিরিশ সেন্টিমিটার লম্বা শিংয়ের গোড়ায় সাদা, মাঝখানে কালো এবং ডগায় লাল। প্লিনির বর্ননা মতে, ইউনিকর্নের মাথা হরিণের ন্যায়। শূকরের লেজের মতো লেজ এবং শিং এক মিটার লম্বা।
তারপরেও একটা বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। ইউনিকর্নের অলৌকিক ক্ষমতার জন্য মানুষ তাকে খুঁজেছে হন্যে হয়ে। অভিজাতরা তাদের আভিজাত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা শত্রুর কুনজর থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠেছে তার শিং-এর আশায়। সামর্থহীনরাও প্রত্যাশা করেছে নিজেদের ভাগ্য উন্নোয়নে। গড়ে উঠেছে অন্যরকম এক ব্যবসা। যদিও প্রায়শ শিংগুলো হয় গণ্ডার ধাঁচের। কিন্তু তারপরেও তা অর্থনৈতিক প্রবাহ তৈরি করেছে ভিন্নভাবে। জিনিসটার আশির্বাদ তখন ছিল স্বর্ণ কিংবা যেকোনো মূল্যবান পাথরের চেয়েও মূল্যবান।
চীনের ইউনিকর্ন
চীনা উপকথায় বিশেষ এক জন্তুর নাম কি-লিন। কি-লিনকে নেওয়া যায় চীনের ইউনিকর্ন হিসেবে। যদিও গ্রীক উপকথার কাইমেরার সাথেও কি-লিনের মিল বিদ্যমান। কি-লিনের শরীর দেখতে হরিণের মতো কিন্তু মাথাটা সিংহের। সবুজ আঁশ দিকে ঢাকা শরীর। একটা লম্বা শিং মাথার ঠিক মধ্যভাগে স্থিত। জাপানি উপকথায় কিরিন নামে যে জন্তুর ধারণা, তা চীনা কি-লিন থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়।
কি-লিনকে শান্তিপ্রিয় এবং অলৌকিক হিসাবে গণ্য করা হয়। সে সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে যাবার সময় একটা পাতাও ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। তারপরেও তাদের যাতায়াত অধিকাংশ সময় মেঘ কিংবা পানির উপর দিয়ে। একটা মানুষ ভালো না খারাপ, তার দিকে তাকিয়েই বুঝে নিতে সক্ষম তারা। সাধারণ সময়ে শান্ত হলেও মন্দ লোকদের শাস্তি দেবার জন্য তারা নিজের অমেয় শক্তির প্রকাশ ঘটায়। ইউনিকর্নের মতোই তাকে উর্বরতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। তারা শিল্পকলায় উঠে এসেছে নবদম্পতির জন্য সন্তান দানকারী হিসাবে।
আফ্রিকান সংস্কৃতি
কঙ্গো উপকথায় আবাদা নামে ইউনিকর্ন সদৃশ প্রাণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। আকারে গাধার মতো এবং শূকরের লেজের মতো লেজ বিদ্যমান। তবে একটি না, এদের শিং দুটি। এই শিং নানা রোগের প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। বিশেষ ভাবে তার শিং বিষের প্রতিষেধক হিসাবে সবথেকে ফলপ্রসূ। যেমনটা বর্ণনা করা হয়েছে ইউনিকর্নের ক্ষেত্রে।
দক্ষিণ আমেরিকা
চিলির উপকথায় ক্যামাহুয়েতো অনেকটা ইউনিকর্নের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। একে বর্ণনা করা হয়েছে অনেকটা ষাঁড়ের মতো। ক্যামাহুয়েতোর শিং অজস্র রোগের প্রতিষেধক। এ কারণে তাদেরকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতো মাচি বা চিকিৎসক শ্রেণি। ইউনিকর্নের মতো তারও একটা শিং। জন্তুটাকে প্রথমে ধরে এনে বন্দী করে রাখা হতো। তারপর খুব সতর্কতার সাথে শিং কেটে নেওয়া হতো। আলগোছে জায়গাটা বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হতো বনে। নপুংষকতা দূরীকরণে কিংবা বৃদ্ধ বয়সেও সন্তান জন্মদানে সক্ষমতা অর্জনের জন্য এই শিং ভূমিকা রাখতো বলে প্রচলিত ছিল।
ইউরোপীয় সংস্কার
ইউনিকর্নের ধারণা নানাভাবে প্রভাবিত করেছে ইউরোপীয় জীবনকে। এমনকি পরবর্তী খ্রিষ্টধর্মেও একে গ্রহণ করা হয়। সাদা ঘোড়ার মতো বড় প্রাণী। মাথার ঠিক মাঝখান থেকে উঠে গেছে দীর্ঘ শিং। ভাবা হতো, ইউনিকর্ন অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। যেকোনো ধরনের রোগ থেকে মুক্তি, অপবিত্র পানিকে পবিত্রকরণ কিংবা ভয়াবহ বিষের প্রতিষেধক হিসাবে শিংকে ভেবে নেওয়া হয়েছিল প্রধান সমাধান। শিং দ্বারা নির্মিত কাপে পানি পান ছিল সীমাহীন উপকারের। আর তাই তার চাহিদাও ছিল আকাশচুম্বী। যেহেতু ইউনিকর্ন খুব পবিত্র ও নিষ্পাপ। শুধুমাত্র কুমারীই তাকে আবদ্ধ করতে পারবে।
ইতিহাসে ইউনিকর্ন
ইউনিকর্নের প্রথম প্রকাশ দেখা যায় গ্রীক চিকিৎসক ও ঐতিহাসিক টিসিয়াসের লেখায়। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিকা’য় তিনি তার অভিমত প্রকাশ করেন। ভারতের এই প্রাণী বুনো গাধার মতো। আলোর গতির মতো দ্রুত চলে। মাথার মাঝখান থেকে আটাশ ইঞ্চি লম্বা শিং তাকে অন্য জন্তু থেকে আলাদা করেছে। শিংগুলো সাদা, লাল কিংবা কালো হতে পারে।
টিসিয়াস খুব সম্ভবত তথ্যগুলো তৎকালীন পারস্য থেকে পান। জীবনের বেশ কিছু সময় তিনি পারস্যে কাটিয়েছেন। প্রায় কাছাকাছি বর্ণনা দেন এরিস্টটল। তার মতে,
খুব অল্প প্রাণী আছে, যাদের সত্যিকার খুর এবং মাথায় একটা শিং বিদ্যমান। ভারতীয় গাধা এবং আফ্রিকান অরিক্স তাদের মধ্যে প্রধান। (Mythical Monsters, Charles Gould, Pages: 234-97)
এছাড়া স্ট্র্যাবো, প্লিনির মতো অন্য অনেকেই বর্ণনা করে গেছেন। প্রাচীন নগরী পার্সিপোলিসে ইউনিকর্নের ভাস্কর্য দেখেও তার প্রভাব অনুমেয়। কসমাস ইন্ডিকোপ্লেসটেস নামে আলেকজান্দ্রিয়ার এক ব্যবসায়ীর লেখা থেকেও বেশ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ভারত ও ইথিওপিয়া ভ্রমণ করেন। তার দাবি ছিল ইউনিকর্নের সমস্ত ক্ষমতা থাকে শিংয়ের মাঝে।
মার্কো পলোর বর্ণনা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও উল্লেখ করার মতো। তিনি খুব কাছ থেকে দেখার দাবি করেন। আকারে হাতির মতো। চুলগুলো অনেকটা মহিষের সাথে তুলনীয়। মাথার মধ্যখানে কালো শিং আছে। প্রাণীটা বেশিরভাগ সময় কাদাতে থাকতে পছন্দ করে। অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেছেন, বহুদিন থেকে শুনে আসা ইউনিকর্নের সাথে চোখে দেখার কত পার্থক্য। তার বর্ণনা থেকে মনে হয়, তিনি যে প্রাণীকে দেখে বিহ্বল হয়েছেন, তা আসলে গণ্ডার ছিল।
মধ্যযুগের বিবর্তন
মধ্যযুগে বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন ঘটলো ইউনিকর্নের ধারণায়। চার্চের নির্দেশনায় থাকা চিত্রকরেরা ফুটিয়ে তুললো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে। ঠিক এই সময়েই কুমারী মেয়ের সংশ্লিষ্টতা আসে। প্রচলিত হতে থাকে নানা উপকথা। শিকারীরা যেহেতু কোনোভাবেই বন্দী করতে পারতো না। সুতরাং কোনো কুমারী মেয়েকে বুঝিয়ে গাছের নিচে বসিয়ে রাখা হতো। ইউনিকর্ন প্রশান্ত মনে কুমারীর কোলে মাথা রেখে বসতো। যখন ঘুমিয়ে পড়তো, তখন শিকারীরা চারপাশে ঘিরে ধরতো এবং আবদ্ধ করতো। ত্রয়োদশ ও চতু্র্দশ শতকে প্রচুর রোমান্টিক আখ্যান গড়ে উঠেছে ইউনিকর্নকে জড়িয়ে।
খ্রিষ্টিয় চার্চের আগ্রহ
চার্চ আগ্রহের সাথেই গ্রহণ করেছিল ইউনিকর্নের ধারণা। যীশু খ্রিষ্টের সাথে রূপকার্থে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য যীশুর অবতার হিসেবে। ইউনিকর্নের কুমারী মেয়ের নিকটবর্তী হওয়া যীশু খ্রিষ্টের কুমারী মা মেরীর নিকটবর্তী হওয়াকেই রূপকভাবে উপস্থাপন করে। এবং একারণেই কুমারীর কোলে ইউনিকর্নের ঘুমিয়ে পড়ার পেছনে যীশু খ্রিষ্টের ঘুমিয়ে পড়ার তাৎপর্য নিহিত। এমনটাই দাবি করতেন সে সময়কার প্রচারকেরা।
অন্য একটি রূপক যীশুর জীবনের শেষের দিনগুলো। ইউনিকর্ন চাইলে শিকারীদের উচিৎ শিক্ষা দিতে পারে। সে শক্তি ও সক্ষমতা তার আছে। কিন্তু তা না করে সে কুমারীর কোলে গিয়ে ঘুমায়। তারপর শিকারীরা এসে তাকে বধ করে। যেন নিষ্পাপ জন্তুটা নিজেকে এক পবিত্র পন্থায় উৎসর্গ করে দিলো। অনুরূপ যীশু খ্রিষ্ট চাইলেই পাপীদের উচিৎ শিক্ষা দিতে পারতেন। অথচ তিনি প্রথমে কুমারী মেরির কোলে আসলেন। তারপর করলেন আত্মোৎসর্গ। এ থেকে অন্তত এটা স্পষ্ট যে, শুধুমাত্র উপকথাতে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউনিকর্ন ধর্মের মূলেও একটা জায়গা করে ফেলেছিল।
সম্ভাব্য ব্যাখ্যা
সত্যিই কি ইউনিকর্ন ছিল? যদি উপকথাই হয়ে থাকে তবে কীভাবে গড়ে উঠেছে এরকম একটা প্রাণীর ধারণা? বলা হয়, ইতিহাস পরিণত হয় কিংবদন্তিতে আর কিংবদন্তি পরিণত হয় উপকথায়। খুব সম্ভবত প্রাকৃতিক কিছু প্রাণীর ধারণা থেকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইউনিকর্নের ধারণা জন্ম লাভ করেছে। আবার এটাও হতে পারে ঘোড়ার মতো, গাধার মত দেখতে এরকম প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিদ্যমান প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে যৌক্তিক অবস্থানে আছে গণ্ডার। তার বৈশিষ্ট্য এবং দেহের আকৃতিই শুধু না, মার্কো পলোর দাবি অনুযায়ী সেরকমই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। গণ্ডারের অতিরঞ্জিত বর্ণনা থেকে ইউনিকর্নের জন্ম লাভ অসম্ভব না। এছাড়া ঔরক্স কিংবা নাওয়েলের মতো কিছু প্রাণী বিশেষত ইউরোপে ইউনিকর্নের উপকথার পেছনে প্রভাবক হতে পারে।
সে যা-ই হোক, সত্য কিংবা মিথ্যার মাপকাঠি দিয়ে উপকথা বিচার করা যায় না। বিচার করতে হয় তার প্রভাব দিয়ে। ইউনিকর্ন যে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বহু সংস্কৃতিকে অণুরিত করেছে, সেখানেই তার সফলতা।