ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ। গ্রীষ্মের এক বিকেলে কলকাতার নারকেলডাঙা মাঠে আট হাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েত। সবার মুখে চাপা উত্তেজনার ছাপ। আর দৃষ্টি মাঠের মাঝখানে রাখা এক বিশাল ফানুসের ওপর!
গ্যাস ভরা হচ্ছে ফানুসে। ফানুসের নিচের দিকে একটি ইস্পাতের আংটা। সেই আংটা থেকে ১২ ফুট নিচে ঝুলছে প্রকাণ্ড এক ঝুড়ি। এই ঝুড়িতে চেপেই নাকি এক বাঙালি উড়বে আকাশে!
ফানুসে গ্যাস ভরা হলো, ঝুড়ির চারদিকে বালির থলেও ঝুলল, আর সেইসাথে অবসান ঘটল সমবেত জনতার প্রতীক্ষার। সাদা রঙের আঁটো জ্যাকেট আর বেগুনি ট্রাউজার পরে, গলায় দূরবীন ঝুলিয়ে পুরোদস্তুর সাহেবি মেজাজে দর্শকদের মাঝে হাজির হলেন আকাঙ্ক্ষিত সেই বাঙালি বাবু। ঝুড়িতে চড়লেন ভদ্রলোক।
কিছুক্ষণ বাদেই ঝুড়িসমেত মানুষটিকে নিয়ে ফানুসটি তরতর করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল। জনসমুদ্রে তখন উল্লাসের জোয়ার! সেই প্রথম কোনো বঙ্গতনয় তথা ভারতীয় এককভাবে আকাশে উড়ল, সৃষ্টি করল নতুন দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী, রোমাঞ্চপ্রেমী মানুষটির নাম রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তারই গল্প জানবেন আজকের লেখায়।
আমরা যাকে ‘হট এয়ার বেলুন’ বলে জানি, সেই যাত্রীবাহী বেলুন উদ্ভাবনের কৃতিত্ব জোসেফ ও স্টিফেন মন্টগলফিয়ার নামক দুই ফরাসি ভাইয়ের। ১৭৮৩ সালের কথা সেটি। আবিষ্কারের অল্পসময়ের মধ্যেই গোটা ইউরোপে এক অভূতপূর্ব বেলুন-উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেশভেদে এই উন্মাদনার প্রকৃতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
যেমন, ফ্রান্সের বিজ্ঞানীমহল যখন এই নতুন আবিষ্কার নিয়ে নানাবিধ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত, তখন ব্রিটেনের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন একেবারেই নির্বিকার। রোমাঞ্চপ্রেমী মানুষ ও ইংরেজ জনসাধারণই বরং বেলুনের প্রকৃত কদর করতে পেরেছিলেন। তারা দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে বেলুনে চড়ে হরেকরকম খেলা দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন। তাদেরই একজনের নাম পারসিভাল জি. স্পেন্সার, যিনি ১৮৮৯ সালে কলকাতায় খেলা দেখাতে আসেন।
স্পেন্সার সাহেব যখন কলকাতায় আসেন, তখন বাঙালির ‘ফিজিক্যাল কালচার মুভমেন্ট’- এর সূচনালগ্ন। ইংরেজদের দেওয়া ‘ভীরু-গোবেচারা’ তকমা ঘোচানোই ছিল এ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠছিল শরীরচর্চার আখড়া। আর দলে দলে তরুণেরা যোগ দিচ্ছিল সেসব আখড়ায়।
এই যখন কলকাতার হাল, তখন স্পেন্সার সাহেব রেসকোর্স ময়দানে প্রথমবার তার কেরামতি দেখান। তারিখটা ১৯ মার্চ। ফলত, বিপ্লবী চেতনার অনেক যুবকের মনেই ইংরেজদের এই দুঃসাহসিক খেলায় তাদেরই টক্কর দেবার ইচ্ছে জাগে। এমনই দুই যুবক, অবতারচন্দ্র লাহা ও অনিলচন্দ্র ব্যানার্জি।
প্রথমজন সরাসরি সাহেবের কাছে বেলুনিং শিখতে চান। দ্বিতীয়জন সমসাময়িক একটি পত্রিকায় সাহেবের জ্ঞাতার্থে লেখেন এক খোলা চিঠি। দুর্ভাগ্যবশত, এদের কারোর ইচ্ছেই পূরণ হয়নি। লাহা স্পন্সর পাননি, আর ব্যানার্জির চিঠি সাহেবের নজরেই পড়েনি। যা-ই হোক, অবতারচন্দ্র লাহাই রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বেলুনিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং স্পেন্সার সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
বাঘ-সিংহের খেলা আর জিমন্যাস্টিক্সে গোটা পশ্চিমা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে সুরেশ বিশ্বাস যখন ব্রাজিলের সৈন্যবাহিনীতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়েই কলকাতার সাহেব-বাবুদের নিজের অসাধারণ সব কসরত দেখিয়ে হাততালি আদায় করছিলেন কাঁসারিপাড়ার রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল নবগোপাল মিত্রের ন্যাশনাল সার্কাসে ফ্লাইং ট্রাপিজ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তিনি গ্রেট ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান সার্কাসের পরিচালকের পদ অলংকৃত করেন। এছাড়া গভর্নমেন্ট নর্মাল স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুকাল।
স্পেন্সার সাহেবকে ৫০০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে রামচন্দ্র বেলুনিং-এর বিলেতি বিদ্যে রপ্ত করেন। স্পন্সর হিসেবে পেয়ে যান পাথুরিয়াঘাটার জমিদার গোপালচন্দ্র মুখার্জিকে। প্রথম শো’র দিনও ঠিক হয়ে যায় ঝটপট।
অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০ এপ্রিল বঙ্গসন্তান রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বেলুন ওড়ে আকাশে। অবশ্য তিনি একাই নন, শিষ্য রামচন্দ্রের সাথে তার সাহেব গুরুও অবশ্য সেবার চড়েছিলেন বেলুনে। তবুও এই বেলুন বিহারটির ইতিহাস রামচন্দ্র বা ভারতবাসীর জন্যে ছিল বিশেষ! কেননা, এর আগে কোনো ভারতীয়ই বেলুনে চড়ে আকাশ ছোঁননি।
বেলুনটি নারকেলডাঙার ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির মাঠ থেকে বিকেল তিনটে তিরিশ মিনিটে যাত্রা শুরু করে এক ঘণ্টা শূন্যে ভ্রমণের পর বর্ধমান থেকে মাইল তিনেক দূরে একটি গ্রামে অবতরণ করে।
বেলুনিং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ খেলা। যেকোনো ছোটখাটো ভুল আরোহীদের ঠেলে দিতে পারে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। বিশেষ করে, অবতরণের সময় বেলুনবিদকে সব থেকে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। সঠিক পরিমাণ গ্যাস বেলুন থেকে বের করে দিয়ে ও বালুর বস্তা ফেলে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় অবস্থান করা বেজায় মুশকিল কাজ। তাছাড়া সঠিক জায়গা নির্বাচন করে অবতরণ করাটাও যারপরনাই দুরূহ। অনেক দক্ষ ইউরোপীয় বেলুনবিদদেরও এইসব কাজ অসীম ধৈর্যের সাথে করতে হতো।
প্রথমবারের সফলতার পর আমাদের বাবু বেলুনবিদ, রামচন্দ্র ২৭ এপ্রিল তার একক প্রদর্শনী করবেন বলে ঘোষণা দেন। স্পেন্সার সাহেবের ‘দ্য ভাইসরয়’ বেলুনটি কিনে তার নতুন নাম দেন ‘দ্য সিটি অভ ক্যালকাটা’।
নির্ধারিত দিনে গ্যাস কোম্পানির মাঠে তো তিল ধারণের জায়গা নেই! কিন্তু আকস্মিক ঝোড়ো হাওয়া দিল সব ভণ্ডুল করে। উড়বার জন্য প্রস্তুত বেলুনের গ্যাস দিতে হলো বের করে। যদিও আবহাওয়া একটু স্বাভাবিক হলে রামচন্দ্র খেলা দেখাতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্পেন্সার সাহেব অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে নিরস্ত করেন।
ঠিক হলো মে মাসের চার তারিখে রামচন্দ্র অবশ্যই খেলা দেখাবেন। হলোও তা-ই। সেদিন আর কাউকে নিরাশ হতে হয়নি। হাজার আটেক দর্শকের সাথে গ্যাস কোম্পানির মাঠে সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পুলিশ কমিশনার ও বেশ কিছু বিজ্ঞানমনস্ক গণ্যমান্য ব্যক্তি। সবাই তো হতবাক! বেলুনটি বিকেল পাঁচটা দশ মিনিট থেকে টানা ৪০ মিনিট শূন্যে অবস্থান করে সোদপুরের কাছে নাটাগড় নামক গ্রামে অবতরণ করে। লেখার শুরুতে এই ভ্রমণের আভাসই দেওয়া হয়েছে।
এরপর রামচন্দ্রকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য ও নেটিভ স্টেট থেকে তিনি আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন। হয়ে উঠলেন ভারতবর্ষের প্রথম পেশাদার বেলুনবিদ।
তবে ২৭ জুন এলাহাবাদের খুশেরাবাগে তিনি যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন, তা তার অন্য সকল অর্জনকে ছাপিয়ে যায়। অপর্যাপ্ত গ্যাস অথবা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের কারণে সেবার আর তার বেলুন ভাসছিল না। তখন রামচন্দ্র বালুর বোঝাসমেত গোটা ঝুড়িটাকেই খুলে ফেললেন বেলুন থেকে। ইস্পাতের আংটার ওপর বসেই দেখালেন তার ক্যারিশমা, প্রমাণ দিলেন তার নিশ্ছিদ্র পেশাদারি দক্ষতার।
তখনকার দিনে প্যারাশ্যুটের ব্যবহার এখনকার মতো ছিল না। বেলুনের একপাশে একটি দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত প্যারাশুট। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত লোকেরাই কেবল জানত এর ব্যবহার। তার ওপর আবার সব বেলুনে এই বিশেষ ব্যবস্থা থাকত না। ছিল না রামচন্দ্রের বেলুনেও। কিন্তু এই সামান্য প্রতিবন্ধকতা কি পারে কিংবদন্তিকে দমিয়ে রাখতে!
রামচন্দ্র ২২ মার্চ ১৮৮০ তে টিভোলি গার্ডেন্স থেকে পুনরায় হাওয়ায় ভাসেন। সেবার বাহনটি ছিল ভিন্ন, স্পেন্সার সাহেবের ‘দ্য এম্প্রেস অভ ইন্ডিয়া’। ৩,৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে লাফ দিলেন রামচন্দ্র আর ব্রিটিশাধীন ভারতীয়দের অর্জনের খাতায় যোগ হলো আরেকটি অধ্যায়। সাক্ষী থাকলেন চৈনিক রাষ্ট্রদূত মহামহিম আম্বান, চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষাবিদ যোগীন্দ্রনাথ সরকার এবং স্বয়ং স্পেন্সার সাহেব।
সেদিন টিভোলি গার্ডেন্সে রামচন্দ্রকে একটি গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে স্পেন্সার সাহেব নিজে স্বীকার করেন যে, অন্য কারুর পক্ষে রামচন্দ্রের মতো দক্ষতার সাথে অবতরণ করা সম্ভব নয়। তিনি তাকে একটি মেডেলও প্রদান করেন।
পরবর্তীতে রামচন্দ্র প্যারাশ্যুটের সুবিধাযুক্ত একটি নতুন বেলুন সংগ্রহ করেন এবং যথাক্রমে দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, ইন্দোর, আগ্রা ও বেনারসে তার অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। অবশেষে কোনো একটি নেটিভ স্টেটের পাহাড়ের ওপর প্যারাশ্যুট ল্যান্ডিং করার সময় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। সেখান থেকে তাকে জীবিত অবস্থায় কলকাতা আনা হলেও শেষরক্ষা করা যায়নি। গোপাল মুখার্জির বাগানবাড়িতে এই মহান অভিযাত্রী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তারিখটা ১৮৯২ সালের ৯ আগস্ট।
হ্যারি হবস নামক একজন মেজর তার স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন,
“রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অসমসাহসী একটি কন্যা ছিল, যে বহুবার বেলুনে চেপেছে ও প্যারাশুটের সাহায্যে অবতরণ করেছে।”
কিন্তু ইতিহাস সে মেয়ের নাম মনে রাখেনি।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/