কুয়াশা ঢাকা শীতকাল অথবা বৃষ্টিস্নাত বর্ষাকাল, আবহাওয়া যতই বৈরি হোক না কেন, ঈদ জামাতে অংশগ্রহণের জন্য ঈদের আগের রাত থেকেই খোলা আকাশের নিচে দলবেঁধে মুসুল্লিদের অবস্থানের দৃশ্য অতি পরিচিত সেই ময়দানে। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিগণ ঈদের আগেই ছুটে আসেন উপমহাদেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সন্ধানে। সকল ভেদাভেদ ভুলে শত শত কাতারে লাখ লাখ মানুষের সাথে জামাতে দাড়িয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন পূণ্যার্থী মুসুল্লিরা।
দৃশ্যপটটি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ময়দানের। উজান-ভাটির মিলিত ধারা কিশোরগঞ্জে এই শোলাকিয়া ময়দানের ঈদ জামাতের ইতিহাস শুরু হয়েছিল আড়াইশো বছরেরও আগে।
বর্তমানে শোলাকিয়া নামে পরিচিত এই এলাকাটির প্রাচীন নাম ছিল রাজবাড়ীয়া। জনবসতি খুব একটা ছিল না এই অঞ্চলে। সেসময় বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি এলাকায় তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। দলিল দস্তাবেজ থেকে বর্তমান শোলাকিয়া এলাকার একটি হাটের তৎকালীন নাম জানা যায় ইচ্ছাগঞ্জ। ঈশা খাঁর নামানুসারে ঈশাগঞ্জ নামকরণ থেকে লোকেমুখে এই ইচ্ছাগঞ্জের উৎপত্তি বলে ধরা হয়।
ঈশা খাঁর শাসনকালে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে আধ্যাত্মিক সাধক ও ধর্ম প্রচারক সৈয়দ আহাম্মদ কিশোরগঞ্জ জেলার রাজবাড়ীয়া এলাকায় আসেন। ১৮২৭ সালে তিনি সর্বপ্রথম এ এলাকায় একটি মসজিদ স্থাপন করেন। ১৮২৮ সালের শেষভাগে জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগর এলাকার জমিদারের সহায়তায় সৈয়দ আহাম্মদ তার ক্রয়কৃত তালুক জমিতে ঈদগাহ মাঠের গোড়াপত্তন করেন। সে বছর আপামর জনগণের অংশগ্রহণে প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় শোলাকিয়া মাঠে।
১৯৫০ সালে ঈশা খাঁ’র ৬ষ্ঠ বংশধর হয়বতনগরের শেষ জমিদার দেওয়ান মোঃ মান্নান দাদ খান তার মায়ের আসিয়াত মোতাবেক শোলাকিয়া ঈদগাহের জন্য ৪.৩৫ একর জমি ওয়াকফ করেন। সে দলিলের সূত্র থেকে জানা যায় আরও দুইশো বছর আগে অর্থাৎ ১৭৫০ সালে এই ঈদগাহে দুটি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে হিসেবে বর্তমানে এই ঈদগাহের ঐতিহ্যের বয়স ২৬৯ বছর।
নামকরণ
ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার ইতহাস নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও এর নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা প্রচলিত জনশ্রুতি। নানাধরনের এসব জনশ্রুতিতে নামকরণের নানা কারণ বর্ণিত হয়েছে। সর্বাধিক প্রচলিত যে মিথ তা হলো, কোনো এক সময়ে এই ঈদগাহ মাঠের ঈদের জামাতে জমায়েত হয়েছিল সোয়া লাখ অর্থাৎ ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। বিশাল সেই ঈদ জামাতের খবর ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সেই থেকে মাঠের নামকরণ হয়ে যায় সোয়ালাখিয়া। লোকে মুখে উচ্চারণের বিবর্তনে এই সোয়ালাখিয়া থেকে শোলাকিয়া নাম রূপান্তরিত হয়।
আরেকটি জনশ্রুতি হলো, ১৮২৮ সালে ঈদগাহের প্রথম ঈদ জামাতে সৈয়দ আহাম্মদ মোনাজাতে সোয়ালাখ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। সেই থেকেই প্রথমে সোয়ালাখিয়া ও পরে শোলাকিয়া নামের উৎপত্তি।
আবার বলা হয়ে থাকে, ঈদগাহ মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদীটি মোঘল আমলে এ অঞ্চলের অন্যতম বিখ্যাত নদী বন্দর ছিলো। স্রোতস্বিনী ও সুগভীর এই নদীতে নিয়মিত চলাচল করত বাণিজ্যিক জাহাজ ও বড় বড় নৌকা। এই নদীবন্দরে একবার ফরাসিদের ১৬টি লবণ বোঝাই জাহাজ নোঙ্গর করেছিল। সেই লবণ বোঝাই জাহাজ থেকে বন্দর কতৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায় করেছিল। উক্ত ঘটনা থেকে এলাকাটি শুল্ক থেকে ক্রমে শোলাকিয়া এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায় জনমুখে।
অপর এক জনশ্রুতি অনুযায়ী, মোঘল আমলে এই এলাকায় যে রাজস্ব আদায়ের অফিস ছিল তার অধীনে পুরো পরগনার রাজস্ব ছিলো সোয়া লাখ টাকা। সোয়া লাখ রাজস্বের সেই অফিস থেকেই শোলাকিয়া নামকরণ বলে মনে করা হয়।
নামকরণের জনশ্রুতিতে বারবার ঘুরেফিরে শুল্ক আদায়ের ঘটনা গুরুত্ব পেয়েছে। এরকমই আরেক জনশ্রুতি মতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে নরসুন্দার নদী বন্দরের পাশেই ছিল ফরাসি বণিকদের শুকনো মাছ ও লবণের আড়ৎ। সে আড়তের শুকনো মাছ রপ্তানি করা হত বাইরের দেশে আর লবণ আমদানি করা হত অন্য দেশ থেকে। এ আমদানি-রপ্তানির জন্য ঘাট কর্তৃপক্ষকে বিশেষ শুল্ক দিতে হত বণিকদের। শুল্ক আদায়ের ঘাট থেকে এলাকার নাম কালক্রমে শোলাকিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে।
মুসাফিরখানা
শত বছরের ঐতিহ্যের ঈদগাহে নামাজ পড়তে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ প্রতবেশী নানা দেশ থেকে মুসুল্লিগণ আসত সেই বৃটিশ আমল থেকেই। দূর দূরান্তের এই ধর্মপ্রাণ মুসাফিরদের অবস্থানের জন্য কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর হাবিলীতে বড় আকারের একটি ঘর ছিল, যা মুসাফিরখানা নামে পরিচিত। ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই বিভিন্ন প্রান্তের মুসুল্লিগণ এসে হয়বতনগরের হাবিলীর সেই মুসাফিরখানাসহ আশেপাশের বাড়িতে অবস্থান করত।
বর্তমানে শহরে নানা আধুনিক আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা হওয়ায় সেই মুসাফিরখানার আয়োজন আর নেই। দেশ-বিদেশের মানুষজন ঈদ জামাতে শরিক হতে এসে হোটেলেই অবস্থান করে। তবে হারুয়া এলাকায় ছোট আকারের কিছু মুসাফিরখানা এখনও দেখা যায়।
ঈদ জামাত
১৮২৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১লা শাওয়াল ও ১০ই জিলহজ্জ যথাক্রমে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহহার বিশাল ঈদ জামাতের আয়োজন হয়ে আসছে শোলাকিয়া ময়দানে। এ বছর শোলাকিয়ায় ১৯২ তম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। শোলাকিয়ার ঈদ জামাত এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ঈদ জামাত হিসেবে পরিচিত।
দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী শোলাকিয়ায় ঈদ জামাত শুরু হওয়ার ৫ মিনিট, ৩ মিনিট ও ১ মিনিট পূর্বে যথাক্রমে ৩টি, ২টি ও টি গুলির আওয়াজ করা হয় শটগানে।
মাঠ পরিচালনা
১৯৫০ সালের ওয়াকফের দলিল অনুযায়ী হয়বতনগর দেওয়ান মান্নান দাদ খানের পর থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে বংশের বড় পুত্রগণ শোলাকিয়া ঈদগাহের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে মোতাওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান মঈন ও নায়েবে মোতাওয়াল্লি হিসেবে আছেন দেওয়ান মো. রউফ দাদ খান। এছাড়াও মাঠ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি।
মাঠের বর্তমান আয়তন ও মুসল্লির সংখ্যা
বর্তমানে শোলাকিয়া ময়দানের মাঠটির মূল আয়তন ৬.৬১ একর। মাঠের পাশে অযু করার পুকুর, টয়লেট, চারপাশের স্থান মিলিয়ে জায়গার সর্বমোট পরিমাণ প্রায় ৭ একর। চারপাশে অনুচ্চ প্রাচীর ঘেরা মাঠের চারদিকে মুসল্লি প্রবেশের জায়গা রয়েছে।
২৬৫টি কাতার সম্বলিত শোলাকিয়া ময়দান। প্রতি কাতারে প্রায় ৫০০ লোক দাঁড়াতে পারেন। মূল মাঠ ছাড়াও ঈদগাহের পাশের রাস্তা, পুকুরপাড়, ব্রীজ, মানুষের বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়েও ঈদ জামাতে অংশগ্রহণ করেন মুসুল্লিরা। প্রতি ঈদে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ মানুষের জনসমাগম হয় শোলাকিয়া ময়দানে।
ঈদের জামাতে যত বেশি মানুষ হয় তত বেশি সওয়াব লাভ ও গুনাহ মাফ হওয়ার আশা থেকে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন বিশাল এই জামাতে অংশ নিতে।
ঈদগাহের ঈমাম
শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রথম জনমুখর জামাতে ইমামের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সৈয়দ আহাম্মদ সাহেব ১৮২৮ সালে। ঐতিহ্যবাহী এই মাঠে অনেক খ্যাতিসম্পন্ন আলেমগণ ইমামতি করেছেন নানা সময়ে। বর্তমানে শোলাকিয়া ময়দানে ঈদ জামাতে ইমামতির দায়িত্বে আছেন প্রখ্যাত আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ।
ঈদের মেলা
বিশাল ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে রাস্তাঘাটের আলোকসজ্জার পাশাপাশি প্রতিবছর বিশাল মেলা বসতো পুরো শোলাকিয়া এলাকা জুড়ে। ঈদগাহে যাওয়ার দু’পাশের রাস্তা থেকে শুরু করে পাশের গরুর হাটের মাঠে পসরা সাজিয়ে বসতো দূর দূরান্তের কুটিরশিল্পের কারিগরেরা। ঈদের মেলায় পাওয়া যেত কাঠ, ফোম, বেতের তৈরি আসবাবপত্র, মাটি, প্লাস্টিক, কাগজের তৈরি নানা খেলনার সমাহার। ঈদের আগের দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত কেনাবেচা। চাঁদরাতে আলো ঝলমলে রাস্তায় পরিবারের সকলে মিলে মেলায় ঘুরতে যাওয়া ছিল স্থানীয়দের ঈদ আনন্দের অপরিহার্য অংশ।
বর্তমানে মুসুল্লিদের নিরাপত্তার স্বার্থে বড় পরিসরে এই মেলা আর হয় না। তবে ঈদের দিন বিকেলে ঈদগাহের পাশে অল্প কিছু পণ্যের স্টল এখনও শিশুদের টেনে নেয়।
টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার
১৯৯৩ ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. ফজলুল হকের উদ্যোগে বিটিভি-তে সর্বপ্রথম শোলাকিয়া ঈদগাহের খবর প্রচারিত হয়। বেসরকারি টিভি চ্যানেলের যাত্রা শুরু হওয়ার পর প্রায় সব চ্যানেলই এই ঈদ জামাতের কভারেজ দেওয়া শুরু হয়।
২০০৬ সালে সর্বপ্রথম শোলাকিয়ার ঈদ জামাত সম্প্রচার শুরু করে বেসরকারি চ্যানেল এনটিভি। এরপর থেকে প্রতিবছর চ্যানেল আই সরাসরি এই ঐতিহ্যবাহী ঈদ জামাত সম্প্রচার করে আসছে।
বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা
২০১৬ সালে শোলাকিয়া এলাকায় ঈদুল ফিতরের জামাতকে কেন্দ্র করে জঙ্গী হামলার ঘটনার পর থেকে ঈদ জামাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় প্রতিবছর। কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় পুরো এলাকায়।
ঈদের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শোলাকিয়া মাঠ, তার আশেপাশের এলাকাসহ পুরো শহরে গোয়েন্দা নজরদারি ও বিপুল পরিমাণ র্যাব, বিজিবি, সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়। মাঠের আশেপাশে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়। ওয়াচ টাওয়ার ও নিরাপত্তা বেষ্টনির মাধ্যমেও নজর রাখা হয়।
মাঠে প্রবেশের আগেই কয়েক জায়গায় মুসল্লিদের দেহ তল্লাশি করা হয় মেটাল ডিটেক্টর দ্বারা। এছাড়াও শোলাকিয়া এলাকা জুড়ে অত্যাধুনিক ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় ঈদ জামাত।
যাতায়াত ব্যবস্থা
বিশাল জনসামাবেতের সাথে ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহের ঈদ জামাতে অংশগ্রহণ করতে বা সাধারণ সময়ে শোলাকিয়া ময়দান ভ্রমণ করতে চাইলে খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ শহরে যেতে পারবেন। নিয়মিত তিনটি ট্রেন ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটে যাতায়াত করে।
ট্রেন ছাড়াও বাসে করে কিশোরগঞ্জ যাতায়াত করা যায় দেশের যেকোনো প্রান্ত হতে। ট্রেন বা বাস স্টেশনে নামার পর রিকশা অথবা ইজিবাইকে করে ১০ মিনিটেই পৌঁছে যেতে পারেন কাঙ্খিত গন্তব্য শোলাকিয়া ময়দানে।
ঈদের দিন সরাসরি জামাতে অংশগ্রহণ করার জন্য ভৈরব ও ময়মনসিংহ থেকে শোলাকিয়া ঈদ স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা থাকে। এই ট্রেনে করে ঈদের দিন সকালেই শোলাকিয়া ঈদগাহে নামাজ আদায়ের জন্য যাওয়া যায়।
শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখা এই শোলাকিয়া ময়দানের সৌন্দর্য ও সুযোগ-সুবিধা বর্ধনে জেলা প্রশাসন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
ঈদ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) কুরআন ও হাদীসের আয়নায় রোযা, ঈদ ও কোরবানী
২) মাসায়েলে ঈদ, কুরবানী ও আকীকাহ
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/