নির্বিঘ্নে আর অল্প সময়ে লম্বা দূরত্ব সহজেই পাড়ি দেওয়ার জন্য বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম হলো আকাশপথ। বিমানে চড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করা কিন্তু বেশ সহজ। কিন্তু এখানেও আছে বিপত্তি! আকাশপথে কেউ ট্রাফিক সিগন্যাল বসিয়ে আপনার বিমান আটকে দেবে না বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির চলাচলের জন্য আপনাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষাও করতে হবে না।
সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল আছে, যেগুলোর উপর দিয়ে আপনি চাইলেও বিমান নিয়ে উড়ে যেতে পারবেন না। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে এমন নিষেধাজ্ঞা। সার্বিক নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষার্থে নেওয়া হয়েছে এমন ব্যবস্থা। কারণ এসব অঞ্চলে যদি কখনো কোনো কারণে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে বিমানের পাশাপাশি সেই অঞ্চলের এত বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে যা এককথায় অপূরণীয়।
এই লেখায় এমনই কয়েকটি পরিচিত অঞ্চলের কথা তুলে ধরবো, যেখানে আপনি বিমান নিয়ে উড়তে চাইলে বিশেষ অনুমতি লাগবে কিংবা সরাসরি ফিরিয়ে দেয়া হবে।
মক্কার কাবা শরিফ
মুসলমানদের তীর্থ স্থান মক্কার উপর দিয়ে আপনি কখনও কোনো যাত্রীবাহী বিমান উড়ে যেতে দেখবেন না। কেন সেখান দিয়ে কোনো বিমান ওড়ে না তার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এর অধিকাংশেরই কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ বা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। প্রথম যে ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায়, সেটি হলো, মক্কার ভূ চৌম্বকত্ব এতই প্রবল যে, সেখান দিয়ে কোনো বিমান উড়ে গেলে বিমানের কম্পাস বিচ্ছিন্ন আচরণ করতে থাকে। তাই বিমান চালকের পক্ষে দিক ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আরেকটি ব্যাখ্যামতে, মক্কার অঞ্চলে পৃথিবীর অভিকর্ষজ টান বেশি হওয়ায় বিমানের পক্ষে সেখানে নিজের উচ্চতা বজায় রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এগুলো যে খুব একটা প্রমাণিত কথা, তেমনটা নয়। বরং হজের মৌসুমে এবং অন্যান্য সময়ে নিরাপত্তার জন্য মক্কার আকাশে হেলিকপ্টারগুলোকে স্বাচ্ছন্দ্যেই উড়তে দেখা যায়।
তবে মূল কথা হলো, মক্কায় বিমান ওঠা-নামা করার জন্য কোনো বিমানবন্দর নেই। যদিও সেখানে প্রতি বছর শতকোটি মুসল্লি জমায়েত হয়, তবুও কাবার সার্বিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় রেখে সেখানে কোনো বিমানবন্দর তৈরি করা হয়নি। যেহেতু মক্কায় কোনো বিমানবন্দর নেই, তাই মক্কার আকাশে বিমান উড়তে দেখা যাবে, এমন আশা করাও উচিত নয়।
আগ্রার তাজমহল
১৯৮৩ সালে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া এই নির্মাণশৈলী তৈরি করতে সময় লেগেছিলো পুরো ২১ বছর। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিতে ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দ সময়ব্যাপী যমুনার পাড়ে নির্মাণ করেন এই ভালোবাসার নিদর্শন। বর্তমানে এই নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে ভারত সরকার। তাজমহলের অঞ্চলটি এতটাই নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রাখা হয়েছে যে, সেখানকার ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনো যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করতে পারে না। যান্ত্রিকতার সাথে মিশে গিয়ে মূল তাজ মহলের যাতে কোনোপ্রকার ক্ষতি না হয়, সেজন্য এ ব্যবস্থা। তার চেয়েও বড় কথা, ২০০৬ সাল থেকে তাজমহলের ওপর দিয়ে বিমান চলাচলও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আগ্রায় কোনো প্রকার বিমান দুর্ঘটনা হলে, তাজমহল এবং অন্যান্য স্থাপনার ওপর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে। সেরকম কোনো সম্ভাবনা যাতে না থাকে, সেজন্য আগ্রার ওপর দিয়ে বিমান চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
তিব্বত
দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল প্রাকৃতিক কারণেই নো ফ্লাই জোন হিসেবে পরিচিত। বিশাল আকৃতির সব পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এই দেশটি বিমান ওঠানামা করার জন্য বেশ কঠিন একটি জায়গা। বিমান চালককে প্রায়ই বিমানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। তিব্বতের পাহাড়-পর্বতগুলোর গড় উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ১৬,০০০ ফুট ওপরে। এই উচ্চতা দিয়ে অধিকাংশ বাণিজ্যিক বিমান স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারলেও, জরুরি অবতরণ করতে হলে পাহাড়ের উপর তো আর বিমান নামানো সম্ভব না। এখানে বিমান চলাচলের চেয়েও যাত্রীদের নিরাপত্তা দেয়াটা বেশি জরুরি। এজন্য পুরো তিব্বতে পাঁচটি বিমানবন্দরের অঞ্চল বাদে আর কোথাও বিমান চলাচল করতে দেখা যায় না।
বাকিংহাম প্যালেস
যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হলো এই বাকিংহাম প্যালেস। রানীর বাসভবন এবং তার সকল সরকারি কর্মকর্তার অফিস এই এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাকিংহাম প্যালেস থেকেই পরিচালিত হয়। তাই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই অঞ্চলে যাতায়াত করে থাকেন। এই অঞ্চলটি এতটাই নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয় যে, ব্রিটেনের সর্বসাধারণের জন্যও এখানের বেশক’টি সড়ক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেবল বিশেষ দিনগুলোতে এই সড়কগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই অঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনা করে সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা করা এবং সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে এখান দিয়ে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়।
পেরুর মাচু পিচু
ইনকা সভ্যতার সকল অবশিষ্ট ভবন ও নির্মাণশৈলী নিয়ে গভীর জঙ্গল এবং পাহাড়-পর্বতের মাঝে গড়ে ওঠা মাচু পিচু হলো পেরুর অন্যতম সংরক্ষিত অঞ্চল। ইউনেস্কো এই অঞ্চলকে বিশেষ স্বীকৃতি দেয়ার পর ২০০৬ সাল থেকে পেরু সরকার এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে সকল প্রকার বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। কারণ এই অঞ্চলটিতে বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার তেমন কোনো ছোঁয়া নেই বললেই চলে। অত্যন্ত সুরক্ষিত এই অঞ্চলটিতে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় সকল জীব-জন্তুর বসবাস। যদি কখনও এই অঞ্চলে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তা সরাসরি ইনকা সভ্যতার অবশিষ্ট ভবনগুলোতে আঘাত করবে। এর ফলে সভ্যতার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে যাবে। আর যদি জঙ্গলে বিমান আছড়ে পড়ে, তাহলে পশু-পাখির বসবাসের নীরব পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। আর সবচেয়ে খারাপ হতে পারে জঙ্গলে দাবানল লেগে যাওয়া। এসকল বিষয় বিবেচনা করে পেরু সরকার মাচু পিচু অঞ্চলের উপর দিয়ে বিমান চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
প্যারিস
আপনি যদি কখনো প্যারিসে ভ্রমণ করে থাকেন তাহলে প্রশ্ন করতেই পারেন, সেখানে তো বিমান উড়তে দেখেছেন। তাহলে এই শহরের নাম এই তালিকায় কেন? একটা শহরে চারটি বিমানবন্দর থাকার পরেও কেন সেখানে বিমান উড়তে পারে না? এখানে একটি শর্ত আছে। প্যারিসে কোনো বিমান উড়তে হলে সেগুলোকে ৬,৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে উড়তে হবে। এর নিচে কোনো বিমান সেখানে উড়তে পারবে না। এজন্য প্যারিসে সাধারণত কোনো বিমান দেখা যায় না।
কিউবা
কিউবার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। এমন নয় যে এখানে নিরাপদ অবতরণ নিয়ে কোনো সমস্যা আছে কিংবা কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিউবার ভেতরে আঞ্চলিক বিমানগুলো সহজেই যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু বিশেষ নিয়ম হলো আন্তর্জাতিক বিমানগুলোর বেলায়। আপনি যদি বাণিজ্যিক বিমান নিয়ে কিউবাতে অবতরণের জন্য প্রবেশ করেন, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ভিনদেশী কোনো বিমান যদি কিউবার আকাশসীমা ব্যবহার করতে চায়, তাহলে তাদের নিতে হবে কিউবা সরকারের বিশেষ অনুমতি। অবশ্যই আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় আপনি কিউবা সরকারের কাছে আবেদনপত্র জমা দিতে পারবেন না। কিউবার আকাশসীমা যদি আপনার ব্যবহার করার দরকারই পড়ে, তাহলে আগে থেকেই সেখানকার সরকারের অনুমতি নিতে হবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আবেদন নাকচ হয়ে ফিরে আসে।
এই সকল অঞ্চলের পাশাপাশি আরও অনেক অঞ্চলেই ভৌগোলিক কিংবা রাজনৈতিক কারণে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই ১১টি অঞ্চলে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ।