
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি সংগঠিত হয়, যার নাম ‘মাধ্যমিক পর্যায়ের পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তি’ বা Intermediate-Range Nuclear Forces (INF) Treaty, সংক্ষেপে যাকে আইএনএফ চুক্তি হিসেবে বলা হয়। ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগান এবং সোভিয়েত জেনারেল সেক্রেটারি মিখাইল গর্ভাচেভ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের সব পারমাণবিক ও প্রচলিত ভূমি থেকে নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ মিসাইল চিরস্থায়ীভাবে সরিয়ে ফেলা ও পরিত্যাগ করা- যেসব ক্ষেপণাস্ত্র ৫০০ থেকে ৫,৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে গমন করতে পারে।

চুক্তিটির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর উভয় শক্তিশালী রাষ্ট্র সম্মত হয়েছিল তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কমাতে, পারমাণবিক অস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে দিতে এবং যাচাইয়ের জন্য ব্যাপকভাবে সাইট পরিদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করতে। ইউরোপীয় অঞ্চলে এ জাতীয় অস্ত্র সরিয়ে ফেলার এবং শুধুমাত্র যুদ্ধ-কৌশল সংক্রান্ত বেশ কিছু পারমাণবিক অস্ত্র জার্মানিতে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আইএনএফ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের ১লা জুন চুক্তি বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত মোট ২,৬৯২টি সংক্ষিপ্ত, মাঝারি ও মধ্যবর্তী পরিসীমা বিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দেয়। আকাশপথে চালিত বা সমুদ্র-চালিত অস্ত্রগুলোকে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে পরিত্যাগ করার ব্যবস্থা করা হয়নি, যদিও বা এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা অস্ত্রগুলোর তুলনায় একই দূরত্ব অতিক্রম করে, যেমন- আমেরিকান টমাহক এবং রাশিয়ান কালিবার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো জাহাজ, সাবমেরিন বা বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী। অন্যদিকে, চুক্তি অনুসারে, ২০০১ সাল পর্যন্ত যাচাইয়ের জন্য সাইট পরিদর্শন করা হতো। কিন্তু তারপর থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

১৯৭০ এর দশকের শেষদিকে, এসএস-২০ স্যাবর (SS-20 Saber) নামক মধ্যবর্তী-পরিসীমা বিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর বিকাশের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখন্ডের জন্য হুমকি হওয়া ছাড়াই সমগ্র ইউরোপ মহাদেশের যেকোনো জায়গাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ক্ষেপণাস্ত্রটিতে তিনটি টর্পেডো ছিল এবং মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আঘাত করার ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিল। তারা ধারণা করছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে এসএস-২০ আন্তঃমহাদেশীয় পরিসরে আঘাত করতে উন্নীত করা যেতে পারে। ন্যাটো জোটের ভয় ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করেই তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তারপর ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্রদের চাপে এসে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপে ১৯৭৯ সালের মধ্যে দুটি মধ্যবর্তী সীমানার অস্ত্র স্থাপনের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল: পার্সিং ২ এবং টমাহক ক্রুজ মিসাইল। ভ্রাম্যমাণ নিক্ষেপণকারীর উপর চড়া, পার্সিং II একটি আইআরবিএম ছিল, যা প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে একক পারমাণবিক টর্পেডো বহন করতে পারে এবং ১০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে মস্কোর আশেপাশে আঘাত হানতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের একটি বিশাল প্রভাব এসবের উপর ছিল।
এরপর এসব ঘটনা দুই পক্ষকে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সুরাহা করতে বাধ্য করে, যার একমাত্র উপায় ছিল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী। নানাবিধ ঘটনা, জল্পনা-কল্পনার পর তারা ব্যাপারটি সমাধানের জন্য এগোলেন। প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা পার করে চুক্তিটি চূড়ান্ত করে স্বাক্ষর করা হয়।

জুলাই ২০১৪ সালের সম্মতি রিপোর্টে (Compliance Report) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অভিযোগ করেছিল, রাশিয়া আইএনএফ চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো লঙ্ঘন করেছে, যার মধ্যে আছে “৫০০-৫,০০,০০০ কিলোমিটার সীমানার আওতায় আগত একটি স্থল-চালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র অধিগ্রহণ, উৎপাদন, বা ফ্লাইট-পরীক্ষা বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপণকারী উৎপাদন।” পরবর্তীতে ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মূল্যায়ন অনুসারে একই অভিযোগ বারবার তোলা হয়। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে,শীর্ষ এক মার্কিন কর্মকর্তা একটি সংবাদপত্রে নিশ্চিত করেন, রাশিয়া অসম্পূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। রাশিয়া আইএনএফ চুক্তির লঙ্ঘন করেছে বলে অস্বীকার করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অযোগ্যতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
তাই, ২ ফেব্রুয়ারি, অনেক ব্যর্থ কৌশল ও অভিযোগের পর, ট্রাম্প প্রশাসন আইএনএফ চুক্তির অধীনে মার্কিন বাধ্যবাধকতাগুলোর স্থগিতাদেশ জানায় এবং ছয় মাসের মধ্যে চুক্তি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়। এর পরদিনই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, রাশিয়াও তার চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্থগিত করবে। কারণ, পুতিনের মতে, ইউরোপে স্থাপিত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালিস্টিক বিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চুক্তি লঙ্ঘনের আলামত হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে। কারণ, এই ধরনের অস্ত্র উল্টো আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এখন, যেহেতু এই চুক্তি আর কার্যকরী নয়, উভয় দেশ নতুনভাবে শক্তিশালী অস্ত্র তৈরির বিকাশ ঘটাতে পারে এবং একে অপরের প্রতি হুমকি হিসেবে মুখোমুখি দাঁড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এমনকি আরও অন্যান্য অঞ্চল হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। এই ক্ষেত্রে ইউরোপ খুব কঠিন অবস্থানে রয়েছে। দুই মহাশক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে অস্ত্র সম্পর্কিত কোনো রেষারেষি, উৎপাদন, এমনকি নিক্ষেপের কারণে ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ওয়াশিংটন এবং মস্কো আইএনএফ চুক্তি থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ৫০০-২,০০০ কিলোমিটার পরিসীমা বিশিষ্ট মধ্যবর্তী পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বৈধভাবে রাশিয়া এবং ইউরোপের পার্শ্বে স্থাপনা করা যাবে। একই সময়ে পোল্যান্ড একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপণ এলাকা এবং প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। ইউরোপের হর্তাকর্তারা একটি ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক অবস্থানে রয়েছে এবং তারা আশা করেন এই চুক্তিটি সঠিকভাবে সময় এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নীত করা যাবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা যাবে।
অন্যদিকে, চীন তার সামরিক বাহিনীর অগ্রগতি বজায় রেখেছে এবং প্রচলিত ও পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ক কর্মসূচী চালাতে সক্ষম। তারা ভূখন্ডে আক্রমণ এবং কোনো জাহাজে আক্রমণ করার জন্য উপযুক্ত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। চীনা সামরিক কর্মকান্ডগুলো তাইওয়ানকে লক্ষ্য করে ভিত্তি করা এবং মার্কিন হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের সাথে জড়িত। চীনের পূর্ব উপকূলে সংঘাত সৃষ্টি হলে যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে সামরিক বিমান বহনকারী জাহাজকে প্রতিরোধ করা যায় এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সবচেয়ে উত্তমভাবে কীভাবে ভেদ করা যায় তা বেইজিংয়ের কৌশলবিদরা নির্ধারণ করতে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। চীন অস্ত্রের একটি বিশাল ভান্ডার তৈরি করেছে যা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য এবং একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে রাশিয়ার জন্যও হুমকিস্বরুপ। সুতরাং এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এই পরিস্থিতিতে উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এক্ষেত্রে যেসব দেশে পারমাণবিক দিক থেকে বা পারমাণবিক না হলেও অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্রের মজুদ রয়েছে সেসব দেশকে নিয়ে একসাথে একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তির ব্যবস্থা করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন।

আইএনএফ চুক্তির বিষয়ে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের পর আমরা চীনের পক্ষ থেকে বেইজিংয়ের অত্যাবশ্যকীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে পেশীবহুল অবস্থান আশা করতে পারি। এদিকে, আমরা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের একটি গতিশীল অগ্রগতি দেখতে পাব, বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে চীনের সাথে যুক্ত, যাদের অর্থনৈতিক বল রয়েছে এবং নিরাপত্তার বিষয়ে যাদের মাধ্যমে চীন লাভবান হবে। তবুও, এশিয়াতে অস্ত্রের রেষারেষির কারণে চীন একটি “প্রতিযোগিতামূলক কৌশল” এর ফাঁদে পড়ে যেতে পারে।
চুক্তি প্রত্যাহার করায় যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়া মোট পারমাণবিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে বলে ধারণা করা হয় এবং রাশিয়া যদি কোনো সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে দখল করার সিদ্ধান্ত নেয় তবে পশ্চিমারা কেউই মাঝখানে হস্তক্ষেপ করার সাহস না-ও পেতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর বর্তমানে নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র ও মাঝারি-পরিসীমা বিশিষ্ট মিসাইলগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নেই, এবং তাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে। সুতরাং, বৈশ্বিক রাজনীতি একটি জটিল এবং ভারসাম্যহীন অবস্থায় বিরাজ করছে যা সমাধান করা দরকার।