Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিয়ানমারে ‘চিন’ জাতি লড়ছে কেন?

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ মিয়ানমারে সরকারি হিসেবমতে ১৩৫ ধরনের জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যারা কথা বলে শতাধিক ভাষা ও উপভাষায়। এর মধ্যে অন্যতম একটি জাতিগোষ্ঠী হলো ‘চিন’, যারা জনসংখ্যায় আনুমানিক ৫ লক্ষ (২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৪,৭৮,৮০১)।

চিন জাতির বসবাস দক্ষিণ-পশ্চিমস্থ মিয়ানমারের চিন রাজ্যে, যার পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ ও ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং উত্তরে ভারতের মণিপুর রাজ্য, পূর্বে মিয়ানমারের সাগাইং বিভাগ এবং ম্যাগওয়ে বিভাগ, দক্ষিণে রাখাইন রাজ্য বিদ্যমান।

চিনদের মধ্য ৬০ ধরনের উপজাতি রয়েছে যারা প্রায় ২০ উপভাষায় কথা বলে। বৈচিত্র্য বিদ্যমান থাকলেও ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভৌগলিক অবস্থান ও জাতিগত পরিচয় তাদের ঐক্যবদ্ধ ‘চিন’ জাতিতে পরিণত করেছে। বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান মিয়ানমারে চিনরা ৯০ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ১৯৮৮ সালের পর চিন প্রদেশে ব্যাপক সামরিকায়নের ফলে সেখানে চিনরা বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়, অনেকে শরণার্থী হয়ে চলে যায় ভারত ও মালয়েশিয়ায়। দীর্ঘদিন ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবী করে আসছে তারা। সামরিক বাহিনী পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর শান্তি আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংকট নিরসনের পথ হয়ে ওঠে সংকীর্ণ, বাড়ে সংঘাতের মাত্রাও। এই লেখায় চিনদের জাতিগত সংঘাতের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

৫৩টি নৃ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে বৃহৎ ‘চিন জাতি’ বসবাস করে দক্ষিণ-পশ্চিমস্থ মিয়ানমারের চিন স্টেটে; Image source: Asia Times

কেন জাতিগত সংঘাত জন্ম নেয়?

এথনিক কনফ্লিক্ট বা জাতিগত সংঘাতের মূলে রয়েছে জাতি বা গোষ্ঠী চেতনা, অর্থনৈতিক স্বার্থ, অসম মর্যাদা, আধুনিকায়ন, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ইত্যাদি। যেখানে মানুষের জন্ম ও বেড়ে ওঠায় ঐতিহ্যের টান বেশি, সেখানে জাতিগত সংঘাত বেশি। জাতিগত সংঘাতে ইতিহাস, ঐতিহ্য হয়ে ওঠে অস্ত্র। মানুষ তখনই সংঘাতে জড়ায়, যখন তারা অন্যের সমান হতে চায়, তারা অন্যের থেকে ভিন্ন সেজন্য নয়। জাতিগত সংঘাতের আরেকটি কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ। জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রম-বিভাজন, শ্রেণী সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে বিভাজন তৈরি হয়। অর্থনৈতিক লাভ ও ক্ষতি হিসেব করে শুরু হয় দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যবসায়ী-ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী-শ্রমিক, শ্রমিক- শ্রমিক দ্বন্দ্ব। যেমন- একটি দেশের মূলধারার জনগণ যখন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোনো পণ্যকে বর্জন করে, তখন তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিঘ্নিত হয়।

দুটো গ্রুপের মধ্যে অসম মর্যাদা অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়ে বেশি সংঘাতের জন্ম দেয়, কারণ মানুষ অর্থনীতির চেয়ে তার মর্যাদা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আধুনিকায়নের ফলে সমাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়, ব্যাপক উন্নয়ন হয় দেশের। ফলে সেখানে তৈরি হয় উন্নয়ন বৈষম্য, একটি গ্রুপ পিছিয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক আমলে যে গ্রুপ উপনিবেশিক শাসকের কাছাকাছি থাকে, তারা এগিয়ে যায় সব দিক থেকে। একপর্যায়ে পিছিয়ে পড়া গ্রুপ সংঘাতে জড়ায়। আবার যে দেশে বহু সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান, সেখানে জাতিগত সংঘাত বেশি। পৃথিবীর সব জাতিগত সংঘাতে এই সকল কারণ উপস্থিত থাকবে বলে মনে করেন না তাত্ত্বিকগণ।  

চিনদের বর্তমান অবস্থা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বার্মার (মিয়ানমার) ত্রিশজন বার্মিজ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের উৎখাতের উদ্দেশ্যে জাপানে প্রশিক্ষণের জন্য যান, প্রতিষ্ঠা করেন বার্মিজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি (বিআইআর)। ১৯৪২ সালের দিকে রেঙ্গুন দখল করে তারা ‘বার্মা রাষ্ট্র’ নামে জাপানের পুতুল রাষ্ট্র গড়ে তোলেন।

বর্তমানে অং সান সুচির বাবা অং সান, যিনি ছিলেন সেই ত্রিশজনের একজন, বুঝতে পারেন জাপানিদের আসন্ন পতনের, করেন দিক পরিবর্তন। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে গেলে অং সানের মাধ্যমে বার্মা স্বাধীনতা পায়। অং সান প্যাংলং চুক্তির মাধ্যমে সেখানকার বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে স্বশাসন বা অটোনমি দেবার কথা বলেন। তার মৃত্যু হলে তা স্তিমিত হয়ে যায়, পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্যুর মাধ্যমে আবার ক্ষমতা দখল করে। সামরিক বাহিনী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহের উপর আরও চড়াও হয়। সামরিক বাহিনী এসব এথনিক গ্রুপের সাথে তাদের বিদ্রোহ, আন্দোলনের দরুন সমঝোতা করে। কিন্তু তারা মূল দাবী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়নি।

বিমান হামলায় পুড়ছে চিনদের বসতবাড়ি; Image source: DW

চিন প্রদেশে যে চিন জাতি বসবাস করে তারা মূলত প্রায় ৫৩ ধরনের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যারা ২০টির মতো উপভাষায় কথা বলে। তাদের মধ্যে প্রধান দুটি শাখা বার্মিজ কুকি-চিন ও চিন-নাগা। ১৮২৪ সালে বার্মা ব্রিটিশ শাসনে অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৮৯৬ সালের পুকোক্কু চিন হিলস রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী চিন প্রদেশ আলাদাভাবে শাসিত হয়েছে। গভর্নরের অধীনে কয়েকজন প্রধান কর্তৃক শাসিত হলেও স্বাধীনতার পর চিন প্রদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয়। একের পর এক সামরিক জান্তা সরকার মিয়ানমারের ক্ষমতায় আরোহণ করলে তার উপজাতিদের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করেনি, বরং স্বায়ত্তশাসন দাবিতে জড়ো হলে তাদের উপর চালানো হচ্ছে নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার।

১৯৮৮ সালে ‘৮৮৮৮’ আন্দোলনের সময় সামরিক জান্তা সরকারের ভিত যখন নেড়ে ওঠে, সেনা সরকার তখন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। একই বছরের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা সিএনএফ যার সামরিক শাখা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ), যারা চিন প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই করে যাচ্ছে সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে। জান্তা সরকার তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন- নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বেআইনি আটক, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি। বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির সহায়তায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার বিমান হামলা চালাচ্ছে চিনদের উপর।

২০২১ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসার পর থেকে বর্তমানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৪৪০ জন চিনকে হত্যা করে, অন্ততপক্ষে ৬৪ চিন বিমান হামলায় তাদের ঘরবাড়ি হারায়, আহত হয় কমপক্ষে ৪১ জন। সামরিক জান্তা এখন পর্যন্ত ৭৭টি বিমান হামলা চালায়, যার ফলে প্রায় ১৪৭টি বাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস হয়। বিমান হামলার ৭০ শতাংশের বেশি পরিচালিত হয় ২০২৩ সালের প্রথম মাত্র ৪ মাসে। চিনদের ৭০ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। বর্তমানে চিনদের অনেকে বসতিহারা, অনেক চিন নারী হয়েছেন ধর্ষণের শিকার। যার দরুন চিনরা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তির জন্য লড়ছে। এর কারণ নানাবিধ।

মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন; Image source: CNN

চিনরা লড়ছে কেন?

মানুষ সংঘাতে জড়ায় যখন সে নিজেকে অন্যের সমান মনে করে না, এই কারণে নয় যে সে অন্যের থেকে উচ্চ আসনে আসীন হতে চায়। মিয়ানমারের চিন জাতি অধ্যুষিত চিন স্টেট প্রতিষ্ঠাকালীন কয়েকটি প্রদেশের একটি। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে তাদের যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

গণতন্ত্র

ব্রিটিশ শাসনভুক্ত বার্মায় চিন প্রদেশ শাসিত হত কয়েকজন প্রধান বা আঞ্চলিক সর্দারদের দ্বারা, যারা ব্রিটিশ সরকারের একজন গভর্নর কর্তৃক পরিচালিত। গভর্নর পরিচালনা করতেন রেঙ্গুন থেকে। ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার আগপর্যন্ত চিন প্রদেশ ছিল প্রধান-শাসিত, এবং বার্মা থেকে স্বাধীন। অং সানের নেতৃত্বে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী নিয়ে যখন ইউনিয়ন অব বার্মা জন্ম নেয়, তখন চিনও ছিল তার অংশ। বার্মায় যুক্ত হওয়ায় পর গোত্রপ্রধানের শাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয় সেখানে। প্যাংলং চুক্তির মাধ্যমে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়ে গণতন্ত্রের সূচনা হলেও তা স্থায়ী হয়নি। বার্মার প্রতিষ্ঠাতা অং সানকে হত্যা করা হলে ১৯৪৭ সালে যখন বার্মার সংবিধান রচনা হয়, তখন উপজাতিদের আলাদা প্রদেশগুলো অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণীত হয়। বর্তমানে তারা গণতন্ত্ররে জন্য লড়ছে। 

স্বায়ত্তশাসন ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা

প্রতিষ্ঠাকালীন সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমার বা বার্মাকে গড়ে তোলা হয় একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আদলে, দেয়া হয় প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক সরকারের উত্থান হলে তিনি সংবিধান বাতিল করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূচনা করেন। তাছাড়া সামরিক সরকার সংসদীয় ব্যবস্থাও বাতিল ঘোষণা করে। মিলিটারি জান্তার আমলে শুরু হয় সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন, হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। পুরো দেশের পাশাপাশি চিন প্রদেশের চিনরাও এর শিকার হয়। সেই স্বায়ত্তশাসন আজও অর্জিত হয়নি, যার জন্য চিনরা লড়ে যাচ্ছে আজ পর্যন্ত।  

জান্তা সরকারের বিমান হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত চার্চ; Image source: Radio Free Asia

ধর্মীয় স্বাধীনতা

চিনদের ৯০ শতাংশ খ্রিষ্টান। ১৮০০ সালে চিন প্রদেশে শুরু হয় আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট চার্চের ধর্মীয় মিশন। যার ফলে চিন প্রদেশের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা ধর্মের ভিত্তিতে এক হতে থাকে। এভাবে মিয়ানমার একটি বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান দেশ হলেও চিনরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী জাতি, যাদের বেশিরভাগ আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট চার্চপন্থী। সামরিক জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চিনদের নির্যাতনের পেছনে একটি কারণ তাদের ধর্মীয় ভিন্নতা। সরকারের বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে চিনদের ধর্মীয় উপাসনালয়। জান্তা সরকার প্রায় ২০০টি ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করে, যার মধ্যে পশ্চিম চিন প্রদেশের খ্রিষ্টান চার্চের সংখ্যা হচ্ছে ৮৫টি। সেজন্য চিনরা ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের নিরসনে লড়াই করছে মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে।  

তাছাড়া, নিজ এলাকায় নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ধরে রাখতে লড়াই করে যাচ্ছে চিন জাতির মানুষ। অযাচিত নির্যাতন, বিধ্বংসী বিমান হামলা, ঘর-বাড়ি উচ্ছেদ, নিরাপত্তার অভাব, বৈষম্য মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী মনে করে মিয়ানমারকে তারা বানিয়েছে, সেজন্য তারাই দেশকে শাসন করবে। আর সামরিক সরকার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেবে এটাই স্বাভাবিক। তাই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চিনরা সশস্ত্র সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এই সংগ্রামে সামরিক জান্তা সরকারকে বেশিরভাগ অস্ত্র দিচ্ছে রাশিয়া, চীন ও ভারত। বিমান হামলার বিমানগুলোর বেশিরভাগ আসে রাশিয়া থেকে।

This article is written in Bangla about the fighting of 'Chin people' against military junta in Myanmar.
All the references are hyperlinked inside text
Feature image: The Irrawaddy

Related Articles