একবিংশ শতকের শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে চীনা পণ্যের আধিপত্য চলছে। উন্নত থেকে অনুন্নত- বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রান্তে চীনের রাজসিক আবির্ভাবের জানান দিচ্ছে তার পণ্য।
এই যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেরও বড় একটি অংশ দখল করেছে চীন। আর এই বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাড়তি কর বসিয়ে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ‘ শুরু করেছেন।
তবে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও ভরে গেছে চীনের হরেকরকম পণ্যে। এর মধ্যে প্রযুক্তিগত পণ্যই বেশি। কিন্তু এশিয়ার পরাশক্তি চীন যেখানে পণ্য রপ্তানি করছে, সেখান থেকেই তাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উঠেছে।
ইউরোপ বলছে চীন তাদের প্রযুক্তি চুরি করছে। ইউরোপের এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু? আর যদি সত্যতা থাকে, তাহলে চীন কীভাবে এই চৌর্যবৃত্তি চালাচ্ছে?
চীনের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রতি বছর চীনও ইইউ ৫৭৫ বিলিয়ন ইউরোর বেশি বাণিজ্য করে থাকে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশ বা ব্লক ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে এগিয়ে নেই। চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ককে দৃঢ় করার জন্য চলতি বছরের এপ্রিলে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসে ই.ইউ৷ সে বৈঠকে ইউরোপের কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের সহজ শর্তে ব্যবসার করার সুযোগ দেওয়ার জন্য চীনের কাছে অনুরোধ জানায় ই.ইউ। বৈঠকটি ইতিবাচকভাবে শেষ হয়।
কিন্তু এর দু’দিন পর ডাচ পত্রিকা Financieele Dagblad এক ভয়ঙ্কর খবর প্রকাশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘এএসএমএল’ এর ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা চীনের যোগসাজশে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে। পত্রিকাটির ভাষ্যমতে, চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এই তথ্য চুরির মূল হোতা! যদিও তারা এর সাথে চীন সরকারের জড়িত থাকার বিষয়ে শক্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
ডাচ কোম্পানি ‘এএসএমএল’ মূলত লিথোগ্রাফি সিস্টেম তৈরি করে। এর মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টরের সার্কিট চিহ্নিত করা হয়। ২০১৫ সালে কোম্পানিটির সিলিকন ভ্যালির অফিস থেকে ছয়জন কর্মকর্তা মেমোরিতে করে বেশ কিছু গোপন নথিপত্র চুরি করে। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই চীনের নাগরিক।
ডাচ পত্রিকা Financieele Dagblad-এর রিপোর্টে বলা হয়, এই কাজটি করা হয়েছে এএসএমএল’র প্রতিদ্বন্দ্বী চীনা মালিকানাধীন এক্স-টাল (XTAL) কোম্পানির নির্দেশে। এক্স-টাল চুরি করা নথিপত্র দ্রুতগতিতে প্রসেস করতে শুরু করে এবং এক বছরের মাথায় এএসএমএল’র ক্রেতার বড় একটি অংশও তাদের দলে ভেড়ায়। অর্থাৎ এএসএমএল’র পণ্য যারা কিনতেন, তাদের বড় একটি চীনা কোম্পানি এক্স-টালের কাছে চলে যায়। এর মধ্যে ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ‘স্যামসাং’ অন্যতম!
ডাচ কোম্পানির অস্বীকার
নথিপত্র চুরির হওয়ার বিষয়টি প্রথমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে এএসএমএল। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা বিষয়টি স্বীকার করলেও বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে, নেদারল্যান্ডসের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ডাচ টেক কোম্পানিগুলো ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি’ বা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ’ চুরির বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করেছিল। কিন্তু এরপরও এএসএমএল তাদের নথিপত্র চুরি ঠেকাতে পারেনি৷
ডাচ পত্রিকা Financieele Dagblad তাদের রিপোর্টে তথ্য-চুরির বিষয়ে চীন সরকারের যোগসাজশের বিষয়টি তুলে ধরে। কিন্তু স্বয়ং এএসএমএল এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তাদের মতে, কোম্পানির নথিপত্র চুরির সাথে চীন সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তবে এএসএমএল চীন সরকারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার পেছনে ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল। চীন তাদের বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। গত বছর চীনে তারা প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এছাড়া, চীনের বড় বড় কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের সাথে ডাচ কোম্পানিটির ভালো সম্পর্ক থাকায় তারা সরাসরি সরকারের ওপর দোষ চাপানোর ঝুঁকি নেয়নি। বরং তাদের ভাষ্য ছিল, চীন সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এএসএমএল’র একজন মুখপাত্র বলেন,
চীন বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়েছে এবং তারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
ডাচ কোম্পানি বিষয়টি হালকাভাবে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র নথিপত্র চুরির সাথে জড়িত থাকা ‘এক্স-টাল’কে ছেড়ে কথা বলেনি। ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারার এক আদালতে ঘটনার সাথে জড়িত ছয় চীনা ব্যক্তিকে তথ্য পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে৷
সেই আদালতের শুনানিতে এএসএমএল অংশ নেয়। তারা বিচারকের কাছে অভিযোগ করে, এক্স-টাল চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে চলা একটি কোম্পানি। কোম্পানিটি তাদের প্রযুক্তি চুরি করে যেসব পণ্য করেছে, সেই একই ধরনের পণ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় এএসএমএল বিক্রি করে।
পরবর্তী সময়ের তদন্তে উঠে আসে এক্স-টাল হলো ডংফ্যাং জিনগুয়ানের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, যার সাথে আবার চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সরাসরি জড়িত। এর ফলে ধারণা করা হয়, এএসএমএল’র প্রযুক্তি চুরির পেছনে চীন সরকারের হাত রয়েছে। কেননা চীন প্রযুক্তি ব্যাপক উন্নতি সাধন করলেও এখনো তারা সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি; বরং এই পণ্যের জন্য তাদের সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ইউরোপিয়ান দেশের উপর নির্ভর করতে হয়।
সবশেষে ক্যালিফোর্নিয়ার আদালত এক্স-টালকে ২২৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এই রায়ের এক মাস পরেই এক্স-টালকে ব্যাংক থেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। ফলে আদৌ এএসএমএল এই ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
একই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর
চীনের বিরুদ্ধে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি’ বা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ’ চুরির অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার বেশ কয়েকটি বড় মাপের কোম্পানি। বিশ্ববিখ্যাত বিজনেস নিউজ চ্যানেল ‘সিএনবিসি’র মতে উত্তর-আমেরিকা ভিত্তিক গড়ে পাঁচটি প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানির মধ্যে একটি কোম্পানির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে চীন। এই তথ্য জানার পর উত্তর আমেরিকার ২৩টি কোম্পানি নিজ উদ্যোগে জরিপ করে ভয়ঙ্কর তথ্য পেয়েছে৷
গত এক দশক ধরে এই ২৩টি কোম্পানির মধ্যে সাতটি কোম্পানির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি চুরি করেছে বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানি। চীনের কোম্পানিগুলোর এই চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট আগে থেকেই সতর্ক করেছিল। কিন্তু এরপরও অ্যাপল, আইবিএম ও জিই (GE) এর মতো টেক জায়ান্টও নিজেদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি চুরি আটকাতে পারেনি। চীনের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য এবং আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করা চীনা কর্মকর্তারা এই চুরির কাজে সহযোগিতা করেছে।
আমেরিকান কোম্পানিগুলোর ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি চুরির বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসন জানার পর চীনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে, যা সর্বশেষ রূপ নিয়েছে বাণিজ্যে যুদ্ধে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জি-২০ সামিট শেষ হওয়ার পর চীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ কিছু নথিপত্র দাখিল করে৷ সেই নথিপত্র থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের ভিত্তিতে চীন তাদের ৩৮টি কোম্পানিকে শাস্তি প্রদান করেছে। শাস্তি হিসেবে কোম্পানিগুলোকে রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো, যেসব কোম্পানিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি৷
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে মূল্যবান ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি’ বা ‘আইপি’। এই সম্পদ দিয়ে যেকোনো প্রযুক্তি কোম্পানি বা কোনো দেশ রাতারাতি তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম। পূর্বে সাম্রাজ্যবাদী নীতির মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দেশগুলো এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে অনেক ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে, যার প্রায় সবই ছিল অনৈতিক পন্থায়। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ক্ষেত্রে কি তবে সেই একই পথে বর্তমানে হাঁটছে চীন?