Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুগাউলি চুক্তি: নেপাল-ভারত সীমান্ত বিরোধের নেপথ্যের কারণ

হিমালয়ের একটি গিরিপথ লিপুলেখ, যেখানে ভারতের উত্তরাখন্ড, চীনের তিব্বত এবং নেপালের সীমানা গিয়ে মিশেছে। ৮ মে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং লিপুলেখ এলাকায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লিঙ্ক রোডের উদ্বোধন করেন। যে পথ ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাস-মানস সরোবরের মধ্যকার দূরত্ব অনেকাংশে হ্রাস করবে। একই সাথে চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হবে।

লিপুলেখ লিঙ্ক রোড উদ্বোধনের পর পরই নেপাল তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের দাবি- লিপুলেখ হচ্ছে হতাদের ভূখণ্ড। কাজেই ভারত তার মধ্যে রাস্তা তৈরি করে নেপালের সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে তার হাতে প্রতিবাদ হিসেবে নোট তুলে দেন, যা বিরল ঘটনা। কারণ এ ধরনের প্রতিবাদ সাধারণত পররাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমেই জানানো হয়। তবে নেপাল এখানেই থেমে থাকেনি। সীমান্তে সেনা পর্যন্ত মোতায়েন হয়েছে।

লিপুলেখ লিঙ্ক রোড তৈরির প্রতিবাদে নেপালে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে তরুণদের বিক্ষোভ © Skanda Gautam/THT

 

নেপালের সাথে ভারতের প্রায় ১,৮০৮ কিলোমিটার মুক্ত সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সীমানা জুড়ে রয়েছে নদী। পূর্বে মেচি, পশ্চিমে মহাকালি এবং সুস্তা এলাকায় নারায়ণী নদী। ভারত ও নেপালের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে মূলত ১৮১৬ সালের ৪ মার্চ ব্রিটিশদের সাথে নেপালের স্বাক্ষরিত সুগাউলি চুক্তির মাধ্যমে। সেই চুক্তি অনুসারে মহাকালি নদীই হবে দুই দেশের মধ্যকার সীমানা। মূলত সুগাউলি চুক্তি করা হয়েছিল সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য। কিন্তু ২০০ বছর পরেও এই চুক্তি ঘিরে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে।

সুগাউলি চুক্তির উপর ভিত্তি করে নেপাল লিপুলেখ গিরিপথকে নিজেদের দাবি করে। সেই সাথে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লিমপিয়াধুরা এবং কালাপানিকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে আসছে নেপাল। গত নভেম্বরে কালাপানিকে ভারত নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে মানচিত্র প্রকাশ করার পর প্রতিবাদ জানায় নেপাল। যদিও ভারত তেমন কর্ণপাত করেনি।

লিপুলেখ রোডের একটি অংশ; Image Source: Outlook India

 

এখন সুগাউলি চুক্তি অনুসারে দুই দেশের সীমানা নির্ধারিত হলেও সমস্যা ঠিক কোন জায়গায়? ভারত ও নেপালের মধ্যে সীমানা নিয়ে সমস্যার কারণ হচ্ছে মহাকালি নদীর উৎস নিয়ে দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব। নেপালের দাবি হচ্ছে- এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিমপিয়াধুরা থেকে। যে জায়গা লিপুলেখ থেকে পশ্চিম দিকে অনেক ভেতরে। অন্যদিকে ভারতের দাবি- মহাকালি নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিপুলেখ থেকে। এর বিপরীতে নেপাল বলছে, ভারত যে নদীকে মহাকালি নদীর উৎস বলছে, যা হচ্ছে সেই নদীরই একটি উপনদী। এদিকে বিতর্কিত ভূখণ্ডটি দুটি নদীর মাঝখানে পড়েছে।

মানচিত্রে বিতর্কিত লিমপিয়াধুরা-কালাপানি-লিপুলেখ; Image Source: Border Nepal

 

সমস্যা হচ্ছে, নেপালের পক্ষে নিজেদের তৈরি পুরোনো কোনো মানচিত্র দাখিল করা সম্ভব না। এর ফলে তাদের ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যার মাধ্যমে সঠিক সীমানা খুঁজে বের করা সহজ নয়। এমনকি নেপালের কাছে সুগাউলি চুক্তির আসল কপিও নেই, যা সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করেছে। এই লেখায় সুগাউলি চুক্তির ইতিহাস, ভারত-নেপাল সীমান্ত বিরোধ এবং এই বিরোধের পেছনের কারণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হবে।

যেভাবে হয়েছিল সুগাউলি চুক্তি

১৮১৬ সালের ৪ মার্চ ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নেপালের মধ্যে যে চুক্তি সম্পন্ন হয়, তা সুগাউলি চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির ফলে নেপাল পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রাজ্য হারায়। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ ছোট ছোট সামন্ত রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে বিশাল এবং শক্তিশালী নেপাল গঠন করেন। তার মৃত্যুর পর যারা উত্তরসূরী যারা ছিলেন তারাও রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন।

কিন্তু ব্রিটিশরা নেপালের এই রাজ্য বিস্তারকে মেনে নিতে পারেনি। যে কারণে তারা নেপালের সাথে নালাপানি, জৈঠাক এবং মাকাওয়ানপুরে মোট তিনটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধগুলোতে ব্রিটিশরা চালাকি এবং প্রতারণার মাধ্যমে গোর্খাদের পরাজিত করে নেপালকে সুগাউলি চুক্তি করতে বাধ্য করে।

সুগাউলি চুক্তি ছিল পুরোপুরি অসম একটি চুক্তি। কারণ দুই পক্ষের মধ্যকার চুক্তি মানে হচ্ছে একপক্ষ একটু বাড়তি সুবিধা পাবে আর অন্যপক্ষ তুলনামূলক একটু কম অথবা উভয়পক্ষই সমান সুবিধা পাবে। কিন্তু এই চুক্তিতে নেপালের প্রাপ্য বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সব সুবিধা পেয়েছিল ব্রিটিশরা। এই চুক্তির আগে নেপালের সীমানা পূর্বে তিস্তা, পশ্চিমে কাংড়ার দূর্গ এবং দক্ষিণে গঙ্গা ও যমুনা পর্যন্ত ছিল। কিন্তু সুগাউলি চুক্তির পর নেপালের তিন দিকেই সীমানা কমে আসে।

এছাড়া কোনো চুক্তি মূলত উভয় পক্ষের স্বার্থের সমতা, পারস্পরিক মঙ্গল এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশরা সুগাউলি চুক্তি করে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুক্তির খসড়া তৈরি করার পর ১৮১৫ সালের ২ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্যারিস ব্র্যাডশ তাতে স্বাক্ষর করে নেপালের কাছে পাঠিয়ে দেন। নেপালকে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্বাক্ষর করে চুক্তিপত্র ব্রিটিশদের কাছে পাঠানোর কথা বলে দেওয়া হয়।

এই চুক্তির কোনো শর্ত নেপাল পছন্দ করেনি। যে কারণে তারা প্রথমে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তখন ব্রিটিশরা গুজব রটায় যে তারা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে হামলা করতে যাচ্ছে। নেপালকে তা বিশ্বাস করানোর জন্য তারা সেনা নিয়ে রওনাও করে, যা ছিল চাপ প্রয়োগের কৌশল। নেপাল তখন মনে করেছিল, তাদের রাজধানীতে ব্রিটিশরা হামলা চালাতে বদ্ধপরিকর। এবং এই হামলা প্রতিহত করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। এরপর তারা বাধ্য হয়েই চুক্তিটি মেনে নেয়।

যেহেতু চুক্তিটি নেপালের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে কারণে দেশটির রাজা এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাতে স্বাক্ষর করতে রাজি হননি। তখন নেপালের পক্ষে চন্দ্রশেখর উপাধ্যায় এবং গজরাজ মিশ্র সুগাউলিতে ব্রিটিশ ক্যাম্পে গিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ব্রিটিশদের ১৫ দিনের বেধে দেওয়া সময়ের পরিবর্তে ৯৩ দিন পর নেপাল চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তা কার্যকর করা হয় ব্র্যাডশ যেদিন স্বাক্ষর করেছেন সেদিন থেকে।

১৮১৪ সালে অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধে ভিমসেন থাপার সাথে সৈন্যরা; Image Source: Wikimedia Commons

 

নেপাল বাধ্য হয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কারণ ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল চুক্তিটি নেপালের রাজার মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে। কিন্তু তৎকালীন রাজা গিরওয়ানা বিক্রম শাহ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এমন কোনো দলিল নেই। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল নেপাল চন্দ্রশেখরের স্বাক্ষর করা সুগাউলি চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না। এই কারণে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ডেভিড অক্টারলোনি চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে তা অনুমোদন করে দেন। এবং চুক্তির একটি প্রতিলিপি চন্দ্রশেখরের হাতে তুলে দেন।

এর অর্থ হচ্ছে কর্নেল ব্র্যাডশ এবং চন্দ্রশেখরের স্বাক্ষর করা চুক্তিটি অনুমোদন করেন শুধুমাত্র অক্টারলোনি। যদিও চুক্তির ধারা বলছে তা নেপালের রাজার মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে। ফলে সুগাউলি চুক্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু চুক্তি যখন অন্যায্য এবং চাপিয়ে দেওয়া সেখানে বৈধতার প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক।

চুক্তির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব

সুগাউলি চুক্তির আগে নেপালের পূর্ব-পশ্চিমের সীমানা ছিল তিস্তা থেকে কাংড়া দূর্গ পর্যন্ত। যার দৈর্ঘ্য ছিল ১,৪১৫ কিলোমিটার এবং মোট আয়তন ছিল ২,৬৭,৫৭৫ বর্গ কিলোমিটার। একইভাবে তিস্তা থেকে সুতলেজ পর্যন্ত সীমানার দৈর্ঘ্য ছিল ১,৩৭৩ কিলোমিটার এবং মোট আয়তন ছিল ২,০৪,৯১৭ বর্গ কিলোমিটার।

কিন্তু চুক্তির পর পূর্ব-পশ্চিমে নেপালের সীমানা কমে দাঁড়ায় ৮৮৫ কিলোমিটার। এবং মেচি থেকে মহাকালি নদীর মধ্যবর্তী নেপালের মোট ভূখণ্ডের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪৭,১৮১ বর্গ কিলোমিটারে। যার ফলে নেপালের আয়তন তিন ভাগের এক ভাগ কমে যায়।

সুগাউলি চুক্তির আগে ও পরের নেপাল; Image Source: imnepal.com

 

এদিকে নেপাল শুধু পশ্চিম সীমান্তেই ভূখণ্ড হারায়নি। তাদের পূর্বে মেচি থেকে তিস্তা নদী পর্যন্তও ছেড়ে দিতে হয়েছে, যেখানে ব্রিটিশদের সাথে তাদের কোনো যুদ্ধই হয়নি। তবে এখানেই শেষ নয়। নেপালের ছেড়ে দেওয়া ভূখণ্ডে আগে থেকে যে সকল গোর্খা সেনা ছিল তাদের ৪০ দিনের মধ্যে প্রত্যাহার করার সময় বেধে দেয় ব্রিটিশরা। তবে মজার বিষয় হচ্ছে সুগাউলি চুক্তির ১১ মাস পর ১৮১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশরা সিকিমের সাথে তিতালিয়া চুক্তি করে। সেই চুক্তিতে তারা নেপালের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ভূখণ্ড সিকিমকে দিয়ে দেয়।

সুগাউলি চুক্তির পর নেপাল প্রত্যক্ষভাবে তার বড় ভূখণ্ড হারায়। আর পরোক্ষভাবে সেখানে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন ব্রিটিশরা নেপালের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ভূখণ্ড সিকিমকে দেওয়ায় তাদের সাথে ভবিষ্যতে বিরোধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এর পাশাপাশি নেপালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়। একটি পক্ষ ছিল যারা যুদ্ধ করে হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিল। আরেকটি পক্ষ যারা আর ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। তবে সর্বোপরি সুগাউলি চুক্তি ছিল নেপালের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত।

ব্রিটিশদের অনুশোচনা

চুক্তির পাঁচ মাসের মাথায় ব্রিটিশরা সীমান্তে নতুন করে পিলার বসানোর কাজ শুরু করে। তবে একসময় তারা অনুধাবন করতে পারে তারা নেপালের সাথে অন্যায় করেছে। সুগাউলি চুক্তির একটি ধারা অনুযায়ী ব্রিটিশরা নেপালের গোর্খা বাহিনীকে খুশি রাখার জন্য প্রতি বছর দুই লাখ রুপি করে প্রদান করার অঙ্গীকার করেছিল। তারা তাদের এই অঙ্গীকার কয়েক বছর পালনও করেছিল। এরপর অনুশোচনা থেকে তারা আরো বাড়তি কিছু দিতে চেয়েছিল।

১৮১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথমে কোশি নদী থেকে রাপ্তি পর্যন্ত তারাই নামে একটি অঞ্চল ব্রিটিশরা ফেরত দেয়। এরপর চুক্তির প্রায় ৪৪ বছর পর তারা রাপ্তি থেকে কালি পর্যন্ত ভূখণ্ড নেপালকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এই ভূমি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ব্রিটিশরা চুক্তি অনুযায়ী দুই লাখ রুপি দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

নেপালের পক্ষে কি হারানো ভূখণ্ড ফেরত পাওয়া সম্ভব ছিল?

সুগাউলি চুক্তি নেপালের উপর ব্রিটিশরা চাপিয়ে দিলেও দেশটি শুরু থেকে পরবর্তী দুই শতক জুড়েই প্রশাসনিক দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। সবার প্রথমে তারা ব্রিটিশদের সাথে চুক্তির শর্ত নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি। এরপর মেচি-তিস্তা পর্যন্ত তারা যে ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়েছে সেখানে ব্রিটিশদের সাথে তাদের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। এরপরও তারা প্রায় বিনা বাক্যে তা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়েছে, যা তাদের প্রশাসনিক দুর্বলতাকে তুলে ধরেছে।

এরপর ব্রিটিশরা যখন ভারতকে স্বাধীনতা দেয় তখন নেপালের সুযোগ ছিল তাদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করার। তখন নেপালের রানা শাসকরা যদি তাদের ভূখণ্ড ফেরত দেওয়ার জন্য ব্রিটিশদের অনুরোধ করতেন তাহলে তা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নিজ দেশেই তাদের অবস্থান ছিল নড়বড়ে, যে কারণে তারা আর আগ্রহ দেখায়নি। রানাদের ধারণা ছিল যে ভূখণ্ড আছে সেখানেই তারা শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারছেন না। বাড়তি ভূখণ্ড যোগ হলে তারা তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না।

ব্রিটিশরা নেপালকে তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেনি। তবে নেপালের কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছে রাজ্যের বড় একটি অংশ; Image Source: Asia Times

 

নেপালের সামনে হারানো ভূখণ্ড ফেরত পাওয়ার আরো একবার সুযোগ এসেছিল। ১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই, ভারত ও নেপালের মধ্যে ‘পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই ট্রিটি বা চুক্তির ৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে,

এই চুক্তির মাধ্যমে নেপাল ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যকার পূর্বের সকল চুক্তি ও সমঝোতা বাতিল ঘোষণা করা হলো।

এর অর্থ হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নেপালের করা সুগাউলি চুক্তি ১৯৫০ সালের পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি দ্বারা বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু নেপালের পক্ষ থেকে কখনোই এই অনুচ্ছেদের সাপেক্ষে সুগাউলি চুক্তি কারণে হারানো ভূখণ্ড ফেরত পাওয়ার দাবি ভারতের কাছে করা হয়নি। মজার বিষয় হচ্ছে সুগাউলি চুক্তির মতো ভারতের সাথে করা চুক্তিরও আসল কপি নেপালের কাছে নেই

নেপাল-ভারত সীমান্ত বিরোধ কী সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নাকি বহুদিনের ফসল?

হঠাৎ করে লিপুলেখ গিরিপথের মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরিকে কেন্দ্র করে নেপালের তীব্র প্রতিবাদ দেখে মনে হতে পারে ভারত এবং নেপালের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ হয়তো সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা। কিন্তু বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বরং বহুদিন ধরে অল্প অল্প করে জমানো তিক্ততা শেষ পর্যন্ত এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। নেপাল বর্ডারে ভারত সেনা মোতায়েন করে রাখলেও অপর পক্ষ থেকে কোনো সেনা উপস্থিতি আগে থেকে ছিল না।

সীমান্ত নিয়ে নেপালের এই অবহেলার কারণে দেশটিকে মূল্য দিতে হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশটি সেন্য মোতায়েন না করায় ভারত ক্রমান্বয়ে আইন ভঙ্গ করে সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড দখল করতে শুরু করে। নেপাল এখন অভিযোগ করছে ভারতের সাথে তাদের সীমান্তবর্তী ৭৫টি জেলার মধ্যে ২৩টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমি ভারত অবৈধভাবে দখল করেছে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নেপালের জনগণ প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে নেপালের কোনো অভিযোগ ভারত আমলে নেয়নি।

নেপাল ও ভারতের মধ্যে যেসব সীমান্ত এলাকা নিয়ে বিরোধ রয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কালাপানি, লিমপিয়াধুরা, সুস্তা, মেচি এবং তানাকপুর। উভয় দেশই এই বিতর্কিত এলাকাগুলো নিজেদের দাবি করে আসছে। এই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য ‘ইন্ডিয়া-নেপাল জয়েন্ট টেকনিক্যাল লেভেল বাউন্ডারি কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।

মূলত ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধে ভারত পরাজিত হওয়ার পর থেকে নেপালের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড দখলে নেওয়া শুরু করে। যুদ্ধে হারের পর পরই চীনের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য তারা প্রথমে নেপালের কালাপানিতে সেনা ক্যাম্প তৈরি করে, যেখান থেকে পরবর্তীতে ভারত আর সেনা প্রত্যাহার করেনি। বরং উল্টো কালাপানিকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করছে।

বিতর্কিত কালাপানি সীমান্ত; Image Source: Nepal outline

 

নেপালের জরিপ বিভাগের সাবেক পরিচালক বুদ্ধি নারায়ণ শ্রেষ্ঠার তৈরি করা রিপোর্টে ১৮৫০ এবং ১৮৫৬ সালের মানচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যে মানচিত্র দুটি নেপালি কর্তৃপক্ষকে সাথে নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সার্ভে অব ইন্ডিয়া তৈরি করেছিল। এই দুটি মানচিত্র থেকে পরিষ্কার যে মহাকালি নদীর উৎপত্তি কালাপানি থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের লিমপিয়াধুরাতে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে কালাপানি নেপালের ভূখণ্ড। কিন্তু ভারত মানচিত্র দুটি দলিল হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ। বিপরীতে তারা ১৮৭৫ সালের একটি মানচিত্র উপস্থাপন করে থাকে, যা থেকে দেখা যায় মহাকালি নদীর উৎপত্তি কালাপানি থেকে পূর্বে। কিন্তু ভারতের দাখিল করা ১৮৭৫ সালের মানচিত্রে নেপালের কোনো সার্টিফিকেশন নেই।

আরেকটি বিতর্কিত স্থান হচ্ছে সুস্তা। এই জায়গার অবস্থান নারায়ণী নদীর পূর্বে। কয়েক বছর আগে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় কয়েক হাজার ভারতীয় নাগরিক জোরপূর্বক নেপালের সুস্তায় প্রবেশ করে প্রায় ১০ হেক্টর জমির আখ পুরোপুরি নষ্ট করে। এছাড়া সেখানকার বিতর্কিত এলাকার স্থানীয়দের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হলে সবসময় ভারতের নাগরিকদের হাতে নেপালিরা প্রহারের শিকার হয়। কারণ নিজ দেশের নাগরিকদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

সুস্তা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টির মূল কারণ হচ্ছে নারায়ণী নদীর গতিপথ পরিবর্তন। নদীর মূল গতিপথ পূর্ব দিক থেকে সরে পশ্চিমে নেপালের দিকে চলে গেছে, যার ফলে ভারত প্রায় ১৪,৫০০ হেক্টর জমি দখল করেছে, যা বিগত কয়েক দশকে হয়েছে। সুস্তার তিন দিকেই ভারত। ফলে এই এলাকায় ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের, যেখানে প্রতাপশালী ভারতের সামনে নেপালের করার তেমন কিছুই নেই।

নারায়ণী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নেপালের ভূখণ্ড ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে; Image Source: nepal24hours.com

 

ভারতের সাথে নেপালের আরো একটি বিরোধ হচ্ছে মেচি সীমান্ত ঘিরে, যেখানে ১৮১৬ সালের সুগাউলি চুক্তির পর ব্রিটিশরা নেপাল-ভারতের সীমানা হিসেবে পিলার বসায়। চুক্তির পর পর ব্রিটিশ ভারতের প্রকাশ করা মানচিত্রও সাক্ষ্য দেয় যে এই পিলারগুলো ভারত ও নেপালের মধ্যকার সীমানা। কিন্তু ভারত বর্তমানে তা মেনে নিতে রাজি নয়।

সরকারিভাবে নেপালের আয়তন ১,৪৭,১৮১ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে তা পাওয়া মুশকিল। কারণ ভারতের দখলদারিত্বের কারণে তারা নিয়মিতভাবে ভূমি হারাচ্ছে। এর আগে ভারত ও নেপালের জেলা পর্যায়ের আধিকারিকরা সম্মত হয়েছিলেন বিতর্কিত ভূমিতে উভয়ের দেশের নাগরিকরা কোনো কাজের জন্যই ব্যবহার করতে পারবেন না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় ভারতের নাগরিকরা সেখানে কৃষিকাজ শুরু করেছে।

নেপাল ও ভারতের যৌথ সীমান্ত বিষয়ক কমিটি ইতোমধ্যে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের ৯৭ ভাগ কাজ সম্পন্ন করার দাবি করেছে, যার ভিত্তি হিসেবে তারা ১৮৭৪ সালের একটি পারসিয়ান ম্যাপকে বেছে নিয়েছে। তারা বলছেন, কালাপানি এবং সুস্তা ছাড়া বাকি সব সীমান্তবর্তী বিতর্কিত ভূমির সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু যখন মাঠে যাওয়া যায় তখন দেখা যায় সীমান্তবর্তী নেপালের অনেক জায়গা ভারতের দখলে।

নেপাল-ভারত সীমান্ত বিরোধ এখন উপমহাদেশের আলোচিত বিষয়; Image Source: Annapurna Express

 

নেপালের দিক থেকেও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে পারসিয়ান ম্যাপকে ভিত্তি হিসেবে মেনে নেওয়ার পর তারা আরো ১,৬৩০ হেক্টর ভূমি হারিয়েছে, যা বর্তমানে ভারতের দখলে। এছাড়া কালাপানিতে ভারতের সেনা থাকার পরও নেপাল কোনো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

এদিকে বিভিন্ন কারণে ভারতের কাছে নেপাল গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য তারা দেশটিতে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে এখানেই শেষ নয়। নেপালের বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপকে ভারত অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে, যা দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিপি কৈরালার আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে। এসব কিছু করার কারণ হচ্ছে নেপালকে ভারত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে চীনের কারণে তা কঠিন হয়ে পড়েছে।

নেপালের ব্যর্থতা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি

গত বছরের নভেম্বরে ভারত যখন কালাপানিকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দেখিয়ে মানচিত্র প্রকাশ করে তখন নেপাল তার প্রতিবাদ জানায়। এই ঘটনার ছয় মাস না পেরোতেই ভারত লিপুলেখ গিরিপথের মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে। কালাপানি এবং সুস্তা নিয়ে ভারতের সাথে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও এমন একটি রাস্তা তৈরির পর নেপাল সরকারের কূটনীতিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন দেশটির আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

২০১৫ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং যখন ভারত সফরে আসেন তখন উভয় দেশ নাথু লা, লিপুলেখ এবং শিপকি লা বর্ডার পয়েন্ট সম্প্রসারণ করার বিষয়ে একমত হয়। নেপালের প্রতিবেশী দুই দেশ যখন কালাপানির কাছে দিয়ে বাণিজ্যিক রুট সম্প্রসারণের বিষয়ে একমত, তারা তখনও অজ্ঞাতসারে। এখন ভারত যখন বিতর্কিত ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরি করলো তখন নেপালের আধিকারিকরা বিস্ময় প্রকাশ করলেন, যা তাদের ব্যর্থতাকে ফুটিয়ে তুলেছে।

এ বিষয়ে নেপালের সার্ভে বিভাগের সাবেক পরিচালক তয়ানাথ বড়াল বলেন,

আমরা ২০১৩ সাল থেকে শুনে আসছি ভারত ও চীন মানস সরোবরের সাথে যুক্ত তিনটি সীমান্ত পয়েন্ট খুলে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলছে। ভালো হতো তখন থেকেই আমরা যদি চীন ও ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ করতাম। ২০১৫ সালে চীন ও ভারত চুক্তি সম্পন্ন করেছে। ভারত ইতোমধ্যে সেখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি।

বড়াল ২০০৭ সালে ভারতের সাথে সীমান্ত বিষয়ে নেপালের আলোচনায় যুক্ত ছিলেন। তার তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ভারত ও চীনের চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর নেপাল প্রতিবাদ জানিয়েছে। নেপাল এখন কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে। পানিও অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এখন নেপাল যে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে তার পেছনে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জড়িত। যদিও ভারতের দিক থেকে চীনের যোগসাজশের কথাও বলা হচ্ছে। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নেপালের শুধু সাধারণ মানুষই নয় সেখানকার রাজনীতিবিদরাও আর ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকতে রাজি নয়। কারণ নেপালে বর্তমানে কেপি শর্মা ওলির যে সরকার ক্ষমতায় তারাও নির্বাচনে জিতে এসেছে ভারত বিরোধী প্রচারণাকে হাতিয়ার করে, যে কারণে তার নরম অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি; Image Source: IANS

 

নেপাল বর্তমানে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। আর তার পেছনে যে চীনের প্রভাব রয়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমানে যে বিষয়টি নিয়ে বিরোধ তার সাথে চীনও জড়িত। প্রতিবাদ শুধু ভারতকে জানিয়ে লাভ নেই। এ বিষয়ে সমাধান করতে হলে চীনের সাথেও নেপালকে বসতে হবে।

২০১৭ সালে সীমান্ত নিয়ে চীন ও ভারতের সাথে দোকলামে যখন দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছিল তখন নেপালের বিশেষজ্ঞরা উভয় দেশকে তাদের নিজেদের বিষয়টি তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু নেপাল সরকার তখন কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেনি। সব মিলিয়ে নেপালে যে ভারতের আগ্রাসন তার পেছনে নিজেদের অবহেলাও দায়ী। বর্তমানে ভারত বিরোধিতার যে জোয়ার উঠেছে তার মাধ্যমে হয়তো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফায়দা তোলা সম্ভব। কিন্তু কালাপানি কিংবা সুস্তার মতো সমস্যার সমাধান হবে কি?

Related Articles