পেন্সিলের খসখস শব্দে বহু বছরের পুরনো মানচিত্রটা ধর্মের ভিত্তিতে কেটে ভাগ করে দিলেন সিরিল র্যাডক্লিফ। পেশায় তিনি ছিলেন দক্ষ ব্রিটিশ আইনজীবী, কিন্তু মানচিত্র নিয়ে সামান্যতম জ্ঞান ছিল না তার। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় নিয়ে হিন্দু- মুসলমানের ভিত্তিতে মানচিত্রজুড়ে র্যাডক্লিফ এঁকে দিলেন ‘সীমান্তরেখা’। এরপর নিজের সব নোট পুড়িয়ে তিনি ফিরে গেলেন ব্রিটেনে, পুরস্কার হিসেবে পেলেন ‘নাইট’ উপাধি।
যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি নিজে হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ তখনও স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ উদযাপনে গভীরভাবে মত্ত। হবেও না বা কেন! এ যে প্রায় দু’শো বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মুক্তি।
কিন্তু স্বাধীনতা কি সবার জন্য স্বস্তি হয়ে এল? অনেক মানুষ ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করল, যে দেশে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, যেখানের মাটি ও বাতাসে তার পরিপুষ্টি, সে দেশ আর তার নিজের নেই। তাকে যেতে হবে অন্য কোন দেশে। ক’দিনের মাঝেই মানবধর্মের ঊর্ধ্বে জয়লাভ করল সাম্প্রদায়িক ধর্ম। ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠল ধর্মের পরিচয়- হিন্দু, না কি মুসলমান? একজনের রক্তে রঙিন হলো আরেকজনের হাত। ভিটেমাটি সব ছেড়ে একদেশের মানুষ অন্য দেশে গিয়ে হলো ‘উদ্বাস্তু’, ‘বাস্তুহারা’। পরবর্তীতে ভয়াবহ রকমের মানবেতর জীবনের মধ্য দিয়ে যাওয়া সে সব মানুষের কাছে ‘দেশভাগ’ একটি দুঃস্বপ্নের নাম।
১৯৪৭ থেকে ২০১৭, দেশভাগের সত্তর বছর পূর্তিতে ‘সীমান্তরেখা‘ নামে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল। ক্রাউড ফান্ডিং বা গণঅর্থায়নে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্রে মূলত সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব হিন্দু পরিবার ভারতে গিয়েছিলেন, ভারত থেকে যেসব মুসলমান পরিবার বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) এসেছিলেন এবং বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসকারী মানুষদের জীবনে দেশভাগের প্রভাব ফুটে উঠেছে।
মূলত এসব বাস্তুচ্যূত মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রামাণ্যচিত্রটিকে এগিয়ে নিয়েছেন, মানুষের গল্পের মধ্য দিয়ে ফিরে দেখতে চেয়েছেন ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে। তৎকালীন নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হওয়া সাধারণ মানুষের জীবনে দেশভাগ যে ভয়াবহ বেদনার জন্ম দিয়েছে, বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে সেই মর্মন্তুদ বেদনার প্রকৃত রূপটিকেই তানভীর মোকাম্মেল পুনঃআবিষ্কার করতে চেয়েছেন গবেষণাধর্মী এই প্রামাণ্যচিত্রে।
যাত্রা শুরু হয় অপরাজিতা ঘোষাল ও অঞ্জলি চক্রবর্তী নাম্নী দু’জন প্রবীণ মহিলাকে নিয়ে, যাদের শৈশব কেটেছে এ দেশের মাটিতে। এরপর দেশভাগের সময় বাধ্য হয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভারতে। দীর্ঘ ৭০ বছর পর দেশের মাটিতে ফিরে তারা দেখতে পান, তাদের জায়গায় এখন বাস করছে অন্য মানুষেরা, নিজেদের বাড়িঘর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবুও শৈশবের স্মৃতি হাতড়িয়ে তারা বলতে থাকেন, “ঘরটা ছিল এখানে। বেলগাছ আর আমগাছটা কই গেল?” হারানো সময়ের এই আকুল রোমন্থন শুরুতেই আমাদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। যে গভীর বেদনা তারা বয়ে নিয়ে চলেছেন, তা তাদের থেকে সংক্রমিত হতে শুরু করে দর্শকের মাঝে। বাংলাভাগ অনিবার্য ছিল কি না, কোনভাবে কি ঠেকানো যেত না, এসব প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে তানভীর মোকাম্মেল আমাদেরকে নিয়ে যান ইতিহাসের পাতায়। দেখান কীভাবে একটি রাজনৈতিক সিন্ধান্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
বাংলা ভাগের ফলে ভারত থেকে প্রায় বিশ লক্ষ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় আটান্ন লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে দেশান্তরী হন। ফলে এই দেশান্তরী হিন্দুদের জীবনে বাংলাভাগ কীভাবে প্রভাব ফেলল, তা এই প্রামাণ্যচিত্রের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। তৎকালীন পূর্ববাংলায় যাদের ঘরবাড়ি ছিল, ফলের বাগান- পুকুর ছিল, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ছিল, বাধ্য হয়ে ভারতে যেয়ে তাদের পরিচয় হয়েছে উদ্বাস্তু। জায়গা হয়েছে রেলের পাশের বস্তিতে, বাস্তুহারা কলোনিতে, উদ্বাস্তু শিবিরে। নিম্নমানের জীবন ও অভাবের সাথে যুঝতে যুঝতে তাদের ‘মনুষ্য’ পরিচয় হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছে।
সত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও সেসব উদ্বাস্তু শিবিরে রয়ে গেছে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যারা বাংলাভাগের বেদনাকে এখনও বহন করে চলেছে। তানভীর মোকাম্মেল আমাদেরকে নিয়ে গেছেন পশ্চিমবঙ্গের সেইসব উদ্বাস্তু শিবিরে, যেখানে বাঙালির আত্মপরিচয় সন্ধানের হাহাকার এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া ক্যাম্প, ভদ্রকালি ক্যাম্প, কিংবা যাদবপুরের বাস্তুহারা কলোনিতে বেঁচে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে, যারা এখনও ভুলতে পারেননি দেশভাগের বেদনা। পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা ভিটেমাটির জন্য তাদের স্মৃতিকাতরতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, আবার শুরুর দিনগুলোয় ক্যাম্পে অন্নহীন, বস্ত্রহীন অবস্থায় যে ভয়াবহ দুঃসময় তারা পেরিয়ে এসেছেন, অনেকে আবার সে দিনগুলোকেই বেশি স্মরণ করেছেন। কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্তসহ নানা রোগে মারা গেছে অনেক মানুষ। স্বল্প জায়গায় গবাদি পশুর মত আটকে থেকে বাস করতে হয়েছে গোটা পরিবারের সদস্যদেরকে।
উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নামে অনেককে পাঠানো হয়েছে সুদূর মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে, রামায়ণে উল্লেখিত সেই অনুর্বর ভূমিতে যেখানে নির্বাসিত রাম ও সীতা আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেই জায়গা পরিষ্কার করে ফসল ফলিয়ে তারা কোন রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। সেই দণ্ডকারণ্যে বসেও তারা স্বপ্ন দেখেছে নিজ জন্মভূমির আশপাশে ফেরার। ১৯৭৮-৭৯ সালে সুযোগ এসেছিল সুন্দরবনের কাছাকাছি মরিচঝাঁপি নামক দ্বীপে পুনর্বাসনের। কিন্তু রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে ভেঙে যায় সে স্বপ্ন, মরিচঝাঁপিতে আবাস স্থাপনের পর ট্রাকে করে তাদেরকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় দণ্ডকারণ্যে। অনেককে আবার পাঠানো হয় উত্তরখণ্ডের নৈনিতালে, সুদূর আন্দামান দ্বীপে- যে দ্বীপ দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহৃত হয়েছে দাগী অপরাধীদের নির্বাসিত করার স্থান হিসেবে।
দেখা গেছে, ভারত সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্পের মধ্যে আন্দামান দ্বীপের পুনর্বাসন প্রকল্পটিই তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল নিজে একজন শিল্পী এবং শিল্পী হিসেবে সমাজ ও ইতিহাসের প্রতি তিনি দায়বদ্ধতা অনুভব করেছেন। ইতিহাসের পাতায় দেশভাগ না খুঁজে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন মানুষের কাছে। তাদের গল্প থেকে তিনি জানতে এবং জানাতে চেয়েছেন দেশভাগকে। বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তাদের জীবনে দেশভাগের প্রভাব বুঝতে চাওয়া, তার এই প্রচেষ্টারই ফসল। নতুন পরিবেশে বাস করতে গিয়ে বাংলাভাষীরা কীভাবে নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে প্রজন্মান্তরে হারিয়ে ফেলছে, তার সকরুণ বর্ণনা বেদনাহত করে দর্শককে।
বাংলাভাগের ফলে সবচেয়ে করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে অভিভাবকহীন নারীরা। বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসে বৃদ্ধ বয়সে তাদের জায়গা হয়েছে পিএল ক্যাম্প বা Permanent Liability ক্যাম্পে। পরিবার পরিজন সবাইকে হারানোর বেদনা বুকে পাথর হয়ে এখনও চেপে বসে আছে তাদের অনেকের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়বহতা স্মরণ করে কেউ বলেন, “দাঙ্গার সময় আমার পরিবারের ৩৬ জনকে মেরে ফেলেছে।” আবার কেউ বলেন, “চোখের সামনে ছোটভাইটারে কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল”; “বাবার কাটা দেহ এসে পড়ল মায়ের পাশে”। দশ বছর বয়সে বিয়ের পর তেরো বছর বয়সে দাঙ্গার কারণে বিধবা হয়েছেন কেউ।
হিন্দু-মুসলমান তিক্ত সম্পর্কের শুরুটা ঠিক যেখান থেকে হয়েছে, সেই পুরনো সময়ের আঁচ তাদের কথা থেকে যেন কিছুটা অনুভব হয়। দেশভাগ নিয়ে তাদের কেউ বা নিঃস্পৃহ, আবার কারো কারো মধ্যে এখন ক্ষোভের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। বরিশালের মুলাদি, পাবনা অথবা নড়াইলের মধুমতী নদীর পারের সে সব ছিন্নমূল মানুষেরা কেউ বা সবকিছু মেনে নিয়ে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, আবার কেউ বা ঐ সময়টার ভার বহন করে চলেছেন অদ্যাবধি।
দেশভাগের সাক্ষী এবং বর্তমান সময়ের গুণী ক’জন মানুষ- জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রমুখের সাক্ষাৎকার এই প্রামাণ্যচিত্রকে ঋদ্ধ করেছে। পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছন তানভীর মোকাম্মেল। মূলত সকল শ্রেণির মানুষ বাংলাভাগকে সত্তর বছর পর কেমনভাবে দেখছেন, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। দেখা যায়, চিন্তাশীল এবং সুবিবেচক মানুষেরা বাংলাভাগকে দেখেছেন একটি ‘ব্যর্থ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে। হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ‘বাঙালি’ পরিচয়টাই তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে।
বাংলাভাগের প্রভাব পাই শিল্প এবং সাহিত্যেও। ঋত্বিক ঘটক বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরা আজীবন এই বেদনা দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। যদিও বাংলাভাগ থেকে বাঙালি মুসলমানরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও তাদের অংশটি এই প্রামাণ্যচিত্রে যেন কিছুটা উপেক্ষিত মনে হয়।
দেশভাগের এই দগদগে ক্ষত থেকেই ভারত ও বাংলাদেশ- দু’দেশের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে সীমান্তরেখা।তানভীর মোকাম্মেল বুঝতে চেয়েছেন,
“কি এই সীমান্তরেখা? এ কি ভারত ও বাংলাদেশ- দু’দেশের মাঝে বিভাজন না কি, হিন্দু মুসলমান- দু’ সম্প্রদায়ের মাঝে বিভাজন? কি সেই পার্থক্য যার জন্য মিলতে পারে না দু’বাংলার মানুষ?”
পর্যায়ক্রমে চলে আসে ফেলানীর কথা। কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যার নৃশংস মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছিল সবাইকে। মনে হতে পারে তবে শুধুই কি বিভেদ? সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি কি কিছু নেই? সম্প্রীতির উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলোও চমৎকারভাবে এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। সময়ের সাথে দুই বাংলার মাঝে যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তার বেড়াজাল ভেঙে কিভাবে সম্প্রীতি স্থাপন করা যায় তা নিয়ে কিছু প্রস্তাবনাও প্রকাশ পেয়েছে এখানে।
২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই প্রামাণ্যচিত্রটি দেখার সময় একঘেয়েমি আসা অস্বাভাবিক নয়, তবে তানভীর মোকাম্মেলের কণ্ঠের বর্ণনা এবং আবহসংগীত সেই একঘেয়েমি অনেকাংশেই দূর করে দেয়। বাংলাভাগের বেদনাকে বুঝতে হলে প্রায় তিন বছরের গবেষণার ফসল এই প্রামাণ্যচিত্রটিকে তাই উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।
তানভীর মোকাম্মেল ঠিক যেমনটা বলেছেন, দেশভাগ এমন এক বেদনা, যে বেদনা প্রকাশের ভাষা এখনও তৈরি হয় নি। শেকড় ছেঁড়া মানুষের আর্তনাদ তাই মিশে আছে পুরো ‘সীমান্তরেখা’ জুড়ে। বাংলাভাগের মর্মন্তুদ বেদনা ও হাহাকার থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত’ সমাজ ও প্রজন্ম গড়ে তোলার এখনই সময়।