
পরিবার নিয়ে বাস বা ট্রেনে করে কোথাও যাবেন, আর সাথে পটেটো চিপস রাখবেন না- এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া ভার। পটোটো চিপস সময়-অসময়ের দেয়াল পেরিয়ে ভালো লাগার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বেই। এই চিপস তৈরি করতে আলু পাতলা টুকরো করে কাটা হয়, তেলে তাড়াতাড়ি ভাজা হয় এবং তারপরে লবণ ও আনুষঙ্গিক মশলা দিয়ে সুস্বাদু করে তোলা হয়।
কিন্তু জেনে হয়তো অবাক হবেন, এই খাদ্যের প্রকৃত উদ্ভাবক কে, সেটি আজও অজানাই রয়ে গেছে। এর ইতিহাস নিয়েও আছে বিতর্ক। আজকের এই লেখায় চলুন সেই ইতিহাসই জানার চেষ্টা করা যাক।
স্ন্যাক ফুড লোককাহিনী অনুসারে, ১৮৫৩ সালে প্রথমবার পটেটো চিপসের আগমনের কথা জানা যায়। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের সারাতোগা কাউন্টির একটি শহর সারাতোগা স্প্রিংয়ে মুনস লেক হাউস নামে একটি রেস্তোঁরা ছিল। সেই বছর ২৪ আগস্ট জর্জ ক্রাম নামে রেস্তোরাঁটির একজন রাঁধুনি এক খদ্দেরের জন্য রাতের খাবার তৈরি করছিলেন।

সেসময় মুনস লেক হাউজের ফ্রাইড পটেটো বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেই খদ্দেরও এই আইটেম অর্ডার করেন। ক্রাম সেই অনুযায়ী খাবার তৈরি করে পরিবেশন করেন। কিন্তু সেই কাস্টমার ক্রামকে ডেকে অভিযোগ করেন, আলুগুলোর আকার বেশ বড় রয়ে গেছে। খাবারটি আবার তার চাহিদানুযায়ী তৈরি করে দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি। ক্রাম আলুগুলো পাতলা বা ছোট করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারও আলুর পুরুত্ব তার পছন্দমতো হয়নি বলে অভিযোগ করেন সেই খদ্দের। তাই তিনি খাবারটি আবারও ফিরিয়ে দিয়ে নতুন করে তৈরি করে আনতে বলেন। ভাবুন তো একবার, কোনো মানুষের কি আর মেজাজ ঠিক থাকে এরপর! ক্রামও পারেননি মেজাজ ঠিক রাখতে।
তার মনে হয়েছিল, তার তৈরিকৃত খাবারকে সম্ভবত অবমাননার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি অবশ্য সেই রাগের বহিঃপ্রকাশও ঘটান তার রান্নার মাধ্যমে। কাগজের মতো পাতলা করে কেটে ফেলেন আলুগুলোকে, ফেলে দেন তেলভর্তি কড়াইয়ে। অনেকটা সময় নিয়ে আলুগুলোকে তিনি তেলে ভাজতে থাকেন যাতে এটি শক্ত এবং মচমচে হয়ে ওঠে। তারপর আলুগুলোর উপর বেশি করে লবণ ছিটিয়ে দেন। ক্রাম ভেবেছিলেন, এবার ব্যাটার শিক্ষা হবে। খেতে চেয়েছিল ফ্রাইড পটোটো, এবার তাকে খেতে হবে আলুর এক অখাদ্য।
যখন আইটেমটি পরিবেশন করা হলো, তখন সেই খদ্দের খাবারটি কেমন হয়েছে সেটি নিয়ে কিছু বলার সুযোগই পেলেন না প্রথমে, একের পর এক শুধু মুখে পুরতে লাগলেন। খাওয়া শেষে তিনি রায় দিলেন- এটি ছিল বেশ সুস্বাদু। পরে আইটেমটি ‘সারাতোগা চিপস’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়।
কিছু কিছু বর্ণনায় এসেছে, এই খদ্দের ছিলেন আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট। কারো মতে, খদ্দের ছিলেন আলবিট হুইনী নামে এক কৃষক যিনি সারাদিন মাঠে পরিশ্রম করে বেশ ক্লান্ত হয়েই এসেছিলেন মুনস লেক হাউজে ডিনার করতে। অবশ্য পুরো ঘটনা নিয়েই আছে বিতর্ক। কারণ পটেটো চিপস এরও আগে থেকে প্রচলিত ছিল বলে দাবী করা হয়।
আঠার শতকের শুরুর দিকে বাচ্চাদের জন্য লেখা বেশ কিছু রেসিপি বইয়ে আলু পাতলা করে ভাজি করার পদ্ধতি দেওয়া ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৮১৭ সালে লন্ডনে ‘দ্য কুক’স ওরাকল’ নামের একটি রেসিপি বই প্রকাশ করেন ব্রিটিশ ফিজিশিয়ান উইলিয়াম কিচিনার। বইয়ে পটেটোস ফ্রাইড ইন স্লাইসেস অর শেভিংস নামে একটি রেসিপি ছিল যেখানে তিনি লিখেছেন,
আলুর খোসা ছাড়াতে হবে প্রথমে। তারপর সেগুলো এমনভাবে কাটবেন যেন আপনি একটি লেবুর খোসা ছাড়াচ্ছেন। এক-চতুর্থাংশ ইঞ্চি পুরু টুকরাগুলো তেলে ঠিকঠাকভাবে ভাজা হতে হবে। একবার এগুলো মচমচে হয়ে গেলে এর উপর লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে।
এই রেসিপি বইটি ১৮২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। এভাবেই পটেটো চিপসের আবিষ্কার নিয়ে নানা সময়ে নানা ইতিহাস সামনে এসেছে।

মুনস লেক হাউজে শেফ ক্রামের সাথে আরও একজন শেফ ছিলেন, ক্যাথরিন আন্ট কেট উইক। উইক ছিলেন ক্রামেরই বোন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, উইককেও পটেটো চিপসের জনক হিসেবে দাবী করা হয়েছে বিভিন্ন সূত্রে। তিনি নিজেও অবশ্য বলেছেন সেই কথা। ১৯২৪ সালে সারাতোগা স্প্রিংয়ের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক সারাতোগিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০২ বছর বয়সে মারা যাওয়া উইকই হচ্ছেন সারাতোগা চিপসের প্রথম উদ্ভাবক। এই বিবৃতি উইকের নিজস্ব গল্পের স্মৃতি দ্বারাও সমর্থিত, যা তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। উইক বিভিন্ন সময়েই ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই দাবীর পক্ষে। বলেছেন, তিনি আলু পাতলা করে কেটে রেখেছিলেন এবং দুর্ঘটনাবশত সেগুলো গরম ফ্রাইং প্যানে পড়ে যায়। তিনি তার ভাই ক্রামকে সেটির স্বাদ নিতে দেন এবং তার থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার প্রেক্ষিতে চিপসগুলো পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উদ্ভাবক যে-ই হোক, সারাতোগা চিপসের স্বাদ নিতে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের নিয়মিত ভীড় লেগেই থাকত মুনস লেক হাউজে। কেউ কেউ দশ মাইল দূর থেকেই ছুটে আসতেন। রেস্তোরাঁর মালিক ক্যারি মুনও চিপসের জনপ্রিয়তা দেখে এর জনক হিসেবে নিজেকে জাহিরের চেষ্টা করতেন। সেসময় চিপসটি বক্সে প্যাকিং করেও বিক্রি করা হতো।
এই চিপসের বিতর্কিত ইতিহাসে আমরা আবার ফিরে আসব। তার আগে চলুন জর্জ ক্রাম সম্পর্কে সংক্ষেপে জানা যাক।
জর্জ ক্রামের জন্ম সারাতোগা স্প্রিংয়েই, ১৮২৪ সালের ১৫ জুলাই। পেশাজীবনে কখনও শিকারী, কখনও বা পাহাড়ি পর্যটকদের গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেষে থিতু হতে চেষ্টা করেছেন শেফের কাজে। ১৮৫০ সালে মুনস লেক হাউজে যোগ দেন ক্রাম। বছর দশেক সেখানে কাজ করে চিপস আবিষ্কারের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ১৮৬০ সালে নিউ ইয়র্কের মাল্টায় নিজেই একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন। কথিত আছে, রেস্টুরেন্টের প্রত্যেকটি টেবিলে তার বিখ্যাত পাতলা পটেটো ফ্রাই অ্যাপেটাইজার হিসেবে রাখা থাকত।
তখনও ক্রাম চিপসের জন্য কোনো ধরনের পেটেন্টের আবেদন করেননি। তার চিপসের প্রসার সীমাবদ্ধ ছিল নিউ ইয়র্কের আশেপাশেই। কোনো এক অজানা কারণে ক্রামের রেস্টুরেন্টটি ১৮৯০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৪ সালে মারা যান তিনি। জীবদ্দশায় তার কোনো বক্তব্যে কিংবা ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত নিজের আত্মজীবনীতে তিনিই যে পটেটো চিপসের জনক সেরকম কোনো তথ্য আসেনি। তবে চিপসের আবিষ্কার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটা ব্যাপারে সকলেই একমত যে, ক্রামই পটেটো চিপসকে প্রথম জনপ্রিয় করে তোলেন।

১৮৯৫ সালে উইলিয়াম ট্যাপেনডন নামে একজন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ডে নিজের কিচেনে পটেটো চিপস বানানো শুরু করেন। সেগুলো তার আশেপাশের প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করতেন ট্যাপেনডন। পরবর্তীতে মুদি দোকানেও পাওয়া যেত তার চিপস।
১৯২০ এর আগপর্যন্ত ক্রামের উদ্ভাবিত চিপস স্থানীয় পর্যায়েই পরিচিত ছিল। ১৯২১ সালে বিল এবং স্যালি উর্টজ নামে এক দম্পতি পটেটো চিপসের ব্যবসা শুরু করেন। স্যালি নিজেদের বাসাতেই পটেটো চিপস তৈরি করতেন, বিলের দায়িত্ব ছিল সরবরাহ করা। সেসময় ঘন্টায় ৫০ পাউন্ড চিপস তৈরি করতেন স্যালি। হ্যানোভার হোম ব্রান্ড পটেটো চিপস নামে তাদের কোম্পানির নাম অল্প সময়েই ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। বাড়তে থাকে চাহিদাও। ১৯৩৮ সালে এসে ঘন্টায় ৩০০ পাউন্ড চিপস তৈরি করতে হতো স্যালিকে। তারা ব্যবসা করছে এখনও। তবে নাম পরিবর্তন করে হয়েছে উর্টজ কোয়ালিটি ফুড।
১৯২০ এর কাছাকাছি সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্যোক্তা লারা স্কুডার মোম কাগজের ব্যাগে পটেটো চিপস বিক্রি শুরু করেন যা চিপসকে সতেজ এবং মচমচে রাখত। সময়ের সাথে সাথে উদ্ভাবনী প্যাকেজিং পদ্ধতিতে ১৯২৬ সালে প্রথমবারের মতো চিপসের ব্যাপক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের দ্বার উন্মোচিত হয়।
১৯২০ এর দশকেই যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার ব্যবসায়ী হারমেন লে তার ব্যক্তিগত গাড়ির ট্রাঙ্কে করে দক্ষিণের মুদি দোকানগুলোয় পটেটো চিপস বিক্রি শুরু করেন। একই সময়ে লিওনার্দো জেপ এবং আল কেপিনো শিকাগোতে চিপস তৈরি করে বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে জয়েস পটেটো চিপস নামে ব্যবসাসফল হয়ে ওঠে তাদের উদ্যোগ।
১৯৫০ এর আগপর্যন্ত ভিন্ন ফ্লেভারের চিপসের কথা কেউ চিন্তাই করেনি। ১৯৫৪ সালে আইরিশ ব্যবসায়ী জয় স্টুড মারফি ‘টাইটো’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেন। সেখানে তিনি চিপসে সিজনীং যুক্ত করা শুরু করেন। সিজনীং হচ্ছে চিপসে মজাদার স্বাদ বাড়ানোর জন্য লবণ, ভেষজ বা মশলা যোগ করার একটি প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতিতে প্রথমবার দুটি ফ্লেভার তৈরি করা হয়- চিজ ও ওনিয়ন এবং সল্ট ও ভিনেগার। এর মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে পটেটো চিপস শিল্পে। অন্য চিপস কোম্পানিগুলোও চিপসে ভিন্ন স্বাদ আনতে উদ্যোগী হয়।

এভাবেই পটেটো চিপস শিল্প এগিয়ে গিয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কোম্পানিগুলো একের পর এক নিত্যনতুন রং, আকার এবং স্বাদের চিপস বাজারে এনেছে এবং আনছে এখনও।