কোনো এক শীতের মাঝামাঝি সময়ে যদি একঘেয়ে লাগে জীবনটা, তাহলে এ ধূসর রং স্থায়ী হওয়ার আগেই ঘুরে আসুন এক রঙিন শহর থেকে। আপনার কল্পনায় দেখা জায়গাগুলোকে প্রাণবন্ত রূপ দান করুন আর মনকে মিশিয়ে ফেলুন বর্ণিল সব রঙের সাথে। মনোবিজ্ঞান বলে, রঙেরও নাকি ভাষা হয়। লাল নাকি ক্ষমতা, উদ্দীপনা, আবেগ, তীব্রতা প্রকাশ করে। আবার হলুদকে বলা হয় ইতিবাচক ও আশাবাদী রঙ, সৌভাগ্য কিংবা পুনরায় আবির্ভাবের ইঙ্গিত নাকি সবুজেই পাওয়া যায়; অনুপ্রেরণা,উৎসাহ বা মনোযোগ আকর্ষণের রঙ হিসেবে কমলাকে বিবেচনা করা হয়। আবার বিশুদ্ধতা ও পূর্ণতার রং বলা হয় সাদাকে, এদিকে কালো রঙটা নাকি রহস্যময়! সব ধরনের গোপনীয়তা, রাগ, বিষণ্নতা এমনকি অশুভ ব্যাপারস্যাপার সব নাকি কালোতেই আছে।
তবে যা-ই হোক, বৃষ্টির পর বিশাল আকাশে একপাশে ওঠা রংধনুটার বর্ণিল আভাটুকু যে আপনার মনের ভেতরে একটু হলেও প্রভাব বিস্তার করে, তা মানতেই হবে। আর ভ্রমণে কোনো জায়গার রঙও আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ী একটা ছাপ ফেলে দেয়। প্রকৃতি যেমন তার নিজের জগতকে বর্ণের রঙে সাজিয়ে রাখে, ঠিক তেমনই মানুষ তার কৃত্রিমতায় একটি শহরকে নানান রঙে সাজিয়ে রাখে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের হাতে গড়া রঙিন শহরগুলো জীবনে একবার হলেও ভ্রমণ করা উচিত।
ওইয়া, স্যান্টোরিনি আইসল্যান্ড (গ্রিস)
ওইয়া- এর পূর্বে নাম ছিল ‘আপানো মেরিয়া’, যার অর্থ হলো ওপরের দিক। শহরটিতে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন এক রঙিন দুনিয়ার গোলকধাঁধা। চোখ জুড়িয়ে যাবে বিভিন্ন রঙ দিয়ে সাজানো সব ভবন, রেস্তোরাঁ, দোকান ও ক্যাফে দেখে। এখানের অধিকাংশ ভবন সাদা রঙের, কিন্তু দরজা, ছাউনি, জানালা কিংবা বারান্দাগুলো রাঙিয়ে দেয়া আছে বর্ণিল রঙে। সাগরের নীল পানির প্রতিফলন ও রঙিন সাজে সজ্জিত শহরটি যেন সৌন্দর্যের এক অপরূপ প্রতীক হয়ে আছে।
সেফচুয়েন (মরক্কো)
বলা হয়ে থাকে, নীল রঙ পছন্দকারী মানুষগুলো অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। অনেকসময় নীল রঙকে শান্তির রঙ হিসেবেও আখ্যা দেয় কেউ কেউ। নীল রঙের সাথে যে মানুষের মনের একটা গভীর সংযোগ আছে। একারণেই হয়তো সেফচুয়েন শহরের বাসিন্দারা পুরো শহরটিকে নীল রাঙিয়ে দিয়েছে।
ইন্সটাগ্রাম কিংবা পিন্টারেস্টে শহরটি ‘নীল শহর’ নামে পরিচিত হয়েছে। নীল রঙের পাউডার ও পেরিউঙ্কেল দিয়ে রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে শহরের ঘর-বাড়িগুলোকে। হালকা ও গাঢ় নীলের এক মনোমুগ্ধকর সমন্বয়ে সাজানো শহরটি পর্যটক ও আলোকচিত্রীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। শহরটির বাসিন্দারা তাদের নীল রঙে সাজানো শহরটির সম্পর্কে বলে থাকেন, “নীল রঙ হলো আকাশ ও স্বর্গের প্রতীক”।
নিহ্যাভ, কোপেনহেগেন (ডেনমার্ক)
একটা সময় পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর ছিল কোপেনহেগেন এর নিহ্যাভ। এখানকার আকর্ষণীয় হলুদ, নীল এবং কমলা রঙের বাড়িগুলোর কিছু কিছু সতের শতকের, যা পরে সংস্কার করা হয়েছে। ক্যানেলের পাশে রঙিন বাড়িগুলো পুরাতন এই পোর্টটির অন্যতম আকর্ষণ।
ইযমাল, মেক্সিকো
মেসোঅ্যামেরিকান উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে হলুদের এক অনন্য রূপ নিয়ে এই শহরটি। ষোল শতকের দিকে সন্ন্যাসীদের আশ্রম হিসেবে শহরটি গড়ে ওঠে। মায়া সভ্যতার অংশ হিসেবে এই শহরটি মেক্সিকোর ‘হলুদ শহর’ নামে পরিচিত।
প্রোসিডা (ইতালি)
এটি ইতালির দক্ষিণে নাপলিসের উপকূলবর্তী একটি সাজানো শহর। ইতালির সাজানো নগরায়নের পরিকল্পনা জড়িয়ে আছে দেশটির ইতিহাসে। শৈল্পিকতার এক অপরূপ নিদর্শন পাওয়া যায় এই শহরগুলো জুড়ে। উপকূলবর্তী এই শহরটিকে সাজিয়ে রেখেছে লাল, নীল, হলুদ, কমলা রঙের সুসজ্জিত বাড়িগুলো। এখানকার জেলেরা তাদের এই বাড়িগুলো বিভিন্ন উজ্জ্বল গাঢ় রঙে বর্ণিল করে তুলেছে, যেন দূর সমুদ্র থেকে সহজেই চিনতে পারা যায়। নীলাভ সমুদ্রের উপকূলে গড়ে ওঠা এই শহর যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো শিল্পীর তুলিতে বিভিন্ন রঙের ছোঁয়ায় তৈরি এক মনোমুগ্ধকর চিত্রাঙ্কন।
যালিপাই (পোল্যান্ড)
পোল্যান্ড এই ছোট্ট গ্রামটিতে এক হাজারেরও কম মানুষের বসবাস, কিন্তু এটিই ইন্টারন্যাশনাল প্রেস দ্বারা ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দারা তাদের প্রতিটি বাড়ি, চার্চ, স্কুল এমনকি আশেপাশের গাছগুলোতে পর্যন্ত বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের ফুলের অঙ্কন করেছে। এরকম চিত্রকর্মের প্রথা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে, যখন সেই গ্রামের নারীরা তাদের রান্নার চুলার চারপাশে রঙ দিয়ে ফুলের চিত্র অঙ্কন করে রাখত। এবং এরপর থেকেই এই প্রথা আস্তে আস্তে পুরো গ্রামের সব বাহ্যিক বস্তুর উপর চলে আসে। নানা রঙের সমারোহে আঁকা রঙিন ফুলে সবাই সাজিয়ে তোলে পুরো গ্রামকে। এজন্য যালিপাই গ্রামের ছদ্মনাম ‘দ্য পেইন্টিং ভিলেজ’।
রেইনবো ভিলেজ (তাইওয়ান)
হুয়াং ইয়ং ফু নামে একজন সৈনিকের হাত ধরে সৃষ্টি হয় গ্রামের এই অসাধারণ শিল্পকর্ম। ইয়ং ফু ও তার প্রতিবেশীর সহায়তায় সাজানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন রঙিন চিত্রকর্মের এই গ্রামটি। প্রতি বছর লাখো দর্শনার্থীর আগমন ঘটে রঙিন গ্রামটি দেখার জন্য।
বো-কাপ (কেপটাউন)
ডাচ ও জর্জিয়ান স্থাপত্যশৈর মিশ্রণে তৈরি কেপটাউনের সবচেয়ে পুরাতন শহর বো কাপ। অনেক রঙে রাঙিয়ে তোলা ভবন ও পাথুরে রাস্তায় ঘেরা এই শহরটি বর্তমানে আলোকচিত্রীদের অন্যতম আকর্ষণ।
বালাত (ইস্তাম্বুল)
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বালাত শহরের বাড়িগুলো ৫০ থেকে ২০০ বছর আগে গড়ে ওঠে। কাঠের তৈরি এই রঙিন বাড়িগুলোর সাথে পাথরের সাজানো রাস্তা শহরের সৌন্দর্যে যেন এক অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। এই শহরের বাসিন্দারা খুবই অতিথিপরায়ণ। তারা আপনাকে খুব সহজেই আপন করে নেবে।
ওল্ড সান জুয়ান (পুয়ের্তো রিকো)
আপনি যদি পুয়ের্তো রিকোর ওল্ড সান জুয়ানের একপাশ ধরে হাঁটা শুরু করেন, তাহলে আপনি কখনো কোনো রঙের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাবেন না। ষোল শতকের দিকে গড়ে ওঠা পুরাতন এই শহরটিকে শহরের বাসিন্দারা নানান রঙের শোভায় সাজিয়ে রেখেছে। শহর জুড়ে কোনো হোটেল-রিসোর্ট, কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা পাশে কোনো সমুদ্রসৈকতও নেই, কিন্তু তারপরও পুয়ের্তো রিকো ভ্রমণে ৫০০ বছরের পুরোনো এই শহরটি পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে থাকে। কারণ, আপনি শুধু শহরের রাস্তায় হেঁটেই অনেক সুন্দর একটি সময় উপভোগ করতে পারবেন।
জুযকার (স্পেন)
যখন অন্য শহরগুলো কোনো ধর্মীয় কারণ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নীল রঙে শহরকে রাঙিয়ে তোলে, তখন স্পেন এর জুযকার নামক এই স্থানটি নীল রঙে রাঙানো হয়েছে ২০১১ সালে ‘স্মার্ফস’ নামক একটি সিনেমার প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন এর জন্য। তখন এটা ক্ষণস্থায়ীভাবে করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টি স্থায়ী রূপ নেয়, যা পর্যটকদের ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করে।
মেনটন (ফ্রান্স)
‘ফ্রান্সের মুক্তা’ খ্যাত মেনটন শহরের অবস্থান মেডিটারিয়ান সি’র পাশে, ফ্রান্স ও ইতালিয়ান সীমান্তের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। ফ্রান্সের অন্যান্য শহরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট এটি। কিন্তু শহরের বহুরঙা ভবনগুলো ও টেরাকোটার ছাদ শহরটিকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
গুয়েনাজুয়াতো (মেক্সিকো)
চোখ জুড়িয়ে যাওয়া বর্ণিল রঙের এই শহরটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি শহরের বাড়িগুলো প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে চলেছে। তবে এটি এখনও পর্যটকদের কাছে অতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। খুবই অল্প পরিসরে এখানে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
জয়পুর (ভারত)
জয়পুর সুপরিচিত এর রুচিসম্মত স্থাপত্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সুস্বাদু খাবার, অসাধারন দুর্গ, মন্দির, চিত্রকর্ম, মৃৎশিল্প ও কারুকার্যপূর্ণ অলঙ্কারের জন্য। পিংক সিটি খ্যাত ভারতের রাজস্থান প্রদেশের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর হলো জয়পুর। আঠারো শতকে রাজা সাওয়াই রাম সিংয়ের নির্মিত এই শহরটি সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ১৮৭৬ সালের দিকে প্রিন্স আলবার্ট ও রানী ভিক্টোরিয়ার ভারত ভ্রমণকে উদ্দেশ্য করে শহরটিকে গোলাপি রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত-পাহাড়েবেষ্টিত এই শহরের নিরুপম বৈচিত্র্যময় স্থাপনাগুলো আপনাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করবে।