যা ঘটেছিল তা ছিল নাটকীয়তা, মুখরোচক গল্প আর বিতর্কে পরিপূর্ণ। একদিকে গণমানুষের প্রিয় নায়ক, অন্যদিকে বিদেশি সাদা চামড়ার খলনায়ক। এই বিতর্ক ড্রেসিংরুম বা ক্রিকেট কমিউনিটির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না, আলোচিত-সমালোচিত হওয়া শুরু করেছিল অফিস থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে পর্যন্ত। ভারতীয় সিরিয়ালের মতো এই ঘটনাটিও হয়ে উঠেছিল প্রত্যেক ঘরের আলোচনার বিষয়বস্তু। চলুন দেখে নিই- কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, এবং এর ফলাফল কী ছিল।
এই বিতর্কের একপাশে ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী, ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের পূজনীয় অধিনায়ক; দলকে যিনি দারুণভাবে বদলে দিয়েছিলেন। এমন একজন অধিনায়ক, যিনি পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জিতিয়েছেন, যার নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে দুর্দান্ত এক সিরিজ উপহার দিয়েছে ভারত। সবার পছন্দের, সবার ভালোবাসার ‘দাদা’।
অন্যদিকে ছিলেন দলের কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। পাথরকঠিন অজি, খেলোয়াড়ি জীবনে আন্ডারআর্ম ডেলিভারির মতো সিদ্ধান্ত নেয়া লোক। অধিকাংশ ভারতীয়ের মতে, ভারত ক্রিকেট দলকে টালমাটাল করে দিয়ে যাওয়া কোচ।
২০০৫ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। তখনকার ভারত জাতীয় দলের কোচ জন রাইটের চুক্তি প্রায় শেষ। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে চুক্তি নবায়নে অপারগতা জানিয়েছিলেন রাইট। ফলে খুঁজতে হতো একজন নতুন কোচ। কোচ হওয়ার দৌঁড়ে নাম শোনা যাচ্ছিল মহিন্দর অমরনাথ, টম মুডি ও ডেভ হোয়াটমোরের। আকস্মিকভাবে আরেকজনের নাম প্রস্তাবিত হলো। তিনি গ্রেগ চ্যাপেল। প্রস্তাবটা কার কাছ থেকে এসেছিল জানেন? খোদ অধিনায়ক সৌরভের কাছ থেকে।
২০০৩-০৪ অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে সৌরভ চাইছিলেন, যেভাবেই হোক এই সিরিজে অসহায় আত্মসমর্পণ করা যাবে না। এই অস্ট্রেলিয়া দলটার বিপক্ষে সাফল্য পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব, তার উপর খেলাটা তাদের ঘরের মাঠে। এমনিতে দল যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে একটু বেশি কিছু করার তাড়না ছিল সৌরভের। তাই সতীর্থদের একপ্রকার না জানিয়ে সফরের চার মাস আগেই অস্ট্রেলিয়া উড়াল দেন তিনি৷ এর আগে যোগাযোগ করেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে। বলে রাখা ভালো, গ্রেগের ক্রিকেটীয় জ্ঞানের ভক্ত ছিলেন সৌরভ। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে এক সপ্তাহ গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে বিভিন্ন ভেন্যু ঘুরে কীভাবে সফরে ভালো করা যায়, সে ব্যাপারে বিশদ ধারণা নিয়ে আসেন ভারত অধিনায়ক।
ভারত দলের সেবারের অস্ট্রেলিয়া সফর ছিল সৌরভ ও তার দলের জন্য মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা। সেই সিরিজে ভারতের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তার গ্রেগ চ্যাপেলের নাম প্রস্তাবের একটা বড় কারণ ছিল।
তবে কিছু মানুষ সৌরভের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সুনীল গাভাস্কার ও জগমোহন ডালমিয়া। অবাক করা ব্যাপার হলো, গ্রেগ চ্যাপেলের বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেলও এই দলে ছিলেন। ইয়ান চ্যাপেল ও গাভাস্কার এটাও বলেছিলেন যে, গ্রেগের ম্যান ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা মোটেও ভালো নয়।
কিন্তু অধিনায়কের সৌরভ তার জায়গায় অনড় ছিলেন। অবশেষে বোর্ড সম্মত হয় এবং ২০০৫ এর মে মাসে ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় গ্রেগকে। সৌরভ গাঙ্গুলী হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, তারই এক সিদ্ধান্ত একদিন নিজের জন্যেই কাল হয়ে দাঁড়াবে।
গ্রেগ চ্যাপেলের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় একটা ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সৌরভ ঐ দলে ছিলেন না, কেননা আগের সিরিজে স্লো ওভাররেটের কারণে ৬ ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ঐ সিরিজের জন্য অধিনায়কত্ব দেয়া হয় রাহুল দ্রাবিড়কে।
এরপর জিম্বাবুয়ে সফরে যায় ভারত। টেস্ট সিরিজে ফিরেছিলেন সৌরভ। টেস্ট ম্যাচে সৌরভের ফর্ম একটা দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, কেননা তিনি গত দুই বছরে দীর্ঘতম ফরম্যাটে কোনো সেঞ্চুরি পাননি।
টেস্ট সিরিজের আগে এই ব্যাপারটা সামনে আনলেন গ্রেগ। প্রস্তুতি ম্যাচের আগে গ্রেগ সৌরভকে অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলেন যে, এটা তার ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। প্রথম টেস্টের আগে গ্রেগ চ্যাপেল চাইছিলেন সেরা একাদশকে মাঠে নামাতে৷ ইঙ্গিতটা ছিল অফফর্মে থাকা সৌরভের জায়গায় অন্য কাউকে সুযোগ দেয়া। সৌরভ রাগান্বিত হন এবং সফর ছেড়ে দেশে ফিরে যাওয়ার হুমকি দেন। তবে দ্রাবিড় ও চ্যাপেল তাকে তা করতে দেননি। সৌরভ অধিনায়ক হিসেবেই মাঠে নামেন এবং শতক হাঁকান।
প্রথম টেস্টের পরেই জল ঘোলা হতে শুরু করে৷ সৌরভ মিডিয়ার সামনে বলেন যে, তাকে অধিনায়কত্ব ছাড়তে চাপ দেয়া হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আঙুল ওঠে গ্রেগ চ্যাপেলের দিকে। কিন্তু তিনি বলেন,
‘আমি কাউকে কোনো কিছু করার জন্য কেন চাপ দেব?’
কিন্তু জিম্বাবুয়ে সফরের সময় বোর্ডের কাছে গ্রেগ চ্যাপেলের পাঠানো ইমেইল ফাঁস হয়ে যায়। চ্যাপেল লিখেছিলেন যে, সৌরভ অধিনায়কত্ব বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন। তিনি আরো লিখেছিলেন যে, সৌরভ শারীরিক ও মানসিকভাবে দলকে নেতৃত্ব দিতে উপযুক্ত নন। গ্রেগের মতে, সৌরভের নেতিবাচক মানসিকতা ও চোটের বাহানা দেয়া পরবর্তী বিশ্বকাপে ভারতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
চ্যাপেল বনাম গাঙ্গুলী বিতর্কের শুরু এভাবেই।
ভাগ্যের কী লিখন! পরের সিরিজের আগেই চোটে পড়লেন সৌরভ। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় ৭ ম্যাচ সিরিজের প্রথম চার ম্যাচে তাই দলের বাইরে ছিলেন সৌরভ। যথাসময়ে সেরে উঠলেও পরের তিন ম্যাচের জন্য দলে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না তাকে। অর্থাৎ, সৌরভকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল, এবং সাথে সাথে অধিনায়কত্বও হারিয়ে ফেলেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি তাকে। সিরিজের একটা ম্যাচ ছিল কলকাতায়। সেখানে সৌরভের ভক্তদের দুয়োধ্বনিও শুনতে হয়েছিল ভারত দলকে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে অবশ্য ফিরেছিলেন তিনি৷ কিন্তু ততদিনে দ্রাবিড়কে অধিনায়ক ও শেবাগকে সহ-অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার ছিল। চ্যাপেল নির্বাচকদের বিশ্বাস করাতে চাইছিলেন যে, সৌরভ ওয়ানডে দলে থাকার যোগ্য নন, পাশাপাশি টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দেবারও যোগ্য নন। গ্রেগের মত ছিল, সৌরভের জায়গায় মোহাম্মদ কাইফ কিংবা যুবরাজ সিংয়ের মতো তরুণদের সুযোগ দেয়া ফলপ্রসূ হবে৷ ফলে, প্রথম দুই টেস্ট ম্যাচের পর দল থেকে বাদ পড়েন সৌরভ।
ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে পাকিস্তান সফর ও ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড সিরিজে। সৌরভ দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরবর্তী সিরিজে ওয়ানডে ও টেস্ট উভয় দল থেকেই বাদ পড়েন তিনি। এই ঘটনায় ফুঁসে ওঠে ভক্তরা। এমনকি সৌরভকে কেন বাদ দেয়া হলো, এই মর্মে তদন্ত চেয়ে সংসদে বিতর্ক পর্যন্ত হয়। জায়গায় জায়গায় গ্রেগ চ্যাপেলের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়৷
ওয়ানডে ও টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার পর সৌরভ ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরেন এবং রঞ্জি ট্রফিসহ বাকি ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে রান করতে থাকেন। তারপরও দক্ষিণ আফ্রিকার সফরে ওয়ানডে দলে জায়গা হয়নি তার। তবে ঘরোয়াতে ভালো করার পুরস্কার হিসেবে টেস্ট দলে জায়গা পান তিনি। প্রস্তুতি ম্যাচেও ভালো করার ইঙ্গিত দেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম টেস্টের দলে জায়গা পান।
প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই অর্ধশতক পান তিনি৷ তিন টেস্ট ম্যাচের সিরিজে ব্যাট হাতে আলো ছড়ান সৌরভ, দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেন। ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের দরুন প্রায় দুই বছর পর ওয়ানডে দলে ফেরেন সৌরভ এবং ২০০৭ বিশ্বকাপের দলেও জায়গা পান।
সৌরভ গাঙ্গুলী ও ভারতের জন্য ২০০৭ বিশ্বকাপ ছিল এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। শিরোপাপ্রত্যাশী দল নিয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় ভারত। ভারতের এহেন বাজে পারফরম্যান্সই যথেষ্ট ছিল গ্রেগ চ্যাপেলের পদত্যাগের জন্য।
চ্যাপেল বনাম গাঙ্গুলী বিতর্ক ভারতের পুরো ক্রিকেট কমিউনিটিকে দু’ভাগ করে ফেলেছিল। কিছু মানুষ সৌরভের উপর আনা গ্রেগের অভিযোগগুলো বিশ্বাস করেছিল। অন্যদের মতে, চ্যাপেল তার মতামতকে দলের উপর চাপিয়ে দিতেন, যেটা মোটেই ফলপ্রসূ ছিল না।
শচীন টেন্ডুলকার তার আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’তে লিখেছেন যে, গ্রেগ চ্যাপেল দলের মধ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিলেন, এবং গাঙ্গুলীর সঙ্গে চ্যাপেল যা করেছেন। তা মোটেও ঠিক ছিল না। জহির খান ও ভিভিএস লক্ষ্মণ পরবর্তীতে গ্রেগের কুৎসিত আচরণ নিয়ে কথা বলেছেন। হরভজন সিং বলেছিলেন,
“গ্রেগ ভারতীয় ক্রিকেটকে এমনভাবে ধ্বংস করে গিয়েছিলেন যে, আবার সব সামলে উঠতে প্রায় তিন বছর লেগে গিয়েছিল।”
চ্যাপেল কোচ হিসেবে দলের জন্য সেরাটা চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক ছিল। হয়তো এমন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, যাতে দলের অন্য খেলোয়াড়েরা বুঝতে পারেন যে, ফর্মে না থাকলে স্বয়ং অধিনায়কেরও ছাড় নেই। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে নিজের কঠোরতা দেখাতে গিয়ে একজন খেলোয়াড়ের সাথে অবিচার করে গেছেন তিনি, যার কারণে ড্রেসিংরুমের স্থিতিশীলতা বজায় ছিল না। ফলাফল হিসেবে বিশ্বকাপে ভারত অসহায় আত্মসমর্পণ করে৷ সৌরভও সম্ভবত এই মানসিক অস্থিতিশীলতা থেকে বেরোতে পারেননি। অবশেষে ২০০৮ সালে অবসর নেন তিনি।
এই চ্যাপেল-গাঙ্গুলী বিতর্ক ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে।