করোনাভাইরাসের ধাক্কায় টালমাটাল এখন ইউরোপসহ গোটা বিশ্ব। বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে চীনের পরপরই ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। দেশটিতে ইতোমধ্যেই প্রায় দেড় লাখ নাগরিক আক্রান্ত হয়েছে করোনাভাইরাসে। মৃতের সংখ্যাও উনিশ হাজার ছাড়িয়েছে। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে বিশাল ধাক্কা খেতে যাচ্ছে দেশটি। যদিও এটি ইতালিতে ছড়ানো প্রথম কোনো বড় মহামারি নয়। গত চারশো বছরে বহুবার মহামারির কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে দেশটি।
১৬২৯-৩১ সাল পর্যন্ত প্লেগের ভয়াবহ সংক্রমণের মুখে পড়ে ইতালির উত্তর এবং মধ্যাঞ্চল। শুধুমাত্র ভেনিসেই মৃত্যুবরণ করে ৪৫,০০০ এর অধিক নাগরিক। এছাড়াও ভেরোনা এবং পার্মার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি লোক তখন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কিছু অঞ্চল ঐ মহামারির প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিল।
উত্তর ইতালির শহর ফেরারা সেই শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৫৭৬ সালের পর এখন অবধি মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে সেখানকার কোনো নাগরিক মৃত্যুবরণ করেনি। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের দিক দিয়ে ইতালির অন্যান্য শহর থেকে আক্রান্তের হার কম এই শহরটিতে। এই ফিচারটি লেখা অবধি ফেরারা শহরে মোট করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬৬ জন এবং তাদের কেউই মৃত্যুবরণ করেনি। আক্রান্তের পরিসংখ্যানে এটি এখন অবধি ইতালির সবচেয়ে নিরাপদ শহর। শুধু রোগটি নিয়ন্ত্রণেই নয়, ১৬২৯ সালের প্লেগের মহামারিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো ফেরারা শহর রীতিমতো চমকে দিয়েছিল ইতালি তথা গোটা ইউরোপকে। শহরটিকে মহামারির প্রকোপ থেকে রক্ষার্থে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৩৫০ এর দশকে।
১৩৪৭ সালে ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথের পর গোটা ইতালি জুড়ে মহামারি প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাপারে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ইতালিয়ান রেঁনেসা বিভাগের অধ্যাপক জন হ্যান্ডারসন অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি ইতালিতে প্লেগের প্রকোপ নিয়ে একাধিক বইও লিখেছেন। তার মতে, ব্ল্যাক ডেথের প্রকোপে ধীরে ধীরে ইতালির ছোট-বড় প্রায় সকল শহরেই মৃতের হার বাড়তে থাকে। অতঃপর চিকিৎসকরা যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ করার পাশাপাশি রোগীকে জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরামর্শ দেন। এতে করে দীর্ঘদিন পর ব্ল্যাক ডেথের প্রকোপ থেকে মুক্তি লাভ করে ইতালি।
পরের কয়েকশ বছর প্লেগের প্রাদুর্ভাব ইতালির জনবহুল শহরগুলোতে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে পরিচিত ছিল। এতে করে কয়েক দফায় মহামারির তাণ্ডবলীলা ভোগ করে দেশটি। কিন্তু ফেরারা শহরের চিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। প্লেগসহ যাবতীয় ছোঁয়াচে রোগ থেকে শহরকে মুক্ত রাখতে ইতালির অন্যান্য শহরগুলোর মতো সেখানেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু অন্যরা একটা পর্যায়ে সেসবের তোয়াক্কা না করলেও ফেরারা বরাবরই প্লেগ বিরোধী কার্যক্রমে কঠোর পন্থা অবলম্বন করে যাচ্ছে। কীভাবে ফেরারা শহরটি এখন অবধি প্লেগসহ বিভিন্ন মহামারি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করে যাচ্ছে সে সম্পর্কেই আমাদের আজকের আলোচনা।
সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি
ফেরারা শহরের সীমান্ত নজরদারি অর্থাৎ শহরে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা এবং কঠোর নিয়মনীতি প্লেগসহ যাবতীয় ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে শহরের মানুষকে অনেকটাই নিরাপদ রেখেছে। এছাড়াও কঠোর স্যানিটেশন নিয়মনীতি এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধিও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে সেখানে বিভিন্ন ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন গাছগাছালি থেকে তৈরি অণুজীব ধ্বংসকারী তরল, বিভিন্ন ধরনের তেল এবং সাপ ও বিচ্ছুর বিষ থেকে প্রক্রিয়াজাত ঔষধ ব্যবহার করা হত।
ইউনিভার্সিটি অব ফেরারার একদল গবেষক প্রাচীন কিছু পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে শহরের বিভিন্ন স্থানে খননকার্য পরিচালনা করেন। তারা পৌরসভা অঞ্চলে এমন কিছু স্থাপনার সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো মূলত ছোঁয়াচে রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি বলে নিশ্চিত করা হয়। যদিও এক্ষেত্রে শহরের অবস্থানগত দিকও বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ভৌগলিকভাবে এটি পাদুয়া এবং বোলোনা শহরের মাঝামাঝি প্রবাহিত পো পো নদীর একটি শাখা বরাবর অবস্থিত প্রাচীরঘেরা শহর। পাদুয়া এবং বোলোনা উভয় শহরই ১৬৩০ সালের প্লেগে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
ইউনেস্কোর দেয়া তথ্যমতে, ফেরারা শহরে ১৩৭৫ সালের দিকে কিছু সংখ্যক উঁচু সড়ক তৈরি করা হয়েছিল। সেকালে ইউরোপ তথা বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশই এমন সড়ক তৈরি করতে পেরেছিল। এগুলো মূলত শহরের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে তৈরি করা হয়। অতঃপর ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে শহরের অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থাও তৈরি করেন শহরের কর্তারা। মূলত ১৩৫০ এর দশকের ব্ল্যাক ডেথের ক্ষয়ক্ষতির কারণে শহরের উন্নয়নে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তার মধ্যে এই দুটি ব্যবস্থাপনা ছিল তাদের শুভসূচনা।
প্রফেসর হ্যান্ডারসনের মতে, পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্লেগ ঠেকানোর জন্য ভেনিস, ফ্লোরেন্সের মতো বড় শহরগুলো অন্যান্য ছোট শহরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পথ ব্যবহারের প্রচলন শুরু করে। অন্যান্য ছোট শহরের মতো ফেরারার সঙ্গে বড় শহরগুলোর যোগাযোগের মাধ্যম ছিল অল্প কয়েকটি পথ। এতে করে প্লেগের সংক্রামণ শুরু হলেও পথঘাট বন্ধ করে দিয়ে, মানুষের যাতায়াত সীমিত করে দিলে এর সংক্রমণ কমানো যেত।
প্লেগের সংক্রমণ শোনামাত্র ফেরারা শহরের সকল প্রবেশপথ বন্ধ করে শুধুমাত্র মূল দুটি পথ খোলা রাখা হতো। অন্য শহর থেকে কেউ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে অবশ্যই প্রবেশদ্বারে পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে নিশ্চিত করতে হতো ভ্রমণকারী প্লেগ মুক্ত অঞ্চল থেকে এসেছেন। এছাড়াও শহরের ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, চিকিৎসকদের নিয়ে সচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। চলমান করোনা সংকটে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যে লক ডাউন প্রথা চালু রয়েছে সেটি শত বছর আগেই ফেরারা শহরের নীতিনির্ধারক গণ প্রচলন করেন।
প্লেগের জন্য নির্মিত হাসপাতাল এবং ইতালীয়দের ধারণা
প্লেগের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে ইতালির বেশিরভাগ শহরেই হাসপাতাল সমূহ শহরের মূল ফটকের বাইরে স্থাপন করা হতো। ১৬২৯-৩১ সাল অবধি চলা ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ফ্লোরেন্সের একটি হাসপাতালে একসঙ্গে ১০,০০০ মানুষের চিকিৎসা দেয়া যেত। আর এই রোগের চিকিৎসার সমস্ত খরচাপাতি বহন করত শহরের প্রশাসন। যদিও শহরের বাইরে হাসপাতাল স্থাপনের ধ্যানধারণা আসে ইতালীয় চিকিৎসকদের ভ্রান্ত ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রফেসর হ্যান্ডারসন বলেন, সেকালে ইতালিয়ানরা বিশ্বাস করত- ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট দূষিত বায়ুর মাধ্যমে প্লেগ সৃষ্টি হয়। এছাড়াও শহরের নোংরা পরিবেশও এজন্য দায়ী বলে তারা মনে করতেন। ফেরারা শহরের হাসপাতালগুলোও মূল ফটকের বাইরে স্থাপন করা হয়েছিল। তবে প্লেগ সম্পর্কে ইতালীয়দের ধারণা পরিবর্তন করেন ইতালিয়ান চিকিৎসক গিরোলামো ফ্রেকাস্তরো। তিনি ১৫৪৬ সালে নিজের মতবাদ লিখে প্রচার করতে থাকেন। প্লেগ একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায় বলে মন্তব্য করেন গিরোলামো। এছাড়াও এই রোগের বীজ (অণুজীব) জামা-কাপড়ের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াতে পারে বলেও উল্লেখ করেন এই চিকিৎসক।
গিরোলামোর এই মতবাদের পর ফেরারা শহরের স্যানিটেশন নিয়মনীতি আরও কঠোর করা হয়। শহরের রাস্তাঘাটে কুকুর, বেড়াল নিয়মিত ঘুরে বেড়াত, যাতে গৃহপালিত হাঁস-মুরগি রাস্তায় নামতে না পারে। এছাড়াও কোথাও ময়লা জমে থাকলে সেগুলোকে পরিষ্কার করার কাজেও সাহায্য করত সেসব কুকুর-বিড়াল। আক্রান্ত ব্যক্তি যাতে অন্য মানুষের মাঝে রোগ ছড়াতে না পারে সেজন্য তার বাড়ির আশেপাশে চুন, পাউডার ছিটিয়ে দিত শহর কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও শহরের স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেও চুন প্রয়োগ করা হত।
তবে এতটুকুতেই যে প্লেগ নির্মঊল করা সম্ভব না তা ভালো করেই জানতেন ফেরারা শহরের কর্তারা। আর এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আসবাবপত্রসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র আগুনে পোড়ানোর প্রচলন শুরু হয়। এছাড়াও টানা ১৫ দিন ঐ বাড়িতে সুগন্ধি ও চুন মিশ্রিত পানি ছিটানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সেই সাথে বাড়ির অন্য সদস্যদের ব্যবহার্য জামা-কাপড় ধুয়ে সূর্যের আলোতে শুকিয়ে তাতেও সুগন্ধি প্রয়োগ করা হত। আর এই প্রক্রিয়াটি শহরে প্লেগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করে।
প্রচলিত ঔষধ
ফেরারা শহরে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাস্থবিধির উপর কর্তৃপক্ষের কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ ছিল। তবুও কয়েক প্রকারের প্রতিষেধকের প্রচলন ছিল সেখানে। তবে সবগুলোর মধ্য থেকে বেশি পরিমাণে যে প্রতিষেধকটি ব্যবহৃত হয়েছিল সেটি হচ্ছে কম্পোজিটো (Composito)। এই প্রতিষেধকটি গোপনে তৈরি করা হত। স্প্যানিশ চিকিৎসক পেদ্রো ক্যাস্টাগনো এটি সর্বপ্রথম প্রস্তুত করেন। পেদ্রো তার ‘রেজিমেন এগেইনস্ট দ্য প্লেগ’ কিংবা প্লেগের বিরুদ্ধে নিয়ামক নামক লেখাতে এই প্রতিষেধক ব্যবহারের নিয়মকানুন উল্লেখ করেন।
পেদ্রোর লেখা অনুসারে কম্পোজিটো ব্যবহারের পূর্বে নিরাপদ পানি দিয়ে হাত-মুখ ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। পুরো শরীর পরিষ্কার করার জন্য পানির সঙ্গে এক চামচ পরিমাণ মদ অথবা ভিনেগার ব্যবহারের নির্দেশনাও দেন তিনি। এই প্রতিষেধক তৈরির পন্থা গোপন রাখায় এর ব্যবহারবিধি তিনি যেমন লিখেছেন ঠিক তেমনিভাবে ফেরারা শহরে প্রয়োগ করা হয়েছিল কি না তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে প্রফেসর হ্যান্ডারসন বিভিন্ন নথিপত্রের আলোকে নিশ্চিত হয়েছেন যে কম্পোজিটো শহরের প্রাচীরে স্থাপিত বাক্সে সংরক্ষণ করা হত। কোথাও প্লেগের সংক্রমণ হয়েছে এমন ঘটনা শোনামাত্রই এটি ব্যবহারের অনুমতি মিলত।
পেদ্রো এই ঔষধ তৈরি করতে যা যা আনিয়েছিলেন, সেসবের মধ্যে মাইরাহ, ক্রোকাস স্যাটিভাসের মতো অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কখনও কখনও সাপ, বিচ্ছুর বিষ আনাতেন এমন প্রমাণ রয়েছে। তিনি মারা যাওয়ার পর ইতালির চিকিৎসকরা শহরের বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে এসব তথ্য সংগ্রহ করেন। জীবদ্দশায় তিনি কখনোই এই প্রতিষেধকের রেসিপি কাউকে বলেননি। তবে এটা সত্য যে ইতালির কয়েকটি অঞ্চলে পেদ্রোর তৈরি প্রতিষেধকটির মতো মলম প্রচলিত ছিল। সেগুলো অবশ্য ভাইপার ভেনম দ্বারা প্রস্তুত করা হতো।
পরবর্তী কয়েকশো বছরে ফেরারা শহরের মতো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেও আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় ইতালীয়দের মাঝে ফেরারার সাফল্য নিয়ে নানা মতামত তৈরি হয়। এতে করে অনেকেই ভাবেন, শহর কর্তৃপক্ষ প্লেগের তথ্যাদি গোপন রাখে। কিন্তু এটিও একসময় ভুল প্রমাণিত হয়। যদিও প্রফেসর হ্যান্ডারসন ফেরারা শহরের এমন সফলতার কারণ হিসেবে অলৌকিকতাকে দায়ী করছেন না, বরঞ্চ তিনি মনে করেন- স্যানিটেশন, প্রতিষেধক ব্যবহার এবং নিয়মকানুন ধারাবাহিকভাবে পালন করার ফলেই তারা প্লেগের মতো মহামারিকে রুখতে পেরেছিল। এখন দেখার বিষয় করোনাভাইরাসে ফেরারা তাদের পুরোনো ঐতিহ্য কতটুকু ধরে রাখতে পারে।