বলা হয়ে থাকে, অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হচ্ছেন আশুরবানিপাল। তার নামের অর্থ ‘দেবতা আশুর একজন উত্তরাধিকারীর স্রষ্টা’। ৬৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সম্রাট এসারহাডন এবং রানি ইশারা হাম্মাতের কোল আলো করে জন্ম নেন আশুরবানিপাল। গ্রীকরা তাকে ‘সারদানাপোলোস’ এবং রোমানরা ‘সারদানাপুলস’ নামে জানত। তার শাসনামলে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য আয়তনে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি পায়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্যাবিলনিয়া, পারস্য, সিরিয়া এবং মিশরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোও। একজন ন্যায্য ও জনপ্রিয় শাসক হিসেবে প্রজাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। তবে, প্রজাদের নিকট তিনি যতটা কোমল, যুদ্ধে পরাজিতদের ক্ষেত্রে ছিলেন ততটাই নিষ্ঠুর ও বজ্রকঠোর। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের এক দেওয়ালচিত্র থেকে দেখা যায়, পরাজিত এক রাজার চোয়ালের মধ্যে দিয়ে কুকুরের শিকল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। রাজারই যদি এত করুণ অবস্থা হয়, তাহলে তার সৈন্যদের সাথে কী আচরণ করা হতো, তা ভাবাও যেন দায়।
নতুন সাম্রাজ্য এবং মিশরে অভিযান
খ্রিষ্টপূর্ব ৬৭১ অব্দে অ্যাসিরীয় সম্রাট এসারহাডন জয় করে নিয়েছিলেন মিশর। কিন্তু নিজেদের উপর অ্যাসিরীয় কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি মিশরীয়রা। শুরু হলো মুহুর্মুহু বিদ্রোহের গর্জন। বিদ্রোহের দরুন বিভিন্ন পদ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হলো আঞ্চলিক শাসনকর্তাগণ। ৬৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসারহাডন তার সৈন্যদের একত্রিত করে বিদ্রোহ দমন করার জন্য মিশরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কিন্তু মিশরীয় সীমান্তে পৌঁছানোর আগেই মারা যান তিনি। দূরদর্শী এসারহাডন মিশর অভিযানে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছিলেন। কারণ, এসারহাডনের পিতা সিনাহেরিবের মৃত্যুর পর পিতার মুকুট রক্ষার জন্য নিজ ভাইদের বিরুদ্ধে তাকে ছয় সপ্তাহের এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। তাই, তিনি চাননি নিজ উত্তরাধিকারীদের মাঝেও সাম্রাজ্যের ক্ষমতা নিয়ে এমন দ্বন্দ্ব বাধুক।
এসারহাডনের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং প্রধান উত্তরাধিকারী, সিন-ইদ্দিনা-আপলা মারা যান ৬৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সেজন্য উত্তরাধিকারের দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় দ্বিতীয় পুত্র আশুরবানিপালের ঘাড়ে। ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার নিয়ে বিদ্রোহ এড়াতে তিনি রাজ্যগুলোকে আশুরবানিপালের প্রতি আগাম আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য করেন। সেসময় এসারহাডনের মা জাকুতু অ্যাসিরীয় শাসনের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলো এবং অ্যাসিরীয় রাজসভাকে বাধ্য করেছিল আশুরবানিপালের রাজত্বকে মেনে নেওয়ার জন্য। ভাইয়ের সাথে সকল প্রকার দ্বন্দ্ব এড়াতে এসারহাডন তার কনিষ্ঠ পুত্র শামাশ-শুম-উকিনকে ব্যাবিলনের সম্রাট হওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৮ অব্দে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন আশুরবানিপাল। রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার বিখ্যাত শহর নিনেভাকে। তাতে নির্মাণ করলেন বিশাল ধবধবে এক প্রাসাদ। এরপর তিনি তার ভাইকে ব্যবিলনের শাসনকর্তা নির্বাচিত করার উপলক্ষে এক রাজ্যাভিষেক উৎসবের আদেশ দেন। ধুমধাম ও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পালিত হয় সে উৎসব। মেসোপটেমীয় উপকথার মহান দেবতা মারদুকের বিশাল মূর্তি ব্যবিলনে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তিনি ব্যাবিলনের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করেন। সেই সাথে শামাশ-শুম-উকিনকে অভিহিত করেন “আমার প্রিয় ভাই” বলে। যখন আশুরবানিপাল দেখলেন, ব্যাবিলন এবং তার সাম্রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে অধিকতর নিরাপদ, তখন পিতার অসমাপ্ত যাত্রা সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে মিশরের দিকে রওয়ানা হন তিনি।
মিশরে ফারাও তিরহাকাহের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও তাকে হত্যা করেননি এসারহাডন। তিরহাকাহের পরিবারকে বন্দী হিসেবে নিনেভাতে ফিরিয়ে আনা হয়ে। কিন্তু সে এবং তার পরিবারের কিছু লোক বন্দিশালা থেকে নুবিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিল। মিশরে হামলা চালানোর পর ৬৬৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আশুরবানিপাল তার সেনাবাহিনী নিয়ে মিশরের দক্ষিণ থেবস পর্যন্ত অগ্রসর হন। পথিমধ্যে সেসব অঞ্চল আনুগত্য স্বীকার না করে বিদ্রোহের সুর তুলেছিল, তাদেরকেই মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে মাটির সাথে। শুধুমাত্র সাইস শহরের সম্রাট নেকোই ছিলেন এর ব্যতিক্রম, যিনি অনুগত ছিলেন অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের প্রতি।
উল্লেখ্য, নেকোর ছেলে সামটিককে ছোটবেলায় এসারহাডন নিনেভাতে নিয়ে এসেছিলেন উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য। শৌর্য-বীর্যে একসময় সামটিক সুঠাম দেহের পুরুষে পরিণত হলে তাকে মিশরে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আনুগত্যের উপহারস্বরূপ, আশুরবানিপাল দুই সম্রাটের মাঝে মিশরীয় অঞ্চলগুলো ভাগ করে দেন। যখন তিনি ভাবলেন অঞ্চলগুলো বিদ্রোহের রোষানল থেকে মুক্ত, তখন মিশর ছেড়ে তিনি অ্যাসিরিয়ায় ফিরে আসলেন। ওদিকে নুবিয়ায় তিরহাকাহের ভ্রাতুষ্পুত্র তাতানামি, নতুন মিশরীয় শাসকদের রাজ্য পরিচালনার দুর্বলতা খুঁজে বের করে একটি বড় দাও মারার অপেক্ষায় থাকেন। তাতানামি তার দলবল নিয়ে মিশরের দিকে অগ্রসর হন, অতিক্রান্ত পথে অনেক শহরই পরাজিত করেন।
রাজধানী মেম্ফিসে নেকোর অধীনে বহু মিশরীয়-অ্যাসিরীয় সেনা নিযুক্ত ছিল। দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধার পর সামটিক নুবিয়ান সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল নেকো। কিন্তু মিশরীয়রা অ্যাসিরীয়দের চেয়ে নুবিয়ানদের শাসনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় খানিকটা পিছু হঠতে হয় ফারাও সামটিককে। ৬৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই বিদ্রোহের কথা নিনেভাতে পৌঁছালে আশুরবানিপাল সৈন্যদের নিয়ে এসে আবারও বিদ্রোহীদের দমন করেন। থিবেসে গাড়া শক্ত ঘাঁটি ফেলে পিছু হটেন তাতানামি, অভিযান প্রচারণা ত্যাগ করে ফিরে যান নুবিয়ায়।
এরপর আশুরবানিপাল মিশরের এক অংশের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেন ফারাও সামেটিচাসকে, বাকি অংশ সামলান সামটিক। গুরুত্বপূর্ণ সকল অবস্থানে সেনা মোতায়েন করে খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৫ অব্দে তিনি ফিরে যান অ্যাসিরিয়ায়। ৬৬৫- ৬৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে টায়রে একটি বিদ্রোহ দমনের পর তিনি এলামাইটদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাবালের বাসিন্দাদের পুনরুদ্ধার করতে তার সেনাবাহিনী সাহায্য করেছিল, এবং এর সাথে তিনি উরাতু রাজ্যকেও পরাজিত করেন। এসবের দিকে মনোযোগ দেওয়ায় ধীরে ধীরে মিশরে তার আধিপত্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল।
এলামে প্রথম প্রচারাভিযান এবং ব্যবিলন বিদ্রোহ
সামটিককে গদিতে বসিয়ে রাখা হয়েছিল আদতে একজন পরাশক্তির পুতুল হিসেবে, উপর থেকে যার কলকাঠি নাড়তেন আশুরবানিপাল। বিষয়টি একসময় খারাপ লাগতে শুরু করে সামটিকের। স্বাধীনভাবে রাজ্যপরিচালনার আশায় মরিয়া থাকা অসন্তুষ্ট সামটিক তখন মিশরীয় গভর্নরদের সাথে চুক্তি সেরে, স্বাধীনতার জন্য লিডিয়ার সম্রাট গিগেসের অনুগ্রহ প্রার্থনা করে বসেন। সম্রাট গিগেস তাতে সায় দিলে আশুরবানিপালের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি স্বতন্ত্র স্বাধীনতা জাহির করতে থাকেন। ৬৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, সামটিক লিডিয়ান সৈন্যদের সাথে একজোট হয়ে মিশর থেকে অ্যাসিরীয় সৈন্যদের বিতাড়িত করেন। এরপর নিজ রাজধানী স্থাপন করেন সাইস শহরে। বিদ্রোহের এই গুঞ্জন আশুরবানিপালের কানে এলেও তিনি আর মিশরে ফিরে আসেননি। কেন আসেননি, তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ নেই। এর প্রধান কারণ হতে পারে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের পুরনো শত্রু এলাম জাতিগোষ্ঠী। যোজন যোজন ক্রোশ দূরের মিশরে গিয়ে বিদ্রোহ দমনের চেয়ে তিনি শত্রুসংকুল এলামীয়দের দমনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন আশুরবানিপালের অধীনে থেকে রাজ্য শাসন করতে করতে খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫৩ অব্দের দিকে বিরক্তি এসে ভর করেছিল শামাশ-শুম-উকিনের উপরও। ব্যাবিলনের কিছু শিলালিপি থেকে জানা যায়, নিজ ভাই আশুরবানিপালের পতনের জন্য এলাম সম্রাটের সাথে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন শামাশ। ওইদিকে আশুরবানিপাল তার ভাইয়ের করা ষড়যন্ত্রের ছিটেফোঁটাও আঁচ করতে পারেননি। তিনি শুধু জানতেন, এলামের সেনাবাহিনী ব্যাবিলনে আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। তাদেরকে ঠেকানোর জন্য তিনি তার সেনাবাহিনীকে এলামের দিকে অগ্রসর হতে বলেন।
আশুরবানিপালের শক্তিশালী সৈন্যদলের কাছে টিকতে পারল না এলামীয়রা। সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার পর তাদের শহরগুলোও ধ্বংস করে দেওয়া হলো। আশুরবানিপাল এলামীয় সম্রাট ও তার ছেলের শিরশ্ছেদ করেছিলেন নিজের ধারালো তরবারির কোপেই। তারপর তিনি সেই মুণ্ডুগুলো নিনেভাতে নিয়ে প্রদর্শনীর বস্তু হিসেবে বাগানে ঝুলিয়ে দেন। অথচ আশুরবানিপাল ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, এই এলামীয়দেরকেই তার ভাই ব্যবিলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
তার ভাই গোপনে এলামীয়দের সাথে হাত মিলিয়েছে, এই কথা তিনি জানতে পারলেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার মতো সময় তার হাতে ছিল না। ওই বছরই মেডিস, পারসীয় এবং সিমেরীয়দের সম্মিলিত একটি জোট নিনেভার দিকে অগ্রসর হয় এবং তারা শহরের মূল প্রাচীদের একদম কাছাকাছি চলে আসে। আশুরবানিপাল তখন তার সিথিয়ান মিত্রদের ডাক দেন, তুখোড় অশ্বারোহী হিসেবে যাদের জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল। ওই জোটকে হারানোর পর মেডিসের সম্রাট ফ্রাওর্টেসকে হত্যা করেন আশুরবানিপাল।
ওদিকে শামাশ-শুম-উকিনের বিরক্তির বাধ একসময় পুরোপুরি ভেঙে গেল, ৬৫২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি প্রকাশ্য বিদ্রোহের ডাক দিয়ে বসলেন তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। তিনি অ্যাসিরীয় গ্রাম এবং চৌকিগুলো দখল করে সেগুলোকে ব্যাবিলনের অংশ হিসেবে দাবি করে বসেন। আপন রক্তের সাথে বেইমানি মেনে নিতে পারলেন না আশুরবানিপাল। অধিক সংখ্যক সৈন্যবাহিনীকে ব্যবিলনে পাঠান তিনি। সংখ্যালঘু হওয়ায় শামাশ-শুম-উকিন তার বাহিনী নিয়ে পিছু হটে ব্যাবিলনের দেয়ালের পিছনে সরে আসেন। পরবর্তী চার বছর সে দেওয়াল অবরুদ্ধ করে রেখেছিল অ্যাসিরীয় বাহিনী।
এলামে দ্বিতীয় প্রচারাভিযান
৬৪৮ কিংবা ৬৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের পতনের সময় এলাম আন্দোলিত হয় গৃহযুদ্ধের বিস্ফোরণে। এলাম সম্রাটের প্রয়াণের পর সিংহাসন দখলের জন্য উঠেপড়ে লাগে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন স্বয়ং আশুরবানিপালও। পুরনো শত্রুর সাথে কিছু হিসাব চুকানোর জন্য সেনাবাহিনী নিয়ে আবার এলামের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন।
আশুরবানিপালের গ্রন্থাগার
আশুরবানিপাল ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাহিত্যানুরাগী মানুষ। সম্রাট আশুরবানিপালের শাসনামলে (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৮ অব্দ – খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৭ অব্দ) নিনেভাতে সম্পূর্ণ নতুন এক প্রাসাদ নির্মিত হয়, এবং তিনি মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস ও উপকথায় বর্ণিত সমস্ত কাহিনি সংগ্রহ ও তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রাচীন পৃথিবীর বিখ্যাত কতক জিনিসের মাঝে সম্রাট আশুরবানিপালের প্রাচীন রাজকীয় গ্রন্থাগার অন্যতম। জৌলুশপূর্ণ শহর নিনেভার প্রাসাদে নির্মিত এই গ্রন্থাগারের নির্মাণকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পুঁথিশালা না হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখানেই প্রথম শ্রেণীবিভাগ অনুসারে বই সাজানো শুরু হয়। বিদ্যার প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল আশুরবানিপালের। তিনি প্রাচীন সুমেরীয় এবং আক্কাদীয় ভাষায় লিখতে পারতেন। রাজত্বকালের পুরোটা জুড়েই গ্রন্থাগারে সাহিত্যকর্মের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি করে গেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন নিজস্ব সংগ্রহশালা।
তখনকার যুগে লেখার জন্য কোনো কাগজ-কলমের ব্যবস্থা ছিল না। তাই বিভিন্ন জিনিস লিখে রাখা হতো চারকোণা বিশিষ্ট মাটির ফলক বা ট্যাবলেটে। পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ, ব্যবিলনীয় সৃষ্টিতত্ত্ব, সুমেরীয় মহাপ্লাবনের কাহিনিগুলো উদ্ধার করা হয়েছে এই ট্যাবলেট থেকেই। তার গ্রন্থাগারে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, উপকথা, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ধর্মীয় গ্রন্থের উপর বিভিন্ন রকমের নথি সংগ্রহ করা ছিল। রাজকীয় প্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর অংশের দ্বিতীয় তলায় এই পুঁথিশালার অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ মেলে। গ্রন্থাগার দেখভালের জন্য আলাদা লোকও নিয়োগ দেওয়া হতো। আজকের যুগে গ্রন্থাগারে বইয়ের যে সুবিন্যস্ত তালিকা ও সূচি পাওয়া যায়, এর উদ্ভাবক মূলত আশুরবানিপাল।
সাম্রাজ্যের পতন
গ্রন্থাগারের দেখভাল, নিনেভার সংস্কার, সামরিক অভিযান, সাম্রাজ্য পরিচালনার পাশাপাশি আশুরবানিপাল ব্যাবিলন সংস্কারের তত্ত্বাবধানও করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৯ সাল নাগাদ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পুত্র আশুর-এতেল-ইলানির হাতে সাম্রাজ্যের ভার বুঝিয়ে দিয়ে নিনেভা ছেড়ে উত্তরে হারান শহরে চলে যান। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে নাখোশ হন নতুন সম্রাটের যমজ ভাই সিন-শার-ইশকুন। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩০ অব্দের দিকে আশুরবানিপালের প্রয়াণের পর শুরু হয় সাম্রাজ্য দখলের পায়তারা। তার পুত্রগণ সিংহাসনের লোভে লিপ্ত হন সংঘর্ষে। আয়তনে বেশ বৃহৎ হওয়ায় পুরো অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখাও হয়ে পড়ে দুষ্কর।
কিছু অঞ্চল অ্যাসিরীয় শাসনের শিকল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাচ্ছিল। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তাদের কাছেও এসে যায় সুবর্ণ সুযোগ। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৫ অব্দের দিকে বেশ জোরেশোরে শুরু হয়েছিল পারসিক, ব্যাবিলনীয়, মেডিস এবং সিথিয়ানদের সামরিক আগ্রাসন। নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যও আভ্যন্তরীণ দুর্বলতায় ভেতর থেকে ক্রমে ক্রমে ভেঙে পড়ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৬১২ অব্দের দিকে শত্রুরা নিনেভা শহরকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে নিজেদের মধ্যে অঞ্চলটি ভাগ করে নেয়। সেই সাথে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় সম্রাট আশুরবানিপাল ও তার শহর নিনেভার কিংবদন্তি।