(প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে)
৫
১৯৫১ সালের কথা। ডুপন্ট তখন প্রথমবারের মতো 3M এর কাছ থেকে টেফলন উৎপাদনের জন্য PFOA কেনে। ওরা এই PFOAকে C8-ও বলত। রাসায়নিকভাবে, যেসব যৌগে ৮টি কার্বন থাকে, তাদেরকে এ নামে ডাকা যায়। 3M ১৯৪৭ সালের দিকে পিএফওএ আবিষ্কার করে। মূলত এর ব্যবহার হতো বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্যের গায়ে প্রলেপ দেয়ার জন্য। পাঠক হয়তো জানেন, ফ্রায়িং প্যানে টেফলন ব্যবহার করা হয়। এতে করে কোনো কিছু ভাজি বা রান্না করতে গেলে তা প্যানের গায়ে লেগে যায় না। তবে বর্তমানে টেফলন উৎপাদনের জন্য পিএফওএ ব্যবহার করা হয় না।
পিএফওএ-এর বর্জ্য কীভাবে নিষ্কাষণ করতে হবে, সে ব্যাপারে থ্রিএম ডুপন্টকে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিল। তাতে বলা ছিল, প্রচণ্ড তাপে একে পুরোপুরি পুড়িয়ে ফেলতে হবে, কিংবা বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাষণের নিয়ম মেনে সব করতে হবে। ডুপন্টের নিজস্ব নির্দেশনাতেও উল্লেখ ছিল, পানি কিংবা নর্দমায় যেন কোনভাবেই না মেশে, সেভাবেই এটি নিষ্কাষণ করতে হবে।
তাতে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তীতে জানা যায়, পাইপের মাধ্যমে হাজার হাজার পাউণ্ড পিএফওএ পাউডার ওহায়ো নদীতে এসে পড়েছে। এছাড়াও, ওয়াশিংটন ওয়ার্কস সংলগ্ন এলাকায় ৭,১০০ টনের মতো পিএফওএ কাদার মধ্যে খোলা পড়ে ছিল, যা পরে সেখানকার মাটি ও পাশের ড্রাই রান ক্রিকের পানির সঙ্গে মিশে যায়। এই জলাশয়ের পানি পার্কারসবার্গ, ভিয়েনা, লিটল হকিংসহ আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত প্রায় লাখখানেকের বেশি মানুষ নিয়মিত পান করত।
সরকারিভাবে পিএফওএকে তখনো বিষাক্ত রাসায়নিক হিসেবে দেখা হতো না। এর কারণ, স্বয়ং থ্রিএম কিংবা ডুপন্ট এ ব্যাপারে আর কাউকে কিছু জানতেই দেয়নি। কিন্তু এই কোম্পানিগুলোর নিজস্ব বিজ্ঞানীরা প্রায় চার যুগের বেশি সময় ধরে পিএফওএ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা, শুধু ইঁদুর কিংবা খরগোশের ওপরে পরীক্ষা করেই তারা থেমে যায়নি। সরাসরি মানুষের ওপরেও তারা জেনে-শুনে এই বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করেছে।
১৯৬১ সালে ইঁদুরের ওপর এক পরীক্ষা চালিয়ে ডুপন্টের বিজ্ঞানীরা দেখতে পায়, এটি ইঁদুর ও খরগোশের যকৃত (Liver) অস্বাভাবিকরকম বড় করে ফেলছে। পরের বছর কুকুরের ওপরে পরীক্ষা চালিয়েও একই ফলাফল পাওয়া যায়। আসলে, পিএফওএতে থাকা ৮-কার্বনের শেকল সহজে ভাঙ্গতে চায় না। সেজন্যই টেফলন উৎপাদনে এটি ব্যবহার করলে, কোনোকিছু সহজে এর সঙ্গে লেগে যায় না। একইভাবে পিএফওএ রক্তে প্রবেশ করলে রক্তের প্লাজমা প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, ভাঙ্গে না। সেজন্যই যকৃত ওরকম অস্বাভাবিক বড় হয়ে যায়।
১৯৭০ এর দশকে প্রথমবারের মতো ডুপন্ট টের পায়, ওয়াশিংটন ওয়ার্কসের কর্মীদের রক্তে বেশ ঘন হয়ে পিএফওএ জমে গেছে। তারা ইপিএকে তো জানায়ইনি, কর্মীদেরকেও কিছু বলেনি। ১৯৮১ সালে থ্রিএম জানতে পারে, গর্ভবতী ইঁদুরের দেহে পিএফওএ থাকলে বাচ্চা ইঁদুরটি বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম দেয়। ডুপন্টকেও তারা এ তথ্য জানায়। ডুপন্ট জেনে-শুনেই তাদের কারখানায় কর্মরত সাতজন গর্ভবতী মায়ের দেহে পিএফওএ ইনজেক্ট করে। এর মধ্যে ২টি শিশু চোখে ভয়ংকর ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। এ ব্যাপারে সেই মায়েরাও কিছু জানত না। আর কারো কিছু জানার তো প্রশ্নই আসে না।
১৯৮৪ সালে ডুপন্ট জানতে পারে, কারখানার চিমনি দিয়ে ধুলো ও ধোঁয়ার সঙ্গে পিএফওএ স্থানীয় জলাশয়ের পানিতে মিশে যাচ্ছে। আগের মতোই নিরব থাকে তারা। ১৯৯১ সালে ডুপন্টে কর্মরত বিজ্ঞানীরা পানির সঙ্গে কতটুকু পরিমাণ পিএফওএ মিশলেও তা খাওয়া নিরাপদ, তার একটা সম্ভাব্য পরিমাণ নির্ণয় করে: ১ পার্ট পার বিলিয়ন। এর মানে, খুব সহজ করে বললে, প্রতি বিলিয়নে ( ১*১০৯ ) ১ ভাগ। ডুপন্ট জানতে পারে, স্থানীয় পানি সরবরাহের লাইনে পিএফওএর পরিমাণ এর তিনগুণেরও বেশি। এ পর্যায়ে এসে মিটিংয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকে না জানানোর সিদ্ধান্তই বহাল থাকে।
ডুপন্ট অবশ্য তাদের শুনানিতে ১৯৮২ ও ১৯৯২ সালে ইপিএকে পাঠানো দুটি চিঠি আদালতে দাখিল করেছিল। সেই চিঠিগুলোতে পিএফওএ যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক, এর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। ইপিএ এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কারণ, এটি কীরকম ক্ষতিকারক, এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো তথ্য তাদের হাতে ছিল না। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৯৯ সালে তাদের তালিকায় পিএফওএর নামও খুঁজে পাননি বিলোত।
‘৯০ এর দশকেই ডুপন্ট জানতে পারে, পিএওফওএর জন্য অগ্ন্যাশয়, যকৃত ও অণ্ডকোষে ক্যান্সার হতে পারে। একাধিক প্রাণীর ওপরে পরীক্ষা করে তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। এ পরীক্ষায় কর্মরত বেশ কিছু কর্মীর প্রোস্টেট ক্যান্সারও হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে তারা প্রথমবারের মতো পিএফওএর একটি বিকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। বিলোত একটি মেমো খুঁজে পান, যেখানে লেখা ছিল, ‘প্রথমবারের মতো আমরা এর কার্যকর সম্ভাব্য বিকল্প খুঁজে পেয়েছি।’ জিনিসটি কী, তা সেখানে উল্লেখ ছিল না। তবে বলা ছিল, সেটি কম ক্ষতিকর। আর, মানুষের দেহে এটি বেশি সময় থাকতে পারে না।
কিন্তু কিছুদিন পরে এই বিকল্প ব্যবহারের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলার লাভের ব্যবসা নিয়ে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায়নি তারা।
‘৮০ এর দশকের শেষে ডুপন্ট নিজেই পিএফওএ বর্জ্য নিষ্কাষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কোম্পানির কোনো অব্যবহৃত জমিতে এই বর্জ্যগুলো পুঁতে ফেলতে হবে। এদিকে, কিছুদিন আগেই তারা জিম ট্যানেন্টের ৬৬ একর জমি কিনে নিয়েছিল। ফলে, এতদিনের পিএফওএ বর্জ্যের সব জায়গা নিল সেই জমিতে।
হ্যাঁ, এই সমস্ত তথ্য-প্রমাণ ডুপন্ট স্বয়ং বিলোতের হাতে তুলে দিয়েছিল না জেনে।
৬
আগস্ট, ২০০০। ডুপন্টের আইনজীবী বার্নার্ড রাইলিকে ফোন দিলেন রবার্ট বিলোত। জানালেন, তিনি কী কী পেয়েছেন। দ্রুত পদক্ষেপ নিল ডুপন্ট। জানাল, তারা ট্যানেন্টদের সাথে সমঝোতা করতে চায়। ট্যানেন্টরাও রাজি। ওরা একটা ভাল অংকের টাকা পেয়েছে। ট্যাফট পেয়ে গেছে তাদের ফি। কেস ডিসমিস।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হলে পারত। হয়নি। মানসিকভাবে শান্তি পাচ্ছিলেন না বিলোত। পিএফওএযুক্ত পানি খেয়ে গরুগুলোর কী অবস্থা হয়েছে, তিনি দেখেছেন। তাহলে যে শত-সহস্র মানুষ নিয়মিত এই পানি খাচ্ছে, তাদের কী অবস্থা? তাদের মাথার ভেতরে কী অবস্থা? কিডনির রং কী? সবুজ? নীল? অস্বাভাবিক বড়? বিলোত বুঝলেন, থেমে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।
পরবর্তী বেশ কয়েকমাস ধরে ডুপন্টকে ঠেসে ধরার জন্য আবারো উঠে-পড়ে লাগলেন বিলোত। তৈরি করলেন ১৩৬টা সংযুক্তি-প্রমাণসহ ৯৭২ পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ আইনি-চিঠি। তার সহকর্মীরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘রবের বিখ্যাত চিঠি’। তিনি প্রমাণ করলেন, ড্রাই রান ল্যান্ডফিল এবং ডুপন্টের আশেপাশের জমি ও স্থানীয় জলাশয়ে যে পরিমাণ পিএফওএ জমেছে, তা মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর। সেই চিঠিতে তিনি স্থানীয়দের জন্য ভাল পানি এবং পিএফওএ নিষ্কাষণ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানালেন। ২০০১ সালের মার্চের ৬ তারিখ তিনি সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছে এই চিঠি পাঠালেন। সেই সূত্র ধরে ইপিএর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ক্রিস্টি হুইটম্যান এবং যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জন অ্যাশক্রফটও ছিল। (পাশাপাশি ক্লাস-অ্যাকশন ল’স্যুটও দাখিল করেছিলেন বিলোত। সে ঘটনা পরবর্তীতে আলোচিত হবে।)
দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল ডুপন্ট। তাদের সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে চেষ্টা করল বিলোতকে আটকাতে। গ্যাগ অর্ডারের আবেদন করল ফেডারেল কোর্টে, যেন কোনোভাবেই ট্যানেন্ট কেসের কাগজপত্র সরকারের হাতে গিয়ে না পড়ে।
সাধারণত সংবেদনশীল ও গোপনীয় কোনো তথ্য গণমানুষ ও সরকার যেন জানতে না পারে, সেজন্য গ্যাগ অর্ডারের আবেদন করা হয়। ইপিএর কাছে একজন আইনজীবীর চিঠি পাঠানো আটকাতে গ্যাগ অর্ডারের আবেদন করা, আর মশা মারতে কামান দাগা একই কথা। কিন্তু লাভ হয়নি। ফেডারেল কোর্ট ডুপন্টের আবেদন নাকচ করে দেয়।
এই চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে বিলোত তার সীমা অতিক্রম করলেন। এখন আর তিনি শুধু ডুপন্টের বিরোধীতা করছেন না। পুরো ‘ফ্লুরোপলিমার ইন্ডাস্ট্রি’র রাশ টেনে ধরতে চাইছেন। এই ইন্ডাস্ট্রির বিস্তৃতি তখন ব্যাপক। টেফলন ও আরো বেশ কিছু রাসায়নিক তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। আর, রান্নার সামগ্রী থেকে শুরু করে কম্পিউটার টেবিল, বিভিন্ন মেডিক্যাল ডিভাইস ইত্যাদিতে প্রলেপ দেয়ার কাজে লাগে এটি। এক চিঠির মাধ্যমে এই বিলিয়ন ডলারের পুরো ইন্ডাস্ট্রি ধ্বসিয়ে দিতে চাচ্ছেন তিনি। এর ফলে শুধু তিনি না, পুরো ট্যাফট স্টেটিনিয়াস এন্ড হলিস্টার ফার্ম পথে বসতে পারে। যে ধরনের কোম্পানিগুলোর পক্ষে তারা কাজ করে, সেরকম একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তারা, ক্ষতি করেছে রাসায়নিক ও বিভিন্ন গৃহস্থালী সামগ্রী প্রস্তুতকারক সমস্ত কোম্পানীর।
বিলোত কিন্তু থামেননি সেজন্য। তার ফার্ম ট্যাফটও তাকে যথাসম্ভব সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু তেমন কোনো নতুন কেস আসছিল না তার কাছে। এ সময় আসল সমর্থনটা তিনি পেয়েছেন স্ত্রী সারাহ বার্লেজের কাছ থেকে। একা হাতে তিনি নিজের ক্যারিয়ার সামলেছেন, ঘর সামলেছেন, সন্তানদের দেখাশোনা করেছেন, যোগান দিয়েছেন প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সার।
৪ বছর পর, ২০০৫ সালে সেই চিঠির ফলাফল পাওয়া গেল। বিষাক্ত রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ আইন (Toxic Substances Control Act.) ভঙ্গ করে পিএফওএর ক্ষতিকর প্রভাবের কথা গোপন করা এবং পরিবেশ বিষাক্ত করে তোলার জন্য ইপিএ ডুপন্টকে ১৬.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করল।
রবার্ট বিলোত এরপর আর কখনো কোনো কর্পোরেট কোম্পানির হয়ে কেস লড়েননি।
৭
আগস্ট, ২০০১। চিঠি দেয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল ডুপন্টের বিরুদ্ধে ক্লাস-অ্যাকশন ল’স্যুট দাখিল। এখানে একটা জিনিস বুঝতে হবে। আগের মামলাটা ছিল এটা দেখানো যে ডুপন্ট পরিবেশ বিষাক্ত করে ফেলছে। ২০০৫ সালে ইপিএ ডুপন্টকে জরিমানা করে সেটাই প্রমাণ করেছে। পাশাপাশি, বিলোত আশেপাশের সব ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মানুষের হয়ে মামলা করতে চাচ্ছিলেন, যেন তারা ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ পায়।
এতক্ষণ যেটা ছিল শুধু কর্পোরেট মামলা, এই পর্যায়ে এসে সেটা আর তা নেই। সেজন্য রাইলি ডুপন্টের সুপারভাইজার থমাস টার্পের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাকে বোঝালেন, এই মামলায় ট্যাফট ডুপন্টকে সমর্থন করলে নিজের পায়ে কুড়াল মারবে। কিন্তু টার্প নিজেও ততদিনে মামলার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। তিনি বিলোতকেই সমর্থন দিলেন। ফলে ট্যাফটের হয়েই ডুপন্টের বিরুদ্ধে ক্লাস-অ্যাকশন ল’স্যুট দাখিল করার জন্য প্রস্তত হলেন রবার্ট বিলোত।
ল’স্যুট দাখিলের আগে বিলোত ভেবেছিলেন, ওয়াশিংটন ওয়ার্কসের আশেপাশের এক-দুটো ডিস্ট্রিক্ট হয়তো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দেখা গেল, সংখ্যাটা ছয়। অর্থাৎ, ছয়টা ডিস্ট্রিক্টের অধিবাসীদের হয়ে মামলা করতে হবে তাকে। কিন্তু মামলা করতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি নিজেই উল্টা বিপাকে পড়ে যাচ্ছেন।
প্রথমত, সরকারি কোনো কাগজপত্রে পিএফওএকে বিষাক্ত রাসায়নিক হিসেবে নথিভূক্ত করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, পিএফওএ নিরাপদে ব্যবহারের মাত্রা কতটুকু, এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক গবেষণা হয়নি। ডুপন্টের বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য মাত্রা হিসেবে ১ পার্ট পার বিলিয়নের কথা বলেছিল। বিলোত একজন টক্সিকোলজিস্টকে পরীক্ষা করে দেখতে বলেছিলেন। তার হিসেবে এই মাত্রা হলো ০.২ পার্টস পার বিলিয়ন। ওদিকে ডুপন্ট ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ইপিএর সঙ্গে যৌথভাবে একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে কাজ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ঘোষণা দিয়েছে, এই মাত্রা নাকি ১৫০ পার্টস পার বিলিয়ন!
২০০০ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া মেডিকেল-মনিটরিং ক্লেইম অনুমোদন করে। এই ক্লেইমের হিসাবে, বাদীকে প্রমাণ করতে হবে, বিবাদীর মাধ্যমে তিনি বিষাক্রান্ত হয়েছেন। যদি বাদী জেতেন, বিবাদীকে তার চিকিৎসা, নিয়মিত মেডিকেল টেস্ট ইত্যাদি সবকিছুর খরচ দিতে হবে। এবং পরবর্তীতে এই বিষের কারণে বাদী যদি বড় কোনো রোগে আক্রান্ত হন, যেমন ক্যান্সার, তাহলে বিবাদীকেই তার চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহণ করতে হবে। বিলোত চিন্তা করলেন, সেটাই কাজে লাগাবেন। ক্লাস-অ্যাকশন স্যুটটা তিনি ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে দাখিল না করে, সরাসরি গেলেন স্টেট কোর্টে।
এদিকে কেস খুব বেশি আগানোর আগেই, বিলোতের রিসার্চ ও চিঠির ওপর ভিত্তি করে ইপিএ নিজস্ব তদন্ত করল। ২০০২ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের তদন্তের রিপোর্ট দেয়। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু পিএফওএযুক্ত পানিই না, এ থেকে তৈরি টেফলনের প্যান বা হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি যারা ব্যবহার করছেন, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তারাও। (বর্তমানে টেফলন আর পিএফওএ থেকে তৈরি করা হয় না।) এছাড়াও, বিলোতের চিঠির সংযুক্তি থেকে দেখা গেল, থ্রিএম এবং ডুপন্ট এই ব্যাপারটা ১৯৭৬ সাল থেকেই জানত। অর্থাৎ পিএফওএর ফলে শুধু ওহায়োর কিছু ডিস্ট্রিক্টের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ২০০৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্তে পিএফওএ ঘনত্বের পরিমাণ ৪-৫ পার্টস পার বিলিয়ন।
জানা যায়, বিলোত এই মামলা হাতে নেয়ার পরপর, ২০০০ সালে থ্রিএম পিএফওএ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ডুপন্ট থামতে রাজি হয়নি। ফ্যাইয়েটেভিলে (Fayetteville) নতুন কারখানা করে তারা নিজেরাই পিএফওএ উৎপাদন শুরু করে।
ওদিকে ডুপন্ট যখন দেখল, ক্লাস-অ্যাকশন ল’স্যুটের কারণে প্রচণ্ড ঝামেলা হতে পারে, তারা সমঝোতা করতে চাইল। জানাল, ক্ষতিগ্রস্থ ৬টি ডিস্ট্রিক্টেই তারা পানি শোধনাগার তৈরি করে দিতে রাজি আছে। পাশাপাশি, ৭০ মিলিয়ন ডলার দেবে তারা। এই অর্থ দিয়ে একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখবেন, পিএফওএর সঙ্গে স্থানীয় কারো কোনো রোগের সম্পর্ক আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে আক্রান্তদের চিকিৎসা সব খরচ তারা বহণ করবে। কিন্তু, এই গবেষণা শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত কিংবা পিএফওএর সঙ্গে রোগের সম্পর্ক পাওয়া না গেলে, স্থানীয় কেউ ব্যক্তিগতভাবে তাদের নামে আলাদা করে মামলা করতে পারবেন না।
এই সমোঝতার ফলে বিলোতের ফার্ম, ট্যাফট স্টেটিনিয়াস এন্ড হলিস্টার ২১.৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল।
তার এক সহকর্মী বলছিলেন, ‘এ পর্যায়ে এসে যে কারো থেমে যাওয়ার কথা। কারণ, এতদিন বিলোত ও তার ফার্মের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এখন এসে ফার্ম এতদিন ধরে কেস চালানোর ক্ষতিপূরণ তো পেয়েছেই, লাভও পেয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ ডিস্ট্রিক্টগুলো পাচ্ছে ভাল পানি। বিলোত এখন বেতন বৃদ্ধির কথা বলতে পারেন ট্যাফটকে। সেই সঙ্গে ভাল ক্লায়েন্টও পাবেন তিনি চাইলে। অর্থাৎ, আইনজীবী হিসেবে ডুপন্টের বিরুদ্ধে এই কেস নিয়ে সামনে আগানোর আর কোনো অর্থ নেই। বরং সমঝোতার ফলে বাদী আইনজীবীর এই কেস ড্রপ করার কথা।’
কিন্তু রবার্ট বিলোত তা করেননি।
৮
ঝামেলা রয়ে গিয়েছিল। বিলোত যাদের কথা জানেন, পিএফওএর কারণে অসুস্থ হয়েছে, তারা সবাই ছিল ডুপন্টের কর্মী। সেজন্য ডুপন্ট চাইলে যুক্তি দেখাতে পারে, পানিতে মিশে যাওয়া সামান্য পিএফওএ কারো তেমন কোনো ক্ষতি করেনি। পিএফওএর কারণে যারা অসুস্থ হয়েছে, তারা দীর্ঘদিন এর সংস্পর্শে ছিল। সেজন্যই এমন হয়েছে। এই যুক্তি তারা দেখিয়েওছিল। অর্থাৎ, তারা যে স্থানীয় সবার ক্ষতি করছে, সেটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই।
বিলোত ভাবলেন, ৭০,০০০ মানুষের কেস এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না। তিনি চিন্তা করলেন, সমঝোতার ফলে যে টাকা পেয়েছেন, এই টাকাটা এক্ষেত্রে কাজে লাগালে কেমন হয়?
ক্লাস-ল’স্যুটে ৩টা প্রশ্নের জবাব দরকার। এক, কারো রক্তে C8 আছে কি না। দুই, তা ক্ষতিকর কি না। এবং তিন, ক্ষতিকর হলে, এটা ঠিক কী ক্ষতি করছে। এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হলে নমুনা রক্ত লাগবে। ৭০,০০০ মানুষের কতজন আর স্বেচ্ছায় রক্ত দিবে?
বিলোত এবং ট্যাফটের সহকর্মীরা মিলে ঘোষণা দিলেন, নির্বাচিত একদল বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে স্থানীয়দের রক্ত সংগ্রহ করা হবে। প্রতিজন মানুষ রক্ত দিলেই পাবেন ৪০০ ডলারের চেক! এই ঘোষণায় জাদুর মতো কাজ হলো। রক্ত দেওয়ার জন্য ঢল নামল মানুষের।
ডুপন্ট চেষ্টা করেও থামাতে পারছিল না। এত এত মানুষের মেডিকেল তথ্য, সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করা ও গবেষণা করার যে খরচ, সব তারা দিতে বাধ্য ছিল। এর ফলে ডুপন্টকে মোট ৩৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছিল।
কিন্তু এতসব নমুনা পরীক্ষা করা, পরীক্ষার জন্য মডেল ডিজাইন করা, প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা ইত্যাদির জন্য প্রয়োজন সময়। কাজেই, শুরু হলো প্রতীক্ষা।
৯
বছর গড়াচ্ছে, কোনো ফল আসছে না। বিলোত নতুন কেস পাচ্ছেন না। ফার্মের যা লাভ হয়েছিল, সেগুলো খরচ হয়ে গেছে রক্ত সংগ্রহের সময় মানুষের পেছনে। এভাবে কেটে গেছে এক-দুই-তিন করে ছয়টা বছর। এতদিনে এসে প্রভাব পড়ছে বিলোতের বেতনে। এবং স্বাস্থ্যেও। দুশ্চিন্তায়, মানসিক চাপে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে, ভর্তি করতে হয়েছে হাসপাতালে। আগের মতোই একনিষ্ঠভাবে সব সামলে যাচ্ছেন তার স্ত্রী সারাহ। কিন্তু আর কত?
পরিবারে অশান্তি দেখা দিয়েছে। বাচ্চারা বড় হয়ে যাচ্ছে, অথচ বাবাকে তারা খুব একটা কাছে পায়নি। যেটুকু পেয়েছে, দেখেছে তার দুর্দশা।
প্রতীক্ষার পালা ফুরালো ২০১১ সালের ডিসেম্বরে। সব নমুনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকদল জানাল, পিএফওএর কারণে কিডনি ও অণ্ডকোষে ক্যান্সার, থাইরয়েড ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ, মলাশয়ে আলসারেটিভ কলিটিস রোগ ইত্যাদি হতে পারে।
সে বছরের অক্টোবরে ডুপন্টের বিরুদ্ধে ৩,৫৩৫টি মামলা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শুনানি শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রথম যে মামলার শুনানি হয়, তার বাদী ছিলেন কার্লা বার্লেট। তার কিডনিতে ক্যান্সার হয়েছিল। সেই মামলায় বার্লেট ১.৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পান। তিনি চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। ডুপন্ট শেষ চেষ্টা হিসেবে আপিল করেছিল, ধোপে টেকেনি।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় মামলায় তাদেরকে যথাক্রমে ৫.৬ ও ১২.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এক বিচারক এ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘বছরে ৪টা করে মামলা নিষ্পত্তি হলেও সব মামলা নিষ্পত্তি হতে হতে ২০৮৯ সাল লেগে যাবে।’
তৃতীয় মামলায় হারার পর, ২০১৭ সালে ডুপন্ট বাকি সব মামলার জন্য ৬৭১.৭ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিষ্পত্তি করে নিতে রাজি হয়। তারপরও আরো ডজনেরও বেশি মামলা হয়েছে ওদের নামে। সেসব মামলা নিষ্পত্তির পাশাপাশি, পরিবেশ সংক্রান্ত অন্যান্য ইস্যু ও মামলা নিয়ে আজও কাজ করে যাচ্ছেন রবার্ট বিলোত।
শেষের আগে
২০১৩ সালে ডুপন্টসহ আরো পাঁচটি কোম্পানি পিএফওএ এবং পিএফওএস উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
২০১৭ সালে রবার্ট বিলোত পিএফওএ এবং পিএফওএস নিয়ে তার কাজের জন্য রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড (Right Livelihood Award) পান। একে ‘বিকল্প নোবেল পুরষ্কার’ও বলা হয়। এছাড়াও, আইনজীবী হিসেবে বেশ কিছু পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি।
২০১৯ সালে এ নিয়ে একটি বই লেখেন বিলোত। এক্সপোজার: পয়জন্ড ওয়াটার, কর্পোরেট গ্রিড এন্ড ওয়ান ল’ইয়ারস টুয়েন্টি-ইয়ার ব্যাটল অ্যাগেইন্সট ডুপন্ট। এই বইয়ের ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালে ডার্ক ওয়াটারস নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন মার্ক রাফেলো (যিনি নিজেও একজন পরিবেশবাদী)। সেখানে বিলোতের চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি। যদিও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে ঘটনাগুলোকে সামান্য এদিক-ওদিক করা হয়েছে, তবে এর মূল সুরটা একই আছে।