১৯৮২ সালের ২ এপ্রিল। সেদিন ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের দিগন্তে দেখা দিল আর্জেন্টাইন নৌবাহিনীর যুদ্ধবহর জেনারেল বেলগ্রানো। বেলগ্রানোর দু’পাশে যুদ্ধের সাঁজে সজ্জিত আরও কয়েকটি নৌবহর। তাদের সবার গন্তব্য ছিল ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। উদ্দেশ্য ব্রিটিশ দখলদারিত্বের হাত থেকে ফকল্যান্ডকে ছিনিয়ে নিয়ে তা আর্জেন্টিনার অধীনস্থ করা। শত বছরের দ্বন্দ্বের কারণ এই ফকল্যান্ড নিয়ে আর্জেন্টিনা আর যুক্তরাজ্যের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ কয়েক বছর ধরে টালমাটাল। তীব্র স্নায়ুযুদ্ধের পর যেকোনো একদিন যুদ্ধ বেঁধে যাবে, এমন আশঙ্কা সবাই করেছিল। অবশেষে সে দিনক্ষণ চলে এসেছে। ভারি অস্ত্র বোঝাই নৌবহর থেকে ইতোমধ্যে প্রদর্শনীমূলক দুয়েকটা গোলা ছোঁড়া হয়েছে। আটলান্টিকের বুকে আছড়ে পড়ে সেগুলো বিশাল জল-বিস্ফোরণের সৃষ্টি করছে।
ওদিকে ফকল্যান্ডের মাটিতে হাতেগোনা কয়েক প্লাটুন ব্রিটিশ সেনা নিজেদের যা কিছু আছে, তা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেও তারা যুদ্ধ ছাড়া হার মানতে রাজি না। তবে তাদের মনোবল বেশ দুর্বল। আর সে দুর্বলতার মাঝে নিজেদের অন্তিম পরিণতি যেন বারবার চোখ রাঙাচ্ছে। দ্বীপের প্রতিটি ব্রিটিশ সেনার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে এক চাপা আতঙ্ক। আরো কাছে চলে এসেছে আর্জেন্টাইন নৌবহর। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় রকমের পরিবর্তন সাধন করবে।
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ
ফকল্যান্ড যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার আগে জানা দরকার ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে। দক্ষিণ আটলান্টিকের বুকে অবস্থিত প্রায় ২০০ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। ১৬৯০ সালে দ্বীপপুঞ্জের ‘ফকল্যান্ড’ নামকরণ করেছিলেন ব্রিটিশ কাপ্তান জন স্ট্রং। আর্জেন্টাইনদের নিকট এটি মালভিনাস নামে অধিক পরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানে বসবাসরত ফরাসি নাবিক এবং অভিযাত্রিকরা ফ্রান্সের সেন্ট মালোর সাথে মিলিয়ে এর নামকরণ করেছিলেন মালোউনি।
সেখান থেকে এটি ‘আইলা মালভিনাস’ বা শুধু ‘মালভিনাস’ নামে পরিচিতি লাভ করে। দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণ বিন্দু থেকে দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার দূরে। বর্তমানে এটি যুক্তরাজ্যের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে বিদ্যমান। ফকল্যান্ডকে পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই অংশে ভাগ করা হয়েছে। ফকল্যান্ডের রাজধানী স্ট্যানলির অবস্থান পূর্ব ফকল্যান্ডে। ২০২০ সালের জরিপ মতে, দ্বীপপুঞ্জের আয়তন প্রায় ১২,২০০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৩,৪৮৬ জন।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ কেন বাঁধল?
১৯৮২ সালে সংঘটিত ফকল্যান্ড যুদ্ধের পেছনে কাজ করছিল শতবর্ষী রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। শতাব্দীর শুরু থেকে নিজেদের সীমানার কাছে থাকা ফকল্যান্ডের উপর সার্বভৌমত্বের দাবি করত আর্জেন্টিনা সরকার। তবে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা দ্বীপপুঞ্জে অবস্থানরত আর্জেন্টাইনদের হটিয়ে দিয়ে এর পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্জন করে ১৮৩৩ সালে। জেনে রাখা ভালো, এর পূর্বে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা একে উপনিবেশে রূপান্তর করলেও অর্থনৈতিক কারণে সেখান থেকে প্রস্থান করেছিল। এরপর থেকে আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জের অধিকার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
দুই দেশের মধ্যে বড় কোনো সংঘর্ষ না ঘটলেও চলতে থাকে শীতল স্নায়ুযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘের দরবারে এই বিতর্ক উত্থাপিত হয়। সেখানে বিশ্বনেতারা দুই দেশকে দ্বীপপুঞ্জের অধিকার প্রসঙ্গে বৈঠকে বসে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানান। জাতিসংঘের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার শুরু হয়। তবে কোনো সমঝোতায় না পৌঁছালে সে বিতর্ক ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। এই বিতর্কের যেন কোনো শেষ নেই। আদৌ কোনো মীমাংসা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন নেতারা।
ওদিকে যুদ্ধের পূর্বে আর্জেন্টিনার ক্ষমতায় ছিল জান্তা সরকার। জান্তা সরকারের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল লিওপলদো গালতিয়েরি সহসা কোনো সমাধান দেখছিলেন না এ বিতর্কের। আবার দেশে তার সরকারের প্রতি জনগণের আস্থাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল। অর্থনৈতিক মন্দা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জর্জরিত জান্তা সরকার যেকোনো সময় পতন হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা ছিল। এ সময়ে এমন কিছু করতে হবে, যা তার সরকারের ভাবমূর্তি দেশবাসীর কাছে উজ্জ্বল করতে পারে। দলের অন্যদের সাথে আলোচনা করে জান্তা সরকার এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ফকল্যান্ডে সামরিক অভিযান অনুমোদন করে।
আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড দখল
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে আর্জেন্টিনার আক্রমণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা অনেকাংশে দায়ী। ফকল্যান্ডের কাছে অবস্থিত এ দ্বীপ নিয়েও যুক্তরাজ্য-আর্জেন্টিনা দ্বন্দ্ব রয়েছে। যদিও দ্বীপটির ইতিহাস ফকল্যান্ড থেকে আলাদা। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে দ্বীপের তিমি স্টেশনে একটি চুক্তিভিত্তিক কাজের জন্য এক আর্জেন্টাইন বণিক নিযুক্ত হন। তাকে দ্বীপে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় আর্জেন্টিনা নৌবাহিনী। তবে দ্বীপে প্রবেশের পূর্বে তারা যুক্তরাজ্য থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি। ১৯ মার্চ দ্বীপে নিজেদের অধিকার দাবি করে আর্জেন্টিনার পতাকা উড়িয়ে দেয় তারা। এ ঘটনার আকস্মিকতায় ব্রিটিশরা নড়েচড়ে বসে।
আর্জেন্টিনা জান্তা সরকার বুঝতে পেরেছিল, অতি শীঘ্রই ব্রিটিশ নৌবাহিনী এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব জোরদার করতে সামরিক পদক্ষেপ নেবে। তাই বিলম্ব না করে ব্রিটিশদের পূর্বে নিজের ঘুঁটি চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। যুদ্ধ জাহাজে করে নৌসেনাদের সুসজ্জিত করে ফকল্যান্ড এবং দক্ষিণ জর্জিয়া দখল অভিযানে প্রেরণ করে। তখন ফকল্যান্ডের বুকে অবস্থান করা ব্রিটিশ মেরিন সদস্য সংখ্যা ছিল নগণ্য। তাদের ক্ষুদ্র প্রতিরোধ নিমিষেই ভেঙে দেয় আর্জেন্টিনা। রাজধানী স্ট্যানলিতে উড়তে থাকে আকাশি-সাদা পতাকা।
এর কিছুদিন পর দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপও দখলে নেয় আর্জেন্টিনা। এপ্রিলের শেষদিকে আরও ১০ হাজার আর্জেন্টাইন সেনা ফকল্যান্ডের বুকে পদার্পণ করে। এদিকে ফকল্যান্ড দখলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় আর্জেন্টাইন নাগরিকরা। তারা সরকারের সমর্থন জানিয়েছে আনন্দ মিছিল করে রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সসহ বড় বড় নগরীতে। নাগরিকদের সমর্থনে তুষ্ট জান্তা সরকার সামনে থাকা অন্ধকার অনিশ্চয়তাকে পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম হয়। দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো আর্জেন্টিনাকে সমর্থন জানায়। তবে ব্যতিক্রম ছিল চিলি। বিগল প্রণালীর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। চিলি থেকে আক্রমণের ভয়ে আর্জেন্টিনা তাদের সেনাবাহিনীর বড় একটি অংশকে ফকল্যান্ড প্রেরণ থেকে বিরত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় আর্জেন্টিনা।
যুক্তরাজ্যের পাল্টা আক্রমণ
তখন যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় ছিলেন ‘লৌহমানবী’ নামে সমধিক পরিচিত মার্গারেট থ্যাচার। আর্জেন্টিনা কর্তৃক ফকল্যান্ড দখলের খবর আটলান্টিকের ওপারে পৌঁছানোর পর তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়ার জন্য চাপ আসে থ্যাচার সরকারের উপর। আর্জেন্টিনার আক্রমণের প্রত্যুত্তরে রয়্যাল নেভির সদস্যদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে যুক্তরাজ্য। তবে টাস্কফোর্স গঠন করার পরেও এটি ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযান। এর প্রধান কারণ ফকল্যান্ডের অবস্থান ছিল ইউরোপ থেকে প্রায় আট হাজার মাইল দূরে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন নটসহ প্রমুখ রাজনীতিবিদ তাই থ্যাচারকে তাৎক্ষণিক যুদ্ধে না জড়াতে অনুরোধ করেন। তবে তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন থ্যাচার।
তিনি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের মধ্যস্থতায় কূটনীতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে ফকল্যান্ডের উদ্দেশে ৫ এপ্রিল টাস্কফোর্স প্রেরণ করেন। আর্জেন্টিনাকে সমর্থন না করে যুক্তরাষ্ট্র তখন যুক্তরাজ্যের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমেরিকানদের শীতে রসদ পৌঁছানোর কাজ সহজ করতে আটলান্টিকের এস্কেসন দ্বীপে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি থেকে যুক্তরাজ্যকে রসদ সরবরাহ করার আশ্বাস দেয় তারা। ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলো আর্জেন্টিনার সাথে সমস্ত বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
এডমিরাল স্যার স্যান্ডি উডওয়ার্ডের অধীনস্থ টাস্কফোর্সটি দুটো যুদ্ধজাহাজের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। এত দূরে যুদ্ধ করতে গিয়ে যদি কোনোভাবে একটি যুদ্ধজাহাজও ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে যুদ্ধ হেরে বসবে তারা। তাই যুদ্ধবহরে নিয়ে আসা বিমানগুলোর সদ্ব্যবহারের বিকল্প নেই। ওদিকে আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনীও ছিল যথেষ্ট দক্ষ। পরিস্থিতি ব্রিটিশদের অনুকূলে না থাকলেও মার্গারেট থ্যাচার ২৮ এপ্রিল ফকল্যান্ডের চারদিকে ৩২০ কিলোমিটার ব্যাপ্তি অঞ্চলকে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে কাগজে-কলমে শুরু হয়ে যায় ফকল্যান্ড যুদ্ধ।
বিতর্কিত বেলগ্রানো নিমজ্জন ঘটনা
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর পর ব্রিটিশদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল দ্বীপের বুকে সেনাদের পদার্পণ করানো। কিন্তু আর্জেন্টাইন নৌসেনাদের দখলদারিত্বকে হটানো সহজ কাজ হবে না। তাছাড়া হুমকি ছিল আর্জেন্টাইন বিমান বাহিনী। নৌ ও বিমান পথে আর্জেন্টাইনদের আধিপত্য বিনষ্ট করতে ব্রিটিশরা প্রথমে দ্বীপে নোঙর ফেলার ভান করে আর্জেন্টাইন নৌ ও বিমান সেনাদের আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। শুরু হয়ে যায় দুই বাহিনীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সমান তালে চলতে থাকে যুদ্ধ।
যুদ্ধের আড়ালে উডওয়ার্ডের পরিকল্পনা ছিল আর্জেন্টিনার একমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করা। তিনি এই কাজের জন্য ব্রিটিশ ডুবোজাহাজ বাহিনীকে নিযুক্ত করেন। কিন্তু ডুবোজাহাজ এইচএমএস কনকয়ারার তাদের লক্ষ্যে থাকা আর্জেন্টাইন নৌবহর খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। বরং তারা যুদ্ধজাহাজ বেলগ্রানোর সন্ধান পায়। টর্পেডোর সাহায্যে তারা নৌবহরটি নিমেষেই ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। ঘটনায় ৩২৩ জন আর্জেন্টাইন সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন এবং নৌপথে আর্জেন্টাইনদের আধিপত্য শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এ ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কের সূত্রপাত করে। কারণ, আক্রমণের সময় যুদ্ধজাহাজটি ব্রিটিশ চিহ্নিত যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে অবস্থান করছিল এবং তা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঘটনার দু’দিন পর ৪ মে আর্জেন্টাইন বিমান বাহিনী ব্রিটিশ ডুবোজাহাজ এইচএমএস শেফিল্ড নিমজ্জিত করে দেয়। এ ঘটনাকে অনেকে বেলগ্রানোর জবাব হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ফকল্যান্ডে পদার্পণ করল ব্রিটিশ বাহিনী
২১ মে ব্রিটিশ ৫ কমান্ডো ব্রিগেড পোর্ট সান কার্লোসে পদার্পণের মাধ্যমে দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করে। এরপরই ঝাঁকে ঝাঁকে আর্জেন্টাইন বিমান তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। সান কার্লোসের জমিনে আর্জেন্টাইন আক্রমণে ব্রিটিশদের বেশকিছু তরী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ডুবে যায় চারটি তরী। কিন্তু তাদের আক্রমণ ব্রিটিশদের রুখে দিতে ব্যর্থ হয়। মে মাসের শেষদিকে ব্রিটিশ বাহিনী তাদের সিংহভাগ সৈন্য ফকল্যান্ডের মাটিতে পদার্পণ করাতে সক্ষম হয়। জলের যুদ্ধ তখন ডাঙায় গিয়ে পৌঁছে। দ্বীপের ডারউইন অ্যান্ড গুস গ্রিন অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ব্রিটিশ কমান্ডার কর্নেল এইচ জোন্স নিহত হন।
১২ জুনের মধ্যে ব্রিটিশ সেনারা রাজধানী স্ট্যানলির সাথে প্রধান বন্দরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর ফলে আর্জেন্টাইন বাহিনী রসদ সংকটের সম্মুখীন হয়। ফকল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে স্ট্যানলিতে পুনরায় ব্রিটিশ পতাকা উড্ডয়ন করা হয়। রাজধানী দখল করতে গিয়ে মাত্র ৪৭ জন ব্রিটিশ সেনা প্রাণ হারান।
যুদ্ধের পরের ঘটনা
যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদের হাতে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার আর্জেন্টাইন সেনা যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক হয়। আর্জেন্টিনার ৬৫০ জন সৈনিক নিহত হয়। এদের অর্ধেক বেলগ্রানো নিমজ্জনের ফলে মারা গিয়েছিল। অপরদিকে ব্রিটিশদের মাঝে ২৫৫ জন সৈনিক নিহত হয়। বেলগ্রানো নিমজ্জনের পর আর্জেন্টিনার পুরো যুদ্ধে মূল চালকের আসনে ছিল বিমান বাহিনী। অন্যদিকে ব্রিটিশদের বিজয়ের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল তাদের ডুবোজাহাজগুলো। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে দুই দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন। এই যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাজ্যের পুনর্জন্ম হিসেবে বিবেচিত হয়।
মার্গারেট থ্যাচারের সরকার এ যুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করেন। ১৯৮৩ এর নির্বাচনে কনজারভেটিভদের নিরঙ্কুশ বিজয় তার প্রমাণ। অনেকটাই ম্রিয়মাণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল ফকল্যান্ড বিজয়ের মাধ্যমে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার জান্তা সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের এক বছরের মাথায় দেশটিতে জান্তা সরকারের পতন ঘটে।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ বিশ্বমঞ্চে তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হলেও একে নিয়ে বহু আলোচনা, পর্যালোচনা হয়েছে। এর প্রধান কারণ এ যুদ্ধ ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ নিয়মিত যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নানা রকমের অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হয়। প্রযুক্তি ছাড়াও ভৌগোলিক পরিস্থিতির সর্বোচ্চ ব্যবহার, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সুশৃঙ্খল সম্পাদনা একে অনন্য করে তুলেছে। সেনা, নৌ ও বিমান- এই তিন বাহিনী সমানভাবে এ যুদ্ধে লড়েছে। ফকল্যান্ড যুদ্ধকে আধুনিক সমরের দিকনির্দেশক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন যুদ্ধবিদরা। এখন পর্যন্ত এটি অন্য দেশের সামরিক বাহিনীর সাহায্য ছাড়া যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণে সর্বশেষ নিয়মিত যুদ্ধ।