অক্টোবর, ১৯৭২। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট– যা দ্য পোস্ট নামেও পরিচিত, তার সম্পাদক বেন ব্র্যাডলি’র অফিস। উপস্থিত আছেন হ্যারি এম. রজেনফিল্ড, হাওয়ার্ড সিমন্স সহ অন্যান্য সম্পাদকেরা। দ্য পোস্ট ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল নিয়ে তাদের প্রথম প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। বব উডওয়ার্ড আর কার্ল বার্নস্টেইনের করা এই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরপরই চারদিক থেকে চাপ, মিডিয়ার ভাষায় যাকে ফ্ল্যাক (flak) বলা হয়, আসতে শুরু করেছে। সম্পাদকেরা একসাথে বসেছেন এ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য। রিপোর্টটি কি প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়া হবে নাকি সব চাপ উপেক্ষা করা তদন্ত চালিয়ে যাওয়া হবে। বেন ব্র্যাডলি টাইপরাইটার থেকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা ছিল:
We stand by our story.
সেদিন যদি ব্র্যাডলি তার তরুণ দুই সাংবাদিককে সমর্থন না করতেন তাহলে আমেরিকার ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। মার্কিন সাংবাদিকতার দুনিয়ায় বেঞ্জামিন ক্রাউনিনশিল্ড ব্র্যাডলি একটি প্রাতঃস্মরণীয় নাম। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এ সাংবাদিক ও সম্পাদক মার্কিন সাংবাদিকতাকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লড়ার পথ দেখিয়েছেন সেই সত্তরের দশকে। বলা হয় বেন ব্র্যাডলির সাহসী পদক্ষেপের কারণে মার্কিন সংবাদমাধ্যমসমূহ আজকের দিন পর্যন্ত নির্দ্বিধায় ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করতে পারে। ব্র্যাডলি যদি সেদিন সম্পাদকের আসনে না থাকতেন তাহলে পেন্টাগন পেপার্স হয়তো এত ফলাও করে জনসমক্ষে প্রকাশ পেত না, উডস্টেইন জুটির ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির প্রতিবেদন ছাপার অক্ষরে দেখা যেত না। নিক্সন সরকারকেও পদত্যাগ করতে হতো না।
বেন ব্র্যাডলির হাত ধরেই দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট স্থানীয় পত্রিকার গণ্ডি পার হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ভূয়সী প্রশংসিত পত্রিকা হিসেবে নবরূপ লাভ করে। পেন্টাগন পেপার্স ব্র্যাডলির নেতৃত্বেই প্রকাশিত হয়। ঠিক তেমনিভাবে বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইনের ওয়াটারগেট স্কুপের ক্ষেত্রেও সব চাপ, ঝুঁকি উপেক্ষা করে নিজের সাংবাদিকদের সমর্থন দিয়ে যান তিনি। এ দুই বিরাট সাফল্যের পর আবার হোঁচটও খান সম্পাদক হিসেবে। জ্যানেট কুকের পুলিৎজারজয়ী নিউজস্টোরি প্রকাশের পর জানা যায় তা ছিল আগাগোড়া বানোয়াট। তবুও তাতে খুব একটা দাগ পড়েনি ব্র্যাডলির বিচিত্র কর্মজীবনে। স্থানীয় নিউজপেপারের কপি বয় হিসেবে সাংবাদিকতার শুরু করলেও শেষ করেন একজন সফল সাংবাদিক, ও ব্যক্তিত্ব রূপে।
প্রাথমিক জীবন
জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। বাবা ছিলেন ধনী ব্যাংকার। মায়ের পরিবার ছিল অভিজাত। এক পিতামহ ছিলেন ভ্যানিটি ফেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২১ সালের ২৬ অগাস্ট বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসে জন্ম নেন ব্র্যাডলি। আট বছর পর্যন্ত বেশ আয়েসেই পার হয় তার জীবন। বনেদি বাড়ির ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা যেমনটা কাটে, ব্র্যাডলিও সেরকম কিছু সুযোগসুবিধার মধ্য দিয়ে তার বাল্যকাল কাটিয়েছিলেন বাকি দুই ভাইবোনের সাথে।
বাড়িতে শিক্ষয়িত্রী রেখে ব্র্যাডলিদের ফরাসি ভাষা শেখানো হয়। পিয়ানো বাজানোর বিদ্যা, ঘোড়সওয়ারির কাজটাও তখনই শেখেন। কিন্তু ১৯২৯-এর মহামন্দা সবকিছু পাল্টে দেয়, ব্র্যাডলির বাবা বলতে গেলে কপর্দকহীন হয়ে পড়েন। সংসার সামলাতে তাকে বিভিন্ন কোম্পানির হিসেবের খাতা দেখা শুরু করতে হয়। পাশাপাশি বোস্টন মিউজিয়ামের জ্যানিটরদের ম্যানেজার হিসেবেও কাজ নিতে হয় ফ্রেডেরিক ব্র্যাডলি জুনিয়রকে।
আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই ছিলেন পয়সাওয়ালা, তাদের সাহায্যে বেসরকারি সেইন্ট মার্কস স্কুলে ভর্তি হন ব্র্যাডলি। স্কুলে থাকাকালীন পোলিও আক্রান্ত হন তিনি। শরীরের নিচের দিক প্রায় অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি আর নিয়মিত ব্যায়ামের জোরে পোলিওকে পুরোপুরি পরাস্ত করে আবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। স্কুলের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলা হয় পুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন হার্ভার্ডে ভর্তি হওয়া ৫২ তম ব্র্যাডলি। হার্ভার্ডে ইংরেজি ও ধ্রুপদী গ্রিক বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন।
ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ব্র্যাডলি ও তার বন্ধুরা জানতেন যুক্তরাষ্ট্রও কোনো না কোনো একসময় এ যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাভাল আরওটিসি-তে (নৌবাহিনীর রিজার্ভ কোর) যোগ দেন। ১৯৪২ সালের যেদিন তিনি গ্র্যাজুয়েট হন, সেদিনই মার্কিন নেভিতে অফিসার হিসেবে কমিশন্ড হয় তার। নেভিতে যোগদানের আগে কলেজের গার্লফ্রেন্ড জিন স্যালটনস্টলকে বিয়ে করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ফিলিপ-এ দায়িত্ব পালন ছাড়াও গুয়াদোকানাল, গুয়াম ইত্যাদি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৌযুদ্ধ দ্য ব্যাটল অভ লেইট গাল্ফ-এ যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে এসে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি
দ্য নিউ হ্যাম্পশায়ার সানডে নিউজ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি। ছোট্ট এ পত্রিকাটিতে মাত্র সাতজন সাংবাদিক কাজ করতেন। কিন্তু পত্রিকাটি আর বড় হতে পারেনি। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে ১৯৪৮ সালে এ পত্রিকা থেকে ইস্তফা দেন। তবে সাংবাদিকতার অনেক কিছু শিখেছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক রালফ এম. ব্ল্যাগডেনের কাছ থেকে। নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছিলেন, “তাকে (ব্ল্যাগডেন) দেওয়া প্রতিটা উত্তরের জন্য তিনি আরও ৫০টা প্রশ্ন তৈরি করতেন। দু’ বছরে তার কাছ থেকে আমি সব শিখে নিই।”
১৯৪৮ সালের নভেম্বরে ট্রেনে চেপে বসেন বেন ব্র্যাডলি, উদ্দেশ্য নতুন চাকুরির সন্ধানে যাত্রা। পরিচিত জনদের তদবিরে দুটো পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের জন্য তার ডাক পড়ে। এর একটি ছিল দ্য বাল্টিমোর সান, অপরটি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। প্রথমে বাল্টিমোরে থামার কথা থাকলেও স্টেশনে ভীষণ বৃষ্টি দেখে সেখানে না নেমে সোজা ওয়াশিংটন চলে যান। অফিসে সাক্ষাৎকার দিয়ে চাকুরিটাও হয়ে যায়। সপ্তাহে ৮০ ডলার মাইনেতে প্রথমবারের মতো দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
নতুন কর্মজীবন
উচ্চাভিলাষী ব্র্যাডলির লক্ষ্য ছিল জাতীয় পর্যায়ে বড়সড় স্টোরি কাভার করা। কিন্তু দ্য পোস্ট তখনও নিতান্তই ছোট পত্রিকা। তার ওপর বছরে এক মিলিয়ন ডলার করে হারাচ্ছিল সেসময়ই। ব্র্যাডলি দেখলেন এখানে বসে বসে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এক বন্ধু তাকে প্যারিসে মার্কিন দূতাবাসে প্রেস অ্যাটাচি হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা জানান। দ্য পোস্ট-এর কাজ ছেড়ে নতুন চাকুরি নিয়ে প্যারিস চলে যান ব্র্যাডলি।
প্যারিসের দিনগুলো ভালোই কাটছিল তার। কিন্তু আবার আমলাতান্ত্রিক জীবনও ধাতে সইছিল না। এমন অবস্থায় ফের সাংবাদিকতায় ফেরার সুযোগ আসে তার কাছে। আড়াই বছর দূতাবাসে কাজ করার পর নিউজউইক-এ যোগ দেন তিনি। ম্যাগাজিনটির আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি হিসেবে সোৎসাহে নতুন করে সাংবাদিক-জীবন শুরু করেন। নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
একজন আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার তীব্র আনন্দ আর রোমাঞ্চ ব্যাখ্যা করা কঠিন, অতিশয়োক্তি করাটা তো আরও কঠিন।
চার বছরের সাংবাদিকতায় তিনি আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম, মধ্যপ্রাচ্য, জেনেভায় বিভিন্ন শান্তিসম্মিলন ইত্যাদি কাভার করেন। প্যারিসে থাকাকালীন এক পার্টিতে ব্র্যাডলি’র সাথে সাক্ষাৎ হয় অ্যান্টয়নেট ‘টনি’ পিঞ্চোট পিটম্যান-এর সাথে। প্রথম দেখায় দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে যান। ব্র্যাডলি আর পিটম্যান দুজনই বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু তাদের ভালোবাসার জোরে দুজনেরই ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর পিটম্যান-ব্র্যাডলি জুটি বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেন।
দ্য পোস্ট-এ ফেরা
১৯৫৭ সালে আবারও ব্র্যাডলির জীবনে নতুন মোড় আসে। স্ত্রী টনিকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। তখন নিউজউইক ম্যাগাজিনের বিক্রির কথা চলছিল। ম্যাগাজিনটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অসবর্ন এলিয়টের কাছ থেকে খবরটি জানতে পারেন ব্র্যাডলি।
ফিলিপ এল. গ্রাহাম ছিলেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর তৎকালীন প্রকাশক ও মালিক। নিউজউইক-এর বিক্রির খবর তার কানে তোলেন ব্র্যাডলি। ব্র্যাডলিকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন দুজন। কয়েকদিনের ভেতর ১৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে নিউজউইককে কিনে নেয় দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট কোম্পানি।
এই ঘটনাটুকুই ব্র্যাডলির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এক লাফে ধনী হয়ে যান বেন ব্র্যাডলি। ফাউন্ডার্স ফি হিসেবে ফিল গ্রাহাম ব্র্যাডলিকে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কিছুটা শেয়ার হস্তান্তর করেন। দিনে দিনে তা কয়েক মিলিয়ন মূল্যমানে গিয়ে দাঁড়ায়।
নতুন করে সাংবাদিকতা শুরু করেন ব্র্যাডলি। নিউজউইক-এর ওয়াশিংটন ব্যুরোর প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ওয়াশিংটনের সাংবাদিকতার মূলধারার সাথে যুক্ত হন ব্র্যাডলি। দ্য পোস্ট-এর অনেকের সাথে তার সুসম্পর্ক তৈরি হয়। বিশেষত গ্রাহাম পরিবারের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করেন ব্র্যাডলি।
ব্র্যাডলির জীবনে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু ছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি। ১৯৫৭ সালে জর্জটাউনের এন. স্ট্রিটে কেনেডি আর ব্র্যাডলি দুজনেই বাড়ি কেনেন। প্রতিবেশির সম্পর্ক ক্রমশ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তখন অবশ্য কেনেডি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। জন এফ. কেনেডি ছিলেন ব্র্যাডলির সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোর্স।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে দেশটির একটি প্রথম সারির দুঁদে সাংবাদিকের এত দহরম-মহরম নিয়ে অবশ্যই চতুর্দিকে নানা গুঞ্জন উঠেছিল। ব্র্যাডলির ক্ষমতা ছিল প্রভাবশালী, স্মার্ট, চমৎকার ব্যক্তিত্বের মানুষদের সাথে খুব সহজে সম্পর্ক তৈরি করে ফেলার। তবে কখনো নিজের সাংবাদিকতা সত্তাকে ভুলে যাননি তিনি।
জন এফ. কেনেডির সাথে অনেক নারীর, এমনকি ব্র্যাডলির শ্যালিকা পিঞ্চোট মেয়ারের সাথেও সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ব্র্যাডলি দাবি করেছেন, বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের এসব সম্পর্কের খবর ঘুণাক্ষরেও জানতেন না তিনি। তাদের বন্ধুত্ব মূলত ব্র্যাডলির সাংবাদিকতার জন্য দারুণ সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। কেনেডির কাছ থেকে অনেক স্কুপ পেয়েছিলেন ব্র্যাডলি। একই কারণে রাজধানীর প্রভাবশালী ও এলিট সাংবাদিক সমাজের মধ্যে নিজেকে খুব সহজেই যুক্ত করে নিতে পেরেছিলেন।
[আগামী পর্বে পড়ুন কীভাবে পেন্টাগন পেপার্স, ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল, পুলিৎজার স্ক্যান্ডাল সামলেছিলেন বেঞ্জামিন সি. ব্র্যাডলি।]