টেলিভিশন ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোগ্রামগুলোর কথা ভাবা যাক। ফ্রেন্ডসের মতো জনপ্রিয় শো একইসাথে পঞ্চাশ মিলিয়নের বেশি মানুষ দেখার রেকর্ড আছে। এই সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়। কিন্তু, ইউটিউবের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওগুলো মাত্র আধাঘন্টার মধ্যে এই সংখ্যাটি পার হয়ে যায়। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, এইচবিওর সম্মিলিত ভিউর চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে ইউটিউবের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওগুলো।
আজকের যুগে ইউটিউবের এই স্রোত অনস্বীকার্য। প্রতি মিনিটে সব মিলিয়ে ৫০০ ঘন্টারও বেশি দৈর্ঘ্যের ভিডিও আপলোড হচ্ছে এবং প্রতিদিন এখানে সম্মিলিতভাবে এক বিলিয়ন ঘন্টা দৈর্ঘ্যের বেশি ভিডিও দেখা হয়। ইউটিউবের সার্চ অপশনটি গুগলের পরে সবচেয়ে বড় সার্চ ইঞ্জিন। আপনি নিজের প্রিয় খাবারের রেসিপি জানতে চান? গিটার শিখতে চান? যা-ই শিখতে চান বা দেখতে চান, সবই ইউটিউবে কেবল একটি সার্চের দূরত্ব। এটা বিনোদনের একটি অবিরাম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৫ বছর আগে ইউটিউব যখন যাত্রা শুরু করেছিল, অনলাইনে ভিডিও শেয়ার করার ধারণাতে তখন একটি বিপ্লব তৈরি করে। এরপরে ভিডিও পোস্ট কিংবা শেয়ার করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। সময়টা তখন এমনই ছিল যে, বেশিরভাগ মানুষ ক্যামেরা ফোনের সাথে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করেছে এবং বাজারে এটি প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এরপরে ইউটিউবকে পেছনে দিরে তাকাতে হয়নি। প্রতি মাসে দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই সাইটটিতে ভিজিট করে। গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেটের জন্য ইউটিউব একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ২০১৯ সালে ইউটিউবের আয় ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার এবং এই বছরে সেপ্টেম্বর মাসেই তা ১৩ বিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
ইউটিউব এমন একটি মাধ্যম, যেখানে একটি ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমেই যে কারো মিলিয়নেয়ার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীতে কনটেন্ট তৈরির সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি হচ্ছে, ব্যবহারের জন্যে ইউটিউব তার কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করে না। তাই কনটেন্টের বিশাল ও বৈচিত্র্যময় আকার এবং পৃথিবীর সব জায়গা থেকে ব্যবহারের সুবিধার সাথে ‘বিনামূল্য’ একে প্রচন্ড শক্তিশালী করে তুলেছে। কিন্তু এই ক্ষমতাটি নিয়ন্ত্রণ করা এত সহজ হিসেবে ধরা দিচ্ছে না। বেশ লম্বা সময় ধরেই ইউটিউব অনেকগুলো বিতর্ক, মামলা এবং নতুন ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হচ্ছে। ভিডিও লাইব্রেরি এত বড় হয়ে উঠেছে যে, যত কনটেন্ট প্রতিনিয়ত আপলোড হচ্ছে, তার সাথে তারা সবসময়ে তাল মেলাতে পারছে না।
পেপালের তিনজন সাবেক কর্মী চ্যাড হার্লি, স্টিভ চেন ও জাভেদ করিমের হাতে ইউটিউব ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রথম আইডিয়া ছিল অনলাইন ভিডিও ডেটিং সাইট হিসেবে ইউটিউব সেবা দিবে। কিন্তু পর্যাপ্ত আপলোডের অভাব তাদেরকে একটি পরিবর্তনের মুখোমুখি করে। ভিডিও হোস্ট করে তা শেয়ার করার মতো ছোট আইডিয়াটি যে এত প্রভাবশালী হয়ে উঠবে, সে সময়ে তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ওই বছরের শেষে, ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে ইউটিউব আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সে সময়ে সাইটটি দিনে ৮ মিলিয়ন করে ভিউ পাচ্ছিল। শুরুর সময়ে ইউটিউব যে কারণে পরিচিত হয়েছিল, সেটাকে বলা হয় ‘ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট’।
‘চার্লি বিট মাই ফিংগার’ কিংবা ‘ডেভিড আফটার ডেন্টিস্টে’র মতো ভাইরাল ভিডিওগুলো শুরুর এই সময়ে ইউটিউবকে মানুষের কাছে পরিচিত করে। এরপর অনেকে স্যাটারডে নাইট লাইভ টিভি শোয়ের বিভিন্ন ক্লিপ এখানে আপলোড করা শুরু করেছিল। এভাবে ইউটিউব তখন মূলধারার মিডিয়াতে পরিচিত হয়। মিউজিক ভিডিওগুলোর আনঅফিশিয়াল আপলোড কয়েক মাসের মধ্যেই সর্বমোট পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ পেয়েছিল। এর মাধ্যমেই ইউটিউব কয়েকবছর লম্বা সময়ের একটি সংগ্রামের মুখোমুখি হয়, যেটা হচ্ছে কপিরাইট মামলা।
স্যাটারডে নাইট লাইভ শো এবং তার স্বত্বাধিকারী এনবিসি ইউটিউবে আপলোড হওয়া আনঅফিশিয়াল ভিডিও ক্লিপগুলোকে কপিরাইটের লঙ্ঘন বলে দাবি করে। এই মামলাটি নিষ্পত্তি করতে ইউটিউবকে একটি বড় পথ পাড়ি দিতে হয়, যেখানে কোম্পানিটি আইনগত একটি নীতিমালা তৈরি করতে পারে। বিনোদন মাধ্যমের লোকেরা একটি বড় সময় পর্যন্ত ইউটিউবকে প্রচারমূলক মাধ্যম হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। অথচ, কেউই এখন নতুন গান, সিনেমা অথবা টিভি সিরিজ ইউটিউবে ঘোষণা না করে বাজারে ছাড়ে না।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে ইউটিউব ঘোষণা করেছিল যে, সাইটটি প্রতিদিন ১০০ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ভিউ পাচ্ছে। গুগল সে সময়ে নিজেদের ভিডিও প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই ইউটিউব একটি বড় অডিয়েন্স তৈরি করে ফেলেছিল। গুগল তাই ইউটিউব কিনে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারের মাধ্যমে ইউটিউবকে গুগল কিনে নিয়েছিল। সে সময়ে, এটাই গুগলের সবচেয়ে মূল্যবান চুক্তি ছিল। ইউটিউবের প্রতিষ্ঠাতাদের বয়স তখন ত্রিশও পেরোয়নি। অনেকে এই চুক্তিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, এটি যে উভয়ের জন্যই লাভজনক ছিল, তা আজকের দিনে সহজেই বোঝা যায়।
ইউটিউবকে অনেকটা ইন্সটাগ্রামের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়, একটি বৃহত্তর প্যারেন্ট কোম্পানির প্রভাব না থাকলে, তাদের এত বড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। তাই গুগলের এখানে ক্রেতা হিসেবে বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে, ইউটিউব গুগলের অন্যতম বড় মুনাফাধারী ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। এর বিজ্ঞাপন থেকে যে মুনাফা আসে তা গুগলের ক্লাউড ব্যবসাকে অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীর তালিকায় ইউটিউব একটি বড় জায়গা ধরে রেখেছে।
গত পনেরো বছর ধরে ইউটিউবে অনেক পরিবর্তন দেখা গেছে। প্রথমদিকে, মানুষ একে শুধুমাত্র মজার ভিডিও শেয়ার করার মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করেছিল। পরে এটি আর্টিস্টদেরও প্রিয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউটিউবে নিজের গান গাওয়ার ভিডিও আপলোড করে মিউজিক এজেন্টদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল তখন। জাস্টিন বিবারের মতো বড় পপস্টারের শুরুটাও এভাবেই হয়েছিল। নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের, বড় অডিয়েন্সের আকর্ষণ তৈরির জন্যে যাদের একটি প্ল্যাটফর্ম দরকার ছিল, ইউটিউব তাদেরকে এই জায়গাটি দিয়েছে। এভাবে বিনোদন মাধ্যমে ইউটিউব একটি বড় পরিবর্তন তৈরি করেছে।
২০০৭ সালে, ইউটিউব পার্টনার প্রোগ্রাম শুরু করেছিল যার মাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তাদের চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা শুরু করে। এর ফলে এমন একটি ক্যারিয়ারের সৃষ্টি হয়েছে, যা আগে ছিল না। এটা এমন একটা জায়গা তৈরি করেছে যে, একটি সম্পূর্ণ ব্যবসা শুরু না করে, বিজ্ঞাপন কিংবা সেলস ডিপার্টমেন্ট ছাড়াই, ডিজিটাল স্পেসে কিছু তৈরি করে উপার্জন করা যায়। প্রথমদিকের অনেক ইউটিউবার এভাবে এই সাইটে আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার তৈরি করে। এরকম অনেক নির্মাতা রয়েছে যারা শুধুমাত্র ইউটিউব থেকেই প্রতি মাসে মিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে।
ইউটিউব তার মাধ্যমের নির্মাতাদেরকে উৎসাহিত করতে অনেকগুলো সুবিধা যোগ করেছে। কনটেন্ট টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর জন্যে সবরকম সুযোগ সুবিধা ইউটিউবে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, ইউটিউবের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গুগল তার সার্চ ইঞ্জিনের শক্তি এখানে যোগ করেছে, এর রেকমেন্ডেশন ও সার্চ অ্যালগরিদমটি এখানে প্রয়োগ করেছে। কনটেন্ট ক্রিয়েটরের পাশাপাশি এই অ্যালগরিদমের উত্থানও ইউটিউবের বিশাল সফলতার একটি কারণ। আপনার যে ধরনের কনটেন্টের প্রতি আগ্রহ রয়েছে, সেটি এখানে সহজেই খুঁজে পাবেন। এরপরে আপনি যেসব ভিডিও দেখেছেন তা বিশ্লেষণ করে রিকমেন্ডেশন ইঞ্জিনটি আপনার পছন্দ হবে, এরকম অন্যান্য ভিডিও চোখের সামনে নিয়ে আসতে পারে।
ইউটিউবের তুমুল সাফল্যের এটি আরেকটি কারণ। প্ল্যাটফর্মটি প্রধানত আপনি কাকে সাবস্ক্রাইব করেছেন কিংবা কী ধরনের ভিডিও আপনি প্রতিনিয়ত দেখেন সে অনুযায়ী আপনার চাহিদা বুঝতে পারে। আবার, অন্যেরা কী পছন্দ করছে সে অনুযায়ী আপনাকে নতুন ধরনের ভিডিও সাজেস্ট করে এবং প্রতিনিয়ত এটি এখানে দক্ষ হয়ে উঠছে। এর ফলে আপনি ইউটিউবে একবার ঢুকলে সহজে আর বের হতে পারেন না, এবং এটাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য যেন আপনি এখানে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেন। গুগল এই ব্যয় করা সময়গুলো থেকেই তাদের উপার্জন খুঁজে নেয়।
নেটফ্লিক্স, হুলু এবং প্রাইম ভিডিওর মতো স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, ইউটিউব নিজেদের কনটেন্টে তখন বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছিল। তাই, ‘ইউটিউব অরিজিনাল’ নামে তারা নিজেদের একটি স্ট্রিমিং সার্ভিস তৈরি করেছিল। গত দুই বছরে এখান থেকে ৫০টির মতো কনটেন্ট মুক্তি পেয়েছে। তবে এটি আশানুরুপ ভালো করতে পারেনি। নেটফ্লিক্স অরিজিনালে যেরকম ভিউ দেখা যায়, ইউটিউব অরিজিনালে তা দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া, এই ধরনের কনটেন্টের বাজার এখন প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক। তাই ইউটিউবকে তাদের ফোকাস ধীরে ধীরে আবার ইউজার জেনারেটেড কনটেন্টেই নিয়ে যেতে হয়েছে। ইউটিউব প্রিমিয়াম, ইউটিউব মিউজিক ও ইউটিউব টিভির মতো পেইড সাবস্ক্রিপশনগুলোও তারা বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে। ইউটিউব টিভির এখন তিন মিলিয়নেরও বেশি পেইড সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। ইউটিউবের সাবস্ক্রিপশনের জন্য টাকা খরচ করা অনেক গ্রাহকের জন্যেই সহজ নয়। কারণ ইউটিউব সবসময়ে তার অডিয়েন্সদের একটি বিনামূল্যের প্ল্যাটফর্ম সেবা দিয়ে এসেছে এবং সবাই তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই ইউজার জেনারেটেড কনটেন্টই ইউটিউবের উপার্জনের প্রধান জায়গা হিসেবে রয়ে গেছে।
ইউটিউবের অন্যতম বড় ক্যাটাগরি হচ্ছে মিউজিক। সবচেয়ে বেশি ভিউ করা ভিডিওগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে মিউজিক ভিডিও। শুরুর সময় থেকেই ইউটিউব এমন একটি জায়গা ছিল, যেখানে অনেকে গান শুনতে ইউটিউবে প্রবেশ করতো। আবার কোচেলার মতো বড় মিউজিক উৎসব ইউটিউবে লাইভ স্ট্রিম হয়। তাই যারা এখানে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারছে না, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা উৎসবটি তারা ইউটিউবে দেখতে পাচ্ছে।
ইউটিউব তার প্লেয়ারটির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেছে, যেন বিজ্ঞাপনগুলোকে ইন্টার্যাকটিভ করা যায়। লিংক যুক্ত করা হয়েছে যেন ক্রেতারা সরাসরি পণ্য কেনার পেজে চলে যেতে পারে। এখন তাই কোনো পণ্য কেনা শুধুমাত্র বাটনের একটি ক্লিকে পরিণত হয়েছে। ইউটিউবে লাইভস্ট্রিম যুক্ত করার পরে তার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। আরেকটি জনপ্রিয় ক্যাটাগরি হচ্ছে ইউটিউব কিডস। এই চ্যানেলগুলো ইউটিউবের সবচেয়ে ভিউ হওয়া চ্যানেলের অন্যতম, যাদের সম্মিলিতভাবে কয়েকশ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। ২০১৫ সালে, ইউটিউব শুধুমাত্র বাচ্চাদের চ্যানেলের জন্যে ইউটিউব কিডস অ্যাপ তৈরি করেছিল।
ইউটিউবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন ছিল কনটেন্ট আইডি। এটা একটা ব্যাক-এন্ড প্রযুক্তি যার মাধ্যমে স্বত্বাধিকারদের কী ধরনের ভিডিও অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে তা নজরে রাখা যায়। কনটেন্ট মডারেশনও আবার ইউটিউবের সবচেয়ে বড় একটি বাধা। কোন ভিডিওটি মুছে ফেলতে হবে, কোনটি রাখতে হবে তা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই কন্সপিরেসি ভিডিও ও ঘৃণা ছড়ানোর মতো ভিডিও আপলোড করছে। ইউটিউব অবশ্য এরকম ভিডিওগুলোতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালে তারা অনেকগুলো নীতি পরিবর্তন করেছে। সেখানে বর্ণবাদ ও লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধে কঠিন নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো অবশ্য অনেকগুলো অপ্রীতিকর প্রতিক্রিয়ার পরে এসেছে।
ইউটিউবের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মিথ্যা সংবাদ ফিল্টার করা। সাধারণ মানুষ ইউটিউব, ফেসবুক এবং টুইটারের মতো জায়গাগুলো থেকে খবর সংগ্রহ করার মাত্রা বাড়িয়েছে, যেখানে সবসময়ে সত্য খবর পাওয়া যায় না। কিছু মিথ্যা মেডিক্যাল সংবাদের ব্যাপারে ইউটিউব অবশ্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা নতুন একটি পলিসি তৈরি করেছে যেখানে এরকম ভিডিওগুলো নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু অনেক কনটেন্টের ব্যাপারেই তাদের সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ছে। এই বছরে, কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের মিথ্যা খবরের বিরুদ্ধে তারা নীতি গ্রহণ করেছে।
সবগুলো সামাজিক নেটওয়ার্ক কোম্পানি আশা করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তারা অনুপযুক্ত কনটেন্ট ফিল্টার করবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো এখনও এই ব্যাপারটিতে সফল হতে পারেনি। ইউটিউব এখনও এরকম অনেকগুলো মামলা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। ফেসবুকও এরকম মামলার মুখোমুখি হচ্ছে। গত বছর শুধুমাত্র বিতর্কিত কনটেন্ট নিয়ে কাজ করবে এরকম দশ হাজারেরও বেশি মানুষ নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছে তারা। ইউটিউব অবশ্য অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর তুলনায় বিতর্কিত কনটেন্টে অনেক দ্রুত সাড়া দেয়।
ইউটিউব ধীরে ধীরে বিভিন্নরকম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। ফেসবুক, টিকটক ও স্ন্যাপের মতো সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন ও ডিজনি প্লাসের মতো স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করছে। তবে ইউটিউব তার মোবাইলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অনেক এগিয়ে রয়েছে। প্রথম পাঁচটি বিনোদন অ্যাপের মধ্যে তাদের অ্যাপ ৭০ শতাংশ সময় ব্যবহার হয়। কনটেন্ট তৈরি করার জন্য নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনের মতো সার্ভিসগুলোকে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করতে হয়। ইউটিউবের সেই খরচটি নেই। এই জায়গায় ইউটিউব ভালো রকম সুবিধা ভোগ করছে।
ইউটিউবের এখন সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে টিকটক। এই অ্যাপটি বিদ্যুতের মতো পুরো দুনিয়াকে গ্রাস করে ফেলেছে। তাছাড়া, টিকটকের কনটেন্টগুলো ইউটিউবের প্রথমদিকের কনটেন্টের থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। টিকটক শুরু হয়েছিল ক্যারিওকি মিউজিকের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। এখন মিউজিকের সাথে কমেডি, ড্যান্স ও বিভিন্ন পারফরম্যান্স যুক্ত করে আপলোড করা হয়। ইউটিউবে শুরুর দিকে দেখা যেত এরকম অনেক কনটেন্টই এখন টিকটকে পাওয়া যাচ্ছে, তাই এটি ইউটিউবের পথে পুরোপুরি হাঁটা শুরু করলেও অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। টিকটকের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্যে ‘ইউটিউব শর্টস’ নামের প্ল্যাটফর্ম শুরু করেছে। টিকটকের অনেক ফিচারই এখানে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে।
ইউটিউবের এখন যে বিশাল সাম্রাজ্য রয়েছে, এখানে পৌঁছতে হলেও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ইউটিউব যে ধরনের বৈচিত্র্যময় কনটেন্টের উৎস হয়ে উঠেছে, তা এককথায় অতুলনীয়। ইউটিউব তার বিভিন্ন ধরনের গ্রাহককে পর্যবেক্ষণ করেছে, তারা কী দেখতে চায় তা বোঝার চেষ্টা করেছে। এভাবে তাদের জন্য একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে ফেলেছে এবং নির্মাতাদেরকে তাদের কনটেন্ট তৈরির জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এই মডেলটি এতই ভালো কাজ করছে যে, সুদূর ভবিষ্যতেও প্রতিযোগিতার দিক থেকে ইউটিউব নিরাপদ তা বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে উপলব্ধি করা যায়।