(সাইরাস (পর্ব-৩) এর পর থেকে) গল্পের পরবর্তী অংশে প্রবেশের আগে সাইরাসের প্রাসঙ্গিকতা ধরে আরেকটু আলোচনা আবশ্যক। অন্তত কেন সাইরাস পৃথিবীর অন্যান্য শাসকের চেয়ে আলাদা, সেটা। শুরুতেই উঁকি দেয় ইহুদি-খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব এবং ইসলামি চিন্তায় সাইরাসের অবস্থান। অবশ্য আজকের আলোচনা কেবল ইহুদি-খ্রিষ্টান ঐতিহ্য অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ।
অদ্ভুতভাবে সাইরাসের জীবন ইসরায়েলি নবী মুসা (আ.)- এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মুসা (আ.)-এর জন্মের আগেই ভবিষ্যদ্বক্তার মাধ্যমে বিপদ আঁচ করতে পারে ফিরাউন। প্রত্যেক হিব্রু পুত্র সন্তানকে নীল নদে ফেলে দেবার আদেশ জারি করে। শুরু হয় ভয়াবহ তাণ্ডব। অথচ নবী মুসা কেবল বেঁচেই যাননি, খোদ ফেরাউনের ঘরেই লালিত পালিত হয়েছেন। পরবর্তীতে আবির্ভুত হয়েছেন নিজ জাতির পরিত্রাতা হিসেবে।
সাইরাসের ক্ষেত্রেও খুব একটা বিচ্যুতি ঘটেনি বিবরণীতে। অস্তাইজেস তাকে হত্যার চেষ্টা করে। অথচ ঠিকই ফিরে আসে এবং পালিত হয় রাজদরবারে। নবী মুসার মতো সাইরাসও স্বীয় জাতির মুক্তিদাতায় পরিণত হয় পরবর্তী জীবনে। পার্থক্য এতোটুকুই যে, মুসা বনি ইসরায়েলকে নিয়ে মিশর ত্যাগ করলেও জেরুজালেমের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। আর সাইরাস পারসিকদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে নতুন সাম্রাজ্য। পারস্যের সাথে সাথে দখল করে নেন খোদ মিদিয়ার রাজধানী একবাটানা।
সাইরাসের সাথে নবী সোলায়মানের সাদৃশ্য অপেক্ষাকৃত কম। সোলায়মান (আ.) রাজদণ্ড ধারণের ক্ষমতা পেয়েছিলেন। আধিপত্য করেছেন অন্য জাতির উপরেও। নির্মাণ করে গেছেন ইবাদতগাহ। সাইরাসও রাজদণ্ড পেয়েছে। বহু জাতিকে অধীনস্ত করেছে। বিধ্বস্ত জেরুজালেমে পুনরায় স্থাপন করতে চেয়েছে ইবাদতগাহ।
প্রথমত সাইরাস সেই বিশেষ মানুষদের একজন, যার ব্যাপারে বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। নবী ইসায়াহর জীবনকাল সাইরাসের দেড়শো বছর আগে। তখনো ইহুদি জাতি ব্যাবিলনে আসেনি। ক্রমবর্ধমান পাপে নিমজ্জনের দরুণ বারবার সাবধান করতে আগমন করছেন বিভিন্ন নবী। অনিবার্য ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরেছেন। ইসায়াহ তাদের একজন। সত্যিই ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুকাদনেজার হামলে পড়েন জেরুজালেমের উপর। আরবি ইতিহাসে এই নেবুকাদনেজারই বখতে নসর নামে পরিচিতি লাভ করেছে। যা-ই হোক, তার মাধ্যমে শুরু হয় ইহুদি ইতিহাসে বন্দিদশার যুগ। প্রায় সত্তর বছর পরে সাইরাসের ব্যাবিলন পদানত করার মাধ্যমে মুক্ত হয় ইহুদিসহ সমস্ত বন্দি। নবী ইসায়াহর মুখ দিয়েই খোদা বলেছেন,
‘কে প্রাচ্য দিক থেকে আসার জন্য এক ব্যক্তিকে উত্তেজিত করছেন? ন্যায়বান খোদা তার কাজের দিকে ডাকছেন? তিনি সেই ব্যক্তির হাতে জাতিগুলোকে তুলে দেবেন। তার সামনে নত করবেন সম্রাটদের। তার তলোয়ার দিয়ে তাদের ধুলার মতো করবে আর তার ধনুকের সামনে বাতাসে নাড়ার মতো তাদের উড়িয়ে দেবে। সে তাদের তাড়া করবে। যে পথে সে আগে কখনো চলেনি, সেই পথে চলবে নিরাপদে।’ (বাইবেল, বুক অব ইসায়াহ, ৪১:২)
অবশ্য নবী ইয়ারমিয়া ছিলেন আরো স্পষ্ট। তার বক্তব্য ছিল আরো সরাসরি। জেরুজালেমের প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে। ভেঙে ফেলা হবে প্রাচীর। তছনছ করে দাস বানিয়ে নেয়া হবে এহুদার জনগনকে। যদি ইসরায়েলের মানুষ সতর্ক না হয়, যদি মূর্তিপূজায় বুঁদ হয়ে থাকে, তবে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে নেবুকাদনেজারের ক্রোধ। জেরুজালেমের পরিণতি এতটাই ভয়াবহ হবে যে, একটা ইটের উপর আরেকটা ইট অবশিষ্ট থাকবে না। অন্তত সত্তর বছরের জন্য ইহকালীন শাস্তি। শাস্তির মেয়াদ পূরণ হলে তবেই তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। সেই দায়িত্বের জন্য নিযুক্ত হয়েছেন এক রাজা। স্পষ্টত সেই ইশারা করা রাজাই সাইরাস।
‘পূর্ব দিকের এক ব্যক্তি আমার নাম ঘোষণা করবে। আমি তাকে উত্তর দিক থেকে আসার জন্য উত্তেজিত করছি আর সে আসছে। যেমন চুন-সুরকি এবং পানি মেশানো হয় আর কুমার মাটি দলাই মলাই করে; তেমনি করে সে শাসনকর্তাদের পায়ে দলবে।’ (বাইবেল, বুক অব ইসায়াহ, ৪১:২৫)
ইহুদিরা তখন সত্যিই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। নবীদের প্রত্যাখ্যান এমনকি হত্যা, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ইন্দ্রিয়সুখের প্রতি অতি আকর্ষণের কারণে ভুলে বসে খোদার নির্দেশন। বিভাজিত হয়ে যায় ইসরায়েল এবং এহুদা নামে দুইটা পৃথক রাজ্যে। মুসা (আ.)-এর আদর্শ, দাউদ (আ.)-এর দুরদর্শিতা কিংবা সোলায়মান (আ.)-এর প্রতাপ- কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রথমে আসিরিয় আঘাতে ৭২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইসরায়েল তছনছ হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাবিলন। বিশেষ করে ৬১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আসিরিয়াকে পরাজিত করার মাধ্যমে পরাশক্তিতে পরিণত হয় ব্যাবিলনের রাজা নেবুপলেসার। তারপরেই মসনদে বসেছিলেন নেবুকাদনেজার। রাজা নেবুকাদনেজার ৫৯৭ এবং ৫৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দুই দফায় অভিযান চালান এহুদায়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বারের আঘাতটা গোটা জাতির জন্য ইহকালীন চরম শাস্তি। উন্মোচন ঘটে এক অভিশপ্ত জীবনের। পরবর্তী প্রতিটা দিন ছিল ইহুদিদের জন্য আক্ষেপ আর অনুশোচনার। সাইরাস যেন সেই নিয়তি নির্ধারিত অভিশাপ থেকে মুক্তির রাস্তা প্রস্তুতকারী। খোদ বাইবেল তার সত্যায়ন করে। সেখানেই প্রমাণিত হয় খোদা কর্তৃক তার মনোনীত বান্দা বা মেসায়াহ হবার ব্যাপারটা।
‘আমি সাইরাস সম্পর্কে বলি। সে আমার রাখাল। আমি যাতে খুশি হই, সে তার সবই করবে। সে জেরুসালেম সম্পর্কে বলবে, ওটা তৈরি হোক। বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে বলবে, ওটার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হোক। খোদা তার মনোনীত বান্দা সাইরাস সম্পর্কে বলছেন। আমি তার ডান হাত ধরেছি। তার সামনে জাতিগুলো পদানত এবং শাসকদের শক্তিহীন করার জন্য। আমি তার সামনে দরজাগুলো খুলে দেবো।’ (বাইবেল, বুক অব ইসায়াহ ৪৪:২৮)
সাইরাস তাই নেহায়েত ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো নামকাওয়াস্তে চরিত্র হয়ে থাকেনি। এ যেনো একজন পরম প্রতিশ্রুত ত্রাতার গল্প। যেমনটা এখনো বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মই কোন না কোন প্রতিশ্রুত প্রতিনিধির অপেক্ষায় আছে। জরাথুস্ত্রবাদে সাওশিয়ান্ত, হিন্দুধর্মে কল্কি, বৌদ্ধধর্মে মৈত্রেয়ী, খ্রিষ্টধর্মে যীশুর দ্বিতীয় আগমন এবং ইসলামে ইমাম মাহদি। সাইরাসের মেসায়াহ হওয়াটা তাই কেবল একটা খেতাব না, একটা ধর্মতত্ত্ব। দুঃসময়ের মধ্যে লালিত হওয়া মজলুম শ্রেণির সর্বশেষ ভরসা। নিপীড়িতের মনের কোণে বেড়ে উঠা প্রত্যাশার আলোকরশ্মি। সেই কথাই প্রমাণিত হয় পরের দফায়।
‘আমার ন্যায্যতায় আমি সাইরাসকে উত্তেজিত করবো; তার সমস্ত পথ সোজা করে দেবো। সে আমার শহর পুনরায় তৈরি করবে। যে বান্দারা বন্দী ছিলো তাদের ছেড়ে দেবে। কিন্তু সে কোন দাম বা পুরস্কারের জন্য করবে না।’ (বাইবেল, বুক অব ইসায়াহ ৪৫:১৩)
খোদা এই কথা বলছেন। অর্থাৎ বনি ইসরায়েলের বন্দিত্বের বেদনার মতো মুক্তিও অবশ্যম্ভাবী। অবশ্যম্ভাবী খোদার সকল পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটা। ‘আমার উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য আমি একজন লোককে দূর দেশ থেকে ডেকে আনবো। সে পূর্বদেশ থেকে শিকারি পাখির মতো আসবে। আমি যা বলছি তা সফল করবো। বাস্তবায়ন করবো যা পরিকল্পনা করেছি।’ (বাইবেল, বুক অব ইসায়াহ ৪৬:১১)
ইহুদি খ্রিষ্টান সিলসিলায় সাইরাসের অবস্থান তাই পোক্ত। প্রতিটা সৎ পথ প্রাপ্ত নবীর মতো খোদা সাইরাসকে নিজের করেছেন। প্রেরণ করেছেন প্রিয় জাতি বনি ইসরাইলকে মুক্ত করার জন্য। যেমনটা আগে মুসাকে প্রেরণ করা হয়েছিল। এইজন্য ব্যাবিলনের মাটিতে সেই মানুষটির প্রত্যাশা করেছে ইহুদিরা। ইউফ্রেটিসের তীরে বসে একবার তাকিয়ে থেকেছে এহুদার দিকে। আরেকবার এলামের দিকে। যে কজন মানুষ ব্যাবিলনে বন্দী ছিলেন তাদের মধ্যে নবী দানিয়েল একজন। দানিয়েল একবার অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। তার ভাষ্যে-
‘আমি নিজেকে এলাম প্রদেশের সুসার কেল্লায় দেখতে পেলাম। সেই স্বপ্নের মধ্যে আমি উলয় খালের পারে ছিলাম। একটা পুরুষ মেষকে খালের পারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মাথায় লম্বা দুটি শিং। একটা শিং অন্যটা থেকে বেশি লম্বা এবং সেটা উঠেছিল পরে। দেখলাম মেষটা পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে গুঁতা মারলো। তার সামনে কোনো পশুই টিকতে পারলো না। তার হাত থেকে উদ্ধার করতে পারে এমন কেউই ছিল না। সে যা খুশি তা-ই করতো এবং শক্তিশালী হয়ে উঠলো।’ (বাইবেল, বুক অব দানিয়েল ৮:২)
পরবর্তীতে স্বপ্নটির তফসির করে দেয়া হয় তাকে। মেষটি আকিমেনিড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইশারা। সেখানে দুইটা শিং প্রতিনিধিত্ব করে মিদিয় এবং পারসিকদের। কনিষ্ঠ শিংটি বেশি লম্বা- তার অর্থ পরে গজিয়ে উঠা পারসিকদের আধিপত্য থাকবে বেশি।
সাইরাস ব্যাবিলনে প্রবেশের আগেই কিছু সিরিয় ভাষা জানা লোকদের নিয়োগ দেয়। খুব সম্ভবত সেই সিরিয় ভাষা জানা লোকগুলো ছিল ইহুদি। নেবুকাদনেজারের দরবারে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইহুদি ছিল। বেলশৎসরের আমলেও ছিল। এটা খুব স্বাভাবিক যে সাইরাসের ব্যাবিলন দখলের পর সেই উচ্চপদস্থ ইহুদিদের জন্য দরবারে গতায়াতের সুযোগ জারি থাকে। তারাই গোচরে আনে প্রত্যাবর্তনের আলাপ। সাইরাস মঞ্জুর করে ফিরে যাবার অনুরোধ। কেবল মঞ্জুর না; যথারীতি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। গঠিত হয় মন্দির। ইহুদিদের সাথে সকল ধর্মের মানুষেরাই মুক্তি পায়। যাদেরকে নেবুকাদনেজার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এনে দাস করে রেখেছিলেন একসময়। সাইরাসের সেই ঘোষণাও লিপিবদ্ধ করে রেখেছে বাইবেল,
“পারস্যের রাজা সাইরাসের রাজত্বের প্রথম বছর খোদা একটি ঘোষণার জন্য তাকে উৎসাহিত করলেন। সাইরাস সেই ঘোষণাটি লিখিয়ে নিয়ে রাজ্যের সব জায়গায পড়বার ব্যবস্থা করলেন। ইয়ারমিয়ার মুখ দিয়ে বলা প্রভুর বার্তাটি যাতে প্রচারের ব্যবস্থা হল। ঘোষণাটি এইরূপ: এই ঘোষণা পারস্যের রাজা সাইরাসের কাছ থেকে। স্বর্গের প্রভু আমায় পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য উপহার দিয়েছেন। এহুদা দেশের জেরুসালেমে তার উদ্দেশ্যে একটি মন্দির নির্মাণের নিমিত্তে আমাকে নিযুক্ত করেছেন। তোমাদের মধ্যে সেখানকার কোন লোক বাস করলে তারা যেন জেরুসালেম শহরে যায়। ইসরায়েলের ঈশ্বর, প্রভুর জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করে যা জেরুসালেমে আছে। প্রভু তাদের রহমত করুন। যেখানে বেঁচে যাওয়া ইসরায়েলিরা বাস করে সেখানকার অধিবাসীদের সমর্থনও তাদের অবশ্যই পাওয়া দরকার। তাই জেরুসালেমে খোদার মন্দির নির্মাণের জন্য সবাই যেন সামর্থ্য তাদের সোনা, রূপো, গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে তাদের সাহায্য করে।” (বাইবেল, বুক অব এজরা, ১:১-৪)
পার্থিব জীবনের আদর্শ সাইরাস। যে খোদার প্রতি সন্তুষ্ট এবং খোদা তার প্রতি সন্তুষ্ট। তার পিতৃসুলভ শাসনব্যবস্থার কারণেই সাইরাসকে ‘খোদার রাখাল’ খেতাব দেয়া হয়। যে খোদার হারিয়ে যাওয়া মেষগুলোকে পথ দেখিয়ে খোয়ারে ফিরিয়ে আনে। যে হারিয়ে যাওয়া ইহুদিদের ঘরে তুলে দিয়েছে। ফলে ইহুদি-খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্বের চোখে সাইরাসের অবস্থান নিয়ে কোন সংশয় নেই। এই অবস্থানই পরবর্তীতে ইসলামে সাইরাসের অবস্থান প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। তবে সেই আলোচনা পরের পর্বে।
আরো পড়ুন-