
১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসের শুরুর দিকের কথা। বোর্ডের সাথে খেলোয়াড় ট্রান্সফার নিয়ে বিতর্কের কারণে নতুন সিজন শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে অপ্রত্যাশিতভাবে বরখাস্ত করা হলো তৎকালীন আর্সেনাল ক্লাব ম্যানেজার ব্রুস রিয়ককে, চারিদিকে প্রশ্ন উঠলো আর্সেনাল বোর্ডের প্রকৃতিস্থতা নিয়ে। আর সবার চোখ যখন ইয়োহান ক্রুইফের দিকে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পরের মাসেই ক্লাবের নতুন ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ করা হলো ফরাসি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারকে।

চারিদিকে সমালোচনার ঝড় উঠলো। এমনকি সমর্থকগোষ্ঠীও ঠিক ভালোভাবে নেয়নি ওয়েঙ্গারের এই নিয়োগ। কেউ কেউ সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেও ভুল করেনি। তবে দিন যত গিয়েছে, ওয়েঙ্গার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। নিজেকে ধীরে ধীরে তুলে নিয়েছেন খ্যাতির শিখরে, হয়ে উঠেছেন আর্সেনালের সমার্থক! আজকে বলা হবে তারই গল্প।
‘দ্য প্রফেসর’ নামে পরিচিত এই মানুষটির জন্ম ১৯৪৯ সালের ২২ অক্টোবর, ফ্রান্সের আলসেশ প্রদেশের রাজধানী স্ট্রাসবার্গে অবস্থিত ছোট একটি গ্রাম ডুপিগহাইমে। তার বাবার নাম আলফোনস ওয়েঙ্গার এবং মায়ের নাম লুসি ওয়েঙ্গার। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল, জন্মের পর থেকেই বাবা-মা যেন আঁচ করতে পেরেছিলেন তাদের ছোট্ট সোনামণি আর্সেনালের হয়ে ডাগআউট কাঁপাবে; তাই হয়তো নামটাই রেখে দিলেন ‘আর্সেন’!

ওয়েঙ্গার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বাবার গাড়ির খুচরা যন্ত্রপাতির ব্যবসা আর মায়ের একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁ- এই ছিল তাদের আয়ের উৎস। সেগুলো থেকে যে আয় হতো, তা দিয়ে তিন সন্তানের পড়াশোনা ও যাবতীয় খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। তাই আলফোনস ওয়েঙ্গার ব্যবসার পাশাপাশি বাড়ি থেকে দশ মাইল দূরে অবস্থিত ডাটেলহাইম গ্রামের ফুটবল টিমের কোচের চাকরি নিলেন। তবে সমস্যা হলো, চাকরির কারণে বেশিরভাগ সময় তাকে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হতো। তাই পরিবারকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা মাথায় নিয়ে সপরিবারে ডাটেলহাইমে চলে আসেন তিনি। তাছাড়া সেখানে শিশু-কিশোরদের পরিচর্যার জন্যে আলাদা সুব্যবস্থা ছিল। তাই একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিল, তার ছেলেমেয়েরা বিনা খরচে সেখানকার স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেল।
ডাটেলহাইম গ্রামটির অবস্থান জার্মান সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ার কারণে সেখানকার অধিকাংশ মানুষ আলমেনিক উপভাষায় কথা বলতো। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই ওয়েঙ্গার সেই ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। পরে স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা পরিচালিত এক স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন, স্কুলের বিভিন্ন পরীক্ষায় তার ফলাফলও খুব ভালো ছিল। সেই মেধার জোরেই তিনি ওবারনাইয়ের একটি স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পান।
ফুটবলার ওয়েঙ্গার
খেলোয়াড় হিসেবে ওয়েঙ্গারের অর্জনের খাতা খুব একটা পরিপূর্ণ নয়। বিভিন্ন অপেশাদারি ক্লাবে খেলার পরে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করতে তার বেশ সময় লেগে গিয়েছিল। অথচ বাবা স্থানীয় জুনিয়র ক্লাবের কোচ হওয়ার কারণে মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি ফুটবলের খেলার সংস্পর্শে আসেন। তাছাড়া প্রায়ই বাবার সাথে জার্মানির বুন্দেসলিগার ম্যাচ দেখতে যেতেন। তখন থেকেই তার মধ্যে ফুটবল খেলার প্রতি আলাদা টান তৈরি হয়। ডাটলেনহাইম অঞ্চলটি অপেশাদারি ফুটবলের জন্যে বেশ সুপরিচিত ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা অনেক কম হওয়ার কারণে সমবয়সী খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি দল গঠন করা ছিল কষ্টসাধ্য। তার বয়স যখন বারো, তখন বাবার দায়িত্বাধীন দলের হয়ে অপেশাদারি ফুটবলে পা রাখেন ওয়েঙ্গার।

বাবার অধীনে খেলতে তিনি বেশ পছন্দ করতেন। তাছাড়া ভাইবোনদের মধ্যে তারই বাবার সাথে সখ্যতা ছিল বেশি, তাই বাবার দলে খেলতে পারাটা তার জন্য ছিল পরম আরাধ্য এক প্রাপ্তি। পনের বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বাবার অধীনেই স্থানীয় ক্লাবে খেলতেন এবং তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তাই তার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত জুনিয়র টিম ছেড়ে অন্য কোথাও যোগদান করেননি।
শারীরিক বৃদ্ধি কিছুটা ধীর হওয়ার কারণে পেশাদারী কোনো ক্লাবে খেলার জন্যে তার বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তার বয়স যখন ষোল, তখন এফ.সি ডাটলেনহাইমের মূল দলে খেলার সুযোগ পান ওয়েঙ্গার। সেখানে খেলোয়াড়দের কৌশলগতভাবে প্রস্তুত করার জন্যে ক্লাবের আলাদা কোচ ছিল না, তাই দলের যেকোনো একজন খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ সেশনগুলো পর্যবেক্ষণ করতো। বেশিরভাগ সময়েই ওয়েঙ্গার নিজেই সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেন। দলের সতীর্থ ক্লদ তার দল পরিচালনার গুণ নিয়ে বলেছিলেন- “আর্সেন আমাদের দলের অধিনায়ক ছিলো না, তবে দায়িত্বটা সে নিজের থেকেই নিয়ে নিতো। ‘তুমি এটা করো, তুমি ওটা করো’… যেন সে-ই ছিল আমাদের দলনেতা।”

আর্সেন ওয়েঙ্গারের পেশাদারি ফুটবল জীবন শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে, এ.এস মুটজিগ ক্লাবের মাঝমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে। তখন সেই ক্লাবের কোচ ছিলেন ম্যাক্স হিল্ড। কোচের সাথে তার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি ওয়েঙ্গার কোচ হবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তার কাছ থেকেই। কোচ হিল্ড পরে ঐ ক্লাব ছেড়ে দিলে ওয়েঙ্গারও ১৯৭৩ সালে মুলহাউজ ক্লাবে যোগ দেন।
খেলাধুলায় এতো ব্যস্ত থাকার পরেও ওয়েঙ্গার পড়াশোনা বন্ধ করেননি। মুলহাউজে যোগ দেওয়ার আগে কিছুদিন মেডিসিন নিয়ে পড়ার পর, ১৯৭১ সালে তিনি স্ট্রাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়তে।

১৯৭৪ সালে এফ.এস.ভি স্টর্সবার্গ থেকে তার ডাক আসে। সেখানে তিন বছর তিনি খেলোয়াড়ের পাশাপাশি কোচের সহকারির দায়িত্ব পালন করতেন। পরে ১৯৭৮ সালের দিকে তার পুরনো কোচ হিল্ড আর.সি স্টর্সভার্গের রিজার্ভ টিমের কোচ হলে, তিনি ওয়েঙ্গারকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। ছোটবেলা থেকে সমর্থন করা ক্লাবে খেলতে পারাটা তার জন্যে সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল, তাই সহজেই তিনি কোচের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি মূল দলের হয়ে প্রথমবারের মতো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি ম্যাচ খেলেন। পরে মোনাকোর বিরুদ্ধে লিগের একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান।
আটাশ বছর বয়সী ওয়েঙ্গারের তখন ক্যারিয়ারের পড়ন্ত সময়, সেভাবে মূল একাদশে সুযোগও পাচ্ছিলেন না। তবুও তা নিয়ে কখনও আক্ষেপ করেননি, উপরন্তু নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন দলের পক্ষে যথেষ্ট অবদান রাখার। স্ট্রাসবার্গ সে বছর লিগ শিরোপা জেতে, এরই মধ্য দিয়ে পেশাদার ফুটবল জীবন শুরুর প্রায় নয় বছর পর ওয়েঙ্গার প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের স্বাদ পান।

১৯৭৯ সালে সিনিয়র দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেললেও, আরও দুই বছর তিনি স্ট্রাসবার্গের রিজার্ভ টিমের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৮১ সালে তিনি প্যারিস থেকে ফুটবল ম্যানেজারদের ডিপ্লোমা পাশ করেন। মাঝামাঝি সময়ে তিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে ক্যামব্রিজে তিন সপ্তাহের একটি কোর্সে ভর্তি হন। ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষা ছাড়াও ওয়েঙ্গার জার্মান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন; এর পাশাপাশি তিনি ইতালীয়, স্প্যানিশ এবং জাপানি ভাষায়ও যথেষ্ট পারদর্শী।
ম্যানেজার হিসেবে আর্সেন ওয়েঙ্গার
পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ারের ইতি টানার পর ১৯৮৩ সালে তিনি বেশ কিছুদিন এ.এস ক্যানি ক্লাবের সহকারি কোচের দায়িত্ব পালন করেন এবং পরের বছরই প্রধান কোচ পদে উন্নীত হন। প্রথম দুই মৌসুমে কোনোরকমে দলকে রেলিগেশন থেকে বাঁচালেও তৃতীয় মৌসুমে গিয়ে শেষ রক্ষাটি আর হয়নি। ক্লাবের রেলিগেশনের সাথে সাথে ওয়েঙ্গারকেও কোচের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।

মোনাকোর হয়ে ট্রফি হাতে আর্সেন ওয়েঙ্গার; Source: Daily Mail
সে বছরই, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে ওয়েঙ্গার মোনাকো ফুটবল ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই ক্লাবের সাথেই যুক্ত ছিলেন। মোনাকোর হয়ে তিনি নিজের সময়কালে একটি লিগ এবং একটি ফ্রেঞ্চ কাপ জিতেছেন। কোচ হিসেবে নৈপুণ্য দেখানোতে ১৯৯৩ সালে ফ্রান্স জাতীয় দল থেকে তার কাছে প্রস্তাব আসে প্রধান কোচ হওয়ার। তবে ক্লাবের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য দেখিয়ে তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। কিন্তু যে ক্লাবের জন্যে তিনি এত বড় সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই ক্লাবই তাকে হতাশ করে পরের বছরই বরখাস্ত করার মাধ্যমে।
মোনাকো থেকে হতাশাজনকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে জানুয়ারি মাসে ওয়েঙ্গার জাপানের নাগোয়া ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেন। সেখানে তিনি মাত্র এক মৌসুম কোচিং করান এবং ক্লাবকে জাপানের ‘এমপেরর কাপ’ জেতান। ১৯৯৬ সালে ক্লাব ছাড়ার আগে তাকে ‘বছরের সেরা ম্যানেজার’ উপাধি দেয়া হয়।

সেই বছরই ওয়েঙ্গারকে আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার নামের সাথে ক্লাবের নামের অদ্ভুত মিল অনেককেই অবাক করে। আর্সেনালের মতো বড় ক্লাবের জন্য ইয়োহান ক্রুইফের মতো কিংবদন্তীকে উপেক্ষা করে ওয়েঙ্গারের মতো অজ্ঞাতকুলশীল কাউকে কোচ হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারটা প্রথম দিকে ক্লাবের সমর্থকেরা সহজভাবে গ্রহণ করেননি, এমনকি দলের অধিনায়কও ওয়েঙ্গারকে নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
তবে সে সন্দেহ দূর করতে খুব বেশিদিন সময় নেননি ওয়েঙ্গার। তার অধীনে লিগের প্রথম ম্যাচেই ব্ল্যাকবোর্ন রিভার্সকে ২-০ গোলে পরাজিত করে আর্সেনাল। দারুণ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত ওই মৌসুমে আর্সেনালকে তৃতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু পরের বছরই ওয়েঙ্গার বাজিমাত করলেন। একই সাথে লিগ শিরোপা এবং এফএ কাপ জিতিয়ে আর্সেনালকে মূল দলগুলোর কাতারে তুলে আনলেন তিনি।

ওয়েঙ্গার ধীরে ধীরে এমন এক আর্সেনাল দল গঠন করেন যেটির শুধু ম্যাচ জেতার ক্ষমতাই ছিল না, বরং ছিল দৃষ্টিনন্দন খেলার পসরা সাজানোর সক্ষমতা। সেই দলের আদর্শ ছিল টিমওয়ার্ক। তাছাড়া প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড় চিহ্নিত করার পাশাপাশি সাধারণ মানের খেলোয়াড়কে নির্ভরশীল ও প্রভাবশালী খেলোয়াড়ে রূপান্তর করার ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি তৈরি হয় ওয়েঙ্গারের। যেমন- মোনাকোর দায়িত্বে থাকার সময় তিনি যখন অখ্যাত লাইবেরিয়ান স্ট্রাইকার জর্জ উইয়াহকে সাইন করেন, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু ওয়েঙ্গার ঠিকই তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন, যার প্রমাণ হলো উইয়াহর পরবর্তীতে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া। আর্সেনালে তার অধীনে খেলেই থিয়েরি অঁরি, প্যাট্রিক ভিয়েরা, সেস ফ্যাব্রিগাস, কলু তোরে এবং রবিন ফন পার্সিরা বিশ্বমানের তারকায় পরিণত হয়েছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া তাকে ‘দ্য প্রফেসর’ নামে সম্বোধন করলে, এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
অর্থনীতিতে ডিগ্রীধারী ওয়েঙ্গার ছিলেন একজন সুকৌশলী অর্থনীতিবিদ। অতিশয় সুলভ মূল্যে কোনো খেলোয়াড় কিনে তাকে মোটামুটি উচ্চতর মূল্যে অন্য ক্লাবে বিক্রি করায় তার জুড়ি নেই। এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন ফরাসি খেলোয়াড় নিকোলাস আনেলকা। তাকে মাত্র ৫ লাখ পাউন্ড দিয়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই থেকে কিনে ঠিক দু’বছর পরে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ২২.৩ মিলিয়ন পাউন্ড দরে বিক্রি করেন ওয়েঙ্গার।
ওয়েঙ্গারের পিঠে স্নাইপারের সাইনবোর্ড লাগে যখন থিয়েরি অঁরি, রবার্ট পাইরেস এবং সিলভেন উইল্টোর্ডকে দলে ভেড়ান তিনি। এই তিনজন খেলোয়াড়ই ২০০৩-০৪ সালে আর্সেনালকে প্রিমিয়ার লিগ জেতাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

আর্সেনালের ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর শুরুর কয়েক বছর সফলতার সাথে পার করেছিলেন ওয়েঙ্গার। এমনকি তার দায়িত্বাধীনে আর্সেনাল দল ২০০৩-০৪ সিজনের শিরোপা জেতে কোনো ম্যাচে না হেরেই, যার জন্য সেই সিজনের আর্সেনাল দলকে ‘ইনভিন্সিবল’ খেতাব দেওয়া হয়। তবে ঝামেলা বাঁধে পরের সিজন থেকেই। ২০০৪ সালের সেই সিজনের পর থেকে টানা প্রায় ১২ বছর সমর্থকদের শিরোপার মুখ দেখাতে পারেননি ওয়েঙ্গার। কিন্তু তারপরও তার উপর পুরোপুরি ভরসা হারায়নি ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে দর্শকরাও। তবে একদমই যে কথা উঠেনি, তা নয়। তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেমন অনেকেই সমালোচনা করেছেন, মাঝেমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে তার খেলানোর ধরন নিয়েও। তবু ওয়েঙ্গার শক্ত হাতে ধরে ছিলেন আর্সেনাল দলের হাল। পরে ২০১৩-১৪ সিজনে তিনি ১২ বছর পর আবার এফ.এ কাপ শিরোপা জেতেন এবং পরের সিজনের শুরুতেই জিতে নেন এফ.এ কমিউনিটি শিল্ড কাপ।
একজন বিদেশি ম্যানেজার হিসেবে প্রায় দুই দশক ধরে আর্সেনালের সাথে যুক্ত থাকা ওয়েঙ্গার জিতেছেন ১৭টি শিরোপা, দলের জন্যে তৈরি করেছেন নতুন একটি স্টেডিয়াম এবং খেলোয়াড় কিনতে ব্যয় করেছেন ৭০০ মিলিয়নের পাউন্ডেরও বেশি। এত কিছুর পর আর্সেন ওয়েঙ্গারকে নিঃসন্দেহে বিশ্বের সফলতম ম্যানেজারদের একজন আখ্যা দেওয়া যায়।

পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ওয়েঙ্গারের অর্জন নেই বললেই চলে। স্ট্রসবার্গের হয়ে তিনি মাত্র একবারই লিগ ১ এর শিরোপা জিতেছেন ১৯৭৮-৭৯ সিজনে। তবে ম্যানেজার হিসেবে তিনি এর তুলনায় অনেক বেশিই সফল। প্রিমিয়ার লিগ সহ বেশ কিছু এফ.এ কাপ শিরোপা জিতলেও, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এখনও তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি ওয়েঙ্গার।
মোনাকো
- লিগ ১: ১৯৮৭-৮৮
- ফরাসি কাপ: ১৯৯০-৯১
নাগোয়া গ্রাম্পাস
- এম্পেরেরস্ কাপ: ১৯৯৫
- জে-লিগ সুপার কাপ: ১৯৯৬
আর্সেনাল
- প্রিমিয়ার লিগ: ১৯৯৭-৯৮, ২০০১-০২, ২০০৩-০৪
- এফ.এ কাপ: ১৯৯৭-৯৮, ২০০১-০২, ২০০৩-০৪, ২০০৪-০৫, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৬-১৭
- এফ.এ কমিউনিটি শিল্ড: ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০২, ২০০৪, ২০০৪, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭

ব্যক্তিগত জীবন
আর্সেন ওয়েঙ্গার বর্তমানে লন্ডনের টট্টারিজ শহরে বসবাস করেন। সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় এনি ব্রোশারহাউসের সাথে তিনি প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন, তাদের দশ বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার পর ২০১০ সালে এই দম্পতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও ২০১৫ সালে তারা আলাদা হয়ে যান। ওয়েঙ্গার তার অবসর সময়ও পার করেন খেলা দেখে এবং তা নিয়ে গবেষণা করেই।
কিছু মানুষের জীবনে অর্থ-সম্পদ থেকেও মূল্যবান কিছু জায়গা থাকে, ওয়েঙ্গারের জীবনে সে জায়গাটা ছিল ফুটবল নিয়ে। সেই কিশোর বয়স থেকেই তিনি ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। খেলার পাশাপাশি তিনি সিগারেট বিক্রির কাজও করছেন। তাও ফুটবল খেলা চালিয়ে গেছেন। খেলা ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না মানুষটি। তার কাছে ফুটবল খেলা একটি শিল্পের মতো। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- “দশ বছর আগে আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘আর পাঁচ বছর, তারপরই অবসর নেবো।’ কিন্তু আমি এখনও রয়ে গেছি।”
কিন্তু বেশিদিন আর রইলেন কই। ২০১৮ সালের এপ্রিলের বিশ তারিখ হুট করে আর্সেনালের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে একটি চিঠি প্রকাশ করা হয়। চিঠিটি স্বয়ং আর্সেন ওয়েঙ্গারের লেখা তার সহকর্মী ও ভক্তকুলের উদ্দেশ্যে-
“কিছু সতর্ক বিবেচনা এবং ক্লাবের সাথে তৎপরবর্তী আলোচনার সাপেক্ষে, আমি মনে করি এই মৌসুমের শেষেই সরে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময়।
স্মরণীয় এতগুলো বছর জুড়ে ক্লাবের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সুযোগ পাওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ।”
আমি পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধতা ও অখণ্ড সততার সাথে ক্লাবটিকে পরিচালনা করেছি।
আমি ক্লাবটির কর্মী, খেলোয়াড়, আধিকারিকগণ এবং ভক্তকুলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যারা এই ক্লাবটিকে এতোটা অনন্য করে তুলতে অবদান রেখেছেন।
আমাদের ভক্তদের থেকে আমি এটাই আশা করি যেন তারা দলের পেছনে থেকে দলকে উচ্চ অবস্থানে পৌঁছুতে সহযোগিতা করেন।
সকল ব্যক্তি যারা আর্সেনালকে ভালোবাসেন, তাদের প্রতি আর্জি: তারা যেনো ক্লাবের মূল্যবোধের প্রতি খেয়াল রাখেন।
আমার ভালবাসা ও সমর্থন সবসময় থাকবে।”
– আর্সেন ওয়েঙ্গার
এবং এই চিঠির মাধ্যমে প্রিমিয়ার লিগের আরো দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই আর্সেনালের ম্যানেজেরিয়াল পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ওয়েঙ্গার। এই সংবাদে আর্সেনালের ভক্তকুলের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও, ওয়েঙ্গার যা দিয়েছেন আর্সেনালকে গত ২২ বছরে তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে উপায় নাই। তাই তো ওয়েঙ্গারের শেষ ম্যাচগুলোর সময় ভক্তরা দাঁড়িয়েছিলেন ‘মার্সি আর্সেন’ লেখা প্লে-কার্ড নিয়ে। আর সে ম্যাচের সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটে আর্সেন এবং আর্সেনালের দীর্ঘ যাত্রার।

শেষ অঙ্ক…
আমার যত বয়স বেড়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ফুটবল নিয়ে আমার উত্তেজনা-পাগলামি। তবে সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন এসেছে আমার প্রত্যাশায়। সাফল্যের চোখধাঁধাঁনি আর শিরোপার হাতছানি এখন আর আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। এখন আমার কাছে ফুটবল হলো রূঢ় বাস্তবতার মাঝে একটুকরো প্রাণস্পন্দন, এক চিলতে শান্তির পরশ। যার অস্তিত্ব ছাড়া মাঝে মধ্যে মনে হয় জীবনই যেন অসম্পূর্ণ। এবং আমি চেষ্টা করি এই প্রজন্মের যা অবশিষ্ট আছে তা অনুভূতিতে ধরে রাখতে। আর সেই প্রজন্মের স্মৃতিচারণের ছুতোয় ফিরে তাকাই সেইসব দিনগুলোতে, যখন আর্সেন ওয়েঙ্গার আমাদের ম্যানেজার ছিলেন। ভেবেছিলাম, হয়তো আরো অনেকদিন তিনি থাকবেন আর্সেনালের ম্যানেজার হয়ে!

ফুটবল কিংবা আর্সেনাল, কোনোটাই হয়তো আমাকে ছুঁতে পারতো না, যদি আর্সেন ওয়েঙ্গার না থাকতেন। আমি যতই তার সম্পর্কে পড়েছি, ততই তার প্রতি ভালোলাগা বেড়েছে। তিনি একদম শেষপর্যন্ত নিজস্ব নীতিতে অটল একজন মানুষ। জানি না সবার কাছে আর্সেন ওয়েঙ্গার আদৌ কোনো প্রতিভাধর ব্যক্তি কিনা, কেননা এ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে অবিসংবাদিত সত্যিটা হলো, আর্সেন ওয়েঙ্গার এমন একজন গুণমানসম্পন্ন মানুষ যিনি এই ফুটবল খেলাটিকে নানাভাবে করেছেন মহিমাণ্বিত, নানা রঙে সাজিয়েছেন, ঘটিয়েছেন পরিবর্তনের বিপ্লব।
তাই আমার জন্য আর্সেন ওয়েঙ্গার সবসময় আমার ‘হিরো’ হিসেবেই থাকবেন। তিনি যতই শিরোপাবিহীন বছর কাটান না কেন, আর আর্সেনাল যতই ৮-২ এর হিসেবে হারের মুখ দেখুক না কেনো, এতে তার মহিমা এতটুকুও ম্লান হবেনা। কারণ যখন আপনি একটু দূর থেকে পুরো জীবনের প্রতি সরেজমিনে দৃষ্টিপাত করবেন, জীবনটা ঠিক সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ধাঁচের রূপকথা নয়। সাফল্যের চোখধাঁধাঁনি আর শিরোপাগুলির মাহাত্ম্য সেখানে বড়ই কম। সেখানে মূল্যবান বিষয় সেইসব রোমাঞ্চকর মূহুর্তগুলো- যা সত্যিকার অর্থেই প্রভাব ফেলে। এবং আর্সেন ওয়েঙ্গার আমার জীবনে সেগুলোর কমতি রাখেননি।