ঘটি আর বাঙাল; কলকাতার প্রেক্ষিতে খুবই পরিচিত দুটো শব্দ। ঘটি হলো আদি ভারতীয়রা, যারা তাদের জন্ম থেকেই কলকাতায় বাস করে আসছে। আর বাঙাল হলো যারা অন্য জায়গা থেকে এসে কলকাতায় থিতু হয়েছে, বিশেষ করে যারা পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ওখানে গিয়েছিল। ঘটি-বাঙালের পার্থক্য প্রথম থেকেই ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন, দুই ধরনের মানুষই হয়তো বাংলায় কথা বলে, কিন্তু তাদের কথার টান হয়তো কিছুটা ভিন্ন। আবার খাবারের ক্ষেত্রে ঘটিরা চিংড়ি পছন্দ করে, অন্যদিকে বাঙালরা ইলিশ। এই পার্থক্যগুলোর রেশ ধরেই দ্বন্দ্ব শুরু, যার ফলাফল দাঁড়ায় ঘটিদের বাঙাল সহ্য করতে না পারা, বাঙালদের প্রতি একটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে ওঠা আচরণে। ঘটিরা মনে করতো তারাই প্রকৃত বাঙালি আর বাঙালরা হলো উদ্বাস্তু, তাদের কোনো অধিকার নেই। হাটে-বাজারে কিংবা অফিসপাড়ায় – সব জায়গাতেই বাঙালরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো প্রতিনিয়ত।
ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্ব যে শুধু প্রাত্যহিক জীবনে সীমাবদ্ধ থেকেছে, তা নয়; ইস্ট বেঙ্গল এবং মোহনবাগানের হাত ধরে তা গুটি গুটি পায়ে চলে আসে ফুটবলেও। একটা সময় পর ফুটবলীয় লড়াইটাই যেন ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্বের সমার্থক হয়ে ওঠে। ফুটবলের কেতাবি ভাষায় এই দ্বন্দ্বের নাম কলকাতা ডার্বি, স্থানীয় ভাষায় ‘বড় ম্যাচ’। আদি ভারতীয় ঘটিদের মোহনবাগান আর অভিবাসী বাঙালদের ইস্ট বেঙ্গলের ফুটবলীয় লড়াই এখনও যে ভালোই ঝাঁঝ ছড়ায়, তা বোঝা যায় ম্যাচের দিন সল্টলেকে কান পাতলে।
মোহনবাগানের ডাকনাম ‘মেরিনার্স’ এসেছে তাদের ক্লাবের প্রতীক থেকে, পাল তোলা নৌকা – যা অনেকটা সমৃদ্ধি ও আভিজাত্যকেই নির্দেশ করে। অপরদিকে ইস্ট বেঙ্গলের প্রতীক জ্বলন্ত মশাল যেন লড়াই ও প্রতিবাদের আরেক নাম। দুই দলের ইতিহাসটাও কিন্তু একই সাক্ষ্য দেয়। মোহনবাগানের পথচলাটা ছিল মসৃণ, কিন্তু ইস্ট বেঙ্গলকে অতিক্রম করতে হয়েছে কাঁটা-বিছানো পথ।
আঠারো শতক পুরোটাই ভারতের জন্য বেশ তাৎপর্যবহ ছিল। অনেক অনেক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের একটা সুক্ষ্ম পরিবর্তন হচ্ছিল ধীরে ধীরে। সেই পরিবর্তনের পালকে নতুন মুকুট যুক্ত করতেই কি না কয়েকটি অভিজাত পরিবারের খেয়াল হয় যে ক্রীড়াক্ষেত্রেও একটা হাওয়া-বদল দরকার। সেই খেয়াল থেকেই ১৮৮৯ সালে কলকাতার বসু ভিলায় অভিজাত কিছু পরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় মোহনবাগান। শুরু থেকেই ভারতের অন্যতম প্রাচীন এই ক্লাবের একটা আলাদা সুনাম ছিল ক্লাব পরিচালনা নীতির কারণে। মোহনবাগান কখনো অভারতীয়দের খেলাবে না, এই ক্লাব শুধু বিশুদ্ধ ও আদি ভারতীয়দের জন্য – এমনটাই ছিল ক্লাবের নীতি।
এর পাশাপাশি ১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ডে ব্রিটিশ এক দলকে হারিয়ে দেওয়ায় মোহনবাগান যেন হয়ে যায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক। এমন গৌরবময় ও অভিজাত প্রেক্ষাপটের কারণেই ১৯৮৯ সালে ক্লাবটির একশ বছর পূর্তিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মোহনবাগানকে ভূষিত করেন ‘ন্যাশনাল ক্লাব অব ইন্ডিয়া’ নামে।
সে তুলনায় ইস্ট বেঙ্গলের ভারতীয় ফুটবলে আগমন বেশ খানিকটা পরে নাটকীয় আবহের মধ্যে দিয়ে।
১৯২০ সালের কথা। জোড়াবাগান নামে একটা ক্লাব খেলত ভারতীয় ফুটবলে, যার অন্যতম সংগঠক ছিলেন বাঙাল সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী। কুচবিহার কাপের এক ম্যাচে ক্লাবের দুই বাঙাল ফুটবলারকে শুধু বাঙাল হওয়ার কারণে দল থেকে বাদ দেওয়ায় সুরেশ বেশ ক্ষুব্ধ হন। ক্ষুব্ধ সুরেশ সাথে সাথে পদত্যাগ করে জেদের বশে খুলে বসেন নতুন এক ক্লাব। সেই ক্লাবের সংগঠকদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙাল, তাই ক্লাবের নামও রাখা হয় ইস্ট বেঙ্গল।
মাঝে মাঝে সামান্য প্রতিবাদ থেকেই হয়ে যেতে পারে বিপ্লব। কে জানত, সেদিনকার অমন পাগলাটে সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে ফুটবল ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় যোগ করবে! বিধাতা কিন্তু একটা ইঙ্গিত দিয়েই রেখেছিলেন, তা না হলে যাত্রা শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই হারকিউলিস কাপ জেতার মতো সাফল্য পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা না! তবে তখনও মোহনবাগানের সাথে তাদের বৈরিতা অতটা জোরালো না। ৩-৪ বছর পর যে তুমুল দ্বৈরথ শুরু হবে, তা বোঝার আগেই দুই দল মুখোমুখি হয় ১৯২১ সালে। গোলশূন্য ড্র ম্যাচটা অবশ্য আনঅফিশিয়াল হওয়ায় রেকর্ডবুকে স্থান পায়নি।
ঘটিদের মোহনবাগান কখনোই বাঙালদের ইস্ট বেঙ্গলকে সহ্য করতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। আদতে হলোও তাই, মোহনবাগান নানাভাবে ইস্ট বেঙ্গলকে অবজ্ঞা করতে শুরু করল। এর মাঝে ১৯২২ সালে নিজেদের মাঠের ভাগ ইস্ট বেঙ্গলকে দিতে হবে, এমন সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করে তারা। বাঙালদের সাথে মাঠ ভাগাভাগি করা… এ তো বড় অসম্মানের ব্যাপার! আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয় ১৯২৪ সালে যোগ্য ইস্ট বেঙ্গলের শীর্ষস্তরের ফুটবলে প্রবেশ ঠেকাতে মোহনবাগানের ভেটো দেওয়ার ঘটনা। সে সময় নিয়ম ছিল, এগারোটা দলের মধ্যে মাত্র দুটো ভারতীয় দল শীর্ষ পর্যায়ের লিগে খেলতে পারবে, ব্রিটিশ দলগুলো বাকি নয়টা জায়গা পূরণ করবে। দুটো ভারতীয় ক্লাব আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, যার একটা ছিল মোহনবাগান। ইস্ট বেঙ্গল সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন ছিল সে বছর, তাই স্বাভাবিকভাবে তাদেরই সুযোগ পাওয়ার কথা শীর্ষ লিগে। কিন্তু মোহনবাগান তাতে ভেটো দেয়, যদিও বাকি নয় ব্রিটিশ দল তাদের পক্ষেই ছিল। শেষমেষ অনেক ঝক্কির পর তারা শীর্ষ লীগে খেলার সুযোগ পায়।
মজার ব্যাপার হলো, তার ঠিক পরের বছরই অফিশিয়ালি প্রথমবারের মতো মোহনবাগানের মুখোমুখি হয়েই ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে সবাইকে চমকে দেয় লাল-সোনালী ইস্ট বেঙ্গল। এ যেন তাদের প্রতি করা সব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যেরই কড়া জবাব। ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্বের জেরে দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা এমনিতেই উত্তপ্ত ছিল, উত্তাপটা যেন আরো বেড়ে গেল এই ম্যাচের পরে। জন্ম হলো ঘটি-বাঙালের ফুটবলীয় লড়াইয়ের।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান বৈরিতার পালে আরেকটু জোরে হাওয়া লাগে যেন। সে সময় পূর্ববঙ্গ থেকে প্রচুর মানুষ কলকাতায় পাড়ি জমায়। তাদের ভাগ্য কিন্তু বদলায়নি, বরং আগের মতোই বৈষম্যের শিকার হতে হয় সব জায়গাতে। ফুটবলের ময়দানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগে থেকেই ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্ব লেগে ছিল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে, সেটাই আরেকটু পাকাপোক্ত হয় দেশভাগের পর।
যদিও সময়ের সাথে সাথে ঘটি-বাঙালের এই ফুটবলীয় দ্বন্দ্ব তার রূপ পাল্টেছে, কলকাতা ডার্বির আবেদন তাতে বিন্দুমাত্র কমেনি। মোহনবাগান একটা সময় এসে শুধু ভারতীয় ফুটবলার খেলানোর নীতি থেকে সরে আসে, যার ফলে জোসে রামিরেজ বারেটো কিংবা সনি নর্দের মতো দুর্দান্ত কিছু বিদেশি ফুটবলারকে পরবর্তীতে দেখতে পাওয়া যায় এই ক্লাবটিতে। ইস্ট বেঙ্গলও কালে কালে নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। তাছাড়াও ভাষাগত পার্থক্যটা কমে যাওয়ায় আর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়ায় এখন কলকাতা ডার্বিতে আগের মতো সেই অস্তিত্ব কিংবা সম্মান রক্ষার প্রখরতা হয়তো আর নেই। তবে দুই ক্লাবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণেই কি না এখনও সমানে তর্ক হয় মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল ম্যাচ নিয়ে, এখনও সমর্থকরা ঘটি-বাঙালের প্রসঙ্গ তুলে খোঁচা দেয় একে অপরকে।
প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে কলকাতা ডার্বি দেখেছে বহু উত্তেজনাকর ম্যাচ। ষাট-সত্তর কিংবা আশির দশক, উনিশ শতকের শেষ ভাগটায় এসে ঘটি-বাঙালের ফুটবলীয় লড়াইটা বেশ জমে উঠেছিল। কলকাতা ডার্বির স্বর্ণযুগটাও মূলত এই সময়েই। সেই স্বর্ণযুগের একটা দারুণ উদাহরণ ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনাল। রেকর্ডসংখ্যক এক লাখ তিরিশ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে সল্টলেক সেদিন হয়ে উঠেছিল বাইচুং ভুটিয়াময়। ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম তারকা ও কলকাতা ডার্বির সর্বোচ্চ গোলদাতা ভুটিয়া দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করে একাই ইস্ট বেঙ্গলকে জিতিয়ে দেন। তার এই গৌরবময় কীর্তির দিনে ৪-১ গোলে হেরে মোহনবাগান মুখ লুকাবার জায়গাটাই যেন পাচ্ছিল না।
শেষবার এই দুই দল মুখোমুখি হয় এ বছরের জানুয়ারিতে আই-লিগের ম্যাচে। স্কোরলাইনটা মোহনবাগানের পক্ষে ছিল, ২-১ গোলে জিতে শিরোপার পথে আরেকটু এগিয়ে যায় এবং শেষমেষ শিরোপাটাও জিতে নেয় তারা।
ফুটবল ভক্তদের কাছে এর সবটাই ভালো খবর হতে পারত, যদি না মোহনবাগান হঠাৎ অমন সিদ্ধান্ত না নিতো। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে হুট করে একদিন মোহনবাগান ঘোষণা দিল যে, তারা ইন্ডিয়ান সুপার লিগের (আইএসএল) অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার সাথে এক হয়ে এটিকে মোহনবাগান নামে শুধু আইএসএলে খেলবে এখন থেকে। ফলে ফুটবল ভক্তদের মাঝে এক ধরণের শঙ্কা কাজ করছিল যে আদৌ ঐতিহাসিক কলকাতা ডার্বি আর মাঠে গড়াবে কি না, কারণ ইস্ট বেঙ্গল তো আইএসএলে খেলে না।
শেষ মুহূর্তে এসে ফুটবলপ্রেমীদের সব শঙ্কার অবসান ঘটেছে ইস্ট বেঙ্গলেরও আইএসএলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। এখন থেকে তাই আইএসএলেই হবে কলকাতা ডার্বি।
আইএসএল শুরু হচ্ছে এই নভেম্বর মাসেরই বিশ তারিখে। আর বহুল প্রতীক্ষিত কলকাতা ডার্বি মাঠে গড়াবে তার ঠিক এক সপ্তাহ পর, সাতাশ তারিখে। একজন নিখাঁদ ফুটবলপ্রেমী হয়ে থাকলে আজই ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখুন। ‘বড় ম্যাচ’টা আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে!