১.
ক্রিকেট খেলায় ব্যাটসম্যানকে আউট করার বিভিন্ন তরিকা আছে। তবে সবচেয়ে সহজ তরিকা কোনটি? ক্রিকেটানুরাগী পাঠকদেরকে যদি এই প্রশ্ন করা হয়, তবে বেশিরভাগ পাঠকই উত্তর দেবেন, বোল্ড আউট। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, ক্যাচ বা রান আউট করতে যেরকম ফিল্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, অথবা এলবিডব্লিউয়ের পরে আম্পায়ারের দিকে, বোল্ডে সেসব কিছুর বালাই নেই। উইকেট থেকে শুধু বেলটা ফেলে দাও, ব্যস কাহিনী শেষ!
বর্তমানে রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে ব্যবহৃত হয় এলইডি লাইটযুক্ত স্ট্যাম্প। বেল আর উইকেটে লাগানো থাকে এই লাইট, জ্বলে ওঠে সামান্য নড়লেই। এই প্রযুক্তি ক্রিকেটে এসেছে বেশিদিন হয়নি। ২০১৪ সালের টি-২০ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো এই উইকেট ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তির আবিষ্কারক এক অস্ট্রেলিয়ান এক ইঞ্জিনিয়ার। আবিষ্কারের পরে এর নাম দেয়া হয় জিং বেলস (Zing Bails)। যেহেতু সামান্য নড়লেই জ্বলে ওঠে এই বেল, তাই স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি এর ওজন।
কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে এ কী তেলেসমাতি! বল লাগছে উইকেটে, কিন্তু বেল পড়ছে না!
এরকম ঘটনা একবার, দুবার হলে মানা যায়। তাই বলে পাঁচবার? তা-ও বিশ্বকাপের মতো আসরে? পাকিস্তানের সাবেক পেসার শোয়েব আখতার তো টুইট করেই ফেলেছেন,
বল লাগার পরেও বেল অক্ষত আছে, এরকম ঘটনা আমি আমার সারাজীবনেও পাঁচবার দেখিনি। বিশ্বকাপের কথা না হয় ছেড়েই দেয়া যাক।
২.
প্রথম ঘটনা বিশ্বকাপের একদম প্রথম ম্যাচের। ওভালে মুখোমুখি হয়েছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই ম্যাচের ১১তম ওভারটা করছিলেন লেগ স্পিনার আদিল রশিদ। ওভারের পঞ্চম বলে সুইপ করতে চাইলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক। মিস করলেন তিনি, উল্টো বল উইকেটে লেগে বাউন্ডারি হয়ে গেল!
বল উইকেটে লাগার সাথে সাথে নড়ে উঠলো বেল, লাইটও জ্বললো বটে। ডি কক আউট হয়েছেন ভেবে যখন উল্লাসে মেতে উঠতে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা, ঠিক তখনই তাদের সবাইকে হতাশ করে বেল জায়গামতো বসে গেল। এককথায় অবিশ্বাস্য যাকে বলে!
আইসিসির আইনের ২৯.১.১ ধারা অনুযায়ী, একজন ব্যাটসম্যান দুভাবে বোল্ড আউট হতে পারেন। এক, উইকেট থেকে বেল পড়ে গেলে। দুই, মাটি থেকে স্ট্যাম্প উপড়ে গেলে। যেহেতু কোনোটাই হয়নি, তাই কুইন্টন ডি কক বেঁচে গেলেন সেই যাত্রায়।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটলো তার দুই ম্যাচ পরে। বিশ্বকাপের তৃতীয় ম্যাচ, কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনসে সেদিন খেলছিল শ্রীলঙ্কা আর নিউজিল্যান্ড। বল করছিলেন নিউজিল্যান্ডের বাঁ হাতি পেসার ট্রেন্ট বোল্ট, ব্যাটিংয়ে ছিলেন করুনারত্নে। ওভারের চতুর্থ বলটা দুর্দান্ত হলো, ঠিকমতো খেলতে পারলেন না শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক। কাট করার চেষ্টা করলেন, ব্যাটের নিচের দিকে লাগলো বল। তারপর ব্যাটে চুমু খেয়ে লেগ স্ট্যাম্প ছুঁয়ে গেল।
রিপ্লেতে দেখা গেল, লেগ স্ট্যাম্পে ধাক্কা দিয়েছিল বল, বেল সামান্য নড়েও জায়গামতো বসে গেছে আবার!
করুনারত্নের কী কপাল! কপাল বুঝি একেই বলে!
তৃতীয় ঘটনা অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের। বিশ্বকাপের দশম ম্যাচ ছিল সেটা। নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ২৮৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
দ্বিতীয় ওভারের পঞ্চম বল। দৌড়ে এসে বল করলেন অস্ট্রেলিয়ান পেসার মিচেল স্টার্ক। বল ক্রিস গেইলের ব্যাটে লেগে জায়গা করে নিলো উইকেটকিপার অ্যালেক্স ক্যারির হাতে। আবেদন উঠলো সমস্বরে, তর্জনী তুলে দিলেন আম্পায়ারও। না দেয়ার অবশ্য কোনো কারণও ছিল না, কারণ ব্যাটে বল লাগার শব্দ শোনা গেছে স্পষ্ট।
কিন্তু এ কী! নিশ্চিত আউট জেনেও রিভিউ নিলেন ক্রিস গেইল!
সিদ্ধান্ত থার্ড আম্পায়ারের কাছে যেতেই গোমর ফাঁস হলো। শব্দটা গেইলের ব্যাটে লেগে হয়নি, হয়েছে বলের সাথে উইকেটের ঠোকাঠুকির ফলে। সব দেখার পরে গেইলকে নট আউট ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন আম্পায়ার, আর বেলের রহস্যময় আচরণের ফলে আরেকবার হতাশ হলো ফিল্ডিং দল।
চতুর্থ ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নাম!
বিশ্বকাপের দ্বাদশ ম্যাচ। আবার কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনস স্টেডিয়াম। কিছুক্ষণ আগেই এখানে বাংলাদেশের বোলারদের উপর দিয়ে ‘নির্যাতন’ চালিয়েছেন ইংল্যান্ডের জেসন রয়, করেছেন ঝকঝকে ১৫৩ রান। আর তার উপরে ভর করে ৩৮৬ রানের এক রান পাহাড়ে উঠে গেছে ইংল্যান্ড।
বাংলাদেশ ইনিংসের ছেচল্লিশতম ওভারের ঘটনা। জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়ে গেছে ততক্ষণে। অপেক্ষা ছিল সাকিব আল হাসানের সেঞ্চুরির, হয়ে গেছে সেটাও। বল করতে এলেন বেন স্টোকস, স্ট্রাইকে তখন সাইফউদ্দিন। স্টোকসের করা বলটা ব্যাটে লাগলো বটে সাইফের, তবে যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে খেলতে পারলেন না। উঁচু হয়ে আসা বলটা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন লেগের দিকে, কিন্তু বলটা ব্যাটে লেগে গড়িয়ে উইকেটে আঘাত করলো।
কিন্তু তারপরেও অক্ষত রইলো বেল!
দৃশ্যটা দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন স্টোকস। মুখে হাসি, কিন্তু দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে অবিশ্বাস। ভাগ্যের এ কেমন রসিকতা? বল লাগার পরেও বেল পড়লো না?
সে যাত্রা বেঁচে গেলেও পরের বলেই সাইফের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে মধুর প্রতিশোধ নিলেন স্টোকস।
পঞ্চম এবং শেষ ঘটনা ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ম্যাচে। ঘটনাস্থল আবার সেই ওভাল। পাঁচ ঘটনার দুটি ওভালে, দুটি সোফিয়া গার্ডেনসে আর একটি নটিংহ্যামে। থ্রিলার গল্প লেখকরা ইচ্ছে করলে এই প্লটে একটা টানটান থ্রিলার গল্প লিখে ফেলতে পারেন।
প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে ৩৫১ রান তুলেছিল ভারত। আঙুলে চিড় নিয়েও সেঞ্চুরি করেছিলেন ওপেনার শিখর ধাওয়ান। কোহলি আর রোহিত শর্মার কাছ থেকে আসে দুটো হাফ সেঞ্চুরি। জবাব দিতে নামে অস্ট্রেলিয়া, ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার করতে আসেন বুমরাহ। প্রথম বলটি ঠেকান ওয়ার্নার, ড্রপ খেয়ে বল ছুঁয়ে দেয় উইকেটকে। কিন্তু তারপরেও বেল পড়লো না!
বুমরাহ তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। অবিশ্বাস ছিল কোহলির চোখে-মুখেও। এটা কী হলো? বল লাগার পরেও বেল পড়লো না?
ম্যাচের পরে মুখ বন্ধ রাখেননি কোহলি। তিনি বলেছেন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এরকম কিছু আশা করা যায় না। আর একজন গতিময় পেসারের বলে এমনটা হয়েছে, কোনো মিডিয়াম পেসারের বলে না। একটা ভালো বল করার পরেও যদি বোলার ব্যাটসম্যানকে আউট না করতে পারে, তবে সেটা মেনে নেয়া তার জন্য কষ্টকর।“
৩.
সমালোচনায় মুখর হয়েছেন অন্যান্য সাবেক ক্রিকেটারও। শোয়েব আখতারের কথা তো বলাই হলো। মুখ খুলেছেন মাইকেল ভনও। এককথায় তিনি ব্যাপারটাকে অভিহিত করেছেন ‘হাস্যকর’ বলে।
“ঘন্টায় আশি মাইল বেগে যাচ্ছিলো বলটা।” বুমরাহর বল দেখে বিবিসি’র এক অনুষ্ঠানে বলেছেন তিনি। “লেগ স্ট্যাম্পে আঘাতও করেছে। এরপরেও যদি কেউ বোল্ড না হয়, তবে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেয়া উচিত, কারণ পুরো ব্যাপারটাই পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।“
চুপ নেই নাসের হুসেইনও। “এরকমটা চলতে দেয়া যায় না।” বলেছেন তিনি। “বোলারদের কাজ খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বেল বদলানো প্রয়োজন অবিলম্বে।“
যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে হয়তো খুব শীঘ্রই জিং বেলস নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে আইসিসিকে!