সংগ্রামী জীবন থেকে উঠে এসে ক্রিকেট মাঠ আপন আলোয় আলোকিত করার অসংখ্য গল্প রয়েছে ক্রিকেটে। না, এ গল্পটি সেরকম সংগ্রামের নয়। মাঠকর্মী থেকে ক্রিকেটের অভিজাত সাদা পোশাককে রাঙিয়ে তোলার।
জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে অনিশ্চয়তারা ওৎ পেতে থাকে। আপনি সে অনিশ্চয়তার কতটুকু আঁচ করতে পারেন? জীবনের গন্তব্য জীবন খুঁজে নেবে, সেরকম চিন্তা হলে ভিন্ন কথা। আর যদি হয় এক তুড়িতে জীবনের অবিশ্বাস্য বাঁক-বদল? কতটা অবিশ্বাস্য হতে পারে, আন্দাজ করতে পারেন? আপনাকে চিন্তার সুযোগ দিয়ে সামনে আগানো যাক।
ক্রিকেটের ‘অখ্যাত’ কোনো এক মাঠকর্মী থেকে একদিন নিজেকে আবিস্কার করলেন আভিজাত্য আর মর্যাদায় মোড়ানো ওই ব্যাগি গ্রিন ক্যাপের একজন হিসেবে। কী, চিন্তার মলাট খুলছে? অখ্যাত বলার কারণটা একটু খোলাসা করে নিয়ে সামনে আগাবো। খানিক বাদেই যেখানে ব্যাটে-বলে ঝড় উঠবে, যেখান থেকে একেকজন মহীরুহের চিত্রনাট্য লেখা হবে, সেটি ওই ক্রিকেট মাঠ, বাইশ গজের ওই গালিচা। আর যিনি পরম আদরে সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানের মতো ওই মাঠের যত্ন নেন, ওই মায়ের মতো প্রতিদিন মাঠকে তৈরি করেন, যে মা প্রতিদিন ধৈর্য্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সন্তানকে তৈরি করে দেন স্কুলে যাবে বলে। কিন্তু সবসময় যার জায়গা হয় গল্পের পেছনের অধ্যায়ে, থেকে যান অখ্যাত। ‘আনসাং হিরো’ শব্দ যেটিকে বোধহয় আরো বোধগম্য করে তোলে।
ওহ! এতক্ষণে নামটাই তো বলা হলো না। সেই অখ্যাত একজন থেকে অনুসন্ধান করে খোঁজার একজন হয়ে যাওয়া নামটা নাথান মাইকেল লায়ন।
লায়নের জন্ম ১৯৮৭ সালের ২০ নভেম্বর, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ইয়াংয়ে। ক্যারিয়ার গড়তে ইয়াং ছেড়ে পরিবারসহ চলে আসলেন ক্যানবেরা। সেখানে অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটোরি’র অধীনে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৮। ২০০৮ সালে এসিটি কমেটসের হয়ে ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া কাপ’-এ সাউথ ওয়েলসের দ্বিতীয় সেরা একাদশের বিপক্ষে অভিষেক হয় লায়নের। এ সময়টাতে নিজের জন্য লায়ন খুঁজে পেয়েছিলেন সেই দলের কোচ এবং অধিনায়ক মার্ক হিগসকে। তিনিই প্রথম লায়নকে স্পিন বোলিংয়ের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন, কোন লাইন লেংথে বল করতে হবে, এবং কোন বলে কীভাবে ফিল্ডিং সাজাতে হবে।
মাঠ পরিচর্যা এবং খেলা, তখন পর্যন্ত দুটোই একসাথে চলেছে লায়নের। মানুকা ওভাল ক্যানবেরার চার বছরের শিক্ষানবীশ হিসেবে থাকার পর মাঠকর্মী হিসেবে লায়ন ক্যারিয়ার শুরু করলেন অ্যাডিলেড ওভালের। এ সময়ে মার্ক হিগসের সাথে বোলিংয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ রেখেছিলেন লায়ন। ভাবছেন, গল্পের মূল পটভূমি কোথায়? বাইশ গজে যে বল দিয়ে অসংখ্য মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে, যে বলে বিষাক্ততা ছড়িয়ে কেউ কেউ ‘শিল্পী’ বনেছেন, এতদিন কাছ থেকে নিশ্চয়ই সেসব লায়নের সাগরেও ঢেউ তুলেছে প্রতিনিয়ত!
তাই তো একদিন মাঠে মধ্যদুপুরে উদ্দেশ্যহীন পথের পথিকের ন্যায় বলটা হাতে নিয়ে সামনে আগালেন। উইকেটে এসে কয়েকটা বলও করলেন। উইকেটে পড়ে বলগুলো ক্রিকেটের ভাষায় ‘শার্প টার্ন’ করলো।
কোথাও পড়েছিলাম প্রতিভাবানদের খুঁজে নিতে নাকি ‘অদৃশ্যের’ আগমন হয়! না, অদৃশ্য থেকে লায়নকে কেউ খুঁজে নেয়নি। আবার ‘অদৃশ্য’ বললেও ভুল ধরবেন, সে সুযোগ খুব একটা নেই! এখান থেকেই সেই দৃশ্য-অদৃশ্যের গল্পের পটভূমি বাঁক নেয়া শুরু করবে, যেটার জন্য এতক্ষণ পাঠকের ধৈর্য্যর বাঁধ ভাঙা!
বল হাতে মাঠকর্মী ছেলেটার কারিকুরি দেখছিলেন ড্যারেন বেরি। ড্যারেন বেরি, পরিচয়টা কি জানা দরকার? তিনি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ ফ্র্যাঞ্চাইজি দল ‘রেডব্যাক’-এর কোচ, যেখান থেকে লায়নের অবিশ্বাস্য স্বপ্নযাত্রার পেখম মেলেছিল।
কোচ বেরি এগিয়ে এসে বললেন আবার বল করতে। লায়ন আবার বল করলেন। আবারও বলকে ওই ক্রিকেটের ভাষার ‘শার্প টার্ন’ করাতে সক্ষম হলেন নাথান লায়ন। কী, সব অবিশ্বাস্য ঠেকছে? চক্ষু চড়কগাছ হবার এখনো যে ঢের বাকী! বেরি তৎক্ষনাৎ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ডাইরেক্টর অফ ক্রিকেট এবং জাতীয় নির্বাচক কক্সিকে ডাকলেন এবং বললেন:
‘মেট, দিস কিড ডাউন হিয়ার ইজ সেনসেশনাল।’
কক্সি বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটা কে? এরপর উত্তর দিলেন বেরিই,
‘নাথান লায়ন। ওহ, ইয়াহ, আই ওয়ান্ট টু পিক হিম।’
কক্সিকে বোঝাতে আরো কিছুটা সময় লাগে বেরির। লায়নের ভাগ্য চাবি খুলে যাওয়া বেরি এবং কক্সির শেষ কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো:
“At that stage I was just the coach of the Big Bash team. Coxy said, ‘Well, he’s not even in the state squad, he’s just playing at Prospect.’ I said, ‘Get down here and have a look, I want to pick him.’ Long story short, Coxy had a look and said, ‘Yeah, looks pretty good, I’ll back your judgement. [But] we’re going to face a bit of criticism here for plucking someone from nowhere’, but I saw enough in three or four balls to know this bloke is special.”
এভাবেই লায়নকে নিজের ডেরায় নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন রেডব্যাক কোচ বেরি। লায়নের কাছে তখনও সবকিছু নিজেকে চিমটি কেটে সত্যি নাকি মিথ্যার যাচাইয়ের মতো মনে হচ্ছিল! কোচ লায়নকে একটা জিনিস বোঝাতে চাইলেন, তাকে এখানে দল ভারী করার জন্য নিয়ে আসা হয়নি। স্পিন, স্পিন এবং স্পিন – এই দর্শনে দলকে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য তাকে নেওয়া হয়েছে। বেরি লায়নের মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছেন।
ওই বছরের ২০১০-১১ কেএফসি টি-টোয়েন্টি বিগ ব্যাশ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘রেডব্যাক’। মনে উঁকি দিচ্ছে, সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী নাথান লায়ন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নতুবা আর জীবনটা স্বপ্নের মতো রঙিন মনে হবেই বা কেন!
টুর্নামেন্টশেষে শেফিল্ড শিল্ডে সিজনের শেষ ভাগে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেন লায়ন, এবং একই দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ওয়ানডে টুর্নামেন্টও খেলেন লায়ন। ড্যারেন বেরি তখন থেকে একটাই কথা বলেছেন,
‘এই ছেলে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলবে।’
না, সময় লায়নকে ১৮ মাসও অপেক্ষায় রাখেনি। ১২ মাসেরও কম সময়ে মাথায় তুলেছেন ওই বিখ্যাত ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। একজন অজি ক্রিকেটারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন!
আবার একটু পেছনে ফেরা যাক।
ঘরোয়া মৌসুম শেষ হয়েছে। তখনকার অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ এবং শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য নিযুক্ত প্রধান নির্বাচক গ্রেগ চ্যাপেল অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের জিম্বাবুয়ে সফরের দলে লায়নকে দলভুক্ত করেন। জিম্বাবুয়েতে সেই ত্রিদেশীয় সিরিজে ১১ উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কা সফরের দলের জায়গা করে নেন নাথান লায়ন। জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার পূর্বে লায়নের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের ভাণ্ডারে সাকুল্যে চারটি শেফিল্ড শিল্ড ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সংস্কৃতি বিবেচনায় যেটি একপ্রকার অবিশ্বাস্য!
৩১ আগস্ট ২০১১, গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে অভিষেক লায়নের। প্রথম ইনিংসের ব্যাটিংয়ে প্রথম দিন পার করে দিল অস্ট্রেলিয়া। সেদিন আর বল হাতে নেওয়া হলো না লায়নের। ১লা সেপ্টেম্বর ২০১১, ক্যারিয়ারের প্রথম বল করতে বোলিং পজিশনে নাথান লায়ন। একটু কি নার্ভাস ছিলেন লায়ন? এই তো, সেদিন প্রথম ট্রাকস্যুট পেয়েই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন! সেই তিনিই আন্তর্জাতিক ম্যাচে নিজের প্রথম বল করবেন… উত্তেজনা ঘিরে ধরাই তো স্বাভাবিক!
হয়তো সাধারণ কোনো অফব্রেক ডেলিভারি হবে – ব্যাটসম্যান ডিফেন্স করবেন, অথবা ডিফেন্সিভ মুডে ছেড়ে দিবেন। এর বেশি কী আর আশা করবেন! প্রথম বল করলেন লায়ন। কিন্তু ভাগ্যদেবী আরেকবার হাসলেন, মধুচন্দ্রিমা জমলো আরো একটু। আউট! ব্যাটসম্যান, কুমার সাঙ্গাকারা!
প্রথম বলে উইকেট! কল্পনার গল্পকে ভ্রম বানিয়ে বাস্তবতায় নামিয়ে আনলেন লায়ন! তবে বাস্তব যে তখন স্বপ্নের মতো! নামটা লিখিয়ে নিলেন পরিসংখ্যানের পাতায়। যেখানে লেখা থাকবে তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান বোলার এবং ১৭তম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলে উইকেট নিয়েছেন লায়ন!
প্রথম ইনিংসে লায়নের বোলিং ফিগার ৫/৩৪। পরিসংখ্যানকে লিখতে বললেন, নাথান লায়ন ১৩১তম বোলার যিনি অভিষেকেই পাঁচ উইকেট নিয়েছেন, এবং ১৫তম অস্ট্রেলিয়ান বোলার, যিনি ইনিংসের শেষ বলে ‘কট অ্যান্ড বোল্ড’ উইকেট নিয়েছেন।
নাথান লায়নের নাম নিয়েও রয়েছে মজার তথ্য। আপনি যদি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ফলোয়ার হন, নিশ্চয়ই উইকেটের পেছন থেকে শুনেছেন ‘নাইস গ্যারি’ শব্দটা। উইকেটের পেছন থেকে ‘নাইস গ্যারি’, ‘নাইস গ্যারি’ প্রথম শোনা যায় ম্যাথু ওয়েডের মুখ থেকে। সেই সূত্রে এখনকার অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক এবং উইকেটকিপার টিম পেইনও উইকেটের পেছন থেকে লায়নের উদ্দেশ্যে বলেন ‘নাইস গ্যারি’ শব্দযুগল। কিন্তু এই নামটা লায়নের সাথে জুটলো কীভাবে? শোনা যায়, সাবেক মেলবোর্ন ফুটবল ক্লাবের অধিনায়ক এবং বর্তমানে ব্রডকাস্টিংয়ের সাথে জড়িত ‘গ্যারি লায়নের’ নাম থেকে এই ‘নাইস গ্যারি’ শব্দের উৎপত্তি।
লায়ন কখনো কি ভেবেছিলেন, পেশাদারিত্বের চাদরে মোড়ানো ওই অজি ড্রেসিংরুমে কাঁধে কাঁধ রেখে জয়োল্লাস করবেন? কখনো কি ভেবেছিলেন, কব্জির ওই ছোট্ট মোচড়ে ইতিহাস-সমৃদ্ধ অজিদের ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন? কখনো কি ভেবেছিলেন, আপনার মাহাত্ম্য বোঝাতে বিভিন্ন প্রান্তের হাজার-হাজার মাইল দূর থেকে লক্ষ-কোটি শব্দ ব্যয় হবে? এই তো সেদিন চরম মুহূর্তে রান-আউট মিসে ময়দানে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ একজন হিসেবে ভেবেছিলেন। কখনো কি ভেবেছিলেন, অজি-ইংরেজ মর্যাদার অ্যাশেজ অজিদের উল্লাসে একদিন আপনিও ‘মধ্যমণি’ হবেন?
সবগুলোর সম্মিলিত উত্তর হয়তো ভাবেননি। সেটা যে কখনো ভাবনায় আসেনি, লায়ন মনে করিয়ে দিয়েছেন নিজের জবানিতে। ভাবনারও দোষ কোথায়? কতটাই বা বিশাল হতে পারে ভাবনার জগৎ? কতটা সীমানা ছড়াতে পারে ভাবনার পরিসীমা? ভাবনা কতটা উচ্চতায় পোঁছালে সাধারণ একজন মাঠকর্মী থেকে জগৎ-বিখ্যাত অজি ড্রেসিংরুমের একজন ভাবা যায় নিজেকে?
নাথান মাইকেল লায়ন, চলতে থাকুক আপনার অবিশ্বাস্য গল্পের দৌঁড়! আপনাকে নিয়ে যে আরো কাব্যের বাকি রয়ে গেছে!
নিজের উপর নাথান লায়নের কতটা আত্মবিশ্বাস রয়েছে, তার ক্যারিয়ারের একটা প্রামাণ্য চিত্রে চোখ বুলানো যাক। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে লায়ন বলেন,
“আমি বিশ্বাস করি, আমার স্টক বল দিয়ে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় যেকোনো ব্যাটসম্যানের উইকেট নিতে পারবো। কিন্তু এর মানে, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল, স্পটস এবং ভেরিয়েশন থেকে প্রতিনিয়ত ব্যাটসম্যানের ডিফেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানানো। উপমহাদেশে সেটাই মূল অস্ত্র।”
শেষটা করবো নাথান লায়নের ক্যারিয়ার বাঁকবদল অধ্যায়ের মূল কান্ডারী রেডব্যাক কোচ ড্যারেন বেরিকে স্মরণ করে। যিনি সেদিন লায়নকে খুঁজে না নিলে লায়নের গল্পটা হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো! সেদিন লায়নের বোলিং দেখে বেরি বলেছিলেন:
I saw the ball come out of an offspinner’s fingers with genuine fizz and drift and loop and thought straightaway, ‘This is special, this isn’t just a flat offie’.
ড্যারেন বেরি যে সেদিন রত্ন চিনতে ভুল করেননি, নাথান লায়ন প্রমাণ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।