বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী যতগুলো অটোমোবাইল রেসিং প্রতিযোগিতা প্রচলিত আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতাটির নাম হলো 24 Hours of Le Mans বা ‘২৪ ঘন্টার ল্য মঁস’ রেস। ১৯২৩ সাল থেকে যাত্রা শুরু করা এই আইকনিক গ্রাঁ প্রিঁ প্রতিবছর ফ্রান্সের ল্য মঁস শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মাঝে কয়েক বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বন্ধ থাকলেও অটো রেসিং ভক্তদের মাঝে আজপর্যন্ত এই রেসিং মহাযজ্ঞের আবেদন এতটুকুও কমেনি।
প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এই রেসকে বিবেচনা করা হয় একজন ড্রাইভারের জন্য ধৈর্য্যের অগ্নি পরীক্ষা হিসেবে। শুধুমাত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রেসিং ড্রাইভারদেরই সুযোগ হয় ২৪ ঘন্টার ল্য মঁস রেসে প্রতিযোগিতা করার। অসংখ্য বিশ্ব রেকর্ড, নতুন প্রযুক্তির অসাধারণ সব রেসিং কার এবং বেশ কিছু করুণ দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা এই রেসিং প্রতিযোগিতা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ধৈর্য্য ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিভিন্ন গাড়ি প্রদর্শনীর এক অনন্য প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
২৪ ঘন্টার ল্য মঁস রেসের ইতিহাস, তার বিবর্তন এবং রেসিং দুনিয়ায় তার আবেদন নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯২০ সালের দিকে এই দুই মহাদেশের কিছু দেশ সাহিত্য, সঙ্গীত এবং শিল্পায়নের দিক থেকে বেশ সম্বৃদ্ধি অর্জন করেছিল যা ‘রোরিং টুয়েন্টিজ’ বা ‘বিশের গর্জন’ নামেও পরিচিত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে এই সময়েই সেসব দেশে ধীরে ধীরে অটোমোবাইলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ফরাসিরাও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
এরও অনেক আগে থেকেই ইউরোপে কার রেসিং বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গতানুগতিক কার রেসিং-কে আরও আকর্ষণীয় এবং চ্যালেঞ্জিং করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ কয়েক বছরের মধ্যেই রেসিং ট্র্যাকে যাত্রা শুরু করে ২৪ ঘন্টার ল্য মঁস রেস।
১৯২৩ সালে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় অটোমোটিভ গ্রুপ ‘Automobile Club de l’Ouest (ACO)’ দেশটির ল্য মঁস শহরে প্রথমবারের মতো ’২৪ ঘন্টার ল্য মঁস’’ রেসের আয়োজন করে, যা বিশ্ববাসীর কাছে ছিল একেবারেই নতুন। শহরটির মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সার্ত নদীর নামানুসারে এর রেসিং ট্র্যাকের নামকরণ করা হয় সার্কিট-দ্য-লা-সার্ত। কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও তৈরির পর থেকে আজ পর্যন্ত ল্য মঁসের সার্কিট প্রায় একই রকমই থেকে গেছে এবং প্রায় ৮.৪৬৭ মাইল দৈর্ঘ্যের এই রেসিং সার্কিটটি পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ রেসিং ট্র্যাক হিসেবে সুপরিচিত।
প্রথম ল্য মঁস রেসটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২৬-২৭ মে তারিখের মধ্যে। রেসের নিয়ম ছিল খুবই সাধারণ– যে গাড়ি ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে সেটিই চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিবেচিত হবে। দ্রুতই নতুন ধরনের এই প্রতিযোগিতার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পরে এবং কালের বিবর্তনে এটিই পরিণত হয় গাড়ি দুনিয়ার অন্যতম সম্মানজনক এক রেসিং প্রতিযোগিতায়।
২৪ ঘন্টার ল্য মঁস রেসের ট্র্যাক ‘সার্কিট-দ্য-লা-সার্ত’ বেশ কয়েক অংশে বিভক্ত। যেখান থেকে রেস শুরু হয় সার্কিটের ওই অংশটুকু ‘ইন্ডিয়ানাপোলিস’ নামে পরিচিত। ইন্ডিয়ানাপোলিস অতিক্রম করার পর একজন রেসারকে একে একে পার হতে হয় ‘আর্নেজ’, ‘পোর্শে কার্ভ’, ‘কর্ভেত্তে কার্ভ’, ‘ফোর্ড শিকেইন’, ‘ডানলোপ কার্ভ’, ‘ টার্ট্রে রূজ’ ইত্যাদির মতো দুরূহ সব বাঁক। এসব বাঁকের একটি উদ্দেশ্য যেমন রেসকে আরও কঠিন করে তোলা, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাড়ির গতি কমিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর ব্যাপারটিও কাজ করে।
‘টার্ট্রে রূজ’ বাঁকের পর শুরু হয় প্রায় ৩.৭ মাইল দৈর্ঘ্যের ‘মুলসেন স্ট্রেইট’। ট্র্যাকের সম্পূর্ণ সোজা এই দীর্ঘ অংশটিতে একেক জন রেসার আক্ষরিক অর্থেই গতির ঝড় তোলেন। ১৯৮০ সালেও ‘মুলসেন স্ট্রেইট’ দিয়ে একজন ড্রাইভার ২৫০ মাইল/ঘণ্টা গতির গাড়ি ছুটিয়েছেন। কিন্তু এত বিপুল গতি অনেক সময়ই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮১ সালে লুইস লাফোসে এবং ১৯৮৬ সালে জো গার্টনার নামক দু’জন ড্রাইভার মুলসেন স্ট্রেইটে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে গাড়ির গতি কমানোর লক্ষ্যে এবং ড্রাইভারদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কর্তৃপক্ষ মুলসেন স্ট্রেইটে অতিরিক্ত তিনটি বাঁক যুক্ত করে দেন। তাই বর্তমানে সার্কিটের এই অংশে গড়ে ২০০-২২৫০ মাইল/ঘণ্টা গতিতে ছুটতে দেখা যায় একেকটি গাড়িকে।
মোট চার শ্রেণীর গাড়ি অংশ নিতে পারে ২৪ ঘন্টার ল্য মঁস রেসে। এগুলো হলো এলএম পি-১, এলএম পি-২, এলএম জিটিই প্রো এবং এলএম জিটিই এএম। শুধুমাত্র রেসিং ট্র্যাকে ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন অটোমোবাইল কোম্পানির অধীনে রেসে নামা বদ্ধ ককপিটের গাড়িগুলো এলএমপি-১ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এলএমপি-২ শ্রেণীর গাড়িগুলোও এলএমপি-১ এর মতোই, তবে সেগুলো কোনো অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অধীনে নয় বরং স্বাধীন কোনো রেসিং দলের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
একইভাবে এলএম জিটিই প্রো এবং এলএম জিটিই এএম এই দুই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত গাড়িগুলো সাধারণ রাস্তায় চলাচলের উপযোগী। তবে কিছু পরিবর্তন করে এগুলোকে রেসের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো, এলএম জিটিই প্রোর গাড়িগুলো যেখানে পেশাদার ড্রাইভারদের দ্বারা চালনা করা হয়, সেখানে জিটিই এএম শ্রেণীর গাড়ি গুলোর দায়িত্বে থাকে কয়েকজন অপেশাদার বা মাত্রই ক্যারিয়ার শুরু করা ড্রাইভার।
২৪ ঘণ্টার প্রতিযোগিতা বলে যে একজন ড্রাইভারকেই ২৪ ঘণ্টা টানা গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে তা কিন্তু নয়। বরং প্রতি দলে বর্তমানে মোট তিনজন করে ড্রাইভার থাকে যারা পালা করে ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করে। তবে গাড়ি একটিই থাকে। তাছাড়া এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পিট স্টপসে গিয়ে গাড়িতে ফুয়েল ভরা, নতুন চাকা লাগানো, টুকটাক যান্ত্রিক গোলযোগ সেরে নিতে হয়।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত ১৯২৩ সালের ল্য মঁস রেসে চ্যাম্পিয়ন হয় একটি ফ্রেঞ্চ রেসিং দল। চেনার্ড-ওয়াকার কোম্পানির একটি ৩-লিটার ইঞ্জিনের গাড়ি ব্যবহার করা ওই ফ্রেঞ্চ দলের সদস্য ছিলেন আন্দ্রে লেগাসি এবং রেনে লিওনার্ডের নামক দু’জন রেসিং ড্রাইভার। ৩৩টি রেসিং দলকে পেছনে ফেলে তারা দু’জন জুটি বেঁধে ওই দিন মোট ১৩৭২.৯৪ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন।
উদ্বোধন পরবর্তী দেড় যুগের মতো নিয়মিতই চলেছিল ল্য মঁস রেস। কিন্তু এরপর শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্রান্সেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পরলে একসময় ধবংসপ্রাপ্ত হয় রেসের ট্র্যাক এবং গ্যালারি। ফলে দশ বছরের মতো বন্ধ রাখতে হয় জনপ্রিয় এই রেসিং প্রতিযোগিতা।
যুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সাল থেকে আবার শুরু হয় ২৪ ঘণ্টার ল্য মঁস রেস। নতুন করে যাত্রা শুরু করা এই রেসিং প্রতিযোগিতা আরও বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে। তার জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, মাত্র চার বছরের মাথায় ২৪ ঘণ্টার ল্য মঁস রেস যুক্ত হয়ে যায় ‘ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস কার চ্যাম্পিয়নশিপে’র। পরবর্তীতে এটি স্পোর্টস কার চ্যাম্পিয়নশিপের একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়।
১৯৫০ সালের পর থেকে ল্য মঁস পৃথিবীর বড় বড় সব অটোমোবাইল কোম্পানি যেমন- ফেরারি, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, অ্যাস্টন মার্টিন, জাগুয়ার ইত্যাদির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব কোম্পানি ল্য মঁস জয়ের জন্য একাধিক গাড়ি রেসে নামাতে শুরু করে। একই সাথে নিজেদের রেসিং দল নিঁখুত করে গড়ে তুলতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা শুরু করে। ফলে ল্য মঁসের আকর্ষণ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
ল্য মঁস রেস তার দীর্ঘ পথচলায় অসংখ্য স্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। এর মধ্যে ১৯৫৩ সালে রেসের ইতিহাসের অন্যতম সফল দল ‘টিম ফেরারি’র প্রথমবারের মতো ল্য মঁস জিতে নেওয়ার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১৯৬৬ সালে আমেরিকান গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ফোর্ডের সাথে ফেরারির দ্বন্দ্ব।
ষাটের দশকের শুরুতে ফোর্ড কোম্পানি ফেরারিকে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তারা ল্য মঁসের তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন ফেরারিকে রেসিং ট্র্যাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। ফলস্বরূপ ১৯৬৬ সালের ল্য মঁসে তারা আবির্ভুত হয় তাদের বিখ্যাত ফোর্ড জিটি-৪০ মডেলের গাড়ি নিয়ে। ওই বারের ল্য মঁসে ফোর্ড আন্ডারডগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরারিকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী চার বছর ফোর্ডের জয় ধারা অব্যাহত থাকে।
অন্যান্য দীর্ঘ রেসিং প্রতিযোগিতার মতো ২৪ ঘণ্টার ল্য মঁস রেসও বেশ কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। এর মধ্যে ১৯৫৫ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে করুণ। ওই বছরের ল্য মঁসে একটি মার্সিডিজ-বেঞ্জ ৩০০ এসএলআর’ মডেলের একটি গাড়ি ট্র্যাকে দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে উড়ে গিয়ে পরে দর্শক সারিতে। গাড়িটি তৈরিতে অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ ম্যাগনেসিয়াম-এলয় ব্যবহৃত হওয়ায় নিমিশেই সেটিতে আগুন ধরে যায় এবং এর ফলে গাড়ির ড্রাইভারসহ দর্শক সারিতে বসে থাকা ৮৩ জন মৃত্যু বরণ করেন। আহতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। এই দুর্ঘটনা এখনও মোটর রেসিং ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
যাত্রা শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত সার্কিট-দ্য-লা-সার্ত সাক্ষী হয়ে আছে অসাধারণ সব ফিনিশিং, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, গতির বেশ কিছু বিশ্ব রেকর্ড এবং অসংখ্য চোখ ধাঁধানো স্পোর্টস কারের। এই রেসিং প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন যাবৎ যেমন সাধারণ দর্শকদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়ে আসছে তেমনি বড় বড় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানির মধ্যে তৈরি করেছে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এক সুস্থ প্রতিযোগিতা। তাদের মধ্যকার প্রতিযোগিতার ফলে পৃথিবী পেয়েছে অসংখ্য উন্নত প্রযুক্তির সব গাড়ি। ২৪ ঘণ্টার ল্য মঁসের সম্বৃদ্ধ ইতিহাস, প্রতিযোগী দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দর্শকের আগ্রহ সবকিছু মিলিয়েই এটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় এক রেসিং প্রতিযোগিতায়।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/