
জোসেফ পেপ গার্দিওলা। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সফল কোচদের একজন। তিনি না জিতেছেন, এহেন কোনো ট্রফি ইউরোপে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বিবিসি’র মুখোমুখি হয়েছিলেন জীবন ও সংগীত নিয়ে কথা বলতে। দার্শনিক ভাবমূর্তির কোচ গাার্দিওলা সঙ্গীত নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি অভিবাসী সংকট, ফুটবল দর্শন, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলেছেন। বাছাই করা সেই অংশটুকুই তুলে ধরা হলো আজ।

নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
পরিসংখ্যান আর সংখ্যা ব্যাপারটা ভালো। কিন্তু সংখ্যা কখনোই আমার আগ্রহের ব্যাপার নয়, এটা আপনাকে কিছু দেবে না। দশ বছর পর এটা বলা ভালো হবে যে, আমাকে কীভাবে মনে রাখা হচ্ছে। আমরা কীভাবে খেলেছি, কীভাবে কাজটা করেছি, সেটা কীভাবে মনে রাখা হচ্ছে, সেটাই ব্যাপার। শিরোপা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আর শিরোপাগুলোই আমাকে চাকরি পেতে সহায়তা করে, আমার আবেগের ব্যাপারটা নিয়ে এতে আমি কাজ করতে পারি।
কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা সব কোচেরা আসলে আমাদের সব পুরোনো খেলোয়াড়দের ব্যাপারে আনন্দিত থাকি। আমরা তাদের সাথে একসাথে হাসতে পারি, তাদের জড়িয়ে ধরতে পারি। প্রত্যেকেই আসলে ভালোবাসা পেতে ভালোবাসে, এটাই জীবনের গোপন রহস্য।
আমি আমার বাকিটা জীবন একজন ম্যানসিউনিয়ান হয়ে থাকতে চাই। আমি ম্যানচেস্টার সিটির একজন ভক্ত হয়ে থাকতে চাই। ইংল্যান্ডে অন্য কোনো ক্লাবকে আমার পক্ষে ম্যানচেস্টার সিটির মতো করে অনুশীলন করানো সম্ভব হবে না। কারণ আমি এখানকার লোকদের ভালোবাসাটা অনুভব করি। লোকে যখন জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কী চাও?’ আমি স্রেফ ভালোবাসা চাই। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো, যখন আপনি অন্যের এই ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারবেন।

ইয়োহান ক্রুইফ সম্পর্কে
[ডাচ ফুটবল কিংবদন্তী ইয়োহান ক্রুইফ। ২০১৬ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাবেক এই ফুটবলারর ও কোচ। তিনি গার্দিওলার নিজের ও বার্সেলোনার প্রাক্তন কোচ ছিলেন। গার্দিওলা যখন কোচিং শুরু করলেন, তার নতুন দর্শনের অন্যতম গুরুও ছিলেন। গার্দিওলা কথা বলেছেন তাকে নিয়েও]
উনি আমাকে এই খেলাটাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, ফুটবলকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। উনি শিখিয়েছেন যে এটা আমাকে বুঝতে হবে, এই ব্যাপারটাকে ভালোবাসতে হবে। উনি আমাদের গোপন কিছু জিনিস দিয়েছিলেন, কারণ সেগুলো এমন কিছু ছিল যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। তিনি ফুটবলকে একেবারেই ভিন্ন একটা দৃষ্টিতে দেখতেন। ওই দৃষ্টিতে দেখার বিপুল এক ক্ষমতা ছিল তার। আবেশে আক্রান্ত, চাহিদাসম্পন্ন এবং পরিশ্রমী একজন মানুষ ছিলেন। আবার তিনি ছিলেন একজন নির্দয় পিতার মতো। উনি এতটা কঠিন ও কঠোর ছিলেন, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
কোনো কিছুই সহজ ছিল না। এমন একটা সময় ছিল যে, আমি আর ওনার সাথে টিকতে পারছিলাম না। কিন্তু দিনশেষে উনিই সঠিক ছিলেন।
আমি খুব বেশি ধার্মিক মানুষ নই। আমি চার্চে যাতায়াত করে বড় হয়েছি, কিন্তু নিজেকে খুব বেশি বিশ্বাসী বলে দাবি করি না। তাই তার সাথে কথা হয় না। তবে সবসময় তাকে মনে পড়ে। হতে পারে যে, আমি বিশ্বাসে সেই আস্থাটা রাখতে চাই যে, তিনি আমাদের দেখছেন। কখনো কখনো আমার মনে হয়, এটাই ঘটে।

অভিবাসী সংকট প্রসঙ্গে
এটা এমন একটা ব্যাপার যে, এই একটা দুনিয়াতেই তো আমরা বাস করছি। ভূমধ্যসাগরের চারপাশে মানুষ মারা যাচ্ছে। আর ইতালি, স্পেনের সরকার সেই মরতে থাকা মানুষগুলোকে উদ্ধার করার অনুমতিটাও দিচ্ছে না।
আমি জানি না, আমরা এসব করে কী ধরণের সমাজ তৈরি করতে যাচ্ছি। কারণ এটা তো আইনের ব্যাপার নয়, এটা মানবতার ব্যাপার। যদি এভাবে মানুষ মরতে থাকে, কিছু নায়কোচিত মানুষ তাদের খালি হাতে উদ্ধার করতে যায়। তাও সরকারগুলো সেই উদ্ধারের অনুমতি দিচ্ছে না। এর কারণ হলো, আমরা খুব, খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছি।
আর এই কারণেই ইউরোপের কমিউনিটি, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সব বড় দেশকেই এই সমস্যার একটা সমাধান করতে হবে। স্পেনেই একসময় গৃহযুদ্ধ হয়েছে, লোকেরা সেখান থেকে পালিয়েছে। এই ইংল্যান্ডে, মেক্সিকোতে, হল্যান্ডে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে লোকেরা যুদ্ধের জন্য পালিয়ে গেছে। আমার প্রপিতামহরা, আমার প্রপিতামহের পিতারাও একদিন এই প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে গেছেন। তখন অন্যরা আমাদের গ্রহণ করেছে। তারা (দেশ) ছাড়তে চাননি, কিন্তু যুদ্ধের জন্য ছাড়তে হয়েছে। আজ অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটছে। তখন যদি অন্যরা আমাদের গ্রহণ করে থাকে, আমরা কেন আজ তাদের গ্রহণ করতে পারবো না?

ডেভিড সিলভা ও তার সন্তান
[ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার ডেভিড সিলভার ছেলে অপরিণত অবস্থায়, মাত্র ২৫ সপ্তাহে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তার জন্ম। জানুয়ারিতে সিলভা বলেছিলেন, তার ছেলে প্রতিদিন একটু একটু করে উন্নতি করছে। মে মাসে ‘মাতেও’ নামের হতভাগ্য এই ছেলেটিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিকিৎসকরা অনুমতি দেন। আর গত আগস্টে সিলভা তার ছেলেকে নিয়ে আসেন ইতিহাদ স্টেডিয়ামে। হাডার্সফিল্ডের বিপক্ষে ৬-১ গোলে জেতা ম্যাচে মাঠে এসেছিলো মাতেও। এই সিলভা ও তার ছেলেকে নিয়ে বলেছেন গার্দিওলা।]
এটা সবসময় আমাদের জীবনের একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার হয়ে রইবে; আমরা যারা দেখেছি ও কীভাবে কষ্ট পেয়েছে, কী ঘটেছে, সকলের জন্যই। মাতেও কয়েক মাস ধরে তার জীবন সংগ্রাম চালিয়েছে। আমরা ডেভিডকে বলেছি, তোমার যদি ওখানে থাকতে হয়, তুমি নিজেই থাকার সিদ্ধান্ত নাও আমরা তোমার সব প্রয়োজনে পাশেই আছি।
এখন সবকিছু ভালো চলছে। ডেভিড খুব শক্ত ছেলে। আমার মনে হয়, ও খুব পরিণত। আমার ইদানিং মনে হয়, ও আগের চেয়ে বেশি হাসছে আজকাল, ও আগের চেয়ে বেশি কথা বলছে। এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতির ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ দেখাটা অসাধারণ একটা ব্যাপার। আমার ধারণা, মাতেও খুব শক্ত মানুষ হবে। সে তার জীবনের শুরুতেই কোনোক্রমে বেঁচে ফিরেছে। ফলে এই জীবনে আরো যত কঠিন পরিস্থিতিই আসুক, আমি জানি ও ভালোভাবেই সামলাতে পারবে।
ডেভিড একটু লাজুক ছেলে, খুব বেশি কথা বলে না, খুব বেশি সাক্ষাৎকার দেয় না। তবে লোকেরা ওকে যেমন মনে করে, ওর ক্ষেত্রে সত্যিটা তার ঠিক বিপরীত। সে একজন সত্যিকারের লড়াকু। আর এ জন্যই মাতেও নিজেও দারুণ লড়াকু হবে।

নতুন কিছু করার গুরুত্ব
আমার মনে হয়, মানুষের ইতিহাস সামনে এগিয়েছে, কারণ মানুষ বর্তমানের বাস্তবতা মেনে নেয়নি এবং নতুন কিছু সবসময় আবিষ্কার করতে চেয়েছে। আপনি যদি সৃজনশীল না হন এবং প্রশ্ন না করেন যে, আমরা কেন এটা করবো, কেন অন্যভাবে করবো না, তাহলে মানবজাতিই আর বেশিদিন টিকে থাকবে না। মানবজাতিকে উন্নতি করতে হলে এই প্রশ্ন করা মানুষগুলোর প্রয়োজন আছে।
ফুটবল খুব সুন্দর এই কারণে যে, এখানে আজ যেটা কাজে দেয়, কাল সেটা আর কাজ করবে না। কখনো কখনো আপনি এমন কিছু করবেন, মনে হবে, ঠিক আছে। কিন্তু সেটাই যদি নিরন্তর করতেই থাকেন, তাহলে ওটা একসময় অকেজো হয়ে যাবে। আপনি যখন এই ইঙ্গিতটা পাবেন, যখন বুঝতে পারবেন, তখন আপনাকে ভিন্ন কিছু করতেই হবে। সব কোচ, আমরা সবাই অনেক সিদ্ধান্ত নেই এই অনুভবের কারণে। আমরা প্রতিপক্ষ সম্পর্কে অনেক তথ্য পাই। কিন্তু শেষ অবধি এটা নিজের অনুভূতি নিয়ে বাঁচার ব্যাপার।