ফরাসি ক্লাব মোনাকোতে ফ্যাবিনহোর দিনগুলো বেশ ভালোই যাচ্ছিল। একজন ডিফেন্ডার তিনি, নিয়মিত খেলে আসছেন রাইটব্যাক পজিশনে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এভাবেই তার ক্যারিয়ার কেটে যাবে। অবশ্য মোনাকো থেকে বড় ক্লাবে খেলার স্বপ্ন আছে তার, আগামী কয়েক মৌসুমে আরও উন্নতি করলে বড় ক্লাব থেকে ডাক পাবার ভালো সম্ভাবনা আছে। কিন্তু একদম আকস্মিকভাবে ফ্যাবিনহোর ক্যারিয়ারের হাওয়া বদলে গেল। লিওনার্দো জারদিম মোনাকোর কোচের চেয়ারের বসে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের মোড়ই ঘুরিয়ে দিলেন।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন মোনাকোর সাথে ফ্যাবিনহোর চুক্তি বাড়ানোর প্রসঙ্গে কথাবার্তা চলছে, ঠিক সে সময়ে মোনাকোর কোচ লিওনার্দো জারদিম তাকে নিয়ে ভিন্ন পরিকল্পনা ভাবছিলেন। চুক্তি করার বৈঠকে তিনি তার পরিকল্পনা পেশ করেন।
ফ্যাবিনহোকে প্রতিনিধিত্ব করতেন বার্সেলোনা, চেলসি ও পোর্তোর একসময়ের সেরা খেলোয়াড় ডেকোর ভাই লুসিও আরাজো। ক্লাব পরিদর্শন শেষে জারদিম আরাজোর কাছে এসে হাসিমুখে ভবিষ্যদ্বাণী করেন,
‘ফ্যাবিনহো ইউরোপের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজন হতে যাচ্ছে।’
নিয়মিত রাইটব্যাক ফ্যাবিনহোকে নিয়ে এমন প্রস্তাবনার জন্য লুসিও ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না, তাই প্রথমে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
লোনে থাকার পর ২০১৫ সালে ফ্যাবিনহোকে মোনাকো কিনে নেয়। প্রথম মৌসুমে ফ্যাবিনহোকে নিয়মিত ম্যাচে সুযোগ দিতে থাকেন জারদিম। জারদিম এমন একজন কোচ, যাকে প্রথম থেকে ভরসা করতেন ফ্যাবিনহো। আর তার নিজের পজিশন রাইটব্যাকেও তিনি সাবলীল ছিলেন। এজন্য হুট করে পজিশন পরিবর্তনের বিষয় তার কাছে সোজা ছিল না। সম্প্রতি তিনি ব্রাজিল জাতীয় দলেও নিয়মিত ডাক পাচ্ছেন। দানি আলভেজের বিকল্প হিসেবে ব্রাজিল দলে তখন সুযোগ্য কোনো রাইটব্যাক নেই। তাই রাইটব্যাক থেকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বনে গেলে ব্রাজিল দলে তার ডাক না-ও আসতে পারে, প্রধানত এই ভয়ই ফ্যাবিনহোকে জাপটে ধরেছিল। তার এই ভয় ও চিন্তার বিষয় তিনি তার এজেন্টকে জানান। কিছুটা অস্থিরতা মেশানো কণ্ঠে তিনি তার এজেন্ট লুসিওকে বলেছিলেন,
‘আমাকে রাইটব্যাক পজিশনেই খেলাতে হবে, নতুন চুক্তিতে এমন কোনো অনুবিধি রাখা যায় না?’
কিন্তু এসব চিন্তার সময় ততদিনে পার হয়ে গেছে। লিওনার্দো জারদিম তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। নতুন মৌসুমকে সামনে রেখে দলের নতুন রাইটব্যাক হিসেবে তিনি পছন্দ করেন লিঁলের ফরাসি ফুলব্যাক জিব্রিল সিদিবে’কে। তাই কোচকে বিশ্বাস করা ছাড়া ফ্যাবিনহোর সামনে অন্য কোনো সুযোগ ছিল না।
ফ্যাবিনহোর মিডফিল্ডার বনে যাওয়া ও নতুন চুক্তি সম্পর্কে লুসিও বলেন,
‘ফুটবলে রাইটব্যাকের চাহিদা অপ্রতুল। তবে এতে তো আমাদের হাত ছিল না। আমরা বিশ্বাস করতাম, ফ্যাবিনহো একজন বিশ্বসেরা ফুলব্যাক হবার যোগ্য। ঠিক সে সময় ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোও তাকে নজর রেখেছিল। যখন হোর্হে মেন্ডেস তার সম্পর্কে অন্য ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করতো, তখন ফ্যাবিনহোকে সে ‘নতুন মাইকন’ বলে তুলনা করতো। কারণ, তার মতো লম্বা, দীর্ঘকায় ও দুর্দান্ত বল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা একমাত্র ব্রাজিলিয়ান তারকা মাইকনের সাথেই তুলনা হতে পারে। তবে পরবর্তীতে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, ফ্যাবিনহো যেকোনো পজিশনে মানিয়ে নেবার মতো প্রতিভার অধিকারী।’
পরবর্তীতে জারদিমের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়। ফ্যাবিনহো ঠিকই মধ্যমাঠে নিজেকে মানিয়ে নেন এবং খুব দ্রুত সবাই ভুলে যেতে শুরু করে, তার মোনাকোর অধ্যায় শুরু হয়েছিল রাইটব্যাক পজিশনে। ফ্যাবিনহোর উন্নতি সর্বপ্রথম চোখে পড়ে লিভারপুল বস ইয়ুর্গেন ক্লপের, এবং সত্যিই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিভারপুল পোর্তোতে মোনাকোর সাথে বৈঠকে বসে। অল রেড’রা যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের ম্যাচে পোর্তোর বিপক্ষে খেলার জন্য পর্তুগালে অবস্থান করছে, তখনই চূড়ান্ত হয়ে যায়, ফ্যাবিনহো সে বছর গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমে অ্যানফিল্ডে যোগ দেবে মাত্র ৪৩.৭ মিলিয়ন ইউরোর বদলে।
অ্যানফিল্ডে খুব দ্রুত একটি বছর পার হয়ে যায়। ২৫ বছর বয়সী ফ্যাবিনহো খুব দ্রুত লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের বিশ্বাস অর্জন করে নেন, এবং নিজেকে তুলে ধরেন একাদশের অন্যতম সেরা আস্থা হিসেবে। তার বদৌলতে লিভারপুল তাদের মধ্যমাঠের সে শক্তি ফিরে পায়, যা ২০১০ সালে হাভিয়ের মাশ্চেরানোর বার্সেলোনায় পাড়ি জমানোর ফলে হারিয়েছিল। ইয়ুর্গেন ক্লপের সহকারী কোচ পেপ লিন্ডার্স ফ্যাবিনহোকে ‘মধ্যমাঠের বাতিঘর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, তাদের মধ্যমাঠের বাতিঘরের নিয়ন্ত্রিত পারফরম্যান্সই চ্যাম্পিয়নস লিগের ৬ষ্ঠ শিরোপা ঘরে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
মোনাকোতে থাকাকালীন সময়ে জারদিম বলেছিলেন, ফ্যাবিনহো হবে বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজন। তবে তার কথার প্রমাণ পাওয়া যায় লিভারপুলের এই সাফল্যের স্তরে এসে। কারণ, মাইকনের সাথে তার তুলনার কথা ততদিনে সবাই ভুলতে বসেছে। মোনাকোতে সাফল্যের পর লিভারপুলের হয়ে মাত্র এক বছরের মাথায় ফ্যাবিনহো নিজেকে তুলে ধরেছেন ইউরোপের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজন হিসেবে।
প্রিমিয়ার লিগে সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজনে পরিণত হতে ফ্যাবিনহো পার করে এসেছেন অদ্ভুতুড়ে এক পথ। তার শৈশবের ফুটবলের একটি বৃহৎ সময় কেটেছে পাউলিনা নামক সাও পাওলো’র খুব ছোট্ট একটি বাজার-সদৃশ অংশে। প্রতিদিন তাকে এবং অনান্য ফুটবলারকে এই পাউলিনায় আসতে হতো বাসে করে। এছাড়া তাদের ট্রেনিং করানোর অন্য কোন উপায় ছিলো না।
ফ্যাবিনহোর ফুটবল জীবনের প্রথম কোচ এলিও সিজেনান্দো ব্লিচার রিপোর্টে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
‘আমরা শুধুমাত্র আমাদের এলাকার খেলোয়াড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতাম। কারণ, ক্লাবের ভেতরে ট্রেনিং করানোর জন্য আমাদের কোনো জায়গা ছিল না।’
ফ্যাবিনহোর উন্নতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন,
“কীভাবে ধৈর্য্য যে খেলা এবং মানুষের জীবনে সাফল্য বয়ে আনে, ফ্যাবিনহো তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যখন সে ছোট ছিল, মাঠে প্রচণ্ড অমনোযোগী থাকত। খেলার মাঠে সে থেকেও যেন হারিয়ে যেত। সে মাঠে খেলা বাদ দিয়ে আকাশের পাখি ভালো গুণতে পারে, এটা বলে আমরা তাকে নিয়ে মজা করতাম। অনূর্ধ্ব-১৭ দলে, বিশেষ করে প্রথম বছরে একাদশে থাকার জন্য রীতিমতো লড়াই করেছে সে। মৌসুমের প্রায় সকল ম্যাচেই ফ্যাবিনহো বেঞ্চে থাকত। আমরা ওর প্রতি আশা ছেড়ে দিতে পারতাম, তবে তা করিনি।’
হয়তো এজন্যই ১৭ বছর পূর্ণ হবার আগেই, ফুটবল ক্যারিয়ার বিকশিত হবার পূর্বেই, ফ্যাবিনহো নজর কেড়ে বসেন। তার বড় সাফল্য অর্জন আসে অনূর্ধ্ব-২০ দলের সব থেকে বড় টুর্নামেন্ট ২০১১ সালের ‘কোপা সাও পাওলো’র গ্রুপপর্বের ম্যাচে। এরপর ব্রাজিলের অনেক ক্লাব তাদের অ্যাকাডেমিতে ফ্যাবিনহোকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু লুসিও তাকে পটিয়ে ফ্লুমিনেন্সে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করেন।
ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে সাউথ আফ্রিকায় একটি টুর্নামেন্ট খেলে আসার পর পর্তুগিজ ক্লাব রিও আভে তাকে কিনে নেয় মাত্র ৫০০ ইউরোর বদলে। ফ্লুমিনেন্সের সমর্থকদের সমালোচনার মুখে পড়ে ক্লাবটি জানায়, তারা ফ্যাবিনহোকে বিক্রি করেছে, কারণ সে দলে তৃতীয় পছন্দের রাইটব্যাক ছিল। আর বিক্রির অর্থ তারা ক্লাবেই পুনর্বিনিয়োগ করবে। ফ্লুমিনেন্সের ক্ষতি মানে ছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের লাভ। আর এই ট্রান্সফার তর্কসাপেক্ষে সব থেকে বাজে ট্রান্সফারগুলোর একটি। কারণ, মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ফ্যাবিনহো নিজেকে আবিষ্কার করেন স্পেনে, রিয়াল মাদ্রিদে!
ফ্যাবিনহো পর্তুগালে আসার পর প্রথমে রিও আভে ক্লাবের সভাপতি আন্তোনিও সিলভা ক্যাম্পোসের সাথে ছবি তোলেন, প্রাক-মৌসুমে মাত্র ৪৫ মিনিট খেলেন রিও আভে দলের হয়ে। এরপর ক্লাবের সবার সাথে সাক্ষাতের একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান। তারপর, হঠাৎ করে ফ্যাবিনহো ক্লাব থেকে অদৃশ্য।
সে সময়ে রিও আভে দলে খেলা মার্সেলো এ সম্পর্কে বলেন,
‘সে সময় ক্লাবে অনেক ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় ছিল। তাই ফ্যাবিনহো তার বাড়িতে আমাদের সবাইকে বার্বিকিউ পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে আমি ছাড়াও ডিয়েগো লোপেজ, এডারসন, ফিলিপে আগুস্তো উপস্থিত ছিল। কিন্তু এর তিনদিন পর ফ্যাবিনহোর কোনো খোঁজ নেই। প্রথমে, আমাদের জানানো হয়েছিল, তার ভিসা-সংক্রান্ত সমস্যা আছে। কিন্তু পরে জানা যায়, তাকে রিয়াল মাদ্রিদে লোনে পাঠানো হয়েছে। তাই শেষমেষ ঐ বার্বিকিউ পার্টিই তার বিদায় অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়।’
মার্সেলো আরও যোগ করেন,
‘ফ্যাবিনহো স্বল্পভাষী, নম্র ছিল। কথা কম বলত। আমি তার সাথে একটিমাত্র ম্যাচ খেলেছি অবশ্য, আমরা সে ম্যাচ জিতেছিলাম। সে রাইটব্যাক হিসেবে দলে ট্রেনিং করত। আমি তো কখনও ভাবতেই পারিনি, সে ভবিষ্যতে নামকরা একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারে পরিণত হবে!’
রিও আভের হয়ে মাত্র ৪৫ মিনিট খেলা ফ্যাবিনহোকে রিয়াল মাদ্রিদ লোনে কিনেছিল। কিন্তু সত্য হলো, স্প্যানিশ এই ক্লাব তার খোঁজ পেয়েছিল সেই ২০১১ সালের কোপা সাও পাওলোতে। এই খেলোয়াড়ের খোঁজ এনে দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের স্কাউট সদস্য লুইস ক্যাম্পোস, যিনি ব্রাজিল ও পাউলিনায় ফ্যাবিনহোর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ক্যাম্পোস, যাকে বলা হয় দলবদলের গুরু। ফ্যাবিনহোকে তিনি প্রথম থেকেই নজরে রেখেছিলেন। ফ্যাবিনহো যখন ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে খেলার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাতে, ক্যাম্পোসও সেখানে ছিলেন শুধুমাত্র ফ্যাবিনহোকে স্কাউট করার জন্য। ফ্যাবিনহোর এজেন্ট লুসিও বলেছেন,
‘ফ্যাবিনহোকে নিয়ে ক্যাম্পোসের সাথে আমাদের কয়েক দফা কথা হয়েছিল। একদিন সে আমাকে ফোনে জানায়, জোসে মরিনহো দলের জন্য একজন নতুন রাইটব্যাক চাচ্ছেন। আর মাদ্রিদে খেলার মতো কোনো খেলোয়াড় আপাতত আমার জানা নেই। কিন্তু আমি তখন জানাই, ফ্যাবিনহো এখনই এমন পথ অতিক্রম করার জন্য প্রস্তুত নয়। তবে আমরা বিকল্প একটি ব্যবস্থা কিন্তু করতে পারি। সে সময়ে দানি কার্ভাহালের বায়ার লেভারকুসেন যাওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল, তাই রিয়াল মাদ্রিদের প্রয়োজন ছিল তার বিকল্প। মরিনহো সিদ্ধান্ত নেন, তৎকালীন রিও আভে কোচ নুনো এসপিরিতো স্যান্তোর সাথে ফ্যাবিনহোর সম্পর্কে কথা বলে তাকে রাজি করবেন।’
মরিনহোর কথাবার্তার পর রিও আভে থেকে ফ্যাবিনহোর রিয়াল মাদ্রিদ যাত্রায় শুধু ৬ ঘন্টার যাত্রার ব্যাবধান ছিল। ভিলা দো কন্দে থেকে ফ্যাবিনহোকে মাদ্রিদে নিতে এসেছিলেন তার এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেস। কিন্তু ফ্যাবিনহো তার এ নতুন দলবদল সম্পর্কে বেশি কিছু জানতেন না। কেউ তাকে খোলাসা করে কিছু বলেনি। এমনকি, তার পরবর্তী গন্তব্য যে রিয়াল মাদ্রিদ কস্তিয়া, সে সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
হোর্হে এই দলবদল সম্পর্কে বলেন,
‘ফ্যাবিনহোকে আমি কীভাবে বুঝাই ব্যাপারটা! তিন সপ্তাহ আগেই সে ফ্লুমিনেন্সের অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করেছে। এরপর রিও আভেতে আসা, আর এখন সে যাচ্ছে স্পেনে, রিয়াল মাদ্রিদের মতো বিখ্যাত ক্লাবে! আমি যখন তাকে ব্যাগ গোছাতে বলি, তখন তার প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, ‘কেন? আমার মেডিকেলে কোনো সমস্যা হয়েছে?’
সে সময়ে আমার ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ছিল না। আমরা গাড়িতে করে মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভোর ৫টায় আমরা মাদ্রিদে পৌঁছাই। তারপর একটি হোটেলে বিশ্রাম নিতে নিতে ৯টা বেজে যায়। আমরা ক্লান্ত ছিলাম, ৯টার সময় ঘুম ভাঙে কলিং বেলের শব্দে। আর দরজার ওপাশে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং জোসে মরিনহো। ফ্যাবিনহোর কাছে তখন সবই স্বপ্ন, কিছু বিশ্বাস করতে পারছিল না।’
স্বল্পভাষী তরুণ ফ্যাবিনহো মাদ্রিদের সাথে প্রথম দিন অনুশীলন করেন কাকা, ইকার ক্যাসিয়াস ও করিম বেনজেমার মতো খেলোয়াড়ের পাশে। সাংবাদিক থেকে সমর্থক, সবাই ব্যস্ত ছিল তাদের নিয়ে। রিয়াল মাদ্রিদের অচেনা নতুন ব্রাজিলিয়ান তরুণকে তখন কেউ পাত্তাই দেয়নি।
ফ্যাবিনহো তার রিয়াল মাদ্রিদ সময়ের অধিকাংশ ম্যাচ খেলেছেন তাদের ‘বি’ দলের হয়ে। তবে মরিনহো তাকে সবসময়ই ডাকতেন মূল দলের সাথে অনুশীলন করার জন্য। লা লিগায় তার মাত্র এক ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিল। মালাগার সাথে ৬-২ গোলে জেতা সে ম্যাচে ফ্যাবিনহো ডি মারিয়ার একটি গোলে প্রত্যক্ষ অবদান রাখেন। মাদ্রিদের লোনের চুক্তিশেষে তিনি আবার রিও আভেতে ফেরেন, এবং নতুনভাবে লোনে পাড়ি জমান ফরাসি ক্লাব মোনাকোতে। মোনাকো প্রথমে লোনে তাকে দলে নিলেও, দুই মৌসুম পর তাকে ৬ মিলিয়ন ইউরোর বদলে কিনে নেয়।
মোনাকোতে ফ্যাবিনহো খুব দ্রুতই দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হন। তিনি ছাড়াও তিমুই বাকায়োকো, কিলিয়ান এমবাপে, বার্নাডো সিলভা, থমাস লেমার ও বেঞ্জামিন মেন্ডি খুব দ্রুত মোনাকোকে রাঙিয়ে দেন। এই তারকাদের সাথে নিয়ে মোনাকো ‘১৬-‘১৭ মৌসুমে ফরাসি লিগ জেতে, এমনকি চ্যাম্পিয়নস লিগেও সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মোনাকোতে টানা কয়েক মৌসুম সাফল্যের পর এটা অনুমেয়ই ছিল, লিভারপুলের মতো বড় ক্লাবগুলো তার প্রতি আগ্রহ দেখাবে। ফ্যাবিনহো লিভারপুলে পাড়ি জমান ২০১৮ সালে।
পাউলিনায় খেলা ছোট্ট এক বালক, যাকে নিয়ে তার প্রথম কোচ ঠাট্টা করত, সেই বালক এখন তার ক্যারিয়ারের প্রতি সব থেকে বেশি মনোযোগী। ফ্লুমিনেন্স, রিও আভে থেকে যাত্রা শুরুর পর রিয়াল মাদ্রিদ ও মোনাকোতে থাকা উত্থান-পতনের সময়ের পর ফ্যাবিনহো বর্তমানে ইউরোপেরা সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজন। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে তার ক্যারিয়ারের সোনালী সময় এখনও বাকিই আছে। তবে ফ্যাবিনহোর সাফল্যে তার প্রাক্তন কোচ লিওনার্দো জারদিম নিশ্চয়ই উৎফুল্ল বোধ করেন, মনে মনে ভাবেন,
‘ফ্যাবিনহোকে আমি কিন্তু ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম!’