Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাইন্ডগেম ইন ফুটবল: ইয়ুর্গেন ক্লপের ‘সেফ সাইডে থাকা’ নীতি

একটি ফুটবল ক্লাবকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে এনে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্য খ্যাতি রয়েছে তার। মেইঞ্জের কথাই ধরুন। একটা সময় ছিল, যখন বুন্দেসলিগার ধারেকাছেও ছিল না দলটা। সবচেয়ে ছোট স্কোয়াড, সব থেকে ছোট স্টেডিয়াম। বলা চলে, ধুঁকছিল দলটা। তার নিজের মতে,

“ছোট্ট একটা স্কোয়াড ছিল, কিন্তু প্রতিপক্ষ ছিল বিশাল বিশাল!”

সামর্থ্য তেমন ছিল না। কিন্তু ছিল ফুটবল-দর্শন, ছিল আবেগ, ছিল ভালোবাসা। আর থাকবে না-ই বা কেন! এগারোটা বছর ধরে খেলেছেন এই দলটার হয়ে, এবার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে সেই দলটাকেই নোঙর করানোর দায়িত্ব বর্তেছে তার উপরে। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই এমন চ্যালেঞ্জ দেখে বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে গেলেন না তিনি, বরং যেন আরেকটু উদ্ভাসিত হলেন। মেইঞ্জকে তুলে আনলেন বুন্দেসলিগাতে। এরপর এই দলটাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন উয়েফা কাপ অবধিও! 

পরের অ্যাসাইনমেন্ট বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সেখানে তিনি কাটালেন দুর্দান্ত কিছু বছর। ২০০৮ থেকে শুরু করে ২০১৫… কী অনবদ্য সব গল্পের ঝুড়ি নিয়ে দলটাকে তুলে আনলেন সেরাদের কাতারে। ব্যাক-টু-ব্যাক বুন্দেসলিগা জিতলেন, বহু বছর বাদে আবারও ফেরালেন জার্মান লিগ শিরোপার ইঁদুর-দৌড়ে। মানুষকে মনে করিয়ে দিলেন, মনোপলি আর চলবে না, সময় এসে গেছে এবার কালো-হলুদ শিবিরেরও!    

ওদিকে সাফল্যনেশায় বুভুক্ষু হয়েছিল ইংল্যান্ডের একটি দল, কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। বলা হচ্ছে লিভারপুল নামের ক্লাবটির কথা। ধ্বংসস্তুপ ঠিক নয় বটে, একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিল, সেটাও ঠিক নয়; তবে কেন জানি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাটি আর ছোঁয়া হচ্ছিল না অল রেডদের। ১৯৯০ সালের পর থেকে নয়জন কোচ অ্যানফিল্ডের ডাগআউট সামলেছেন, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা ছুঁতে পারেননি কেউই। তাই প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাখরা কাটানোর জন্য লিভারপুল বোর্ড খুঁজছিল এমন কোনো ব্যক্তিকে, যাকে সময় দেয়া হবে, পছন্দের খেলোয়াড়কে আনার জন্য পর্যাপ্ত ইউরোও দেয়া হবে, কিন্তু দিনশেষে শিরোপাটা যেন লিভারপুলের ট্রফি ক্যাবিনেটে যোগ হয়। সেই হিসেবে ইয়ুর্গেন ক্লপের চেয়ে ভালো বোধহয় আর কেউ ছিলেন না।

হ্যাঁ, মেইঞ্জ-ডর্টমুন্ড জয় করে ইয়ুর্গেন ক্লপ এবার পাড়ি জমালেন লিভারপুলে। 

সনসনসহসসম
বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে নিজের কোচিং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেই প্রিমিয়ার লিগে এসেছিলেন; Image credit: Getty Images

লিভারপুলের হয়ে প্রথম মৌসুমটি খুব একটা ভালো কাটেনি, পয়েন্ট টেবিলে অষ্টম হয়ে সেই মৌসুম শেষ করে লিভারপুল। এরপরের টানা দুই মৌসুম পয়েন্ট টেবিলে চতুর্থ হয়ে শেষ করে অন্তত ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছিল অলরেডরা। ধীরে ধীরে লিভারপুলের উন্নতিটা চোখে পড়ছিল, বড় মঞ্চের জন্য তৈরি হচ্ছিল দলটি। ২০১৭-১৮ মৌসুমে একবার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল বটে, কিন্তু ইউক্রেনের কিয়েভে সেই বেদনাবিধুর ফাইনালে গোলকিপারের শিশুসুলভ ভুলের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।

২০১৮-১৯ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের জন্য রচিত হয় ট্রাজেডি ঘরানার কাব্য, এক পয়েন্টের জন্য শিরোপা হারাতে হয় পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির কাছে। তারপরও সেই মৌসুমে অলরেড সমর্থকদের আফসোস থাকা উচিত নয়, কারণ ১৫ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ইয়ুর্গেন ক্লপ নিজের উপর সমর্থক ও বোর্ডের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন দারুণভাবে। এরপরের মৌসুম ছিল লিভারপুল সমর্থকদের জন্য ছিল একেবারে রূপকথার মতো। এবার আর কোনো ট্রাজেডি নয়, কোনো হতাশার গল্প নয়। এবার একেবারে পুরো মৌসুমজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের গল্প, আগের মৌসুমের প্রতিশোধ নেওয়ার গল্প।

Image Credit: Getty Images

জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে নিজেকে প্রমাণ করেই প্রিমিয়ার লিগে এসেছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। এরপর ধীরে ধীরে প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনেছেন, ইউরোপীয় প্রতিযোগিতার জন্যও লিভারপুলকে প্রস্তুত করেছেন দুর্দান্তভাবে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে এখন লিভারপুল ‘শিরোপা জয়ের জন্য ফেভারিট’ হিসেবেই অংশগ্রহণ করে, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল এখন ‘বাজির ঘোড়া’। সব মিলিয়ে লিভারপুলের যে পুনর্জন্ম, তার পিছনে প্রধান কারিগর কিন্তু সেই জার্মান ভদ্রলোক, ইয়ুর্গেন ক্লপ।

এবার তার মাইন্ডগেমের প্রসঙ্গে আসি। প্রিমিয়ার লিগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগে মাঠের শারীরিক খেলার পাশাপাশি মিডিয়ার কল্যাণে মাঠের বাইরেও বেশ কথার লড়াই চলে। কোচদের মাঝে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এখানকার নিয়মিত ঘটনা। প্রিমিয়ার লিগের বেশিরভাগ বড় দলের কোচ প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আগেই একহাত দেখে নিতে চান। এক্ষেত্রে ইয়ুর্গেন ক্লপ বেশ সতর্ক মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি বলটি প্রতিপক্ষের কোর্টে ঠেলে দিতে ভালোবাসেন, স্পষ্ট করে বললে প্রতিপক্ষের প্রশংসার করে তাদের উপর প্রত্যাশার চাপ ও মিডিয়ার নজরদারি বাড়াতে বেশ দক্ষ তিনি। তাকে লক্ষ্য করে অপ্রাসঙ্গিক কথা বললে তিনি সেগুলো গায়ে মাখেন না, এড়িয়ে যান, এবং জবাবটা পরবর্তীতে মাঠেই দিয়ে থাকেন।

য়ননসসহসম
বর্তমানে লিভারপুল খেলোয়াড়দের যে হাল না ছাড়ার মানসিকতা দেখা যায় তার পেছনে নিশ্চিতভাবে ক্লপের অবদান রয়েছে;
Image Credit: Getty Images

প্রতিপক্ষের প্রশংসা করে কীভাবে তাদের উপর চাপ বাড়িয়ে দেয়া যায়, তার জন্য খুব বেশিদিন আগের উদাহরণ খুঁজতে হবে না। এই মৌসুমেই এক সময় ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের চেলসি ও হোসে মরিনহোর টটেনহ্যাম শীর্ষে থেকে বেশ ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড একটি অনভিজ্ঞ, তরুণ কিন্তু প্রতিভাবান স্কোয়াড নিয়ে যেভাবে লড়াই করছিলেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ২০২০-২১ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে কোন দল বেশি সম্ভাবনাময়, সাংবাদিকদের এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে তার পুরনো কৌশলটাই অবলম্বন করেন লিভারপুল বস। যদিও তার দল এবারও প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের অন্যতম দাবিদার, তারপরও তার উত্তর ছিল ‘চেলসি’।

স্বাভাবিকভাবেই ক্লপের এই মন্তব্যের পর মিডিয়ায় চেলসিকে নিয়ে আরও বেশি করে আলোচনা হতে থাকে। ক্লপের মন্তব্যের ফলে চেলসির উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়, তার ফলাফল দেখা দেয় কিছুদিন পরই। এরপর প্রিমিয়ার লিগে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পায় ল্যাম্পার্ডের শিষ্যরা। শীর্ষস্থান থেকে নবম স্থানে নেমে আসে তারা।

য়ননয়নসনাসন
ত্রিশ বছর পর লিভারপুলকে লিগ জেতানো ক্লপ আগ বাড়িয়ে মাইন্ডগেম খেলতে যান না; Image Credit: REUTERS

এই যে লিভারপুল বস ইয়ুর্গেন ক্লপ নিজের দলকে আড়ালে রেখে বেশিরভাগ সময় প্রতিপক্ষের প্রশংসায় মুখর থাকেন, এর আরেকটি দিক হলো নিজের খেলোয়াড়দের নির্ভার রাখা। প্রতিপক্ষের প্রশংসা করলে মিডিয়া প্রতিপক্ষের দিকেই সাধারণত বেশি আলোকপাত করে, নিজের খেলোয়াড়দের প্রতি আলাদা স্পটলাইট না থাকার কারণে তারা চাপমুক্ত হয়ে মাঠে সেরাটা দিতে পারে। মিডিয়া একটা খেলোয়াড়কে নিয়ে বেশি আলোচনা করলে তার প্রতি সমর্থক-কোচ সবারই প্রত্যাশা বেড়ে যায়। এর ফলে সেই খেলোয়াড়ের মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তার মনে এই ধারণা জন্মায়, যদি মাঠে ভালো খেলা উপহার দিতে না পারেন, গণমাধ্যমে তার সমালোচনা হবে, সমর্থকরা তাকে দুয়ো দেবে, কোচ তাকে হয়তো পরবর্তী ম্যাচে একাদশে রাখবেন না। এজন্য ক্লপ এই ছোট্ট মাইন্ডগেমের মাধ্যমে আগেই নিশ্চিত করেন, তার নিজ দলের খেলোয়াড়েরা যেন নির্ভার থেকে মাঠে সেরাটা দিতে পারে।

ইয়ুর্গেন ক্লপ মাইন্ডগেম খেলেন তার নিজ দলের খেলোয়াড়দের সাথেও। তার ‘গেগেনপ্রেসিং হেভিমেটাল’ ফুটবলীয় কৌশলে বল হারানোর সাথে সাথে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের উপর উচ্চমাত্রায় প্রেসিং করা হয় পুনরায় বল নিজেদের পায়ে নিয়ে আসার জন্য। এই ধরনের কৌশলে লিভারপুল খেলোয়াড়দেরকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়, একেবারে শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত মনোবল ঠিক রেখে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। বর্তমানে লিভারপুলের খেলোয়াড়দের মধ্যে মাঠে লড়াইয়ের যে তীব্রতা দেখা যায়, সেটির পেছনেও ইয়ুর্গেন ক্লপের অবদানের কথা অস্বীকার করার কিছু নেই। ড্রেসিংরুম নিয়ন্ত্রণেও তিনি ভালো দক্ষতা দেখিয়েছেন।

জতওতজত
প্রেস কনফারেন্সে তিনি প্রতিপক্ষের প্রশংসা করে তাদের উপর বাড়তি চাপ দিতে ভালোবাসেন; Image Credit: AFP

প্রিমিয়ার লিগে বড় ম্যাচ কিংবা ঐতিহ্যবাহী ডার্বি ম্যাচগুলোর আগে কোচদের মাইন্ডগেমের মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ, এসব ম্যাচের গুরুত্ব অন্যান্য ম্যাচের চেয়ে বেশি; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ম্যাচই শিরোপা নির্ধারণে মূল ভুমিকা পালন করে। ক্লপ বড় ম্যাচের আগে মাইন্ডগেমে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন কিংবা হোসে মরিনহোর মতো আগ্রাসন দেখান না, আবার অন্য কেউ যখন তাকে বা তার কোন খেলোয়াড়কে সুক্ষ্ম আক্রমণ করেন, তখন তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন সচরাচর; প্রতিপক্ষ কোচের মাইন্ড গেমের ফাঁদে পা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। তিনি একজন কোচ হিসেবে যেহেতু মাইন্ডগেম প্রায়শঃই খেলেই থাকেন, তাই আরেকজন ফাঁদে ফেলার চাল দিলে সেটি সহজে ধরে ফেলতে পারেন। আর সেগুলো ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবেলা করে নিজেকে ও তার খেলোয়াড়দের নির্ভার থাকতে সহায়তা করেন।

তার ক্লাবের খেলোয়াড়দের সামর্থ্য, তার নিজের ট্যাকটিকাল মেধা, হোমগ্রাউন্ডে তার দলের আধিপত্য — প্রতিপক্ষ কোচকে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করার সব উপাদানই তার হাতের কাছে আছে। কিন্তু সেটি না করেও তিনি সফলভাবে ঠাণ্ডা মাথায় মাইন্ডগেমটা খেলতে জানেন, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ না করেও, আগ্রাসন না দেখিয়েও চাপে ফেলতে পারেন — ক্লপের বিশেষত্বটা ঠিক এখানেই।

Related Articles