বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে, দেশের বিমান ধরেছে পুরো দল। কেমন ছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন? তা নিয়ে শুরু হয়েছে কাঁটাছেঁড়া। পরিসংখ্যান কিংবা নান্দনিকতা, সব মিলিয়ে দলের ব্যাটিং ছিল মন্দের ভালো। বোলিংয়ের কথা বলতে গেলে সমর্থকদের বুকে ব্যথা উঠবে। ফিল্ডিংয়ের আলোচনায় কপাল আর চোখে আসবে বিরক্তি।
ব্যাট হাতে দলের সেরা সাকিব আল হাসান। তারপরই আছেন মুশফিকুর রহিম। কিন্তু এই দুজনের মধ্যে ফারাকটাও কয়েকশ’ রানের। তবে এটাও সত্যি যে, সাকিব এবার খেলেছেন ‘অতিমানবীয়’। বাংলাদেশের সেরা ব্যাটিং নিয়েই এই আয়োজন। সাজানো হয়েছে পরিসংখ্যান, পরিস্থিতি আর সার্বিক পারফরম্যান্সের বিচারে।
সাকিব আল হাসান
হয়তো বিশ্বকাপের আগে থেকে যে কেউই ভেবে রেখেছিলেন, প্রথম নামটি হবে তামিম ইকবালের। আদতে তা হয়নি, দারুণ ফর্মে থাকা বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম পুরো বিশ্বকাপজুড়েই ছিলেন নির্জীব। অন্যদিকে, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) মূল একাদশে সুযোগ না পাওয়া সাকিব সেই সময়টা কাজে লাগিয়েছিলেন ফিটনেসে, নিজের ব্যাটিংয়ে। ফলাফলটাও পেয়েছেন হাতেনাতে। যত কিছুই বলা হোক, সাকিব বিশ্বকাপে খেলেছেন অনেকটাই ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে। বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো টুর্নামেন্টেই তিনি এই মুহূর্তে অন্যতম শীর্ষ ব্যাটসম্যান। এই আসরে সাকিব ৮ ম্যাচে ৮৬.৫৭ গড়ে তুলেছেন ৬০৬ রান। সর্বনিম্ন ৪১ রানের ইনিংসটি বলে দেয়, সাকিবের ব্যাটিং মেজাজ কেমন ছিল। সর্বোচ্চ ১২৪ রানের অপরাজিত ইনিংসের পাশাপাশি, নিজেদের সবগুলো ম্যাচে মাঠে নেমে সাকিবের ব্যাটে বাংলাদেশ পেয়েছে দু’টি সেঞ্চুরি, আর পাঁচটি হাফসেঞ্চুরি। বল হাতে ১১ উইকেট নেওয়ার কারণে সাকিব এই মুহূর্তে টুর্নামেন্টসেরা হওয়ার সর্বোচ্চ দাবিদার।
আর সাকিবকে নিয়ে অধিনায়ক মাশররাফি বিন মুর্তজার দুঃখটাই সেখানে। দল সেমিফাইনালে উঠতে না পারায় খেলার সুযোগ হলো না কয়েকটি ম্যাচ। সেগুলো খেলতে পারলে হয়তো সাকিব ছাড়িয়ে যেতে পারতেন বাকি সবাইকে। বিশ্বকাপে নিজের দলকে সেমিফাইনালে ওঠাতে না পারা, নিজে ভালো করতে না পারা, সবকিছুই যেমন পোড়াচ্ছে, তেমনই পোড়াচ্ছে সাকিবকে আরও একটু সুযোগ করে না দিতে পেরে,
‘সাকিবের জন্য বেশি খারাপ লাগছে। এটাই বড় আক্ষেপ। ও যে টুর্নামেন্ট খেলেছে, আরও ভালো অবস্থান বা সেমিফাইনালে যাওয়া আমাদের দরকার ছিল। একজন খেলোয়াড় যখন এমন দুর্দান্ত খেলে, তখন তার দলের সেমিফাইনালে খেলার কথা। যখন আমাদের রান করার দরকার, যখন ক্যাচগুলো ধরার দরকার, মিস হয়েছে। যখন ভালো বোলিং দরকার, করতে পারিনি। এ জিনিসগুলো অবশ্যই আক্ষেপের। পরের বিশ্বকাপ যখন খেলবে বাংলাদেশ, যেখানে খেলবে, আরও নতুন কিছু খেলোয়াড় যদি আসে, দল আরও এগোবে।’
নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে সাকিব নিজেও খুশি। কিন্তু দিনশেষে তাকেও পোড়াচ্ছে সেমিফাইনালে না যেতে পারার আক্ষেপ। সাকিব বলেছেন,
‘ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কথা যদি বলেন, খুবই খুশি। যে ধরনের ইচ্ছা, মন-মানসিকতা নিয়ে এসেছিলাম, সেদিক দিয়ে আমি খুশি, তৃপ্ত। আমি ভালো করলাম, কিন্তু দল সেমিফাইনাল খেলতে পারল না। আক্ষেপ হলো, আমরা দল হিসেবে খেলতে চেয়েছিলাম, সেটা করতে পারলাম না। বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, ঠিকভাবে সেটা পূরণ করতে পারলাম না।’
মুশফিকুর রহিম
‘ফ্যাভ ফাইভ’ বা বাংলাদেশ দলের পঞ্চপাণ্ডবদের প্রতি বিশ্বকাপে যে প্রত্যাশা সমর্থকদের ছিল, তা থেকে সবচেয়ে পিছনে পড়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্রমিক করলে তারপরের নামটি আসে তামিম ইকবাল। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ২০১৫ বিশ্বকাপের তুলনায় অনেকটা নিষ্প্রভ ছিলেন বটে, কিন্তু প্রয়োজনে জ্বলে উঠেছিলেন এবারও। অন্যদিকে, সাকিবের আকাশছোঁয়া পারফরম্যান্সের তোড়ে হারিয়ে গেলেও দলের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম ছিলেন স্বরূপে বিরাজমান।
এই আসরে ৮ ইনিংসে ৩৬৭ রান তোলা এই ক্রিকেটারের গড় ছিল ৫২.৪২। সর্বোচ্চ ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন। পুরো টুর্নামেন্টে ওই একটি সেঞ্চুরির সাথে ছিল আরও দু’টি হাফ সেঞ্চুরি। এই পারফরম্যান্সে মুশফিক পিছনে ফেলেছেন এবারের আসরের সব উইকেটরক্ষককে। অর্থাৎ উইকেটরক্ষক হিসেবে এই আসরে এখন পর্যন্ত মুশফিকুর রহিমই এবারের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। নিজের ক্যারিয়ারে ব্যক্তিগত বিশ্বকাপের হিসেবে এটাই তার সেরা বিশ্বকাপ।
তবে মুশফিকের এত প্রাপ্তির মাঝেও তাকে ‘ভিলেন’ বানিয়েছে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ। এখন জয়ের খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসার দুঃস্বপ্নে নিউ জিল্যান্ডের ম্যাচই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি তাড়া করছে। আর সেই ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কেন উইলিয়ামসনের রান আউট মিস সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করে চলেছে এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে। সেই মিসটাও বেশ অদ্ভুত। সময়মতোই উইকেট ভেঙেছিলেন মুশফিক। কিন্তু সেটা বলে নয়, নিজের গ্লাভসে। সুযোগ ছিল উইকেট উঠিয়ে ফেলার, কিন্তু তা বুঝতে পারেননি মুশফিক। শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান উইলিয়ামসন।
লিটন কুমার দাস
তিন নম্বরে লিটনকে রাখতেই হচ্ছে। প্রথম তিন ম্যাচে সুযোগ পাননি, আর সুযোগ পেয়েই খেললেন নজরকাড়া এক ইনিংস। উইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদশের জয়ের ম্যাচে তুলেছিলেন অপরাজিত ৯৪ রান। চাইলে সেঞ্চুরিটাও করতে পারতেন। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ম্যাচটা সাকিব আল হাসানের সাথে মিলে বের করে আনতে চেয়েছিলেন লিটন। ওই ম্যাচের পর আরও চারটি ম্যাচে সুযোগ পেয়েছেন লিটন। কিন্তু বাকিগুলোতে মেলেনি সফলতা। কে জানে, এর জন্য তার নিজের দায়ের পাশাপাশি বদলে দেওয়া পজিশনও দায়ী কি না! মূলত লিটন সেরাদের কাতারে তিনে উঠে এসেছেন তার গড়ের কারণে। ৫ ইনিংসে ৪৬ গড়ে ১৮৪ রান, যা মোটামুটি তাকে অন্ততপক্ষে সমালোচনা থেকে রক্ষা করেছে।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
ইনজুরি, ইনজুরি এবং ইনজুরি। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে থেকে ভুগতে থাকা ইনজুরি তাকে বিশ্বকাপে নিয়ে গেল স্রেফ একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে। ছয় নম্বরে মাঠে নামা মাহমুদউল্লাহ মানেই ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। মূলত দলকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবেন, এটা মেনেই মাঠে নামেন এই ক্রিকেটার। ২০১৫ বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্সের সুবাদে এই আসরেও তার কাছে ভালো কিছু আশা করেছিল দল। কিন্তু তেমনটা পুরোপুরি হয়নি। ইনজুরির কারণে দুই ম্যাচে মাঠে নামা হয়নি তার। এরপরও ৬ ইনিংসে ৪৩.৮ গড়ে ২১৯ রান ভালোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আসরে তার বড় ইনিংস বলতে একটি হাফসেঞ্চুরি, সেটি ছিল ৬৯ রানের ইনিংস।
তামিম ইকবাল
ভারতের বিপক্ষে শুধুমাত্র রোহিত শর্মার ক্যাচ ছেড়েই ভিলেন বনে গিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। সেই ক্যাচ মিসের মাশুল বাংলাদেশ দিয়েছিল রোহিতের ১০০ রান পার করা পর্যন্ত।
পুরো টুর্নামেন্টেই বাংলাদেশ দল তাকিয়ে ছিল তামিম ইকবালের দিকে। কিন্তু বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত দারুণ ফর্মে থাকা এই ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ডে গিয়ে যেন নিজেকে হারিয়েই ফেললেন। কিন্তু তারপরও এটা সত্যি যে, তার ব্যক্তিগত রানের হিসেবে এটিই খাতা-কলমে তার সেরা বিশ্বকাপ। আবার অন্যদের পারফরম্যান্সের দিকে তাকালে মনে হবে, তামিম পিছিয়ে আছেন অনেক বেশি। তার কারণও সহজ, দলের বাকিরা যখন সমানে বড় রানের ইনিংস খেলছে, তখন তামিম ত্রিশের আশেপাশে। ৮ ইনিংসে ২৯.৩৭ গড়ে ২৩৫ রান, তার শেষ কয়েক বছরের পারফরম্যান্সের সাথে একেবারেই মেলে না। ৬২ রানের একটি ইনিংস, এটিই তার একমাত্র হাফসেঞ্চুরি ও সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।