Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রথম চারবারের গল্প…

চলে গেছে চারটি বছর, দুয়ারে আবারও কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এবারের আসর বসতে যাচ্ছে ক্রিকেটের আতুড়ঘর ইংল্যান্ডে, ১৯৯৯ সালের পর প্রথমবার, সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পঞ্চম বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে এটি। এবারের আসরের নিয়ে হয়ে গেছে বহু আলোচনা, চায়ের কাপে বারবার উঠেছে ঝড়। তবে, যেকোন কিছু নিয়ে আলোচনা করবার পূর্বশর্ত হওয়া উচিত অতীতটাকে জেনে নেওয়া, আর তাই ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনার আগে সবার অন্তত বিশ্বকাপের শুরুর সময়কার কথা জানা প্রয়োজন। সেজন্যই এই আয়োজন, চলুন ঘুরে আসা যাক প্রথম চারটি বিশ্বকাপ থেকে, করা যাক সেগুলোর স্মৃতিরোমন্থন।

১৯৭৫: সবকিছুর শুরু

প্রথমবারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ! ; Image Source: ICC 

মাত্র বছর চারেক আগেই শুরু হয়েছে সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলা, পাঁচ দিনের খেলাকে নামিয়ে আনা হয়েছে ৬০ ওভারে। আর এই ফরম্যাটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই ইংল্যান্ডে আয়োজন করা হয় প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপের, নাম দেওয়া হয় প্রুডেনশিয়াল কাপ ১৯৭৫।

প্রুডেনশিয়াল কাপ ১৯৭৫ এ অংশ নিয়েছিল সব মিলিয়ে আটটি দল – ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড, শ্রীলংকা ও পূর্ব আফ্রিকা। আট দলের মধ্যে শ্রীলংকা ও পূর্ব আফ্রিকা ছাড়া বাকি ছয় দলই ছিল টেস্ট খেলুড়ে দেশ। আট দলকে ভাগ করা হয়েছিল দু’টি গ্রুপে, গ্রুপ এ ও গ্রুপ বি। গ্রুপ এ’তে ছিল ইংল্যান্ড, ভারত, নিউ জিল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকা; অন্যদিকে গ্রুপ বি’তে জায়গা পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। প্রতি জয়ের জন্য বিজয়ী দল পাবে চার পয়েন্ট এবং পরিত্যক্ত ম্যাচে উভয় দল পাবে দুই পয়েন্ট করে, এটিই ছিল পয়েন্ট ব্যবস্থা।

১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল ছয়টি ভেন্যুতে। ভেন্যুগুলো ছিল – লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড (লন্ডন), দ্য ওভাল (লন্ডন), এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ড (বার্মিংহ্যাম), ট্রেন্ট ব্রিজ (নটিংহ্যাম), ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ক্রিকেট গ্রাউন্ড (ম্যানচেস্টার) এবং হেডিংলি (লিডস)।

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারতকে ২০২ রানের বিরাট ব্যবধানে পরাজিত করে স্বাগতিক ইংল্যান্ড। গ্রুপপর্বের একমাত্র হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের মধ্যে, পাকিস্তানের দেওয়া ২৬৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২০৩ রানেই নয় উইকেট হারিয়ে ফেলে ক্যারিবিয়রা। সেখান থেকে ড্যারেক মারে এবং অ্যান্ডি রবার্টসের ৬৪ রানের জুটিতে দুই বল হাতে রেখেই জয় তুলে নেয় তারা। তিন ম্যাচেই জয়লাভ করে ‘গ্রুপ এ’তে শীর্ষস্থান নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড, দুই জয়ে গ্রুপে দ্বিতীয় হয় নিউ জিল্যান্ড। সব ম্যাচ জিতে ‘গ্রুপ বি’-এর শীর্ষস্থান দখল করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দুই জয়ে দ্বিতীয় হয় অস্ট্রেলিয়া।

প্রথম সেমিফাইনালে লিডসে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে গ্যারি গিলমোর নামের ঝড়ের মুখোমুখি হয় তারা, গুটিয়ে যায় মাত্র ৯৩ রানে। নিজের ১২ ওভারে মাত্র ১৪ রান দিয়ে ছয় উইকেট তুলে নেন গিলমোর। জবাবে মোটেও সুবিধা করতে পারছিল না অস্ট্রেলিয়া, ৩৯ রানেই হারিয়ে ফেলে প্রথম ছয় উইকেট। কিন্তু তখনই তাদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন গিলমোর, তার ২৮ রানের ইনিংসে ভর করে আর কোনো উইকেট না হারিয়েই জয়লাভ করে অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচজুড়ে ব্যাটে ও বলে দারুণ ভূমিকা রাখা গ্যারি গিলমোর ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।

গ্যারি গিলমোর নামের ঝড়ে উড়ে যায় ইংল্যান্ড; Image Souce : ESPNCricinfo 

দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বার্নার্ড জুলিয়ানের বোলিং তোপে মাত্র ১৫৮ রানে গুটিয়ে যায় নিউ জিল্যান্ড, জুলিয়ান নেন চার উইকেট। গর্ডন গ্রিনিজ ও আলভিন কালিচরণের ফিফটিতে ভর করে সেই লক্ষ্য অনায়াসেই পেরিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কালিচরণ নির্বাচিত হন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হিসেবে।

ফাইনালে টস হেরে ব্যাট করতে নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজ পড়ে গ্যারি গিলমোর নামের তোপের সামনে। কিন্তু গ্রিনিজের সেঞ্চুরি ও রোহান কানহাইয়ের ফিফটিতে ভর করে ২৯১ রান সংগ্রহ করে তারা। গ্যারি গিলমোর এ ম্যাচে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট।

জবাবে ইয়ান চ্যাপেলের ইনিংসে ভর করে ভালোই এগোচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া, কিন্তু নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনে তারা। তারা পাঁচটি উইকেট হারায় রান আউটে, এর মধ্যে ভিভ রিচার্ডস একাই করেছিলেন তিনটি। লক্ষ্য থেকে ১৭ রান দূরে ২৭৪ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ক্যারিবিয়ান সাগরের নির্ভীক ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

৪ ম্যাচে ৩৩৩ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হন নিউ জিল্যান্ডের গ্লেন টার্নার, অন্যদিকে দুই ম্যাচে ১১ উইকেট তুলে নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গ্যারি গিলমোর।

১৯৭৯: আবারও ওয়েস্ট ইন্ডিজ

আবারও! টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্যারিবীয়রা; Image Source : ICC 

চার বছর পর ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে আসর বসে দ্বিতীয় প্রুডেনশিয়াল কাপের। আগেরবারের মত এবারও অংশ নিয়েছিলো আটটি দল। তবে এবার জায়গা হয়নি পূর্ব আফ্রিকার, বরং আইসিসি ট্রফির ফাইনাল খেলে জায়গা করে নেয় শ্রীলংকা ও কানাডা। গ্রুপ পর্বের নিয়মগুলো একই ছিল, এবার ‘গ্রুপ এ’তে ছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান ও কানাডা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউ জিল্যান্ড, ভারত ও শ্রীলংকাকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল গ্রুপ বি। প্রথম বিশ্বকাপের ছয়টি ভেন্যুতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল দ্বিতীয় প্রুডেনশিয়াল কাপ।

বলতে গেলে বেশ উত্তেজনাহীন ছিল গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো। নিজেদের সবগুলো ম্যাচ জিতে ‘গ্রুপ এ’-এর শীর্ষে থেকে গ্রুপপর্ব শেষ করে স্বাগতিক ইংল্যান্ড, দুই ম্যাচ জিতে আট পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল পাকিস্তান, আগেরবারের রানার্স আপ অস্ট্রেলিয়া বাদ পড়ে গ্রুপপর্ব থেকেই। অন্যদিকে ‘গ্রুপ বি’তে উইন্ডিজ তাদের তিন ম্যাচের দু’টি জিতে নিয়ে গ্রুপে প্রথম হয়, তাদের শ্রীলংকার সাথে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। আট পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থেকে গ্রুপপর্ব শেষ করে নিউ জিল্যান্ড।

প্রথম সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় নিউ জিল্যান্ড। গ্রাহাম গুচ ও মাইক ব্রিয়ারলির ফিফটিতে ভর করে ৬০ ওভারে ইংল্যান্ড স্কোরবোর্ডে জমা করে ২২১ রান। জবাবে ওপেনার জন রাইট অর্ধশতক হাঁকান, কিন্তু আর কেউ তেমন কিছু করতে না পারায় ২১২ রানের বেশি করতে পারেনি নিউ জিল্যান্ড। ৯ রানে প্রথম সেমিফাইনাল জিতে ফাইনালে চলে যায় ইংল্যান্ড, ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন গ্রাহাম গুচ।

ওভালে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে গর্ডন গ্রিনিজ ও ডেসমন্ড হেইনেসের ফিফটিতে নির্দিষ্ট ৬০ ওভারে ২৯১ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে টপ অর্ডারে মাজিদ খান এবং জহির আব্বাসের দারুণ অর্ধশতকে জয়ের পথেই ছিল পাকিস্তান। কিন্তু তাদের মিডল ও লোয়ার অর্ডারে ধ্বস নামলে তাদের ইনিংস থেমে যায় মাত্র ২৫০ রানেই। ৪১ রানে জিতে টানা দ্বিতীয় ফাইনালে চলে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন গর্ডন গ্রিনিজ।

লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড এবং তখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে অজেয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংলিশ কাপ্তান মাইক ব্রিয়ারলি টসে জিতে সিদ্ধান্ত নেন বোলিংয়ের, এবং তাকে ঠিক প্রমাণ করতেই যেন দলীয় একশ’ রানের আগেই চার ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানকে তুলে নেন ইংলিশ বোলাররা। তবে তখনও ভিভ রিচার্ডস এবং কলিস কিং ঝড় বাকি ছিল। ভিভ রিচার্ডসের সুখ্যাতি ছিল ইংল্যান্ডকে পেলেই ঝড় তোলার জন্য, তবে সেদিন টর্নেডোর রূপ ধারণ করেছিলেন কলিস কিংও। কলিসের ৮১ এবং রিচার্ডসের ১৫৭ বলে অপরাজিত ১৩৮ রানের ইনিংস দু’টিতে ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করে ২৮৬। সেই ইনিংসের শেষ বলে ভিভের ফ্লিক করে ছয় মেরে আর সেদিকে না তাকিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার দৃশ্যটি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছে প্রবাদতুল্য।

সেদিন অতিমানব হয়ে গিয়েছিলেন রিচার্ডস; Image Source : Cricket World Cup 

মাইক ব্রিয়ারলি ও জিওফ বয়কটের ১২৯ রানের জুটি ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে শিরোপার আশা দেখাচ্ছিল বটে, কিন্তু তখনই আবির্ভাব ঘটে জোয়েল গার্নারের। গার্নার তুলে নেন পাঁচ উইকেট, ভেঙে পড়ে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ, অলআউট হয়ে যায় ১৯৪ রানে। ইংল্যান্ডের শেষ সাত ব্যাটসম্যানের কেউই পৌঁছাতে পারেননি দুই অংকের ঘরে, পাঁচজন আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে! আবারও তাই শিরোপা তুলে নেয় ক্যারিবীয়রা, আবার ক্যালিপসোর সুরে মাথা নত করে পুরো বিশ্ব।

১৯৭৯ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ, চার ম্যাচে তিনি করেছিলেন ২৫৩ রান। অন্যদিকে, পাঁচ ম্যাচে দশ উইকেট তুলে নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হয়েছিলেন ইংলিশ বোলার মাইক হেনড্রিক।

১৯৮৩: নতুন চ্যাম্পিয়ন

প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত! ; Image Source : ICC 

চার বছর পর সময় ঘনিয়ে আসে আরেকটি প্রুডেনশিয়াল কাপের, আবারও ইংল্যান্ডে। এবারও অংশ নেয় আটটি দল, তবে গতবারে সুযোগ পাওয়া কানাডার জায়গায় এবার খেলছিল জিম্বাবুয়ে। দুই গ্রুপে ভাগ করা হয় আটটি দলকে, ‘গ্রুপ এ’তে জায়গা পায় ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড ও শ্রীলংকা, ‘গ্রুপ বি’তে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জিম্বাবুয়ে। আগের দুই আসরে গ্রুপ স্টেজের নিয়ম ছিল রাউন্ড রবিন লিগ, কিন্তু ম্যাচ সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এবার নিয়ে আসা হয় ডাবল রাউন্ড রবিন ফরম্যাট, অর্থাৎ প্রতিটি দল তার গ্রুপের প্রতিটি দলের সঙ্গে দু’বার করে খেলবে। ম্যাচ সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়াতে হয় ভেন্যুর সংখ্যাও, তাই আগের দু’বার মাত্র ছয়টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৮৩ এর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৫টি মাঠে। তবে পয়েন্ট বিতরণ ব্যবস্থা ছিল একই, প্রতিটি জয়ের জন্য বিজয়ী দল পেতো চার পয়েন্ট।

নিজেদের ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জয়লাভ করে ‘গ্রুপ এ’-এর শীর্ষস্থান দখল করে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় স্থানের জন্য বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নিউ জিল্যান্ড ও পাকিস্তানের মধ্যে, দুই দলই জিতেছিল সমান তিনটি করে ম্যাচ। তবে নেট রানরেটের হিসাবে ভাগ্য খোলে পাকিস্তানের, বাড়ি ফিরতে হয় ব্ল্যাকক্যাপসদের।

অন্যদিকে ‘গ্রুপ বি’তে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তারা হারিয়ে দেয় বিশ্বকাপের মঞ্চে। ভারতের সাথে সেই ম্যাচের আগে বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচই হারেনি ক্যারিবীয়রা, অথচ ভারতের কাছে তারা হার মানলো আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই!

ভারত অবশ্য জিম্বাবুয়ের সাথে দ্বিতীয় ম্যাচে অবিশ্বাস্য এক কাজ করে ফেলেছিল। ‘ভারত’ না বলে ‘কপিল দেব’ বলাই শ্রেয়। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৭ রানেই ভারত হারিয়ে ফেলেছিল পাঁচ উইকেট। সেখান থেকে বলতে গেলে একা হাতেই ভারতকে টেনে তুললেন কপিল দেব। ভারত দিনশেষে করলো ২৬৬, সেখানে কপিল দেব একাই করেছিলেন অপরাজিত ১৭৫! দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল কিরমানির করা ২৪, কপিল দেব সেদিন যে ভারতীয়দের জন্য দেবতা হয়ে উঠেছিলেন, তা আর বলতে! তবে ভারতের কাছে এক ম্যাচ হারলেও বাকি চার ম্যাচ জিতে ঠিকই গ্রুপসেরা হয়েছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, চার ম্যাচ জিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভারত।

প্রথম সেমিফাইনালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও ইংল্যান্ড। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড গুটিয়ে যায় মাত্র ২১৩ রানে। জবাবে যশপাল শর্মা ও সন্দ্বীপ পাতিলের ফিফটিতে অনায়াসেই সেই লক্ষ্য টপকে যায় ভারত। ব্যাট হাতে ৪৬ রান ও বল হাতে ২৭ রানে দুই উইকেটের জন্য ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন মহিন্দর অমরনাথ।

অধিনায়ক কপিল দেবের সঙ্গে ভারতীয় অলরাউন্ডার মহিন্দর অমরনাথ; Image Source : The Hindustan Times 

কেনিংটন ওভালের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মহসিন খান ফিফটি করলেও ক্যারিবিয়ান বোলিং তোপের সামনে দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তানি ব্যাটিং লাইনআপ, ৬০ ওভারে তারা করে মাত্র ১৮৪। জবাবে ভিভ রিচার্ডস ও ল্যারি গোমেজের অর্ধশতকে ৬৮ বল হাতে রেখেই সেই লক্ষ্য টপকে টানা তৃতীয়বারের মত ফাইনালে পৌছে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অপরাজিত ৮০ রানের ইনিংসের জন্য ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন ভিভ রিচার্ডস।

আবারও লর্ডস, আবারও ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আবারও ভিন্ন প্রতিপক্ষ, এবার প্রতিপক্ষের নাম ভারত। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত পড়ল রবার্টস-গার্নার-হোল্ডিং-মার্শাল সেই বিখ্যাত পেস কোয়াট্রেটের সামনে। শ্রীকান্ত, অমরনাথ আর সন্দ্বীপ পাতিলের ছোট ছোট অবদান মিলিয়ে ভারত সর্বসাকুল্যে করতে পারল ১৮৩। গ্রিনিজ-লয়েড-রিচার্ডসদের নিয়ে বানানো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিং লাইনআপের কাছে সে লক্ষ্য মামুলিই হওয়ার কথা। কিন্তু, অলৌকিকভাবেই বোধ করি তা হলো না। অমরনাথ-সান্ধু-মদনলালদের সামনে গুড়িয়ে গেলো সেই ব্যাটিং লাইনআপ, পরাক্রমশালী ভিভ রিচার্ডসকে ভারতীয় কাপ্তান কপিল দেব আউট করলেন দুর্দান্ত এক ক্যাচ লুফে নিয়ে। মাত্র ১৪০ রানেই গুটিয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ৪৩ রানে জয় তুলে নিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত। সেই ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন হলো ভারত, যারা তাদেরকে উপনিবেশ করে রেখেছিলো প্রায় দুইশ’ বছর। কপিল দেব ট্রফি উঁচিয়ে ধরলেন, নতুন বিশ্বসেরা পেল পৃথিবী!

৭ ম্যাচে ৩৮৪ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হয়েছিলেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডেভিড গাওয়ার, ৮ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী ছিলেন ভারতের রজার বিনি।

১৯৮৭: বিলেত ছেড়ে উপমহাদেশে

ইডেন গার্ডেনসে প্রথম শিরোপার স্বাদ অস্ট্রেলিয়ার! ; Image Source : ICC

তিন তিনটে আসর ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর ইংল্যান্ডে হওয়ার পর আয়োজন করা হলো ক্রিকেটের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চলে, উপমহাদেশে। প্রথমবারের মতো যৌথ আয়োজন, আয়োজক ভারত ও পাকিস্তান, স্পন্সরশিপ চুক্তির কারণে টুর্নামেন্টের নাম প্রুডেনশিয়াল কাপ থেকে বদলে হয়ে গেল রিলায়েন্স কাপ।

অংশগ্রহণকারী দল থেকে প্রতিযোগিতার ফরম্যাট – সবই ছিল আগের বিশ্বকাপের মতোই। তবে এবার ভেন্যু ছিল আগের যেকোনোবারের চেয়ে বেশি, দুই দেশ মিলিয়ে ভেন্যুর সংখ্যা ছিল ২১টি! ‘গ্রুপ এ’তে ছিল স্বাগতিক ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে, অন্যদিকে ‘গ্রুপ বি’তে ছিল আরেক স্বাগতিক পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলংকা। তবে ততদিনে ওয়ানডে ক্রিকেট ৬০ ওভার থেকে নেমে এসেছে ৫০ ওভারে, এটি তাই ছিল প্রথম ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ।

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই বেশ হাস্যরসাত্মক একটি ঘটনা ঘটে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া করে ২৬৮, কিন্তু তাদের একটি বাউন্ডারি নিয়ে সন্দেহ ছিল, সেটি ছয় নাকি চার। কপিল দেব সেটি নিয়ে বাকবিতণ্ডা না করে সেটি ছয় হয়েছে মেনে নেন, অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৭০। শেষ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিলো ছয় রান, বোলিংয়ে আসেন স্টিভ ওয়াহ। প্রথম চার বলে একটি রান আউটসহ আসে চার রান, শেষ দুই বলে প্রয়োজন দুই রান। স্টিভ ওয়াহ’র সেই বলে আউট হয়ে যান ভারতের শেষ ব্যাটসম্যান মনিন্দর সিং, ভারত হেরে যায় এক রানে! অর্থাৎ, ওভার বাউন্ডারিটি স্রেফ বাউন্ডারি হলেই ম্যাচ জিতে যেত ভারত! ‘গ্রুপ এ’তে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া উভয়ই পাঁচটি করে ম্যাচে জয়লাভ করে, তবে নেট রান রেটে এগিয়ে থাকায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।

‘গ্রুপ বি’ এর পঞ্চম ম্যাচে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান ও সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে ব্যাট করে ফিল সিমন্স ও ভিভ রিচার্ডসের ফিফটির পরও মাত্র ২১৬ রানে গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে সেলিম ইউসুফের ফিফটিতে ভর করে শেষ বলে এক উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নেয় পাকিস্তান, আবদুল কাদিরের ৯ বলে ১৬ রানের ক্যামিও তাতে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পাঁচ ম্যাচ জিতে ‘গ্রুপ বি’এর শীর্ষস্থান দখল করে পাকিস্তান, চার ম্যাচ জিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ইংল্যান্ড। দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও আগেরবারের রানার্সআপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিটকে পড়ে গ্রুপপর্ব থেকেই।

সেমিফাইনালের প্রথম ম্যাচে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ডেভিড বুনের ফিফটি, জিওফ মার্শ, ডিন জোন্স, স্টিভ ওয়াহ ও মাইক ভেলেটার ছোট ছোট অবদানে ৫০ ওভারে ২৬৭ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে জাভেদ মিঁয়াদাদ ও ইমরান খানের ফিফটিতে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল স্বাগতিকরা। কিন্তু ক্রেইগ ম্যাকডারমট নামের ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় সব, পাকিস্তান গুটিয়ে যায় লক্ষ্য থেকে ১৮ রান দূরে। নিজেদের দ্বিতীয় ফাইনালে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া।

দ্বিতীয় সেমিফাইনালে স্বাগতিক ভারত ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে গ্রাহাম গুচের সেঞ্চুরি ও মাইক গ্যাটিংয়ের ফিফটিতে ২৫৪ রান তোলে ইংল্যান্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন ফিফটি করলেও তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি কেউ। ভারতও গুটিয়ে যায় জয় থেকে ৩৫ রান দূরে ২১৯ রানে। দুর্দান্ত এক শতকের জন্য ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন গ্রাহাম গুচ।

অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড এর আগে একটি করে ফাইনাল খেলেছিল, কিন্তু জেতেনি কোনো দলই। তাই ফাইনালে এই দুই দলের মুখোমুখি হওয়ার মানে ছিল, নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেতে যাচ্ছিল বিশ্ব।

ইডেন গার্ডেনসে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অজি কাপ্তান অ্যালান বোর্ডার। জিওফ মার্শ ও ডেভিড বুন তার দলকে এনে দেন দারুণ সূচনা। ডেভিড বুনের ৭৫ রানের ইনিংস এবং ডিন জোন্স, অ্যালান বোর্ডার ও মাইক ভেলেটার ছোট ছোট অবদানে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৫৩। জবাবে দারুণ খেলছিলেন গ্রাহাম গুচ, বিল অ্যাথি, মাইক গ্যাটিং ও অ্যালান ল্যাম্বরা। কিন্তু হঠাৎ ব্রিটিশ অধিনায়ক গ্যাটিং এক অদ্ভুত রিভার্স সুইপের চেষ্টা করলেন। কাজ হলো না, আউট! সেই ধাক্কা আর সামলাতে পারেনি ব্রিটিশরা, রানের চাকা থেমে যায়। ৫০ ওভারে তারা তুলতে পারে ২৪৬ রান, জয়ের বন্দর থেকে সাত রান দূরে। বিশ্বকাপ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। কে জানতো, এরপর আরও বহুবার জিতবে তারা!

বিশ্বজয়ের পর সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের প্রথম পাতা; Image Source : The Sydney Morning Herald 

ইংলিশ ব্যাটসম্যান গ্রাহাম গুচ আট ম্যাচে ৪৭১ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হিসেবে বিশ্বকাপ শেষ করেন, অন্যদিকে আট ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী ছিলেন ক্রেইগ ম্যাকডারমট।

এরপর হয়েছে আরও সাতটি বিশ্বকাপ আসর, সেগুলোয় হয়েছে বহু নাটক, জন্ম দিয়েছে বহু রোমাঞ্চের। তবে সেগুলোর শুরু এখান থেকেই। এই বিশ্বকাপগুলোই ছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ভিত্তিপ্রস্তর, যেই বিশ্বকাপ ক্রিকেট এখন আকাশছোঁয়া অট্টালিকা।

This article is in Bangla language. It is an article on the first four editions of the World Cup - 1975, 1979, 1983 & 1987; the ones which started it all, the ones which lay the foundation. 

Featured Image : Wallpaper Better 

Related Articles