অলিভার কানকে কে না চেনে? জার্মানির সেই কিংবদন্তী গোলরক্ষক সম্প্রতি কিছুদিন যাবত মাদ্রিদে আছেন। আরো বিশেষভাবে বললে রিয়াল মাদ্রিদের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে তার নিয়মিত আনাগোনা হচ্ছে কিছুদিন ধরে। খেলোয়াড়ি জীবনে রিয়ালের সাথে তার কোনো বিশেষ হৃদ্যতা ছিলো না, উল্টো থুথু-কাহিনীও আছে! তিনি লিভারপুলের ফাইনালের আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “রিয়াল মাদ্রিদে কেবল একটা জিনিসই চলে, সেটা হলো চ্যাম্পিয়নস লীগ! আপনি টয়লেটে গেলেন, গিয়ে দেখবেন চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফির রেপ্লিকা ঝুলছে। মুখ ধুতে যাবেন, দেখবেন চ্যাম্পিয়নস লীগের স্টিকার। একাডেমীর বাচ্চারাও চ্যাম্পিয়নস লীগের গল্পই করছে।”
অলিভার কান এমন একটি ক্লাবের চ্যাম্পিয়নস লীগ প্রীতির কথা বলছিলেন যে ক্লাবটি মাত্র দিন কয়েক আগে টানা তিনবারের মতো ও গত পাঁচ বছরে চারবার জিতেছে এই ট্রফি। চ্যাম্পিয়নস লীগের এই ফরম্যাটে এর আগে কারোর এই অর্জন নেই। আয়াক্স ও বায়ার্ন মিউনিখের আছে সত্তরের দশকে, আর তাঁরও আগের দশকে রিয়ালেরই ছিল টানা পাঁচবার জয়ের রেকর্ড। পাঠক, আজকে এই লেখায় কিছু তেঁতো-সত্য বলা হবে ব্যক্তিগত সমর্থন-সত্ত্বার বাইরে গিয়ে ।
আপনি চ্যাম্পিয়নস লীগের পুরো মাহাত্ম্য নিয়ে অবগত কি?
প্রায় সবাই জানেন, তবুও বলে নিই, উয়েফা সদস্য দেশগুলোর লীগের চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ এবং কিছু দেশের তৃতীয়, চতুর্থ দলগুলো নিয়ে এই প্রতিযোগিতা। এবার ইংলিশ লীগে ম্যানসিটি প্রায় ফেব্রুয়ারির দিকেই নিশ্চিত করে ফেলে যে তারাই চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে, ব্যবধান ছিল অনেক। তাহলে ২য় থেকে ৬ষ্ঠ দলগুলোর কী লক্ষ্য ছিল? সোজা বাংলায়, চ্যাম্পিয়নস লীগে সুযোগ পাওয়া। শেষ দিনের আগবধি যেকোনো লীগে উত্তেজনা থাকে তিনটি বিষয়ে। এক, কে হবে চ্যাম্পিয়ন; দুই, কারা কারা খেলবে চ্যাম্পিয়নস লীগে আর তিন, কাদের অবনমন হচ্ছে।
অনেক দলের গোটা মৌসুমেই উদ্দেশ্য থাকে মৌসুম শেষে এমন অবস্থায় থাকা যাতে চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলা যায়। আর এই চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচে একজন কোচ তার তূণের সেরা তীরটি বের করেন, খেলোয়াড়রাও একইভাবে মুখিয়ে থাকেন। বড় ক্লাব কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লীগে নেই, সেই ক্লাবের খেলোয়াড় কিনতে কষ্ট হয়। ইউরোপিয়ান ক্লাবে খেলা প্রত্যেক খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে এই রুপোলী ট্রফিতে চুমু খাওয়া। এই রুপোলী রঙের ঝলসানো অনেকের চোখেই অচেনা। ব্রাজিলের রোনালদো, বালাক, বুফোন, নেদভেদ, ভিয়েরা, নিস্তেলরয়রা এই ট্রফির স্বাদ পাননি। সর্বকালের অন্যতম সেরার কাতারে থাকা কোচ ওয়েঙ্গারও পাননি। আর সেই জায়গায় টানা তিন ট্রফি জয় কোনো বালকের ক্রীড়া নয়!
কেন টানা চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতা প্রায় অসাধ্য?
আপনি যদি এ বছর চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতে,ন তবে সেদিন থেকে পরের চ্যাম্পিয়ন আসার আগবধি খবরের কাগজে লেখা হয় ‘বর্তমান ইউরোপ সেরা ’ বলে। প্রতিপক্ষ কোচ বা খেলোয়াড়রাও সংবাদমাধ্যমে একবার হলেও এটা বলবেই। এটা কোনো নিয়ম না, এটাই মাহাত্ম্য। চ্যাম্পিয়নস লীগের গ্রুপ পেরোনো বেশ কঠিন। কিন্তু নক আউট খেলাগুলো অসম্ভব শক্ত। প্রায় খবরের কাগজের বাইরে থাকা রোমাও বার্সাকে হারাতে পারে, আবার নিশ্চিত বাদ পড়তে যাওয়া বার্সাও ৬-১ এ পিএসজিকে হারাতে পারে। তাই যারা চ্যাম্পিয়ন হয় তাঁরা মোটামুটি সব বাঁধা পেরিয়ে আসে। তাই তাদেরই ধরা হয় ‘রেফারেন্স দল’ হিসেবে। এ জন্যই চ্যাম্পিয়ন দলকে পরেরবার ‘বিশেষ’ আতিথ্য দেয় সব দল। সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিতে চায় সবাই তাদের সাথে। সেই সাথে চ্যাম্পিয়ন দলের কৌশল, শক্তি, দুর্বলতা নিয়ে এত কাঁটাছেড়া হয় যে, তাদের পথ কন্টকাকীর্ণ করার সব আয়োজনই করা হয়। আর সে জন্যই আধুনিক চ্যাম্পিয়নস লীগ ফরম্যাটে রিয়ালের আগে কোনো দলই টানা দুবার জেতেনি।
কেন রিয়ালের এই কাজ প্রশংসার দাবিদার?
২০১৬ সালের ফাইনালে রিয়ালের যে দল খেলেছিল, ২০১৭ সালের ফাইনালে সেখান থেকে একজন বাদ গিয়েছিলেন। তার বদলে যিনি আসেন তিনিও নতুন কেউ না, ২০১৪ ফাইনালে তিনি খেলেছেন! ২০১৭ ফাইনালের হুবহু দলটা খেলল ২০১৮ ফাইনালে। এই তিন বছরে তাদের নিয়ে কম কাটাছেড়া হয়নি। তবুও একই দল খেলল! ২০১৪-তে রিয়াল বায়ার্নকে বায়ার্নের মাঠে ৪-০ তে হারিয়ে ফাইনালে আসার পর রিয়ালের জয় নিয়ে কোনো কথা হয়নি। ২০১৫ তে নিজেদের মাঠে ফরোয়ার্ডদের অতিরিক্ত ভুলে রিয়াল সেমি ফাইনালে বাদ পড়ে। সেবারও রিয়ালের খেলার ধার ছিল বেশ।
কিন্তু ২০১৬ তে রিয়ালের অভ্যন্তরে শুরু হলো নানা ঝামেলা। টালমাটাল রিয়ালে জিদান এলেন। রোমার সাথে দুই ম্যাচে মোট ৪-০ তে জেতা রিয়ালকে বলা হলো ভাগ্যের জোরে জিতে গেছে! এরপর উলফসবার্গের সাথে হেরে এল ২-০ তে, রব উঠে গেল ‘এই ছোট দলের সাথেই এই অবস্থা?’! নিজেদের মাঠে ফিরতি ম্যাচে যখন ৩-০ তে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন হলো, তখন কথা উঠলো ‘ছোট দলের সাথে এ আর এমন কি!” ম্যানসিটির সাথে দুই ম্যাচ মিলিয়ে ১-০ জয়ের পর বলা হলো ‘কি সব সহজ দলের সাথে খেলা পড়ছে একের পর এক, তা-ও এভাবে খুঁড়িয়ে!” ফাইনালে সবার রোমান্টিকতা গিয়ে পড়লো অ্যাটলেটিকোর উপর। আন্ডারডগদের উপর রোমান্স ইতিহাসে নতুন কিছু না! হারার পর বলা হলো, “লাকি জিদান আর লাকি রিয়াল”! চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে এসে রিয়াল পেল নানা উল্টোপাল্টা তকমা!
২০১৭ তে ভাবলো এবার আর হচ্ছে না ভাগ্যের লীলা। শেষ ষোলোয় নাপোলির সাথে দেখা, তাঁরা তখন দারুণ ফর্মে, ভাবা হলো কেবল ক্রসে খেলা রিয়াল আটকে যাবে নাপোলির জালেই। দুই লেগেই ৩-১ এ হারের পর যখন বায়ার্ন এলো সামনে, তখন সবাই বেলুন ফাটার আশায়। বায়ার্নের মাঠে ২-১ এ জেতার পর তীর গেল সব ভিদালের কার্ডে। দ্বিতীয়ার্ধে মুহুর্মুহু রিয়ালের আক্রমণ, ভিদালের অযাচিত ফাউল আর অ্যাওয়ে ম্যাচে রিয়ালের স্তিতধী মনোভাব নিয়ে কোনো কথা হয়নি। হোম ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ে রিয়ালের একটি গোলে রেফারির ভুল ছিল, কিন্তু রেফারির যে ভুলে বায়ার্ন অতিরিক্ত সময়ে এসেছিল তা অনুক্ত থেকে গেল! তবে সেই ম্যাচের রেফারিং ছিল জঘন্য। সেমিতে আবার সবার মানবতা, রোমান্স অ্যাটলেটিকোর উপর এসে পড়লো। এবার রোনালদোর হ্যাটট্রিক আর বেঞ্জেমার এক মূহুর্তের ম্যাজিকে সেই আশায়ও বালি। ফাইনালে জুভেন্টাসের রক্ষণ দেয়ালে মাদ্রিদের ঠেকে যাওয়ার কথাই চললো মিডিয়ায়। বার্সার মেসি-নেইমাররা ১৮০ মিনিটে যাদের সাথে গোল পায়নি একটাও, তাদের গুনে গুনে ৪ গোল দেয়ার পরেও নিন্দুকদের মুখে সেই বায়ার্ন ম্যাচেরই অনাচার! টানা দুবারের জয়ে কেবল ভাগ্য আর রেফারিং খুঁজে পেল অনেকে।
এবার রিয়ালের ঘরোয়া ফর্ম তথৈবচ। সে কি বাজে খেলার ধরন! টটেনহ্যাম, বরুশিয়ার কঠিন গ্রুপ পেরিয়ে পিএসজির সাথে ম্যাচ। গতবার বার্সাকে হোমে চার গোল দেয়া পিএসজিতে এবার আরো নেইমার যোগ দিয়েছেন। সবাই আশায় ছিল ভাগ্য আর রেফারির সহায়তাধন্য দলটির এবার মোহভঙ্গ হবে। উল্টো আশাভঙ্গ হলো প্যারিসিয়ানদের, পাত্তাই পেল না রিয়ালে অভিজ্ঞতার কাছে। এরপর কোয়ার্টারে জুভেন্টাসের সাথে ম্যাচ। জুভেন্টাসের মাঠে তাদের ৩-০ তে হারালো রিয়াল, সেই ম্যাচে শেষদিকে গোল আরো হতে পারতো। ২০১৪ এর শক্তিশালী রিয়াল হলে এই লিড সহজেই জয়ে রূপ দিতো, এমনকি রামোস বা নাচো থাকলেও। অনভিজ্ঞ ২১ বছরের এক ভালেহো আর কারভাহালের উচ্চতাকে টার্গেট করে জুভেন্টাস ইতিহাস করেই ফেলতে যাচ্ছিলো প্রায়, অতিরিক্ত সময়ের এক পেনাল্টিতে রিয়াল জিতে যায়। পুরো সময় নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকার কথা না। অভিযোগ পেনাল্টি নিয়ে, যেটা ম্যাচের অন্য যেকোনো সময়ে করলে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিত। কিন্তু কামব্যাক করার শেষ অবস্থায় অন্তিম লগ্নে দেয়ায় বিতর্ক হলো। যদিও অধিকাংশ সাবেক রেফারির মতে, এই পেছন থেকে ঘাড়ে চাপ দিয়ে করা ফাউলের পেনাল্টি নিয়ে বেশি সন্দেহ নেই।
সেমি ফাইনালে বায়ার্নের সাথে রিয়াল আসলেই ছিল নিজেদের ছায়া। বায়ার্ন ছিল সব মিলিয়ে যোগ্য দল। কিন্তু এই চ্যাম্পিয়ন্স লীগ একটা অভিজ্ঞতার লড়াইও। ক্লপ যেমন বলেছিলেন, রিয়ালের দুই গোল করতে লেগেছিল চারটা মোটামুটি সুযোগ আর বায়ার্নের এক গোল করতে লেগেছিল আটটা সুবর্ণ সুযোগ! বায়ার্ন ম্যাচে রিয়াল সেরা দল না হয়েও ভাগ্য ও অভিজ্ঞতার জোরে ফাইনালে উঠে আসে।
এবার ফাইনালে মোটামুটি রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বাকি বিশ্ব! সালাহর কাঁধে চেপে আসা লিভারপুল এবারের সবার ‘রোমান্স’! আর সেই সালাহর কাঁধ নিয়েই যত বিতর্ক! সালাহ থাকলে এই করে ফেলত- যুক্তির প্রেক্ষিতে একবারও কি আসে না রিয়ালের বেঞ্চের খেলোয়াড়ের কোয়ালিটি আর লিভারপুলের বেঞ্চের খেলোয়াড়ের কোয়ালিটি নিয়ে কথা? নিশ্চয়ই রিয়ালের আর্থিক ব্যাপারটা টানবেন। অথচ জিদান আসার পর কোনো বড় খেলোয়াড় কেনেননি। এক ভ্যান ডাইকের দামের চেয়ে রিয়ালের গোটা ডিফেন্সের দাম কম! হ্যাঁ, রিয়ালের আগের অনেক ব্যয় ছিল। কিন্তু কৌতিনহোকে ধরে না রাখা কি ক্লাবের ব্যর্থতা নয়? ফুটবলে সাবস্টিটিউট বেঞ্চ খুবই গুরুত্ববহ। আর এই প্রতিযোগিতার যুগে ভাল বেঞ্চ না থাকার পর আবেগীয় যুক্তিতে ‘সালাহ থাকলে এই হতো’ কথাবার্তা অবান্তর!
একনজরে চলুন দেখে নেয়া যাক এবার বাদে গত চার বছরে রিয়ালের সব বড় ম্যাচগুলো।
২০১৩-১৪
গ্রুপপর্ব: জুভেন্টাস ২-১ (হোম), ২-২ (অ্যাওয়ে)
শেষ ষোলো: শালকে ৬-১ (হোম), ৩-১ (অ্যাওয়ে)
কোয়ার্টার: বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ৩-০ (হোম), ০-২ হার (অ্যাওয়ে)
সেমিফাইনাল: বায়ার্ন ১-০ (হোম), ৪-০ (অ্যাওয়ে)
ফাইনাল: অ্যাটলেটিকো ৪-১
২০১৪-১৫
গ্রুপপর্ব: লিভারপুল ১-০ (হোম), ৩-০ (অ্যাওয়ে)
শেষ ষোলো: শালকে ৩-৪ হার (হোম), ২-০ (অ্যাওয়ে)
কোয়ার্টার: অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ১-০ (হোম), ০-০ (অ্যাওয়ে)
সেমিফাইনাল: জুভেন্টাস ১-১ (হোম), ১-২ হার (অ্যাওয়ে) এবং সেমি থেকে বাদ
২০১৫-১৬
গ্রুপপর্ব: পিএসজি ১-০ (হোম), 0-0 (অ্যাওয়ে)
শেষ ষোলো: রোমা ২-০ (হোম), ২-০ (অ্যাওয়ে)
কোয়ার্টার: উলফসবার্গ ৩-০ (হোম), ০-২ হার (অ্যাওয়ে)
সেমিফাইনাল: ম্যানসিটি ১-০ (হোম), ০-০ (অ্যাওয়ে)
ফাইনাল: অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ১-১ (পেনাল্টিতে জয়ী)
২০১৬-১৭
শেষ ষোলো: নাপোলি ৩-১ (হোম), ৩-১ (অ্যাওয়ে)
কোয়ার্টার: বায়ার্ন ৪-২ (হোম), ২-১ (অ্যাওয়ে)
সেমিফাইনাল: অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ৩-০ (হোম), ১-২ (অ্যাওয়ে) হার
ফাইনাল: জুভেন্টাস ৪-১
মোট ৩২টি ম্যাচের মধ্যে ৫টি পরাজয়, যার মধ্যে মাত্র একটি পরাজয়ে রিয়ালের বিদায় হয়েছিল। সহজ জিনিস? গত তিন বছরে ৬টি করে ১৮টি নকআউটের প্রায় ১,৭০০ মিনিটের মাঝে এমন কেউ কি ছিল না তাদের বিদায় করতে? সব কি রেফারি আর ভাগ্যের বদান্যতা?
যেটাকে মোটাদাগে ভাগ্য বলা হয়, সেটাকে জয়ের প্রচন্ড ইচ্ছার ফলাফলও বলা যায়। ক্রুস-মড্রিচের খেলা দেখলে মনে হয় অফিসে আর পাঁচটা দিন! যেটাকে আপনি ভাগ্য বলে ভাবেন সেটাকে তো জেতার প্রচন্ড ইচ্ছার ফলও বলা যায়। কম সুযোগে বেশি কার্যকরিতা একটা গুণ, এই রিয়ালের এটা আছে। নাহলে রোনালদো, বেলরা তাদের সেরা সময়ে না থাকার পরেও ঠিকই উতরে যাচ্ছে রিয়াল। যেদিন ফরোয়ার্ডরা গোল পায় না সেদিন ডিফেন্ডার হয়েও মার্সেলো গোল দেয়। বেল-বেঞ্জেমা জ্বলে উঠলো একদম শেষভাগে। খুব দারুণ কোনো খেলার ধাঁচ নেই, ভয় জাগানিয়া আক্রমণ নেই, তবুও ঠিক কাজটা হয়ে যাচ্ছে। এটাই চ্যাম্পিয়ন্স লীগ মানসিকতা, যেটা কান বলেছিলেন। এই চ্যাম্পিয়নস লীগের সঙ্গীত বেজে উঠলেই এই দলের আবহ বদলে যায়। কিংবদন্তী কোচ কাপেলো যখন মাদ্রিদে আসেন, তখন ৩১ বছর কোনো চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফি নেই রিয়ালের। উনি অবাক হয়ে গেলেন এক গ্রাউন্ডসম্যানকে দেখে। তিনি নিজের ক্লাবকে সগর্বে সেরা বলে যাচ্ছেন, আউড়ে যাচ্ছেন ৩০ বছর আগের স্টেফানোদের জয়ের গল্প। এটাই হার না মানা মানসিকতা।
যে ব্যক্তিটি এই সাফল্যের নেপথ্য নায়ক, জিদান, তিনি নিজেও প্রাপ্য সন্মান পাচ্ছেন না। ডাগআউটে উল্টোপাল্টা ভঙ্গিমা নেই, তাই লোকে তার ট্যাক্টিকাল জ্ঞানকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই জিদান এমন। জিদান মাঠে থাকার সময় পাশের গড়পড়তা খেলোয়াড়টিকেও দারুণ মনে হতো। কোচ হিসেবেও তিনি আহামরি কোনো দর্শন বা ধরন আনেননি। একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যেটা ফল দিচ্ছে। ভবিষ্যতে জিদানের মনস্তাত্ত্বিক কাজগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। ২০১৬ ও ২০১৮ দু’বারই রিয়াল ফাইনালে যায় এমন অবস্থায় যে, হারলেই মৌসুম পুরোটাই ব্যার্থতায় পর্যবসিত হবে। তবুও খেলোয়াড়রা ছিলেন স্থিতধী। সেই দেল বস্ক ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে রিয়ালে কেবল ছিল ইগোর লড়াই। জিদান আসার পর ড্রেসিংরুমে ফুরফুরে পরিবেশ, প্রেসিডেন্ট পেরেজও তাঁর সাথে একসুরো। সব মিলিয়ে এখন না হলেও ভবিষ্যতে জিদানের কাজ নিয়ে আরো আলোচনা হবে।
বিতর্ক আর চ্যাম্পিয়ন প্রায় সমার্থক। এমন কি যে এর আগে কোনো চ্যাম্পিয়নই বিতর্কিত ছিলো না বা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ একদম কলঙ্কমুক্ত ছিল? ২০০৯ সালে হবু চ্যাম্পিয়ন বার্সা বনাম চেলসি ম্যাচ কি খুব বেশি অতীত? ২০০৫ এ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের চেলসির সাথে ‘ভূতুড়ে গোল’ বিতর্ক, আয়াক্স-জুভেন্টাস ফাইনাল বিতর্ক বা ১৯৯৩ এর চ্যাম্পিয়ন মার্শেই এর তুলকালাম সবই চাক্ষুষ। না, বিতর্ক দিয়ে বিতর্ক ঢাকা হচ্ছে না। কিন্তু নকআউট ও ফাইনাল মিলিয়ে গত তিন বছরে প্রায় ২,০০০ মিনিটে যাদের কেউ হারাতে পারেনি, তাদের সব অর্জন ভাগ্য বা রেফারিংয়ের বদান্যতা বলে আখ্যায়িত করা অর্বাচীনতা।
অনেক ক্লাবের কাছে তিন বছরে একটা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতাও বিশাল ব্যাপার। সে জায়গায় একটানা তিনটি ও পাঁচ বছরে চারটি অনন্য ব্যাপার। সমালোচনা, ভাগ্য, রেফারিং বিতর্ক সব পাশে সরিয়ে রেখেও তাদের অর্জনকে সম্মান দেয়া যায়। লেখায় সমর্থনসত্ত্বা খোঁজার আগে ভাবুন, আপনি আপনার জীবদ্দশায় কোনো ক্লাবকে এমন এর আগে করতে দেখেছেন? এর চেয়ে শক্তিশালী ক্লাব কি আর ছিল না? তবে কেন হয়নি?
কারণ হলো মানসিকতা। বড় মঞ্চে স্নায়ু ধরে রাখা, অহং ধরে রাখাও একটা শিল্প। রিয়াল মাদ্রিদ তা-ই করছে। এই ক্লাবের রক্তেই এই প্রতিযোগিতার আহবান। এসব হুট করে আসেনি। এগুলো একটা প্রক্রিয়ার বহুদিন সাধনার ফলাফল। হয়তো এমন সাফল্য আর পুনরাবৃত্তি রিয়াল করতে পারবে না। কিন্তু এই রেকর্ড ভাঙতে অন্য ক্লাবগুলোর কত বছর লাগবে? আধুনিক বাস্তবতায় ভেবে দেখুন, সহসা প্রায় অসম্ভব। তাই সকল সমালোচনা পাশে সরিয়ে স্বীকার করে নিন, এই সাফল্য সত্যিই অতুলনীয়।
ফিচার ছবিসত্ত্ব: Sportsnet