বর্তমান যুগের পেশাদার ফুটবলে খেলোয়াড়দের আনাগোনা শুরু হয় ৮-১০ বছর থেকেই। ক্লাবের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলে এরপর তাদের ক্যারিয়ার শুরু হয় মূল দলে। একেকজন প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়ের হাতেখড়ি হয় তার সেই শৈশবে শুরু করা ক্লাবে, এরপর সেখান থেকে আস্তে আস্তে বয়স যখন ২০-এর আশেপাশে হয়, তখন ডাক পায় মূল দলে। সেক্ষেত্রে ২২ বছর বয়সে একজন খেলোয়াড় মোটামুটি একটি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। আর সামান্য অভিজ্ঞতা মিলিয়ে কিছুটা পরিপক্বও হয়ে ওঠেন। কিন্তু ২২ বছর বয়সে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করার গল্প আছে কতগুলো?
“You ain’t born a Londoner, you’re made one.”
২০১৯-২০ সিজনে আর্সেনালের জার্সি উন্মোচনের ভিডিওর একটি বিখ্যাত লাইন, যেটা আমরা শুনতে পাই ইয়ান রাইটের মুখ থেকে। জন্মগতভাবে আসলেই কেউ কিছু হয় না, সবাইকে সেটা বানিয়ে নিতে হয়।
ইয়ান রাইটও কি ভেবেছিলেন যে ২২ বছর বয়সে তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করবেন? না টানেল রিফাইনারিজেই বাকি সময় পার করবেন? একই সাথে দুই ক্লাবের লেজেন্ড খেতাব পাওয়া কয়জনের পক্ষে সম্ভব? দুই দলের ফ্যানদের ভালবাসা কয়জনই বা পেতে পারেন সমান ভাবে? দুই দলেরই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিতে পারেনই বা ক’জন? ক্রিস্টাল প্যালেস আর আর্সেনাল — দুটো ক্লাবকেই যেমন উজাড় করে দিয়েছেন সব, সেই ক্লাব কিংবা ক্লাবের ভক্তরাও তাকে খালি হাতে ফেরায়নি। দুই ফ্যানবেজের অন্তরে ছিলেন, আছেন এবং হয়তো আজীবনই থাকবেন।
ছোট থাকতে সৎ বাবার সাথে কখনোই ভালো সম্পর্ক ছিল না তার। বাড়ি থেকে চলে গিয়ে বাইরে থাকাই ছিল তার কাছে শ্রেয়। তিনি এবং তার বড় ভাই দু’জনেই ছিলেন ফুটবলার, তখন আশেপাশের এলাকায় খ্যাপ খেলেই তাদের জীবন চলত। এর মাঝে ৬ মাসের জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিল ড্রাইভিংয়ের নিয়ম ভঙ্গের জরিমানা পরিশোধ না করায়। তবে দায়িত্ব বেড়ে যায় যখন দুই সন্তানের অভিভাবক হন। তখন তার বয়স ১৯ বছরের আশেপাশে। মিলওয়াল, চার্লটন ও চেলসিতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ছয় সপ্তাহের ট্রায়ালের সুযোগ পান ব্রাইটনে। সেখানে ট্রেইনিংয়ে মূল দল বা রিজার্ভ সবার সাথেই তার গোল করা হয়ে যায় একদম ডাল-ভাত। কিন্তু ব্রাইটন থেকে বাসায় ফেরার টাকাটা তার কাছে ছিল না তখন। ক্লাবের কাছে চাওয়ায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাকে অফিসের বাইরে বসিয়ে রাখে পাক্কা ৬ ঘণ্টা। এটি ছিল তখন সামান্য কয়েকশ’ পাউন্ডের ব্যাপার। কিন্তু সেই টিনেজারের কাছে তখন টাকাটা ছিল না। ক্লাব কর্তৃপক্ষও তাকে এভাবে বসিয়ে রেখে কোনোরকম জবাব না দিয়ে অপমান করে। সেই বয়সে এই অপমানটি দারুণভাবে গায়ে লাগে তরুন ইয়ান রাইটের। পরে ব্রাইটনের অধিনায়কের মধ্যস্থতায় সমাধানে আসেন তারা। এহেন কাণ্ডের পর আর ব্রাইটনে যোগ দেয়া হয়নি তার।
সেখান থেকে ফিরে এসে যোগ দেন সেই টানেল রিফাইনারিজে। তবে সানডে ফুটবল লিগে তিনি ছিলেন নিয়মিত, শুধুমাত্র মনের প্রশান্তির জন্য সেখানে খেলতেন। সানডে লিগ হচ্ছে আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনের একটি অপেশাদার ফুটবল প্রতিযোগিতা, যেখানে অন্য পেশায় থাকা খেলোয়াড়েরা কেবল রবিবার ছুটির দিনে খেলে থাকেন। সেখান থেকে এরপর তার কাছে প্রস্তাব আসে ক্রিস্টাল প্যালেস থেকে; পেটের চিন্তায় এই প্রস্তাবটি নেননি, কারণ আরেকটি ব্রাইটন কাণ্ড হোক তা তিনি চাননি।
কিন্তু তিনি না নিলেও কর্মক্ষেত্রে তার বস ঠিকই নিয়েছিলেন এই সুযোগ। ক্যান্টিনে রাইটকে ডেকে তিনি বুঝালেন সব। ৮০’র দশকে ব্রিটেনে শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের সাথে সেখানকার বসের থেকে এমন ব্যবহার পাওয়াটা ছিল রীতিমতো অমাবস্যার চাঁদের মতো। কিন্তু কপালগুণে সেটাই পেয়ে যান রাইট। তবে এখানেও তিনি ক্রিস্টাল প্যালেসের লোকদের তিনবার ঘুরিয়েছেন প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে।
শুরুতে প্যালেসে প্রস্তাব পান মাত্র ৩ মাসের চুক্তির। ট্রেইনিংয়ে নিজের পুরোটা উজাড় করে দেন, কারণ এটাই ছিল তার শেষ সুযোগ। আগের-পরের সব চিন্তা দূরে ফেলে মনোনিবেশ করেন ট্রেইনিংয়ে। প্যালেস পেয়ে যায় একটি নতুন রত্ন। ঝিনুকের ভেতরে থাকা মুক্তাটি বের করে আনে তারা। এরপর তারা তাকে একটি স্থায়ী পেশাদার চুক্তির প্রস্তাব দেয়। ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নেন একজন নতুন ফুটবলার।
ঈগলদের হয়ে প্রথম মৌসুমে করেন ৯টি গোল। কম মনে হলেও সেটাই ছিল ওই মৌসুমে এই ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তার অবদান সবার চোখে পড়ে যখন প্যালেস ডিভিশন ওয়ানে প্রমোশন পায়। প্রমোশনের ওই মৌসুমে ৩৩টি গোল আসে রাইটের পা থেকে। ‘৮৯-‘৯০ মৌসুমটা নষ্ট হয় দুইবার পা ভাঙায়৷ এরপর ১৯৯০ সালের এফএ কাপ ফাইনালেও পৌছে যায় প্যালেস। ইনজুরির জন্য তাকে বেঞ্চে থেকে শুরু করতে হয় খেলা। ৭২ মিনিটে নেমে গোল করে ৩-৩ গোলের সমতায় এনে ফাইনাল খেলাটিকে নিয়ে যান রিপ্লেতে। রিপ্লেতে যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে ১-০ গোলে হারে তারা। এটি ছিল স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রথম শিরোপা। ক্রিস্টাল প্যালেসের হয়ে তার গোলের এই দৌড় গিয়ে থামে ১১৭টিতে, যেটি এখন পর্যন্ত এই ক্লাবের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত গোল।
১৯৯০-৯১ মৌসুম থেকে শুরু হয় প্রিমিয়ার লিগ। আগের মৌসুমে অল্পের জন্য ডিভিশন ওয়ানের শিরোপা হাতছাড়া করা আর্সেনাল এবার ভালোভাবে দল গুছানো শুরু করে। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম মৌসুমটিও জিতে নেয় তারা। কিন্তু তাদের কীসের যেন একটা কমতি ছিল সে সময়। ১৯৯১-৯২ মৌসুমের শুরুতেই তাই সেখান থেকে ডাক চলে আসে ইয়ান রাইটের। ক্লাব রেকর্ড ২.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তাকে নিয়ে আসেন তৎকালীন কোচ জর্জ গ্রাহাম।
লিগ কাপে অভিষেক ম্যাচেই লেস্টার সিটির বিপক্ষে গোল পেয়ে যান রাইট। এরপর সাউদাম্পটনের সাথে লিগ অভিষেকে সাউদাম্পটনের মাঠেই করে বসেন হ্যাটট্রিক। এর চেয়ে ভাল শুরু আর কেমনই বা হতে পারে! আর্সেনালের এরপরের ৬ মৌসুমেই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। এছাড়াও জর্জ গ্রাহামের অধীনে তিনি স্বাদ পান লিগ কাপ, এফএ কাপ, উয়েফা কাপ উইনার্স কাপের। ইয়ান রাইটের জন্য আর্সেনালে এই সময়টি ছিল তার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তিনি সেখানে সঙ্গী হিসেবে পান তার চাইতে ভালো কিছু খেলোয়াড়, এবং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস – সৎসঙ্গ। রাইটের আচরণ-চলাফেলা সব বদলে দিতে খুব সাহায্য করেন তারা। এর ফলাফল হিসেবে রাইটও চলে আসেন নিয়ম-কানুনের মধ্যে, আর দুর্দান্ত কম্বিনেশনের এই আর্সেনাল দলটিও ১৯৯৩ সালে জিতে নেয় এফএ কাপ।
রাইটের মধ্যে এই পরিবর্তন নিয়ে আসার পেছনে কিন্তু আরো একজনের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ইংল্যান্ডের সাবেক মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ডেভিড রোক্যাসল। দু’জন একসাথে ছিলেন খুব অল্প সময়। মাত্র এক বছর ড্রেসিংরুম শেয়ার করার পর রোক্যাসল চলে যান লিডস ইউনাইটেডে। কিন্তু প্রয়াত সাবেক এই সতীর্থের প্রভাব রাইটের উপর অনেক বেশি কাজ করে। তবে আরেকজনের কথা না বললেই নয়, তার নাম সিডনি পিগডেন। তিনি ছিলেন রাইটের স্কুল শিক্ষক। শৈশবের খারাপ সময়ে এই একজনের কাছেই রাইট খুঁজে পেতেন শীতল ছায়া।
এরপর ১৯৯৫ সালে বিতর্কিতভাবে বিদায় হয় জর্জ গ্রাহামের, কেয়ারটেকার কোচ হিসেবে আসেন স্টুয়ার্ট হিউস্টন। এরপর তার জায়গায় স্থায়ী কোচ হিসেবে আসেন ব্রুস রিউখ। কিন্তু তার সাথে ঝামেলা শুরু হয় রাইটের। এক পর্যায়ে রাইট আর্সেনাল বোর্ডের কাছে দলবদলের আবেদন করে চেলসির সাথে কথাবার্তা শুরু করেন। অন্যদিকে তখন রিউখও নিয়ে আসেন ডেনিস বার্গক্যাম্পকে৷ কিন্তু আর্সেনাল বোর্ড এই ঝামেলা এড়াতে রিউখকেই সরিয়ে দেয়, আর তার জায়গায় আগমন ঘটে প্রখ্যাত ফরাসি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের। রিউখ নামের সেই কোচ স্থায়ী হলে আমরা হয়তো রাইটকে শেষমেশ ‘চেলসি লেজেন্ড’ হিসেবে পেতে পারতাম।
এরপর ওয়েঙ্গারের অধীনে রাইট-বার্গক্যাম্প জুটি হয়ে ওঠে দুর্দান্ত। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে, অর্থাৎ ওয়েঙ্গারের প্রথম মৌসুমে ৩৩ বছর বয়সী রাইটের পা থেকে আসে ২৩টি গোল।
১৯৯৮ সালে আর্সেনাল আবার একই সাথে জিতে নেয় প্রিমিয়ার লিগ এবং এফএ কাপ। সানডে লিগ ছাড়লেও ওই লিগের স্বভাব পুরোপুরি কখনোই ছাড়তে পারেননি রাইট। মাঠে ধাক্কাধাক্কি, খেলোয়াড়দের চুল ধরে টান দেওয়া, বা তার চেয়ে সাইজে বড় প্লেয়ারদের সাথে শুধু শুধু ঝগড়া লাগতে যাওয়া ছিল একদম সাধারণ দৃশ্য। ১৯৯৮ সালের প্রিমিয়ার লিগ বিজয়ী মেডেল গলায় ঝুলিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড লেজেন্ড রয় কিনের সামনে গিয়ে শুধু শুধুই শুরু করেন ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গি। মাঠে সেদিন বাদানুবাদ কম হয়নি তাদের মধ্যে। তবে সেই সানডে লিগে তিনি যেমন বিধ্বংসী ছিলেন, নিজের সেই রূপটি তিনি প্রিমিয়ার লিগেও নিয়ে এসেছিলেন।
তবে দলে রাইটের সময় এখানেই আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। রাইটের বয়স বিবেচনায় আর্সেন ওয়েঙ্গার ফ্রান্স থেকে নিয়ে এসেছিলেন নতুন অস্ত্র, নিকোলাস আনেলকা। ১৯৯৮ সালের এফএ কাপ ফাইনালে নামার সুযোগ হয়নি রাইটের; দলে সে জায়গা আস্তে আস্তে নিয়ে নিচ্ছিলেন আনেলকা, যিনি তখন বয়সে একদমই তরুণ আর রাইটের চেয়েও ধারালো। ফলে নতুনকে জায়গা দিতে সরে যেতে হয় রাইটকেই।
সে বছর গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় প্যারিসে রাইটকে ডেকে নেন আর্সেন ওয়েঙ্গার। প্যারিসের সেই রাতে রেঁস্তোরায় আর্সেনাল বোর্ড, ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড ডেইন, আর্সেন ওয়েঙ্গার ও রাইটের মধ্যে চলে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা। সিদ্ধান্ত হয়, রাইটের আর্সেনাল ক্যারিয়ারের দৌড় এখানেই থামবে। রাইটও তেমন কোনো অভিযোগ করেননি এটি নিয়ে। কারণ, ততদিনে তার রক্তেই মিশে গিয়েছে আর্সেনাল। নিজের চেয়ে তিনি ক্লাবের স্বার্থটাকেই এগিয়ে রাখলেন।
এরপর বিভিন্ন সময়ে রাইট ওয়েস্টহ্যাম, সেল্টিক, বার্নলি, নটিংহ্যামে যোগ দিলেও তার ক্যারিয়ার আর সেভাবে আগায়নি। তিনি পরবর্তীতে এ নিয়ে বলেছিলেন যে আর্সেনাল ছাড়ার পর ফুটবল নিয়ে তার আবেগের জায়গাটি অনেক কমে যায়। ২০০০ সালে নতুন শতাব্দীতে অবসরে যান খুবই অল্প সময় দর্শককে মাতানোর সুযোগ পাওয়া এই ফুটবলার। আর্সেনালে মাত্র এই অল্প সময়েও হয়ে যান ক্লাবের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা (১৮৫ গোল), যে রেকর্ড পরে ভাঙেন থিয়েরি অঁরি।
এই লোকের সম্পর্কে বলা হয়, “He bleeds Arsenal”। শুরুতে যে উদ্ধৃতিটি দেওয়া হয়েছে, ইয়ান রাইট আসলেই একদম এমনই, জন্ম থেকে তিনি আর্সেনালের ছিলেন না; কিন্তু তিনি নিজেকে বানিয়ে নিয়েছেন আর্সেনালের জন্য। বর্তমানে যদি ক্লাবের এক নম্বর সমর্থক বলা হয় কাউকে, সেটি অবশ্যই হবেন ইয়ান রাইট। আর্সেনালের সবকিছুতেই এখনও তিনি জড়িয়ে রাখেন নিজেকে।
ইংল্যান্ডের হয়ে তার অভিষেক হয় ২৬ বছর বয়সে। তবে কোনো কোচই তার উপর ভরসা রাখতে পারেননি, তাকে বেশিরভাগ ম্যাচই খেলতে হয় বদলি হিসেবে। ৮ বছরের এই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন তিনজনকে। তার নামের পাশে ৮৭টি ম্যাচের কথা উল্লেখ থাকলেও এগুলোর মধ্যে কেবল ১৭টি ম্যাচেই তিনি শুরুর একাদশে ছিলেন। ১৯৯১ সালের পরবর্তী পাঁচ মৌসুমে ক্লাবের হয়ে প্রতিবারেই করেছিলেন ৩০টির বেশি গোল। কিন্তু এই ফর্মও রাইটকে জাতীয় দলে টানা ৩ ম্যাচ খেলাতে পারেনি। রাইট যে ১৭টি ম্যাচ খেলেন, তার ৯টিই ছিল শুধু গ্রাহাম টেইলরের অধীনে। তার কাছে রাইটের চাইতে নাইজেল ক্লফ বা পল স্টুয়ার্টের মতো প্রোলিফিক স্ট্রাইকাররা প্রাধান্য পেতেন। ১৯৯২ সালের ইউরোতে জায়গা হয়নি তাই রাইটের, যদিও সেই মৌসুমে লিগে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। সেই দলে্র সাথে স্ট্রাইকার হিসেবে গিয়েছিলেন নাইজেল ক্লফ, অ্যালান শিয়েরার, অ্যালান স্মিথ, গ্যারি লিনেকার ও পল মারসন।
কিছুটা কি অবিচারই হয়েছিল? সে উত্তর হতে পারে বিতর্কিত। তবে পরবর্তীতে আর কখনোই তার জায়গা হয়নি কোনো ইউরোপীয়ান টুর্নামেন্টে বা বিশ্বকাপে। মাইক চ্যানানের পর ইয়ান রাইটই ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়, যারা এইসব মহাদেশীয় এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় স্কোয়াডের বাইরে ছিলেন।
খেলা ছাড়ার পর রাইট প্রথমে যোগ দেন বিবিসি স্পোর্টসে। সেখানে ২০০২ বিশ্বকাপ, ২০০৬ বিশ্বকাপ ও ২০০৪ ইউরোর বিশ্লেষক ছিলেন। এরপর সেখানকার চাকরি ছেড়ে আসেন বিটি স্পোর্টসে। এখানে সহকর্মী হিসেবে পান আরেক আর্সেনাল লেজেন্ড লি ডিক্সনকে। একই সাথে তারা ঘরোয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য ইউরোপীয় খেলাগুলো বিশ্লেষণ করতেন। ২০১৭ সালে আবার ফেরেন বিবিসিতে, সেখানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে পান গ্যারি লিনেকার ও অ্যালান শিয়েরারকে। এসব জায়গায় অ্যালান শিয়েরারের সাথে তার হাস্যরসের মুহূর্তগুলো প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। নিয়মিত রুটিনমাফিক কাজের বাইরে বেশ কিছু ইউটিউব ভিডিও আছে তাদের এসব নিয়ে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম সেন্স অফ হিউমার থাকা এই লোকটি যে সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারেন, সে প্রমাণও রয়েছে অঢেল।
এই হলো ইয়ান রাইট, যিনি গোলমুখে যেকোনো হাফ-চান্স থেকে করতে পারতেন লক্ষ্যভেদ। বিধ্বংসী ক্ষমতা, চতুরতা, আগ্রাসী মনোভাব, আর কলাকৌশলের এক দারুণ মিশ্রণ ছিলেন তিনি। শৈশবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভেঙে পড়ার পর আবার নিজেকে গড়ে তোলা এক মানুষ তিনি। শেষ হাসি কিন্তু তিনি হেসেছিলেন, একটু দেরিতে হলেও। সবকিছু হারিয়ে একদম তলানিতে পৌঁছেছিলেন, সেখানেই খুঁজে পেয়েছিলেন তার নতুন জীবনের উৎস। এভাবেই তিনি নায়ক হয়ে রয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।