আপনি হয়তো লিভারপুল ভক্ত। আড্ডায় বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভিড়ে আপনি সংখ্যালঘু। এলাকার চায়ের আড্ডায় আপনি বরাবর শুনে আসছেন, ‘লিভারপুল যেদিন লিগ জিতবে…’
আপনি জবাব দেন না। আপনি অপেক্ষা করেন লিভারপুলের লিগ জেতার। কিন্তু চায়ের কাপের সঙ্গী সিগারেটের দাম এক টাকা, দু’টাকা করে ফি বছর বাড়তে থাকলেও লিভারপুলের লিগ সংখ্যা আটকে থাকে আঠারোতেই, যেরকমভাবে সুকান্ত আটকে আছেন একুশে। আপনি হাল ছেড়ে দিতে চান স্টিভেন জেরার্ডের ‘স্লিপ’ দেখে, কিন্তু আরেকবার এই বলে আশায় বুক বাঁধেন, ইয়ুর্গেন ক্লপ হয়তো পারবেন।
তিন বছর চলে যায়, লিগ ঘরে আসে না। চতুর্থ বছরেও আসি আসি করে ফাঁকি দিয়ে যায়, আপনার তিন দশকের তরতাজা ঘায়ে কে যেন নুনের ছিটে দিয়ে যায়।
আপনি তবু অপেক্ষা করেন। প্রশ্ন করেন নিজেকে, শেষবার যে কেনি ডালগ্লিশের হাত ধরে লিগ এসেছিল, তিনিও কি হাল ছেড়ে দিয়েছেন?
সেবার সবে আঠারো হলো…
১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল, হিলসবোরো স্টেডিয়ামে লিভারপুল আর নটিংহ্যাম ফরেস্টের মধ্যে এফএ কাপ সেমিফাইনাল। উপস্থিত প্রায় হাজার পঞ্চাশেক লোক, লিভারপুল ভক্ত হাজার তিনেক। ভিড় সামলাতে পুলিশ স্ট্যান্ডিং এরিয়ার গেট খুলে দিল, তিন হাজার লিভারপুল ভক্ত হুড়মুড়িয়ে পৌঁছে গেলেন সেই স্ট্যান্ডিং এরিয়ায়, যেটি বানানো হয়েছিল সর্বোচ্চ ১,৬০০ জনের জন্য। রেফারি খেলা শুরু করতে পারলেন, তবে চললো মাত্র ছ’মিনিট, কারণ ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।
হিলসবোরোর সেই দুর্ঘটনায় মারা যান ৯৬ জন লিভারপুল ভক্ত, আহত হন আরও ১৬২ জন।
বছর ঘুরতেই অবশ্য লিগ জিতে নেয় লিভারপুল, অধিনায়ক অ্যালান হ্যানসেন ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরলেন। ঠিক পরের মৌসুমটায় লিভারপুল রানার্স আপ। হয়তো সবাই ভেবে নিয়েছিল, একটা বছরই তো, আবার ফিরবে শিরোপা মার্সিসাইডে। তারা কি কখনো ভেবেছিল, একটা বছর, তার পরের বছর, এমনকি পরের দশকেও ট্রফিটা ঘরে ফিরবে না?
হচ্ছে না, একটুর জন্য হচ্ছে না…
শেষবার রানার্সআপ হবার পর এক দশক কেটে যায়, লিভারপুল শিরোপার কাছেধারেও পৌঁছে না। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এই এক দশকে লিগ জিতে নেয় সাতবার। কিন্তু লিভারপুল? বড়জোর তৃতীয় হয়।
২০০১-০২ মৌসুমে অবশ্য আবার আশার দেখা মেলে, ডিসেম্বরে এগারো পয়েন্টের ব্যবধানে শীর্ষে লিভারপুল। কিন্তু হুট করে যেন শুরু হয় ঝড়, জেরার্ড হুলিয়ারের দল অসহায় হয়ে তাকিয়ে দেখে, ইউনাইটেড এগিয়ে যায় পাঁচ পয়েন্টে। সিজন শেষ হতে হতে আর্সেনাল, লিভারপুল এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ ক’বার মিউজিক্যাল চেয়ার খেলে বটে, তবে আরামসে লিগটা জিতে নেয় আর্সেনাল।
এরপর আবার অপেক্ষা। মাঝখানে ইস্তাম্বুলে অলৌকিকতাকে বাস্তব বানিয়ে অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ড চ্যাম্পিয়নস লিগ ঘরে নিয়ে আসেন। কিন্তু লিগ? সে আর হয় না।
২০০৮-০৯ মৌসুমে যেন স্টিভেন জেরার্ড আর ফার্নান্দো তোরেস পণ করলেন, লিগ ঘরে আনবেনই। দু’জনের উত্তুঙ্গ ফর্মে চড়ে লিভারপুল ইউনাইটেডকে হারায় অ্যানফিল্ড এবং ওল্ড ট্রাফোর্ড – দুই মাঠেই। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় না, ৮৬ পয়েন্ট নিয়ে আবারও হতে হয় দ্বিতীয়, চোখের সামনে দিয়ে আরেকবার জয়োল্লাস করে ওঠে চিরশত্রু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আপনি তখনও ফুটবলটা ঠিক বোঝেন না, কিন্তু লিভারপুলকে জিততে না দেখে আপনার খারাপ লাগে, আপনি বোধহয় ভক্ত হয়ে পড়েন।
হায় স্টিভেন জেরার্ড!
সময় গড়ায়, আপনি ফুটবলকে ভালোবেসে ফেলেন, লিভারপুলকেও। স্কুলে আপনার বন্ধুরা স্রেফ লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়েই কথা বলেন, অথচ আপনার হিরো স্টিভেন জেরার্ড থাকেন উপেক্ষিত। আপনি তবুও ভাবেন, একবার লিগ জিতলেই দেখবোখন…
২০১৩-১৪ মৌসুমের শুরু হয় দুর্দান্ত, লুইস সুয়ারেজ, স্টিভেন জেরার্ড, রাহিম স্টার্লিং, ফিলিপে কৌতিনহো যেন মিডাস, অ্যানফিল্ডে ফলতে শুরু করে সোনা। বড়দিন আসতে আসতে লিভারপুল প্রিমিয়ার লিগ টেবিলের শীর্ষে, প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাস আপনাকে বলে, বড়দিনে শীর্ষে থাকা দল কখনও লিগ হারেনি। আপনি আশায় বুক বাঁধেন, ৩৫ ম্যাচের পর যখন তিন পয়েন্টের ব্যবধানে শীর্ষে লিভারপুল, তখনও আপনি চেলসির সাথে খেলা দেখতে বসেন জয়োল্লাসের প্রস্তুতি নিয়ে।
প্রথমার্ধে লিভারপুল খুব ভালো খেলে না, আপনার মনে কী একটা যেন কু-ডাক দেয়। প্রথমার্ধ শেষ হবার ঠিক আগ মুহূর্তে স্টিভেন জেরার্ড পিছলে পড়ে যান, দেম্বা বা ভুল করেন না, এগিয়ে যায় চেলসি। অ্যানফিল্ডে সে ম্যাচ হেরে বসে অল রেডস, পরের ম্যাচে শেষ দশ মিনিটে ক্রিস্টাল প্যালেসের কাছে তিন গোল খেয়ে ড্র করে ট্রফিটা তুলে দেয় ম্যানচেস্টার সিটির হাতে। আপনি তখন ভাগ্যকে দোষারোপ করেন, কিংবা নিজেকে, অথবা অ্যানফিল্ডের ঘাসকে…
অতঃপর ক্লপ
ব্রেন্ডান রজার্স লিগ জেতার কাছে নিয়ে গেলেও পরের দেড় মৌসুমে উপহার দিলেন হতাশা, মালিকপক্ষ এফএসজি তাই জার্মানি থেকে উড়িয়ে আনলেন ইয়ুর্গেন ক্লপকে। সেই ইয়ুর্গেন ক্লপ, যিনি বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে নিয়ে রীতিমত জাদু দেখিয়েছেন, বায়ার্নকে টপে টানা দু’বার লিগ জিতিয়েছেন। আপনি আবার আশায় বুক বাঁধেন, এবার একটু ধৈর্য্য নিয়ে বসেন, কারণ ক্লপ সময় চেয়েছেন চার বছর।
প্রথম মৌসুমেই ক্লপ লিভারপুলকে নিয়ে যান লিগ কাপ এবং ইউরোপা লিগের ফাইনালে। লাভ হয় না অবশ্য, দু’টোতেই ফিরে আসতে হয় হারের বিষাদ নিয়ে।
পরের মৌসুমে দলে ভেড়ান সাদিও মানে-জিনি ভাইনালদুম-জোয়েল ম্যাতিপদের, তবে লাভ হয় না তেমন। লিগে চতুর্থ হন, কোনোমতে জোগাড় হয় চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার টিকেট।
পরের মৌসুমে দলে যোগ দেন মোহাম্মদ সালাহ, অ্যান্ডি রবার্টসন; অ্যাকাডেমি থেকে আসেন ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ড। জানুয়ারিতে কৌতিনহো বার্সেলোনায় চলে যান, তবে ডিফেন্সের সমস্যা মেটাতে দলে আসেন ভার্জিল ভ্যান ডাইক।
লিগে সুবিধা করতে না পারলেও চ্যাম্পিয়নস লিগে এগিয়ে যায় ক্লপ বাহিনী। আপনি এক যুগ পর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু আবারও হয় না, সালাহ ফাইনালে ইঞ্জুরড হয়ে মাঠ ছাড়েন, লরিস কারিউসের ভুলে স্বপ্নভঙ্গ হয় কার্ডিফে।
আপনি অবশ্য ক্লপকে অনুসরণ করে দমে যান না, বরং অ্যালিসন-ফ্যাবিনহো-শাকিরি দলে আসায় আপনার বিশ্বাস বাড়ে, এবার হবে ট্রফিজয়। লিগে শুরুটা করেন দারুণ, আবারও বড়দিনে শীর্ষে থাকে লিভারপুল। এর আগে মাত্র একবারই বড়দিনে শীর্ষে থাকা দল লিগ জেতেনি; আপনার ফ্ল্যাশব্যাক হয়, সেই দলের নাম লিভারপুল।
ম্যানসিটির সাথে লিভারপুল হেরে বসে ২-১ এ, এরপর একটানা কয়েকটি ড্র, লিগ শিরোপা ঠিক ছোটবেলায় আপনার পুকুরে ধরা কই মাছের মতো ফসকে যায়। ৯৭ পয়েন্ট, মাত্র একটি হার – এসব কিছুই সান্ত্বনা দিতে পারে না, লিগ শিরোপা যে আসেনি!
চ্যাম্পিয়নস লিগেও সেমিফাইনালে বার্সেলোনার কাছে প্রথম লেগ হেরে বসেন ৩-০তে, ভাবেন ক্লপের চার বছরে ট্রফি আনার ওয়াদার কথা। পরের লেগে অবশ্য শুধু বার্সাই নয়, আপনার হতাশাকেও অ্যানফিল্ডে সালাহ-ফিরমিনোকে ছাড়াই দুমড়েমুচড়ে দেয় লিভারপুল, ৪-০ তে জিতে চলে যায় ফাইনালে।
সেখানে স্পার্সের সাথে ম্যাড়মেড়ে এক ফাইনালে ২-০ তে জয় আসে। তবে ম্যাড়ম্যাড়েতে কী-ই বা আসে যায়? আপনি ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের উল্লাস করেন, আপনি মনে মনে আউড়ে ওঠেন, শুধু লিগ শিরোপাটাই বাকি…
অবশেষে স্বপ্নপূরণ
২০১৯-২০ মৌসুমটাও লিভারপুল শুরু করে দারুণভাবে। তবে এবার ঠিক তাল রাখতে পারে না ম্যানসিটি, পিছিয়ে পড়ে। লিভারপুল এবার আর পেছনে ফিরে তাকায় না, এগুতেই থাকে। নয় ম্যাচ থাকতে লিগে ২৫ পয়েন্টে এগিয়ে থাকে লিভারপুল, আপনি চায়ের আড্ডায় সবার সামনে, তবুও সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে সেইফ খেলেন, ‘লিভারপুলের ভরসা নাই…’
আসলেই নেই। চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে ছিটকে পড়ে তারা, করোনার থাবায় পুরো বিশ্বই থেমে যায়। গুঞ্জন ওঠে, লিগ মৌসুম বাতিল করা হতে পারে। আপনার আবার মনে হয়, হলো না…
কিন্তু হয়, তিন মাস বিরতি দিয়ে ফুটবল ফেরে। সিটি প্রথম দুই ম্যাচ জিতে নেয়, লিভারপুল এভারটনের সাথে ড্র করলেও ক্রিস্টাল প্যালেসকে উড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে চেলসি-ম্যানসিটি ম্যাচের দিকে।
লিভারপুলের সব খেলোয়াড় ও স্টাফ এক হোটেলে জমায়েত হন সেই ম্যাচ দেখার সময়। আপনিও সবকিছু বন্ধ করে স্ট্রিমটা চালু করে দেন। ক্রিস্টিয়ান পুলিসিচ সলো গোল দেন, আপনার মনে হয় যেন আপনিই এডারসনকে পরাস্ত করলেন। কেভিন ডি ব্রুইন বেরসিকের মতো ফ্রি-কিক থেকে গোল করে বসেন, আপনি অপেক্ষা বাড়বার প্রস্তুতি নেন। ত্রাতা হয়ে ওঠেন ফার্নান্দিনহো। ব্রাজিলিয়ান এই মিডফিল্ডারের খ্যাতি আছে বড় ম্যাচ ডোবানোর। চেলসির সাথে গোল লাইন থেকে হাত দিয়ে বল সরালেন, লাল কার্ডের সঙ্গে দিয়ে আসলেন পেনাল্টিও। স্পট থেকে আরেক ব্রাজিলিয়ান উইলিয়ান ভুল করেন না। রবার্টসনকে দেখা যায় টিভির সঙ্গে উন্মত্ত নাচ নাচতে, ঢাকার কোনো এক ঘরে হয়তো আপনিও তাই করছেন।
স্টপেজ টাইম মিলিয়ে ৯৬ মিনিট পেরিয়ে যায়, রেফারি বাশি বাজান, এবং অবশেষে কমেন্টেটর ৩০ বছর পর বলবার সুযোগ পান, লিভারপুল প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন। স্কাই স্পোর্টসের লাইভে আপনি কেনি ডালগ্লিশের আনন্দাশ্রু দেখেন, জেমি রেডন্যাপকে দেখেন শ্যাম্পেনের বোতল খুলে উল্লাস করতে, চিরকালীন যেই ক্লপকে বাগ্মী হিসেবেই চিনে এসেছেন, তাকে দেখেন কথা হারিয়ে ফেলতে।
আপনি মুচকি হাসেন। আপনি ক্লপের মতোই বলতে চান, আমার অপেক্ষা তো ৩০ বছরের না। কিন্তু আপনি তা বলবেন না। আপনি তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় উদযাপন করেন, ঘর থেকে বেরোতে পারেন না করোনার জন্য, তাই ঘরে বসেই মার্সিসাইডের বুনো উল্লাস দেখেন।
আপনি অবশেষে একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ত্রিশ বছর কেটে গেছে, লিভারপুল কথা রেখেছে!