“৪৮ দলের বিশ্বকাপ নিয়ে জল্পনা কল্পনা শেষ, ২০২২ এর কাতার বিশ্বকাপই ৩২ দল নিয়ে শেষ বিশ্বকাপ, ২০২৬ এবং এরপরের প্রত্যেক আয়োজনে থাকছে ৪৮ দল” ফুটবলের কর্তা সংগঠন ফিফার ডিরেক্টর মার্কো ভন ব্যাস্টেন এই ঘোষণার পরে ইউরোপিয়ান ফুটবল বোদ্ধা মহলে আবারো ঝড় উঠছে। ৪৮ দলে বিশ্বকাপ হলে ইউরোপিয়ান লিগের প্লেয়ারদের বেশী ম্যাচ খেলতে হবে, ফলে সেই লিগগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে তারা বরাবরের মতোই সরব। এই চাঞ্চল্য কাটতে না কাটতেই মার্কো ঘোষণা দিয়ে দিলেন ফুটবলের মানোন্নয়নে কিছু মৌলিক পরিবর্তনের কথা চিন্তা করছে ফিফা।
ফিফার এই মুখপাত্র বলেন বিশ্বব্যাপী ফুটবলের জনপ্রিয়তা যত তুঙ্গে উঠছে ততই এই খেলা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে এর পরিবর্তন হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এই খেলাকে আরো জনপ্রিয়, দর্শকনন্দিত করবে। তবে প্রতিটি পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ববাসী একমত হবেন না এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন এই ফিফাকর্তা।
৪৮ দল কেন?
সেপ ব্লাটারের যুগ শেষ হবার পর থেকেই ৪৮ দলে বিশ্বকাপ হবার কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিলো। পালে হাওয়া দিলেন নতুন ফিফা কর্তারা। এমনকি এমন গুঞ্জন উঠেছিলো কাতার বিশ্বকাপেই ৪৮ দলের খেলা হচ্ছে। কিন্তু উয়েফা সহ আঞ্চলিক ফুটবলের মোড়লরা ৪৮ দলের বিশ্বকাপে বেশী সময় নিয়ে হলে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দেখিয়ে তা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
দুর্নীতি, টিভিস্বত্ত্ব সহ নানা ঝামেলা ফিফার পিছুই ছাড়ছিলো না। এমন সময় ফিফার কড়া সিদ্ধান্ত ২০২৬ সালেই আসছে ৪৮ দল। কারণ বিশ্বকাপে বেশী দলের অংশগ্রহণের ফলে ফিফা চায় ফুটবল ইউরোপের গন্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। খেলার রাউন্ড বা গ্রুপ কী রকম হবে এই প্রশ্নে সোজা উত্তর- ৩ গ্রুপে ভাগ করে ১৬ দলের খেলা হবে। এর বাইরে আপাতত তেমন কিছু জানাচ্ছেন না ফিফার এই কর্তা।
উঠে যেতে পারে অফসাইড!
মার্কো ভ্যান ব্যাস্টেন এর কথা থেকে বেরিয়ে এসেছে ফুটবলে অফসাইড সিস্টেমটিকে তুলে দেবার সময় এসেছে। আয়াক্স আর এসি মিলানের সাবেক বেশ কয়েকজন তারকার মতে অফসাইড তুলে দিলে ফুটবল আরো বেশি জনপ্রিয় হবে। দুই দল সমান ভাবে এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে ফ্রি কিক, সেট পিস কিংবা লং শটে অনেক বেশী গোল করতে পারবে।
মার্কো আরো বলেন “অফসাইড ছাড়া ফুটবল দেখতে আমি মুখিয়ে আছি, আশা করছি দুই দলের খেলোয়াড়রা যদি এর সুযোগ কাজে লাগায় তবে ফুটবল আরো আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর হবে।” তবে তিনি একই সাথে ধারণা করেন এই প্রস্তাবের বিপক্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষের অবস্থান থাকবে। ফুটবলকে অত্যাধিক রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকে বের করে কৌশলগত দিক থেকে অনেক বেশী আক্রমণাত্মক ও গতিশীল করতেই ফিফার এই চিন্তা। আর গোলের খেলা ফুটবলে গোল না হলে মজা কোথায়? তাই এই নিয়ে রাখঢাক করে আর লাভ কী! তবে এই নিয়ম চালু হলে ফুটবল বোদ্ধারা দিনশেষে ভালো গোল দেখতে পাবে বলেই ফিফার আশা।
পেনাল্টির বদলে টেক-অনস!
খেলা ড্র, এক্সট্রা টাইমও শেষ, তারপর পেনাল্টি-টাইব্রেকার থাকছে না আর, আসছে টেক-অনস। এতে একজন খেলোয়াড় পেনাল্টি বক্সের ভিতর থেকে শুট করার বদলে গোললাইনের ২৫ মিটার দূর থেকে শুট করবেন, সময় পাবেন ৮ সেকেন্ড, গোলকিপার বক্সের ভিতরেই থাকবেন। এই ৮ সেকেন্ডে প্লেয়ার নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রিবল করতে, সময় নিয়ে শুট করতে পারবেন। পেনাল্টি টাইব্রেকারের চেয়ে টেক-অনস আরো আকর্ষণীয় হবে বলেই ধারণা ফিফার এই কর্তাব্যক্তির।
উঠে যেতে পারে হলুদ কার্ড!
ফুটবলে বাজে ফাউল হয়েছে, রেফারি হকুদ কার্ড বের করছেন, এই দৃশ্য আর কয়দিন দেখা যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। হলুদ কার্ডের বদলে খেলোয়াড়কে শাস্তি হিসাবে নির্দিষ্ট সময় কাটাতে হবে সাইডলাইনে! ততক্ষণ তার দল খেলবে ১০ জন নিয়ে! তবে ইতোমধ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে বর্তমান আর সাবেক রথি মহারথী ফুটবলারদের কাছ থেকে এবং এর বেশীরভাগই এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে।
বুঝতেই পারছেন হলুদ কার্ড জাদুঘরে গেলে কত মিস করবেন তারা। তবে লাল কার্ড ঠিক থাকছে। সাথে পরপর দুই ম্যাচে এইভাবে বাজে ফাউল করে সাইডলাইনে গেলে পরের ম্যাচে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোচ আর সাবেক প্লেয়াররা এর নাম দিয়েছেন ‘কার্ডবিহীন হলুদ কার্ড’! আর একই ম্যাচে দ্বিতীয়বার সাইডলাইনে স্থায়ী বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে লাল কার্ড কিন্তু থাকছেই!
আরো কার্যকরীভাবে হবে সময়ের ব্যবহার
ম্যাচ শেষের ১০ মিনিটের ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবছে ফিফা। শেষ ১০ মিনিটে লিড নেয়া দলের কালক্ষেপণ আর দেখা যাবে না হয়তো! ৮০ তম মিনিট শুরুর সাথে সাথে কোনো অবস্থাতেই মাঠে একটানা ১০ সেকেন্ডের বেশী বল স্থির থাকবে না। বেশী সময় নিয়ে ফ্রি কিক কিংবা সেট পিস নেওয়া হয়তো দেখা যাবে না আর ৮০ মিনিটের পর। এই সিদ্ধান্তে নৈতিক সমর্থন আছে উয়েফাসহ আঞ্চলিক ফুটবলের মোড়লদের। এমনকি খেলার মাঝে খেলোয়াড় বদলের সময়টুকু বেধে দেওয়ার ও চিন্তা করছে ফিফা!
খেলার শেষ সময়ে এসে এগিয়ে থাকা দলের ঘন ঘন প্লেয়ার বদল করার কৌশল ফুটবলে বেশ জোরালোভাবে সমালোচিত একটি বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয় নিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের কয়েকটি দলের কোচ এবং খেলোয়াড়দের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এই আগুনে নতুন করে ঘি ঢালছে!
আসতে পারে তিনের অধিক বদলির সুযোগ
বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ফুটবলে তিনের অধিক বদলি খেলোয়াড় খেলানো যায় না। কিন্তু মার্কো ভন ব্যাস্টেন সহ বর্তমান ফিফা নীতিনির্ধারকরা চান তিনের অধিক বদলি খেলোয়াড় খেলানোর সুযোগ আসুক। এতে করে খেলায় একদিকে যেমন গতিশীলতা আসবে, ঠিক অন্যদিকে খেলোয়াড়দের ইনজুরি সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে। এই প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন আছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ সহ বাঘাবাঘা সব পেশাদার লীগের প্লেয়ার আর কোচদের।
নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবে ফিফা
ফুটবলে রেফারির দেয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা পড়তে হয় ফিফা কিংবা উয়েফার মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে। তাই সামনে পেনাল্টি কিংবা ফাউলের আরো সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ভিডিও এসিস্ট্যান্ট রেফারি (VAR) এর ব্যবহার ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে ফিফা। কাতার বিশ্বকাপের আগেই এর পুরোপুরি ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে বলে ফুটবল বিশ্লেষকদের অভিমত।
গোললাইন টেকনোলোজির ব্যবহার ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়। গত ব্রাজিল বিশ্বকাপে এর ব্যবহার দেখা গেছে। পেশাদার লিগগুলোতে এর ব্যবহার লক্ষণীয়। এর ফলে ফুটবলে রেফারিদের উপর চাপ আরো কম পড়বে এবং সিদ্ধান্ত আরো দ্রুত এবং কার্যকরী হবে বলেই অভিমত সবার।
আরো কড়া হতে পারে ডোপ টেস্টিং
খেলার মাঠে নৈপুণ্য বাড়াতে নিষিদ্ধ সব ওষুধপাতি সেবন করে অনেক সময়ই আলোচনায় আসেন তারকা ফুটবলাররা। অনেকের ক্যারিয়ারটাই ধ্বংস হয়ে যায়। তাই ফিফা খেলোয়াড়দের ডোপ টেস্টের পাশাপাশি তাদের শারীরিক বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ এবং তুলনা করে অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়লে তা দ্রুত শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড এন্টি ডোপিং এজেন্সিসমূহ ফিফার সাথে এই ব্যাপারে একইসাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০১৮ বিশ্বকাপ রাশিয়ায় বলে কথা! রাশিয়ানদের ক্রীড়াবিদদের মধ্যে ডোপ নেবার প্রবণতা আশংকাজনক হারে বেশি বলেই কি ফিফা এই ব্যবস্থা নিচ্ছে?
নিয়ম কানুনের যাঁতাকলে বাধা পড়ে ফুটবল তার সৌন্দর্য হারাবে না বরং আগের চেয়ে আরো বেশি সম্মোহিত করে যাবে বিশ্বের শত কোটি দর্শকের এই কামনা।