১.
বিশ্বকাপে আসার আগেই সুখবরটা পেয়েছিলেন, বিশ্বকাপের মঞ্চে যাচ্ছেন অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে থেকেই। কিন্তু তাতে তার থোড়াই কেয়ার, লক্ষ্যটা যে ছিল আকাশ ছোঁয়ার!
গত প্রায় দশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। শেন ওয়াটসন, বেন স্টোকস, মঈন আলী, রবিচন্দ্রন অশ্বিন থেকে শুরু করে হালের রশীদ খান – তার প্রতিদ্বন্দ্বীর নামগুলো নিয়ে রীতিমতো মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলেছে। কিন্তু ধোপে টেকেননি কেউ, স্বীয় পারফরম্যান্সে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়। তবু ‘সময়ের সেরা’ উপাধিটা কপালে জুটছিল না, অন্যতম সেরা হয়েই ছিলেন এতদিন। গত বিশ্বকাপে তাই গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত দুটো মিশনে, বাংলাদেশকে অনন্য এক অর্জন উপহার দেওয়া এবং নিজেকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
‘পরবর্তী পর্যায়’ বলতে? কে জানে, হয়তো হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন সর্বকালের সেরা!
২.
সাকিব আল হাসান বোধহয় জাদু জানেন!
২০০৮ সালের নভেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রথম টেস্ট। সারাদিন কেটে গেল, প্রথমদিনে উইকেটের দেখা পেলেন না সাকিব। ‘গুরু’ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বারবারই বলছিলেন, সাকিব যেন ফ্লাইট দেওয়ার চেষ্টা করেন। সাকিব ঠিক সাহস পাচ্ছিলেন না ফ্লাইট দিতে, পাছে রান বেশি দিয়ে ফেলেন যদি!
পরেরদিন স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে বাসে বসে সালাহউদ্দিন পড়তে শুরু করলেন ‘ফ্লাইট’ নিয়ে একটা অধ্যায়। চোখে পড়লো সাকিবের, সালাহউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করছেন তিনি। সালাহউদ্দিন বললেন, স্পিন বোলিংয়ে ফ্লাইটের গুরুত্ব নিয়ে পড়ছেন। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ে নিলেন বইটা, একটু এদিক-ওদিক উল্টেপাল্টে দেখলেন। ব্যস, কেল্লা ফতে। প্রথমদিনে ২৫ ওভার হাত ঘুরিয়ে যেখানে একটিও উইকেট মেলেনি, সেখানে পরেরদিন মাত্র ১৩ ওভারের মধ্যেই তুলে নিলেন ৫টি উইকেট! বই পড়ে পাঁচ উইকেট পাওয়ার মতো অদ্ভুত ব্যাপার কি আর যে কেউ করতে পারেন?
এই ঘটনার মাসখানেক আগের কথা। সাকিব তখন পুরোদস্তুর ব্যাটিং অলরাউন্ডার বলে পরিচিত, যিনি কাজ চালানো বোলিংটার পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে দারুণ চৌকষ! অথচ হুট করেই তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্স নিউ জিল্যান্ড সিরিজের প্রাক্কালে ঘোষণা করলেন, সাকিবকে তিনি টেস্ট সিরিজ খেলাবেন ‘বিশেষজ্ঞ স্পিনার’ হিসেবে! আর সাকিবও কম যান না, গোটা বিশ্বের চক্ষু চড়কগাছ করে দিয়ে প্রথম ইনিংসেই তুলে নিলেন ৩৬ রানে ৭ উইকেট!
পরের বছর, শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট। বৃষ্টি ম্যাচকে করে দিল সংক্ষিপ্ত, ৩১ ওভারের ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ১৪৭ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছাতে বোনাস পয়েন্টের খুব প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের, আর এর জন্য তাদেরকে ম্যাচ জিততে হতো ২৪.১ ওভারের মধ্যেই। অন্যদিকে, টুর্নামেন্টটা হচ্ছিল একেবারেই লো-স্কোরিং, পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচেই পরে ব্যাটিং করে ১৫০ রান তুলতে ঘাম ছুটছিল ব্যাটসম্যানদের। এমন পরিস্থিতিতে ২৪ ওভারের মধ্যেই ১৪৮ রান তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল দারুণ ব্যাটসম্যানশিপ। মাত্র ১১ রানেই তিন উইকেট হারিয়ে সেই পরিস্থিতি আরেকটু ঘোলাটে করে তুললেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা। পাঁচ নম্বরে নামলেন সাকিব, জুটি বাঁধলেন মোহাম্মদ আশরাফুলের সাথে।
৪১ বলে ২৬ রান করে যখন সাজঘরে ফিরলেন আশরাফুল, ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে রান জমেছে ১০২। রকিবুল হাসানের সঙ্গে গড়লেন ২৪ রানের ছোট্ট জুটি, যেখানে রকিবুলের অবদান স্রেফ তিন রান! মেন্ডিসের বলে মুরালিধরনের হাতে তালুবন্দী হয়ে ফিরলেন রকিবুল, ততক্ষণে ২২ ওভার শেষ। এবার নাঈম ইসলাম নামার পর এক ওভারে ১০ রান নিয়ে ম্যাচটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এলেন সাকিব। আর তাতে শেষ তুলির আচড় দিলেন নাঈম ইসলাম, পরপর দুই বলে একটি চার এবং একটি ছক্কা মেরে দলকে পৌঁছে দিলেন জয়ের বন্দরে। ম্যাচশেষে যখন সাজঘরে ফিরছেন সাকিব, তার নামের পাশে লেখা হয়ে গেছে ৬৯ বলে ৯২ রান! শুধু সংখ্যা এই ইনিংসের মাহাত্ম্য বোঝায়, সে সাধ্যি কি আর পরিসংখ্যানের আছে?
কিছুদিন আগেও সাকিব ব্যাটিং করছিলেন পাঁচ নম্বরে, সেখানে আস্থার প্রতিদানও দিচ্ছিলেন নিয়মিতই। কিন্তু ওয়ানডাউনে উপর্যুপরি সব ব্যাটসম্যানই ব্যর্থ হতে থাকায় সাকিব ভাবলেন, সুযোগটা লুফে নেবেন তিনিই। যেই ভাবা, সেই কাজ। সাকিব উঠে এলেন তিন নম্বরে, ব্যাটিং অর্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পজিশনে আলো ছড়াতে। কী ভানুমতীর খেল, সাকিব রীতিমতো ব্র্যাডম্যানীয় গড়ে রান করতে শুরু করলেন!
আর এই পারফরম্যান্স পূর্ণতা পেল বিশ্বকাপের মঞ্চে এসে, সময়ের সেরা এই অলরাউন্ডার আলো ছড়ালেন ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চটাতেই!
বিশ্বকাপের আগে আইপিএলে খেলতে গিয়ে জাতীয় দলের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদান করতে পারেননি সাকিব। অন্যদিকে, আইপিএলের ম্যাচও খেলতে পারছিলেন না নিয়মিত। হাতে থাকা তিলমাত্র সময়টুকু নষ্ট করতে চাইলেন না সাকিব, বাংলাদেশ থেকে উড়িয়ে নিলেন প্রিয় গুরু মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনকে। ফিটনেস নিয়ে কাজ করলেন, খুঁটিনাটি আরো কিছু ব্যাপারে ফাইন টিউনিং করে ষোল আনা প্রস্তুত করলেন নিজেকে। আয়ারল্যান্ড সিরিজের আগে বাড়তি মেদ ঝরিয়ে পুরোদস্তুর ১৬ বছরের যুবক বনে গেলেন সাকিব, কিছু একটা প্রমাণ করা যে এখনও বাকি!
৩.
‘লর্ডস বা এমসিজি’তে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট, নাকি বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যাচসেরা?’
প্রশ্ন করা হয়েছিল একবার তাকে। উত্তরটা খুব সংক্ষেপে দিয়েছিলেন তিনি,
‘বিশ্বকাপটা পেয়ে গেলে আর কিছু লাগবে না।’
সাকিব বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করেছেন সেই দশ বছর আগে থেকে। আমরা যখন নিউ জিল্যান্ডকে ঘরের মাটিতে ‘বাংলাওয়াশ’ করাতে তৃপ্তি খুঁজি, আমরা যখন হঠাৎ একদিন জ্বলে ওঠা বাংলাদেশে ভালোবাসার আবেশ খুঁজি, পেশাদারিত্বের আড়ালে সাকিব তখন বিশ্বকাপ জয়ের ছক কষেন মনে মনে। দর্শনধারীতে তার আগ্রহ ছিল না কস্মিনকালেও, তিনি কর্মেই সবকিছু প্রমাণে বিশ্বাসী। সেই সাকিব এইবার ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
‘সত্যিই এবার আমাদের টুর্নামেন্ট জয়ের সুযোগ আছে বলে মনে করি। তবে অবশ্যই আমাদের ধারাবাহিক পারফর্ম করতে হবে। তা করতে পারলে নকআউট পর্বে উঠতে পারব, এবং সেখান থেকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। এবার আমরা ভালো করব, সে ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।’
পুরো বাংলাদেশ তখনই বিশ্বাস করল, কিছু একটা এবার সত্যিই করতে পারে বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখতে শুরু করল গোটা বাংলাদেশ, সাকিব যে স্বপ্ন দেখতেই বলেছেন!
তবে সে স্বপ্নের পূর্ণতায় যে মূল ভূমিকা রাখতে হবে তাকেই। ব্যাটে-বলে ছন্দ মিলাতে হবে, দলকে উজ্জীবিত রাখতে হবে, সেরা পারফরমার হতে হবে, সর্বকালের সেরাদের কাতারে তুলে নিতে হবে নিজেকে। ছোট্ট দুটো কাঁধে গোটা বাংলাদেশকে বয়ে চলছেন গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে, এবার সে প্রত্যাশা আকাশ ছুঁয়েছিল। সাকিবও জানান দিয়ে দিলেন, তিনি প্রস্তুত!
৪.
বিশ্বকাপে ‘ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছে সেই ১৯৯২ সাল থেকে। সেবার খেতাব জিতেছিলেন মার্টিন ক্রো, তার সাকুল্যে সংগ্রহ ছিল ৪৫৬ রান। পরের বিশ্বকাপে সে খেতাব পেলেন সনাৎ জয়াসুরিয়া, ক্রিকেটকে খোলনলচে বদলে দেওয়া সেই বিশ্বকাপে ২২১ রান ও ৭ উইকেট নিয়ে সেরার খেতাব পেলেন তিনি। ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে ৬৭৩ রান করে টুর্নামেন্টসেরা হয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো টুর্নামেন্টসেরা হলেন কোনো বোলার, ২৬ উইকেট নিয়ে সেবার খেতাব জিতলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা।
কিন্তু সাকিবের এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের সাথে তুলনা হয় কেবল ল্যান্স ক্লুজনার এবং যুবরাজ সিংয়ের। ১৯৯৯ সালে পুরো বিশ্বকাপটাকে নিজের করে নিয়েছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার, ২৮১ রানের পাশাপাশি ১৭ উইকেটও বুঝাতে পারে না সেই টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকাকে কীভাবে দুটো কাঁধে বয়ে নিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, ২০১১ সালে ভারতকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন যুবরাজ সিং। ব্যাটিংয়ে ৩৬২ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট।
সাকিব আল হাসান একদিক থেকে কিছুটা দুর্ভাগ্যবান। ক্লুজনার-যুবরাজদের দল বিশ্বকাপে এসেছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সবটুকু রসদ নিয়ে, তাদের সঙ্গত দেওয়ার মতো খেলোয়াড়েরও বিশেষ অভাব ছিল না। কতটা সহায়তা পেয়েছিলেন সতীর্থদের থেকে, সেটার একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যেতে পারে নিচের ছবিটা থেকে।
ছবিটি থেকেই দেখা যাচ্ছে, ভারত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা, কোনো দলের ক্ষেত্রেই যুবরাজ সিং বা ল্যান্স ক্লুজনার দলের পক্ষে সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা বোলার যুগপৎ ছিলেন না। দু’জনের কাউকেই ইনিংস গড়তে হয়নি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নতুন বলও হাতে তুলে নিতে হয়নি। যুবরাজ বা ক্লুজনার কেউই দলের মূল বোলার ছিলেন না। সে গুরুভার বাংলাদেশ দলে অর্পিত সাকিবের উপরই। ব্যাটিংয়ে ঝড় তুলতে হবে, সাকিব আছেন। ইনিংস গড়তে হবে, সাকিব আছেন। বল হাতে রান আটকাতে হবে, সাকিব আছেন। ব্রেকথ্রু প্রয়োজন, সাকিব আছেন। আর প্রত্যাশার চাপের কথা আলাদা করে বলাই বাহুল্য। যুবরাজ বা ক্লুজনার কেউই বিশ্বকাপমঞ্চে সেবার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দায় নিয়ে আসেননি, সাকিব এসেছেন সর্বকালের সেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাড়না নিয়ে।
তুলনামূলক দুর্বল দলগুলোতে খেলা ‘গ্রেট’ খেলোয়াড়দের জন্য স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়াটা বরাবরই প্রচণ্ড কঠিন কাজ। কঠিনতম কাজগুলোই তাদেরকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিনিয়ত করতে হয়, যাতে সাকিব নিজের স্মার্টনেস, আত্মবিশ্বাস এবং স্বীয় প্রচেষ্টাবলে হয়ে উঠেছেন অদ্বিতীয়। বল হাতে বরাবরই তিনি বিশ্বের সেরা বাঁহাতি স্পিনার, নিয়মিতই বোলিং করেন পাওয়ারপ্লে কিংবা ডেথ ওভারে। গত বছর থেকে নিয়মিত হয়েছেন ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বর পজিশনে।
বিশ্বকাপের মঞ্চে কতটুকু সফল হয়েছেন সাকিব? চলুন, দেখে নেওয়া যাক সেগুলোই।
- যুবরাজ সিংয়ের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের আসরে একই ম্যাচে ফিফটি এবং পাঁচ উইকেটের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন সাকিব। ২০১১ বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে যুবরাজ সিং এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
- একই বিশ্বকাপে শতক এবং পাঁচ উইকেট প্রাপ্তির মতো কীর্তি আগে ছিল কেবল কপিল দেব এবং যুবরাজ সিংয়ের। কপিল দেব করেছিলেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে, যুবরাজ ২০১১ বিশ্বকাপে, এরপর সাকিব করলেন এবারের ২০১৯ বিশ্বকাপে।
- সাকিব ইতিমধ্যেই করেছেন ৪৭৬ রান, বল হাতে নিয়েছেন ১০ উইকেট। এর আগে বিশ্বকাপে আর কেউ পারেননি কমপক্ষে ৪০০ রান এবং ১০ উইকেট নেওয়ার মতো ‘ডাবল’ পূর্ণ করতে। সাকিবের হাতে এখনো রয়েছে দু’টি ম্যাচ, নিঃসন্দেহে এই মাইলফলকটিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিপূর্ণ সুযোগ রয়েছে তার।
- সাকিবের আগে এক টুর্নামেন্টে ন্যূনতম ৪০০ রানের পাশাপাশি অন্তত ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড আছে কেবল দুইজনের। ১৯৮০ সালে গ্রেগ চ্যাপেল, এরপর ১৯৮১ এবং ১৯৮৫ সালে স্যার ভিভ রিচার্ডস।
- বাংলাদেশের পক্ষে এর আগে বিশ্বকাপের মঞ্চে আর কেউ পাঁচ উইকেট নিতে পারেননি। এর আগে বাংলাদেশের সেরা বোলিং পারফরম্যান্স ছিল শফিউল ইসলামের, ২০১১ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২১ রানে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
- সাকিবই একমাত্র খেলোয়াড়, যার বিশ্বকাপের আসরে একই সঙ্গে সহস্রাধিক রান এবং ত্রিশোর্ধ্ব উইকেট রয়েছে। ২৭ বিশ্বকাপ ম্যাচে তার সংগ্রহ ১,০১৬ রান এবং ৩৩ উইকেট।
সাকিব যে একার কাঁধে বয়ে চলেছেন গোটা বাংলাদেশের ভার, সেটা এতদিন আমরা সকলে জানলেও এবার দেখছে গোটা বিশ্ব। এবার নিশ্চয়ই ‘সময়ের সেরা’ থেকে ‘সর্বকালের সেরা’ হয়ে ওঠার সময় হয়ে এসেছে সাকিবের। তার সঙ্গে একই ড্রেসিংরুম শেয়ার করা যে কতটা অসাধারণ একটা ব্যাপার, সেটা লিটন-মিরাজ-মোসাদ্দেকরা নিশ্চয়ই জানেন। সাকিবের মিশন সফল হবে কি না, সময়ই সেটা বলে দেবে। কিন্তু নিজের সামর্থ্যের পুরোটুকু উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশকে যে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা, সেটা চোখে পড়ছে তাবৎ ক্রিকেটবিশ্বের নামজাদা সব বিশ্লেষকদেরও। অধিকাংশের মতেই, এই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় এখন পর্যন্ত তিনিই। পরিসংখ্যানও সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
বোলিংটা তেমন সিরিয়াসলি ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন করার সুনাম নেই তার, প্রায়ই অনুশীলন ক্যাম্প মিস করারও অভিযোগ শোনা যায় তার নামে। বোলিংটা তার সহজাত, এমনিই চলে আসে। আর সেই ‘সহজাত’ বোলিংই সারা বিশ্বের ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। কিন্তু এমন কী স্পেশাল আছে তার বোলিংয়ে?
এই গেল বিশ্বকাপেই আফগানিস্তান ম্যাচের কথাই ধরুন না! রহমত শাহ, আফগানিস্তানের তর্কসাপেক্ষে সেরা ব্যাটসম্যান তিনিই। সাকিব বোলিংয়ে এলেন, সার্কেলের বাইরে রাখলেন স্রেফ তিনজন ফিল্ডারকে। আগ্রাসী ফিল্ড সেটআপ করে এরপর শর্টার ফুলিশ লেংথে কিছুটা ঝুলিয়ে দিলেন বলটাকে। পরিকল্পনা কাজে দিল হাতেনাতে, তামিমের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে রহমত শাহ ফিরে গেলেন সাজঘরে। আসগর আফগান এবং হাসমতউল্লাহ শহীদী দু’জনই ধীরে ধীরে বিপদজনক হয়ে উঠছিলেন, তার ব্যাটে বলও আসছিল দারুণ। সাকিব নিয়ে এলেন সিলি পয়েন্ট, ফ্লাইটের পর ফ্লাইটে তটস্থ করে তুললেন ব্যাটসম্যানদেরকে। সেই চাপেই মোসাদ্দেকের বলে স্ট্যাম্পড হলেন শহীদী, সিলি মিড অফে দাঁড়িয়ে থাকা সাব্বিরকে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরলেন আসগর। আর মোহাম্মদ নবীর ডিসমিসাল? স্রেফ নিজের সেরা ডেলিভারিটাই করলেন, যেটা তিনি সবচেয়ে ভালো পারেন। প্রথম বলটাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি নবীকে, আর্ম বলটাকে স্রেফ দেখেশুনে ডট খেলেছেন। পরের বলটাও হুবহু একই জায়গায় ফেললেন, এবার গতিতে খুব সামান্য একটা ভ্যারিয়েশন, আর বাতাসে সামান্য টার্ন। ব্যস, বলটা হুট করে ঢুকে গেল ভিতরে, একদম গেট ফাঁকা করে ঢুকে যাওয়া এক ক্ল্যাসিক লেফট আর্মার ডেলিভারি। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা এবং সামর্থ্য নিয়ে আত্মবিশ্বাস মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, সাকিব বুঝিয়ে দিলেন আরেকবার।
‘মিনি অলরাউন্ডার’ কোটায় তাকে জাতীয় দলে সুযোগ পেতে দেখেছি আমরা। ‘কিছুটা ব্যাট কিছুটা বল’ থেকে পুরোদস্তুর নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার হয়ে উঠতে দেখেছি তাকে। কৈশোর পেরোতেই বাংলাদেশ দলের গুরুভার এসে পড়েছে তার উপর, সেই বয়সেই বাংলাদেশকে ম্যাচের পর ম্যাচ জিতিয়েছেন অনায়াসে। বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন বারবার, ভুল কারণে শিরোনাম হয়েছেন, নানাভাবে নানা কারণে তাকে ভুল বুঝেছেন অনেকেই। তিনি নিজেকে শুধরে নিয়েছেন, প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জে নেমেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘নয়টা-পাঁচটা’ পেশাদারিত্বের ছাপ এনে দিয়েছেন সাকিব, সমগ্র বিশ্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, নিজে সেরা হয়ে উঠেছেন। তার শ্রেষ্ঠত্বের পথে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে ‘মিনোজ’ থেকে সময়ের শ্রেষ্ঠতম দলগুলোর একটিতে পরিণত করেছেন।
সাকিব হগওয়ার্টসের নাম শুনে থাকবেন, হয়তো দেখে থাকবেন জুয়েল আইচের জাদুকরী সব কৌশলও। কিন্তু সেসব ‘ভানুমতীর খেল’ ছাড়িয়ে তিনি যেসব কীর্তি গড়েছেন, কিংবা গড়ে চলেছেন, স্রেফ ‘জাদুকর’ না হলে তা সম্ভব নয় কোনোমতেই। তার জাদু আমাদেরকে বিমোহিত করুক আরো অনেক বছর, তিনিও নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছান খুব দ্রুত, এটাই কামনা। তার জাদুকরী সব সাফল্য যে বাংলাদেশকে উন্মাতাল করে তোলে, স্বপ্ন দেখতে শেখায়!