Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেসি কি পারবেন আর্জেন্টিনাকে বাঁচাতে?

১.

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্বে ইতালি তিন ম্যাচের তিনটিতেই ড্র করল। ফিসফাস শুরু হলো তাদের সেরা স্ট্রাইকার পাওলো রসিকে নিয়ে। এ কেমন স্ট্রাইকার? তিনটি ম্যাচ খেলেও কোনো গোল পাচ্ছেন না! তিন ম্যাচে মাত্র দুই গোল করেও ভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় পর্বে জায়গা হলো ইতালির। সেই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বের ফিকশ্চারটা একটু আলাদা ছিল। ইতালির সঙ্গী ছিল আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা আর সর্বকালের অন্যতম আক্ষেপ জাগানো দল হিসেবে পরিচিত জিকো-সক্রেটিসের ব্রাজিল। তিন দলের এই গ্রুপ থেকে সেমিতে যাবে মাত্র ১টি দল। আর্জেন্টিনার সাথে ইতালি পেরে উঠলেও আবারও রসি গোল পেলেন না। দল থেকে তিনি বাদ যান যান অবস্থা। কিন্তু কোচ আস্থা রাখলেন তার উপর।

পরবর্তীতে সেই রসিই গড়লেন ইতিহাস। তার দেওয়া তিন গোলেই ইতালি জিতলো ৩-২ এ। পরের ম্যাচে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচের গোল দুটিও ছিল তার। ফাইনাল ম্যাচের প্রথম গোলটিও ছিল রসির। এরপর ১৯৩৮ সালের পর ইতালি ৩য় বিশ্বকাপ জিতে নিল রসির নেতৃত্বেই। রসি জিতে নিলেন সেই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট।

ক্লাব পারফর্মেন্স বিবেচনা করলে রসির চেয়ে ভালো খেলোয়াড় অনেক পাওয়া যাবে। এমনকি জাতীয় দলের হয়ে ৪৮ ম্যাচে মাত্র ২০টি গোলও কখনোই এই বিশ্বাস জাগায় না যে, স্ট্রাইকার হিসেবে তিনি খুব উঁচু মানের ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র ৯টি গোল বিশেষ করে ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্ট্রিকটি তাকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে

সঠিক সময়ে জ্বলে উঠে রসি গড়েছিলেন ইতিহাস; Source: The18

বিশ্বকাপের মাহাত্ম্য এটাই। যতই একজন ফুটবলার ক্লাব ফুটবলে পারফর্ম করুক না কেন, ইতিহাসের মণিকোঠায় জায়গা পেতে হলে ৪ বছর অন্তর অন্তর হওয়া এই ৭ ম্যাচের টুর্নামেন্টে পারফর্ম করাটা যেন বাধ্যতামুলক। ব্রাজিলের বিপক্ষে পাওলো রসির হ্যাটট্রিক, ‘৯৮ আর ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের ব্রাজিল বধ, দুই বিশ্বকাপ ফাইনালে পেলের গোল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার শতাব্দী সেরা গোল– এরকম আরো অসংখ্য মুহূর্ত এসব খেলোয়াড়কে চিরস্থায়ী করে রেখেছে ইতিহাসে। চার বছর পর যখন বিশ্বকাপ আসে, তখন এসব আলোচনা ঘুরে ঘুরে আবার ফিরে আসে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, সময়ের দুই সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো– এই দুজনের কারোরই এই বিশ্বকাপ শুরু হবার আগে তেমন কোনো স্মরণীয় ম্যাচ ছিল না, যা কিনা আজ থেকে ২০ বছর পরেও মানুষ মনে করবে। অবশেষে এই বিশ্বকাপে স্পেনের বিপক্ষে তেমন একটা পারফর্ম করে ফেললেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পর্তুগালের মতো দলের হয়ে স্পেনের বিপক্ষে হ্যাটট্ট্রিক করাটা যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্যেই স্বপ্নের মতো। আর তার মাঝে একটি গোল যদি ম্যাচে পিছিয়ে থাকার পর ৮৮তম মিনিটে ফ্রি কিক থেকে হয়, তাহলে নাটকীয়তার আর কী বাকি থাকে!

২.

এখন বাকি থাকলেন কেবল মেসি। তবে এই পারফর্মেন্সের জন্য সবার আগে কী প্রয়োজন? ভালো দল, ভালো পারফর্মেন্স, কোচের ভালো পরিকল্পনা– তবে এসব কিছুর আগে যে জিনিসটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে প্লাটফর্ম তথা মঞ্চ। ভালো পারফর্ম করার আগে আপনাকে আগে মঞ্চটা পেতে হবে। বিশ্বকাপে ক্লোসার গোলও ১৬টি (এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ), কিন্তু তেমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল না থাকায় ক্লোসার কথা কেউ সেভাবে মনে রাখে না যেভাবে মনে রাখি রসি কিংবা জিদানদের।

নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি মেসির জন্য বড় ধরনের একটি সুযোগ হয়ে এসেছে; নিজের সক্ষমতাটা সবার সামনে প্রকাশ করার জন্য, নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করার জন্য।

‘চাপের মুখে মেসি খেলতে পারেন না’– শুরু থেকেই এই সন্দেহটা বর্তমানে চিৎকারে পরিণত হচ্ছে। সম্ভবত মেসি এই মুহূর্তে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তে অবস্থা করছেন। দল খারাপ খেলছে, প্রতিপক্ষ ভালো খেলছে, শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার ড্র হলেই চলবে, চারিদিকে সমালোচনা, কোচের সাথে বিবাদের গুঞ্জন, নিজেও খারাপ খেলছেন– এতগুলো চাপের সাথে যুক্ত হয়েছে পুরো ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্ন।

ভাগ্যটাও যেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে; Source: Telegraph

‘গ্রেট’ খেলোয়াড়দের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা তাদের আশেপাশের সাধারণ খেলোয়াড়দেরকেও নিজের সংষ্পর্শে অসাধারণ বানিয়ে ফেলেন। এদিকে আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়রা ক্লাব ফুটবলে অসাধারণ হলেও, জাতীয় দলের হয়ে মেসির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে না। এর দায় শুধুই খেলোয়াড়দের, নাকি একজন অধিনায়ক এবং দলের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মেসির উপরেও বর্তায়; সেটিও আলোচনার বিষয়।

৩.

এখন এত আলোচনা কিংবা সমালোচনার জবাব এই মুহূর্তে কেবল একজন মানুষই দিতে পারেন, তিনি হচ্ছেন মেসি নিজেই।

সমস্যা হচ্ছে ম্যাচের শুরুতেই নাইজেরিয়া এগিয়ে রয়েছে। ড্র করলেই পরের পর্বে চলে যাবে নাইজেরিয়া– এই কথাটার অর্থ হচ্ছে, ম্যাচ শুরুর আগেই ১ গোলে এগিয়ে তারা। আর্জেন্টিনাকে পরের পর্বে যেতে হলে কী করতে হবে তাহলে?

ডি গ্রুপের অবস্থানটা একটু দেখা যাক।

ডি গ্রুপের পয়েন্ট টেবিল; Source: News18

দুই ম্যাচ জিতে ৬ পয়েন্ট নিয়ে সবার আগে শেষ ষোলোতে পৌঁছে গেছে ক্রোয়েশিয়া। ৩ পয়েন্ট নিয়ে নাইজেরিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়, ১ পয়েন্ট নিয়ে আইসল্যান্ড আর আর্জেন্টিনার অবস্থান যথাক্রমে ৩য় আর ৪র্থ নম্বরে।

মজার বিষয় হচ্ছে, পরের তিন দলের যে কারোরই এই মুহূর্তে দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

নাইজেরিয়াকে হারালে আর্জেন্টিনার পয়েন্ট হবে ৪। সেক্ষেত্রে আইসল্যান্ড বনাম ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ যদি ড্র হয় কিংবা আইসল্যান্ড হেরে যায়, তাহলে পরের পর্বে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গী হবে আর্জেন্টিনা। কিন্তু যদি ক্রোয়েশিয়ার দ্বিতীয় সারির দল নামানোর সুযোগ নিয়ে এবং কোনো কিছু হারাবার ভয়ে ভীত না হয়ে আইসল্যান্ড জিতে যায়, তাহলে গোল ব্যবধানে হিসেব হবে। গোল ব্যবধানে আইসল্যান্ড এগিয়ে থাকায় তারা কিছুটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে থাকবে। এই কারণে আর্জেন্টিনার লক্ষ্য থাকবে নাইজেরিয়ার সাথে জেতা আর আইসল্যান্ড ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া যেন অন্তত না হারে, সেটা কামনা করা।

নাইজেরিয়ার সাথে ৮ বারের দেখায় ৫ বার জয়ের বিনিময়ে মাত্র ২টি হার থাকলেও, বর্তমানে পরিস্থিতি বিবেচনায় নাইজেরিয়াও অনেক শক্তিশালী দল। তবে এটা সত্য, আর্জেন্টিনা নিজের খেলাটা ঠিকভাবে খেলতে পারলে জয় পাওয়ারই কথা

নাইজেরিয়ার জন্য হিসেব অত্যন্ত সহজ। আর্জেন্টিনাকে হারাতে পারলেই তারা চলে যাবে পরের পর্বে। ড্র হলেও যাবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে আইসল্যান্ড যদি নিজেদের ম্যাচে জিতে তাহলে নাইজেরিয়া আর আইসল্যান্ড দুই দলের পয়েন্টই হবে ৪। তখন গোল ব্যবধানের হিসেব হবে। কাজেই নাইজেরিয়ার কামনা থাকবে আইসল্যান্ড-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটি অন্তত যেন ড্র হয়।

মুসার দিকে তাকিয়ে আছেন নাইজেরিয়ানরা; Source: Daily Post Nigeria

একই কারণে আইসল্যান্ড চাইবে আর্জেন্টিনার নূন্যতম ব্যবধানে জয় এবং নিজেদের জয়।

৪.

বাংলাদেশ সময় আজ রাত বারোটার শুরু হওয়া ম্যাচের পর মোটামুটি দুই ঘণ্টার মাঝেই নির্ধারিত হয়ে যাবে কোন দল যাচ্ছে পরের পর্বে। আর্জেন্টিনা যদি বাদ পড়ে, সেটা অপ্রত্যাশিত হলেও খুব অস্বাভাবিক কিছু হবে না। গত দুই বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলই তো পরের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল। এরকম অঘটন তো প্রতি বিশ্বকাপেই দুয়েকটা ঘটে থাকে। কিন্তু লিওনেল মেসির জন্য বিষয়টা অনেক মর্মান্তিকই হবে। বিশ্বকাপের মতো আসরে প্রথম পর্বে লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়ের বাদ পড়াটা কোন ফুটবলপ্রেমীই মানতে পারবেন না।

রাইভাল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও খেলেছেন স্মরণীয় একটা ম্যাচ; Source: The Ringer

‘চ্যাম্পিয়ন’ খেলোয়াড়দের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা তাদের দিকে ছুঁড়ে আসা স্টোন তথা পাথরকে মাইলস্টোনে পরিণত করেন। বার্সেলোনার হয়ে অসংখ্য ম্যাচে মেসির এমন পারফর্মেন্স আছে। আর্জেন্টিনার হয়ে মেসিকে খুব বেশি দিন এমন বিপদে পড়তে হয়নি, অথবা বলা যায়, তার পারফর্মেন্সই আর্জেন্টিনাকে কখনো এমন বিপদে পড়তে দেয়নি। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে আর্জেন্টিনার এত বড় বিপদে ত্রাতা হতে পারলেই কেবল মেসি ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় এবং বরণীয় হয়ে থাকতে পারবেন। আর যদি মেসি ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রেও তিনি নিশ্চয়ই স্মরণীয় হয়েই থাকবেন তার খেলার জন্য; তবে একইসাথে কাঁটার মতো তার মুকুটে যুক্ত হবে প্রতিকুল পরিবেশে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে সফল না হবার যন্ত্রণা।

বার্সেলোনার মেসিকেই যেন মাঠে চান আর্জেন্টাইনরা; Source: Stadium Astro

এমনও হতে পারে যে, আজকের ম্যাচে মেসির তেমন পারফর্মেন্স বাদেই আর্জেন্টিনা জিতে যাবে। আবার এমনও হতে পারে যে, মেসির অসাধারণ পারফর্মেন্সের পরেও আর্জেন্টিনা হেরে যাবে। তবে ডি গ্রুপের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, একজন মেসির দিকেই তাকিয়ে থাকবে বিশ্ববাসী। খুব বাজেভাবে শুরু করেও বিশ্বসেরা হবার ইতিহাস তো পাওলো রসির মতো খেলোয়াড়েরও আছে। মেসিকে নিয়ে তাই এই মুহূর্তেই আশাহত হবার কোনো কারণ নেই।

আর যা-ই হোক, মেসির মতো একজন অসাধারণ খেলোয়াড়ের বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠ আসর থেকে এমনভাবে প্রস্থানটা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। 

ফিচার ইমেজ: GoalBall

Related Articles