এই মুহূর্তে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া অনেক ক্রিকেটারের চেয়ে নাসির হোসেনের ফ্যানবেজ বেশ বড়। তাই নাসিরের প্রতি প্রায় সবারই আলাদা একটা টান আছে, যাকে বলে ‘সফট কর্নার’। কিন্তু নাসির কই! নাসির ফিরছেন। ফেরার পথেই আছেন। সেই পথটা শুরু হয়েছে এই সপ্তাহেই। নেটে ফিরেছেন গেল রবিবারে। সেদিন থেকেই আবারও আলোচনায় নাসির।
১.
কোনো এক স্নিগ্ধ সকালের কথা। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নেই। ক’দিন আগে প্রিমিয়ার লিগও শেষ হয়েছে। বিসিবির প্রধান কার্যালয়ে কেবল গণমাধ্যম কর্মীরা আসেন, খুঁজে ফেরেন সংবাদ। কখনও কখনও একাডেমি মাঠে কোনো খেলোয়াড় এসে অনুশীলন করেন। এরই মাঝে মূল গেট পেরিয়ে একটি প্রাইভেট কার এসে থামলো। অনেকে চিনে গিয়েছিল, গাড়িটি নাসিরের। কিন্তু যখন ভেতর থেকে মানুষটি বের হলেন, তখনই ঝুলে গেল সবার চোয়াল। নাসিরই নামছেন বটে, কিন্তু ক্রাচে ভর দিয়ে! বাকিদের দেখে কেবল কাষ্ঠ হাসি দিলেন। তারপর আরও অনেকের সাহায্যে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে গেলেন।
এই অবস্থা কী করে? বিব্রত মুখে জানালেন, বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন লিগ শেষ করে। সেখানে ফুটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুতে চোট পেয়েছেন। চিকিৎসা চলছে, বাইরে যেতে হবে অস্ত্রোপচারের জন্য। এখন এসেছেন বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরীকে দেখাতে।
নাসির ইনজুরিতে ছিলেন। সেটাই কাটিয়ে ফিরছেন তিনি। ইনজুরির শেষাংশটা এমনই ছিল যে, সমালোচিত হয়েছিলেন ২৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। কিন্তু পরে দেখা গেল অন্য জিনিস।
চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে নাসির খেলেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজার অধীনে আবাহনী লিমিটেডে। ফাইনালে তার ব্যাটে এসেছিল ১২৯ রানের ঝড়ো এক ইনিংস। ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মাঠে। সেখান থেকে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েই এই অবস্থা। যদিও বলা হচ্ছে, নাসির আসলে চোট পেয়েছেন আরও আগে। ফিটনেস ট্রেনিংয়ের সময়।
ফুটবল কিংবা ফিটনেস ট্রেনিং; যা-ই হোক না কেন, নাসিরের চোটটা গুরুতরই ছিল। পরে স্ক্যান করে দেখা যায়, হাঁটুর দুটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। অস্ত্রোপচার করতে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়, ডেভিড ইয়ংয়ের কাছে। সেখানে জানা গেল, তার হাঁটুর মিনিস্কাসও চোটগ্রস্থ। শেষপর্যন্ত, নাসিরের এক হাঁটুতেই তিনবার অস্ত্রোপচার করলেন ইয়ং।
সবকিছু শেষ করে নাসির দেশে ফিরেছিলেন চলতি বছরের ২২ জুন। শুরুতে কেবলই বিশ্রাম। তারপর আবারও ফেরার লড়াই। এই লড়াই জাতীয় দলে ফেরার নয়, ক্রিকেটে ফেরার। সপ্তাহ দুয়েক ধরে রানিং করছেন নাসির। রবিবার মেশিনে খেললেন হালকা গতির বল।
২.
সদা হাস্যোজ্জ্বল নাসির বাংলাদেশ জাতীয় দলে আসেন ২০১১ সালে। সেই থেকে নিজেকে প্রমাণ করেছেন ফিনিশার হিসেবে। তবে কালের পরিক্রমায় নিজেকে কখনও হারিয়ে ফেলেছেন, কখনও বা আবারও ফিরেছেন। দেশের হয়ে ১৯ টেস্ট, ৬৫ ওয়ানডে আর ৩১ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা এই ক্রিকেটার এবারই প্রথম কেবল ইনজুরির কারণে এতদিন মাঠের বাইরে থাকলেন।
ডানহাতি ব্যাটিংয়ের সঙ্গে অফ স্পিন, দুইয়ে মিলিয়ে নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ করেছেন এই ক্রিকেটার। ত্তবে ৮ মাসের যে বিচ্ছেদ তার ছিল, তাতে নিজেও পুড়ছেন।
প্রথমদিন শেরে বাংলার ইনডোরে ব্যাট করতে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। সেখানে বলেন,
‘সত্যি বলতে এটা আমার জন্য খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। কারণ আমি এর আগে কখনও এমন গুরুতর কোনো ইনজুরিতে পড়িনি। আমার তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে যখন আমি ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতাম, ওই দিনগুলো আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল।’
৮ মাস আগে করা নাসিরের সেই সেঞ্চুরিই হয়তো তার জন্য জাতীয় দলে ফেরার পথে একটা দরজা হয়ে যেত। কারণ ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে সেবার ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কা এ দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ এ দলে নেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। শেষবার চলতি বছরের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে খেলেছিলেন, তারপর আবার বাদ। ফর্মটা ফিরে পেয়েছিলেন প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে।
তিনি বলেন,
“আমি ফর্মেই ছিলাম। শেষবার যখন ব্যাট করতে নেমেছিলাম, তখন সেঞ্চুরি করেছিলাম। আমি ভাগ্যে খুব বিশ্বাস করি। তো এটাও বিশ্বাস করি যে, আমার কপালে যা লেখা ছিল তা-ই হয়েছে। তাছাড়া অতীত নিয়ে এখন ভেবেও লাভ নেই, সেগুলো ফিরে আসবে না। তো আমি এখন যেটা করতে পারি তা হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, পুনর্বাসনের পুরো সময়টাকে কাজে লাগানো। ২০১৮ সালে আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। একটা পর্যায়ে,আমি আমার জীবন, খেলা; সবকিছু নিয়ে অনেক হতাশ ছিলাম। আজকে আমি যে অবস্থানে, সেখানে আমাকে নিয়ে এসেছে ক্রিকেট। তাই ক্রিকেট থেকে দূরে থাকা অনেক কষ্টের ছিল। আমি এই পুরো সময় বন্ধুদের সাথে কাটিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন,
“খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পথে কিছু মানুষ শক্তিশালী হয়। আমি খেয়াল করেছি, অনেক ক্রিকেটার ইনজুরি কাটিয়ে ফিরে ভালো করছে। আমি নিজেও একটা ভালো শুরু চাই। ৮ মাস অনেক সময়। আমি এই সময়ের মধ্যে খেলা দেখেছি, নিজেকে বুঝিয়েছি। আমার ইচ্ছা আছে বিকেএসপিতে গিয়ে অনুশীলন করা। ওখানে একটা ক্যাম্পের মতো পরিবেশ থাকে। তাছাড়া দল থেকে বাদ পড়া আর ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থাকা দুটো ব্যাপার একেবারেই আলাদা। আমি জাতীয় দল, জাতীয় লিগ, সবকিছুর বাইরে ছিলাম। এখন ফিরতে চাই যত দ্রুত সম্ভব।”
৩.
নাসির এই মুহূর্তে তার পুনর্বাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছেন। যার ধারাবাহিকতায় ব্যাটিং, রানিং করা শুরু করেছেন। তবে সেগুলোর কোনোটিই নিজের শতভাগ দিয়ে নয়। প্রয়োজন আরও সময়ের।
নাসির বলেন,
“আমি আমার ৭০-৮০ শতাংশ ব্যবহার করছি এখন। দুয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শতভাগ দিতে পারবো। আমি আশাবাদী, বিপিএলের আগেই আমি পুরোপুরি ফিট হয়ে যাবো।“
মূলত বিপিএল দিয়েই মাঠে ফিরতে চান নাসির। সেখানে ভালো করতে পারলে তার জন্য জাতীয় দলের দরজাটাও খুলে যাবে, এই বিশ্বাস তার আছে। বলেছেন, জাতীয় দল সহজ হবে না। কারণ যারা দল থেকে ছিটকে যায়, তাদের জন্য কাজটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দলের তরুণ ক্রিকেটাররা খানিক পারফর্ম করলেই তাদের দিকেই সব আগ্রহ চলে যায়।
নিজেকে ফিট করা ছাড়া আর অন্যকিছু এখন ভাববার সময় নেই নাসিরের। কতদিন পর নিজেকে শতভাগ ফিট বলতে পারবেন, কবে থেকে পারফর্ম করবেন; সেই স্বপ্নে বিভোর এই ক্রিকেটার। বলেছেন,
“আমি পারফর্ম করতে চাই। বিপিএল আমার জন্য এক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করছে আমার পাফরম্যান্সের উপর।“
নিজের ক্রিকেট নিয়ে কতটা আবেগী ছিলেন নাসির? জানিয়েছেন নিজেই। গেল ৮ মাসে নিজের কিট ব্যাগ থেকে একবারও ব্যাট বের করেননি তিনি। অপেক্ষা করছিলেন এই দিনগুলোর। যেদিন তিনি ব্যাট হাতে ফিরবেন।
বলেছেন,
“পুরো ৮ মাস আমি ব্যাগ থেকে ব্যাট বের করিনি। আজ আমি ৮ মাস পর ব্যাট করতে নামলাম। আজকের দিনটার জন্যই অপেক্ষা করেছি। এখন আমার একটাই চিন্তা, কীভাবে আবারও পুরনোকে ফিরে পাবো।”