ফুটবল দলগত খেলা। দলগত খেলায় অনেকের মাঝ থেকে একজনকে সেরা নির্ণয় করাটা বোকামি। তবুও যুগ যুগ ধরে মানুষ এই বোকামি করে আসছে। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, বরং ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা দ্বারাই এই নির্বাচন হয়ে থাকে। এই সেরা নির্বাচন করার একটি স্বীকৃতি হচ্ছে ব্যালন ডি অর। বছরের সেরা খেলোয়াড়কে এই পুরষ্কারটি দেওয়া হয়ে থাকে। যতগুলো সেরার পুরষ্কার দেওয়া হয়, তার মাঝে এটি সবচেয়ে প্রাচীন এবং ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার আসার আগ পর্যন্ত ব্যালন ডি অরই সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
অন্যদিকে বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর। ক্লাব ক্যারিয়ারে একজন ফুটবলারের নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ অনেক বেশি থাকে। পুরো মৌসুমে লিগ ম্যাচ সাধারণত ৩৮টি, এর সাথে ঘরোয়া কাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ। কোনো খেলোয়াড় ১৫টি মৌসুম খেলতে পারলে ক্যারিয়ারে ১৫টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পাবে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়টিও বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পান সাধারণত ৩/৪টি। আবার ম্যাচ সংখ্যাও থাকে অনেক কম। সর্বোচ্চ ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারলে ৭টি। তার চেয়েও বড় কথা, একজন খেলোয়াড় যে সময়টিতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকেন, সেই সময়টায় বিশ্বকাপ না-ও হতে পারে। দেখা গেল এমন একটা সময় বিশ্বকাপ হচ্ছে যে সময়টাতে সেই খেলোয়াড় তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে ফর্মে আছেন। এরপর আছে দলগত শক্তি। ক্লাব ফুটবলে চাইলেই বিভিন্ন পজিশনে পছন্দ সই খেলোয়াড় কিনে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিকে নিজের শক্তি অনুযায়ীই দলকে সাজাতে হয়। সুযোগ কম বলে মূল্যয়নটাও হয় অনেক বেশি।
সেরা টুর্নামেন্টে সাধারণত সেরা খেলোয়াড়দের দিকে একটা বাড়তি নজর থাকে। ব্যালন ডি অর জয়ী অথবা ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে যারা বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন স্বভাবতই তারা সেই সময়ের স্বীকৃত সেরা। ফুটবলের সেরা মঞ্চে তারা কী করবেন, সেটা নিয়ে আগ্রহ সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষজ্ঞ সবারই থাকাটা স্বাভাবিক।
বিশ্বকাপে যেসব খেলোয়াড়রা ব্যালনজয়ী অথবা ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে গিয়েছিলেন তারা কেমন পারফর্মেন্স করেছিলেন সেদিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
বিশ্বকাপ ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হলেও ব্যালন প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৫৬ সাল থেকে। এজন্য ১৯৫৮ বিশ্বকাপ থেকে হিসেবটা ধরা যাক।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ
১৯৫৮ বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে যাওয়ার কথা ছিল ১৯৫৭ সালের ব্যালন ডি অর বিজয়ী আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর। সেই মৌসুমে লা লিগা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ব্যালনের ভোটে তিনি পেয়েছিলেন ৭২ পয়েন্ট, যেখানে দ্বিতীয় সেরা পেয়েছিলেন মাত্র ১৯। কিন্তু স্পেন সেই বিশ্বকাপে বাছাইপর্বের গণ্ডি পার হতে পারেনি। বিশ্বকাপের মৌসুমটাতেও স্টেফানো দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। লা লিগা আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার সাথে সাথে ১৯টি গোল করে ঘরোয়া লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং ১০টি গোল করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেরও সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন।
বাছাই পর্বেও ৪ ম্যাচে ২টি গোল করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য বাছাইপর্বের গণ্ডি পেরুতে পারেনি স্পেন। সেই বাদ পড়াটা স্পেনের দুর্ভাগ্য, বিশ্বকাপের দুর্ভাগ্য, স্টেফানোর দুর্ভাগ্য নাকি ফুটবলপ্রেমীদের দুর্ভাগ্য, সেই মীমাংসায় আসা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
১৯৬২ বিশ্বকাপ
১৯৬২ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী হিসেবে যান ইতালির ওমর সিভোরি। কিন্তু ইতালি প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায়। সিভোরি বিশ্বকাপে কোনো গোল করতে পারেননি।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ
১৯৬৬ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী হয়ে যান পর্তুগালের ইউসেবিও। পর্তুগাল প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে আসে এবং বাছাই পর্বে পর্তুগালের ৯টি গোলের মাঝে ইউসেবিও করেন ৭টি। টুর্নামেন্টে চমক দেখিয়ে পর্তুগাল ৩য় হয়। ব্যক্তিগতভাবে ৯ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ইউসেবিও।
১৯৭০ বিশ্বকাপ
১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী হিসেবে যান ইতালির রিভেরা। দল রানার্স আপ হয়। বদলি হিসেবে খেলতে নেমেও টুর্নামেন্টে ২টি গোল করেন রিভেরা।
১৯৭৪ বিশ্বকাপ
১৯৭৪ বিশ্বকাপে ব্যালন ডি অর জয়ী হিসেবে গিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডের ক্রুয়েফ। ঘরোয়া লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ডাবলস জেতার কারণে পুরস্কারটা পান তিনি। নেদারল্যান্ড টপ ফেভারিট হিসেবে ফাইনালে খেললেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না, রানার্স আপ হয়। ব্যাক্তিগতভাবে ৩ গোল করেন ক্রুয়েফ এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান।
১৯৭৮ বিশ্বকাপ
১৯৭৮ বিশ্বকাপে ব্যালন ডি অর জয়ী হয়েছিলেন ডেনমার্কের অ্যালান সিমিওসেন। তার দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগই পায়নি।
১৯৮২ বিশ্বকাপ
১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্যালন ডি অর জয়ী হিসেবে গিয়েছিলেন জার্মানির রুমিনিগে। জার্মানি রানার্স আপ হয়। রুমিনেগে টুর্নামেন্টে ৫ গোল করে সিলভার বুট জিতে নেন।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ
১৯৮৬ বিশ্বকাপে ব্যালন ডি অর জয়ী হিসেবে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি। টুর্নামেন্টে ফ্রান্স ৩য় হয়। ব্যাক্তিগতভাবে প্লাতিনি ২টি গোল করেন এবং বিশ্বকাপের অলস্টার দলে সুযোগ পান।
১৯৯০ বিশ্বকাপ
১৯৯০ বিশ্বকাপে ব্যালন ডি অর জয়ী হিসেবে গিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডের ভ্যান বাস্তেন। দল বাদ পড়ে দ্বিতীয় পর্বে। ব্যাক্তিগতভাবে কোনো গোলই করতে পারেননি বাস্তেন।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ
১৯৯৪ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী আর ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে গিয়েছিলেন ইতালির রবার্তো ব্যাজিও। শুরুটা মনের মতো না হলেও নকআউট স্টেজে নিজেকে ফেরত পান। কিন্তু ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করে হিরো হবার বদলে ট্র্যাজিক হিরোতে পরিণত হন। ব্যাক্তিগতভাবে ৫ গোল করে সিলভার বুট আর সিলভার বল জিতে নেন ব্যাজিও।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ
১৯৯৮ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী আর ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে গিয়েছিলেন ব্রাজিলের রোনালদো। ৪ গোল আর ৩টি অ্যাসিস্ট করে দলকে ফাইনালেও নিয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যময় ইনজুরির কারণে ফাইনালে ছিলেন ছায়া হয়ে। দল ফাইনালে হারলেও জিতে নেনে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
২০০২ বিশ্বকাপ
২০০২ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী এবং ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় ছিলেন ভিন্ন। ব্যালনজয়ী হিসেবে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন মাইকেল ওয়েন আর ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে গিয়েছিলেন লুইস ফিগো। ইংল্যান্ড বাদ পড়ে কোয়ার্টারে আর পর্তুগাল গ্রুপপর্বেই। ওয়েন করেন ১টি গোল আর ফিগো গোলের খাতাই খুলতে পারেননি।
২০০৬ বিশ্বকাপ
২০০৬ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী এবং ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন রোনালদিনহো। ব্রাজিল বাদ পড়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। কোনো গোল করতে না পারা রোনালদিনহোর পারফর্মেন্সও ছিল হতাশাজনক।
২০১০ বিশ্বকাপ
২০১০ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী এবং ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। দল বাদ পড়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে, জার্মানির বিপক্ষে। ব্যাক্তিগতভাবে ১ টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি এবং ১ ম্যাচে ম্যান অব দি ম্যাচের পুরস্কার পেয়েছিলেন।
২০১৪ বিশ্বকাপ
২০১৪ বিশ্বকাপে ব্যালনজয়ী এবং ফিফা বর্ষসেরা হিসেবে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তার দল পর্তুগাল প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায়। ব্যাক্তিগতভাবে ১ ম্যাচে ম্যান অব দি ম্যাচ হন এবং তার গোল সংখ্যা ছিল ১টি।
শেষকথা
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই পর্যন্ত সেরা খেলোয়াড় হিসেবে যাওয়া কোনো খেলোয়াড়ই বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাক্তিগত এবং দলগত পারফর্মেন্স ছিল খুবই খারাপ।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো আর অ্যালান সিমিওসেন বিশ্বকাপ খেলার সুযোগই পাননি। রিভেরা, ক্রুয়েফ, রুমিনেগে, ব্যাজিও এবং রোনালদো– এই পাঁচজন খেলোয়াড় ফাইনাল খেলতে পেরেছিলেন। এর মাঝে ক্রুয়েফ এবং রোনালদো টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারও পেয়েছেন। বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুটের পুরস্কার পেয়েছেন ইউসেবিও। কিন্তু সোনার ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার স্বাদ কারোরই হয়নি। এদের মাঝে এক ব্রাজিলের রোনালদো এবং রোনালদিনহো বাদে আর কেউ কখনো বিশ্বকাপ জেতার স্বাদও পাননি।
এবার সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃত নিয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ইতিহাসের কথা মনে রাখলে ফুটবলপ্রেমীদের তার কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করা উচিত না। আবার এই ইতিহাস জানলে কোনো খেলোয়াড় হয়তো বিশ্বকাপের আগের মৌসুমে অন্তত সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা পেতেও চাইবেন না!
ফিচার ইমেজ: Goal.com