ক্রিকেটটা আপনি কেন দেখেন? দর্শক হিসেবে ক্রিকেট আপনাকে কী দিয়েছে?
শুরুতেই এমন প্রশ্ন করে সম্ভবত চমকেই দিলাম, খানিকটা বোধহয় নস্টালজিকও। ক্রিকেটের পাঁড়ভক্ত হয়ে থাকলে ক্রিকেট দেখার কারণে শৈশব কিংবা কৈশোরে বাবা-মায়ের মুখে এমন কথা আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন!
এমন প্রশ্নের জবাবে চুপ থাকাই নিয়তি ছিল। উত্তর দেবার মতোই যে কিছু ছিলো না। ব্যাট-বলের এই খেলায় ভক্ত-সমর্থকদের জন্য তো কোনো প্রাপ্তির ব্যবস্থা নেই! তবুও আপনি ক্রিকেট দেখছেন, সারাদিনে সমস্ত কাজ ফেলে রেখে টিভি-পর্দাতে বুঁদ হয়ে রইছেন, এবং এই সময় অপচয় করেও আপনি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবছেন!
কারণ, আপনি ১৪ জুলাই দেখেছেন! ইংল্যান্ড-নিউ জিল্যান্ড ম্যাচ দেখেছেন! যে ম্যাচ দেখতে পারাকে আপনি ভাবছেন, ‘সাত জনমের ভাগ্য’, আর নিউজিল্যান্ডাররা ভাবছেন, ‘আগের জন্মে কোনো পাপই করেছিলাম হয়তো!’
ফাইনালে না হেরেও ট্রফিটা ঘরে তোলা যায়নি, এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে!
ফাইনালের প্রথম ঝাঁজটা কেটে যাবার পরে, এখন যদি আরেকবার জিজ্ঞাসা করা হয়, আসলেই নিউ জিল্যান্ড ‘আনলাকি’ ছিল কি না, আপনার উত্তর কি একই রইবে? স্কোরবোর্ডে মাত্র ২৪১ রান তোলার পরে ভাগ্যকে দোষ দিলে সেটা রীতিমতো অজুহাত হতো। নিউ জিল্যান্ড সে পথে যায়নি। তবে, নিউ জিল্যান্ডের হয়ে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর লাক ইন্ডেক্স জানাচ্ছে, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়া দলটির নাম নিউ জিল্যান্ড!
ফাইনাল ম্যাচে রস টেলর আউট হয়েছিলেন আম্পায়ারের ভুলে, লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে কাটা পড়লেও পরবর্তীতে হক-আই জানিয়েছিলো, বল স্পষ্টতই স্ট্যাম্প মিস করতো! রিভিউ যে নেবেন, সে সুযোগও মার্টিন গাপটিল রাখেননি। আগের ম্যাচেই অর্ধশতকের দেখা পাওয়া ব্যাটসম্যানকে এভাবে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড নিজেদের দুর্ভাগা ভাবতেই পারে।
আপনি যদি একে কেবলই মানবীয় ভুল হিসেবে দেখতে চান, তবে নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা তেড়ে আসবেন আরেকটি ঘটনা নিয়ে! বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে আসা সেই অতিরিক্ত চার রান তো নিউ জিল্যান্ডারদের মন ছাপিয়ে ক্রিকেটের উপকথাতেই জায়গা করে নেবে!
গাপটিলের থ্রো স্টোকসের ব্যাটে লেগে দিক বদল না করলে, শেষ দুই বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন হতো ৭ রান। ক্রিজে একজন সেট ব্যাটসম্যান হিসেবে বেন স্টোকস থাকায় ইংল্যান্ড সমর্থক হয়ে থাকলে আপনি শেষ দুই বলে সাত রান তোলা যেত বলে তর্ক করতেই পারেন। ম্যাচের ফল তো এখন আপনার পক্ষেই কথা বলবে!
তবে লাক ইনডেক্সের মতে, ম্যাচ তখন নিউ জিল্যান্ডের দিকেই ‘একটু বেশি’ হেলে যেত! নিউ জিল্যান্ড তাই আফসোস করতেই পারে, ‘ইশ, ভাগ্যটা যদি সঙ্গী হতো!’
টুর্নামেন্ট শেষে দেখা যাচ্ছে- ক্যাচ মিস, রান-আউটের সুযোগ মিস কিংবা আম্পায়ারের ভুলের মাশুল নিউ জিল্যান্ডকেই গুনতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ব্যাটের কানায় লেগে চার, ব্যাটসম্যান আউট হয়েও বেঁচে যাচ্ছেন, প্রতিপক্ষ রান-আউট মিস করছে, এমন ঘটনা নিউ জিল্যান্ডের পক্ষে ঘটেছিল ১৭ বার। আর, বিপক্ষে? ২৬ বার! ভাগ্য নিউ জিল্যান্ডের চেয়ে বেশি বিপক্ষে কথা বলেনি আর কারও বেলাতে!
তবে ইএসপিএনের লাক ইনডেক্স থেকেই জানা যাচ্ছে, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দুর্ভাগা দলটি ছিল ইংল্যান্ড। ভাগ্য তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ২৮ বার। তবে পক্ষেও কথা বলেছিল ২১ বার! এই দুই দল তাই দাবি করতেই পারে, ‘যোগ্যতা বলেই খেলেছি, ভাগ্যের আনুকূল্যে নয়!’
এমনকি এই দাবি আরও ভিত্তি পাবে, যখন জানবেন, টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যের দয়াদাক্ষিণ্য পাওয়া তিন দলের নাম- উইন্ডিজ, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা! আর বিশ্বকাপে এই তিন দলের অবস্থান যথাক্রমে নবম, অষ্টম এবং ষষ্ঠ।
তবে কেবল ভাগ্যের সহায়তা পেলেই তো হবে না, সেটাকে কাজে লাগানোর সক্ষমতাও থাকতে হবে। যেমনটা ছিল রোহিত শর্মার, এবারের টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক সেঞ্চুরি করেছেন পাঁচটি। যার ভেতর চারটিতেই আউট হতে পারতেন রানসংখ্যা দুই অংকের ঘরে পৌঁছানোর আগেই। সেই চার সুযোগই নয়, বিশ্বকাপজুড়ে আউট হবার আগে নিজেকে আউট করবার সুযোগ দিয়েছিলেন আরও আটবার, প্রতিপক্ষ ফিল্ডাররা পারেননি সুযোগগুলো কাজে লাগাতে। যার দরুন বিশ্বকাপে তিনি করেছেন ৬৪৮ রান, যা কি না থেমে যেতে পারতো ১৭৪ রানেই।
তবে সুযোগ তো অনেকেই পেয়েছেন। ক্রিস গেইলও তো সুযোগ পেয়েছিলেন সাতটি, কিন্তু নতুন জীবন কাজে লাগাতে পেরেছিলেন কোথায়! বিশ্বকাপে রান করেছিলেন, প্রথমবারেই আউট হলে এর চাইতে মাত্র ৮১ রানই কম করতেন।
আর রোহিত শর্মা পরে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগানোতে উপকৃত হয়েছে তার দল ভারত। এবারের বিশ্বকাপে ভাগ্য সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে ভারতকেই। এবার বিশ্বকাপে ভারতের ব্যাটসম্যানরা দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছেন ১৯ বার। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা যদি এই দ্বিতীয় সুযোগগুলো না পেতেন, ইএসপিএন ক্রিকইনফোর মতে, ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হতো ২০৫ রান পরিমাণ। আর কোনো দল পারেনি প্রাপ্ত সুযোগকে এতটা কাজে লাগাতে!
আর ভাগ্য ব্যাটসম্যানের পক্ষে কাজ করা মানেই তো বোলারের দুর্ভাগ্যের সূচনা। রোহিত শর্মা যে এবারের বিশ্বকাপের ‘সবচেয়ে লাকি ক্রিকেটার’ সে তো সর্বজনস্বীকৃতই। ভারত-পাকিস্তানের চিরবৈরিতা প্রমাণ করে, এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে ‘আনলাকি’ বোলারের নাম পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজ। কখনো আসিফ আলী তাকে বঞ্চিত করেছেন, কখনো বা আম্পায়ার তাকে নিরাশ করেছেন, এমন করে কমপক্ষে আটবার ভাগ্য প্রতারণা করেছে তার সঙ্গে।
বাংলাদেশের ম্যাচেও তো ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে এসেছিলো। ফিল্ডারদের ক্যাচ মিস, আম্পায়ার্স কল কিংবা রান আউট হতে হতে বেঁচে যাওয়া, কমপক্ষে ২২ বার ভাগ্য কথা বলেছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর অনুমান বলছে, এই সুযোগগুলো না এলে, বাংলাদেশের রান হতো আরও ১৪১ কম। কিন্তু, টুর্নামেন্ট শেষে দেখা যাচ্ছে, এই অতিরিক্ত রানগুলো যথেষ্ট হয়নি বাংলাদেশের জন্য। কেননা, যে ১৪ বার ভাগ্য কথা বলেছে বাংলাদেশের বিপক্ষে, ম্যাচের মোড় ঘুরে গিয়েছে ওখানেই!
যেমন গিয়েছিল ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে। ব্যক্তিগত ৮ রানে রোহিত শর্মা ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ তুলেছিলেন মোস্তাফিজের বলে, তামিম ইকবাল সেই ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ সুযোগ কেবল ফসকাতেই পেরেছিলেন! ইএসপিএন ক্রিকইনফোর স্কোর প্রেডিক্টর বলছে, তামিম ওই সহজতম সুযোগটি কাজে লাগাতে পারলে ভারত থেমে যেতে পারতো ২৬৭ রানেই, কিন্তু রোহিত শর্মার সেঞ্চুরিতে ভারত থেমেছিল ৩১৪ রানের পাহাড়ে। ২৬৭ রান বাংলাদেশ তাড়া করতে পারতো কি না, সে অবশ্য এখন আর জানবার উপায় নেই। তবে ৩১৪ রানের চাইতে ২৬৭ রান তাড়া করা যে সহজ কম্ম হতো, এ কথা বলতে তো দ্বিধা নেই।
আর ইএসপিএনের অনুমানকে যে অস্বীকার করবেন, সে উপায়টিও তো নেই। এমনিতেই, ভারতের ব্যাটিং লাইনআপকে প্রথম তিনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার দোষে দোষী করা হচ্ছে গত কয়েক বছরের পারফরম্যান্সে। এই বিশ্বকাপেও চলেছিল সে নিয়মেই, ভারতের মোট রানের ৬৭ শতাংশই এসেছে টপ থ্রির কাছ থেকে। ভারতের টপ অর্ডারকে পাঁচ রানের ভেতর প্যাভিলিয়নের পথ ধরিয়ে নিউ জিল্যান্ড তো খেলে ফেললো ফাইনালেই!
এমন গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তো বাংলাদেশ ফসকেছিলো আরও অনেকবারই। বিশ্বকাপে ডেভিড ওয়ার্নার জীবন পেয়েছিলেন মাত্র তিনবার, তাতেই যোগ করেছেন ২০৩ রান। এর মাঝে ১৫৭ রানই তো এসেছিলো বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে, দুবার সুযোগ পেয়ে। প্রথমে ৯ রানে পয়েন্টে ক্যাচ তুলেছিলেন, পরে রান আউট করবার সুযোগ দিয়েছিলেন শতক পূর্ণ করে। দুবারই সুযোগ এসেছিলো সাব্বির রহমানের কাছে, সাব্বির যা কাজে লাগাতে পারেননি কোনোবারই। টুর্নামেন্ট-শেষে বাংলাদেশের সদ্য সাবেক হওয়া কোচ স্টিভ রোডস তাই আক্ষেপভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ভাগ্য একটু পক্ষে থাকলে আমরাও সেমিফাইনালে খেলতাম!’
কিন্তু ব্যর্থতার সবটাই কি ভাগ্যের কাঁধে চাপানোর সুযোগ আছে? নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে মুশফিকের শিশুতোষ ভুল, ফিল্ডিং-মিসের তালিকায় আফগানিস্তানের পরপরই অবস্থান করা, এসব ব্যর্থতাকে তো ভাগ্যের দোহাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না কোনোমতেই।
আর টুর্নামেন্ট শেষে তো দেখা যাচ্ছে, গোটা টুর্নামেন্ট জুড়েই ভাগ্য সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করেছে নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে। সাথে সাথে এটাও অস্বীকার করবার উপায় নেই, বেশ কিছু ম্যাচ পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা অবস্থায় দিক বদলেছিলো নিউ জিল্যান্ডের পক্ষেই। মুশফিক কেন উইলিয়ামসনকে রান আউটের সহজ সুযোগ মিস করেছিলেন হাত দিয়ে স্ট্যাম্প ভেঙে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে ডি কক বুঝতেই পারেননি, তিনি কেন উইলিয়ামসনের ক্যাচ নিয়েছেন! তবে, ভাগ্যের এই দানগুলো লুফে নেবার জন্যও যে সক্ষমতা দরকার হয়, সে তো রোহিত শর্মা আর ক্রিস গেইলের পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত!
দিনশেষে, ‘সবটাই নিয়তির খেলা’ বলে কি এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে? সুযোগ তো সবার সামনেই এসেছিলো, কেউ কাজে লাগাতে পেরেছেন, কেউ পারেননি।
নিউ জিল্যান্ড তা পেরেছিলো, বাংলাদেশ পারেনি!