Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২০১২ সালের সিবি সিরিজ: একবিংশ শতাব্দীর সেরা ত্রিদেশীয় সিরিজ

বর্তমান সময়ে ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের বড় একটি অংশ জুড়ে থাকে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বছরের প্রায় পুরোটা সময়ে কোথাও না কোথাও কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ব্যবসাকেন্দ্রিক এই ক্রিকেট আসরগুলোর প্রচলন তো খুব বেশি দিন ধরে হয়নি, এর আগের ক্রিকেট ক্যালেন্ডার তবে কেমন ছিল? তখন কি ক্রিকেট ম্যাচ কম অনুষ্ঠিত হতো?

উল্টো করে ভাবলে এমনই মনে হবে, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচের সংখ্যা কমাতে হয়েছে। তখন ক্যালেন্ডারে পর্যাপ্ত সময় থাকায় বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সিরিজের দেখা মিলতো। বিশেষ করে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রচলন তখন খুব বেশি ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন বাইলজে অনুষ্ঠিত হতো এসব ত্রিদেশীয় সিরিজ।

এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বিচিত্র ও দীর্ঘতম ত্রিদেশীয় সিরিজ অনুষ্ঠিত হতো। মূলত ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ থেকেই সর্বপ্রথম ত্রিদেশীয় ক্রিকেট সিরিজের ধারণার সূত্রপাত ঘটে। প্যাকারের সেই বিপ্লব থেমে গেলেও তার সেই ত্রিদেশীয় সিরিজের ধারণা অজি ক্রিকেটে পাকাপোক্তভাবে স্থায়ী হয়ে যায়। ১৯৭৯ থেকে ২০০৮– এই দীর্ঘ সময়ে প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ার সাথে সফরকারী দুই দলকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ত্রিদেশীয় সিরিজ। ২০০৮ সালের পর এই সিরিজের ধারবাহিকতায় ছেদ পড়লেও ২০১২ সালে আবারো ফিরে আসে ত্রিদেশীয় সিরিজ, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে অনুষ্ঠেয় সেই কমনওয়েলথ ব্যাংক সিরিজ অনেকের মতে এই শতাব্দীর সেরা ত্রিদেশীয় সিরিজ।

কেন এই সিরিজকে শতাব্দীর সেরা ত্রিদেশীয় সিরিজ বলা হচ্ছে তা বুঝতে হলে ওই সিরিজের পুরো গল্পটা জানতে হবে। এই সিরিজ শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়ার সাথে টেস্ট ও টি-টুয়েন্টি সিরিজ খেলেছিল ভারত। টেস্টে ধবলধোলাই হলেও টি-টুয়েন্টিতে অজিদের বিপক্ষে সিরিজ ড্র করেছিল ভারত। ঘরের মাঠ ও তখনকার ফর্ম– সবমিলিয়ে ভারতের চেয়ে বেশ এগিয়েই ছিল অস্ট্রেলিয়া।  

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ হারার পর অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান দিলশান; Photo Credit: Duif du Toit / Gallo Images / Getty Images

লড়াইয়ের সমীকরণে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কা, সিরিজ শুরুর কিছুদিন আগেই দলের বাজে ফর্মের দায় নিয়ে অধিনায়ক হিসেবে পদত্যাগ করেছিলেন তিলকারত্নে দিলশান। পরীক্ষিত সেনা মাহেলা জয়াবর্ধনে নেতৃত্বে ফিরলেও শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিপক্ষে তাদের লড়াইয়ের সামর্থ্য নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন হচ্ছিল। তাই শ্রীলঙ্কাকে টপকে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া খুব সহজেই ফাইনালে উঠে যাবে– এমনটাই সবচেয়ে অনুমিত ফলাফল ছিল।

সিরিজের শুরুটাও ঠিক তেমন কিছুরই আভাস দিচ্ছিল, উদ্বোধনী ম্যাচে ডি/এল মেথডে ভারতকে ৬৫ রানে হারিয়ে বোনাস পয়েন্টসহ ম্যাচটি জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। পাঠকদের সুবিধার্থে বোনাস পয়েন্টের ব্যাপারটি পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার, এই আসরের নিয়ম অনুযায়ী জয়ী দলের রানরেট যদি বিজয়ী দলের রানরেটের চেয়ে ১.২৫ গুণ বেশি হয়, তবে তাদের মূল পয়েন্টের সাথে একটি বোনাস পয়েন্ট দেওয়ার নিয়ম ছিল।

প্রথম ম্যাচ বড় ব্যবধানে হারলেও পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে চার উইকেটে হারিয়ে সিরিজে বেশ ভালোভাবে ফিরে আসে ভারত। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেও হেরে বসে শ্রীলঙ্কা, অজিদের মাত্র ২৩১ রানে বেধে ফেললেও ম্যাচটি তারা হেরে বসে মাত্র পাঁচ রানে। অস্ট্রেলিয়ার টানা আধিপত্য এবং শ্রীলঙ্কাকে টপকে অজিদের সঙ্গী হিসেবে ফাইনালে ভারতের যাওয়া– প্রথম রাউন্ড শেষে এই অনুমিত ফলাফলটি বেশ ভালোভাবেই মিলে গেছিল। 

সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে অ্যাডিলেডে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। পিটার ফরেস্ট ও ডেভিড হাসির ফিফটিতে ভারতকে ২৭০ রানের চ্যালেঞ্জিং টার্গেট ছুঁড়ে দেয় অজিরা। জবাব দিতে নেমে গৌতম গম্ভীরের ৯২ রানের ইনিংসে ভর করে লড়াইয়ের ময়দানে বেশ ভালোভাবেই টিকে ছিল ভারত। খেলা গড়ায় শেষ ওভার পর্যন্ত, যেখানে জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন ছিল ১৩ রান। ক্লিন্ট ম্যাককেইর করা ওই ওভারের তৃতীয় বলে ছক্কা মেরে কাজ সহজ করে দেন ধোনী, শেষপর্যন্ত চার উইকেটে ম্যাচটি জিতে নিয়ে সিরিজে অজিদের প্রথম হারের স্বাদ দেয় ভারত। 

শেষ ওভারে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দলকে দারুণ জয় এনে দেন ধোনী; Photo Credit: Chris Hyde/Getty Images

সিরিজের পঞ্চম ম্যাচটিও অনুষ্ঠিত হয় অ্যাডিলেডে, লড়াইয়ে টিকে থাকতে ভারতের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দিনেশ চান্দিমালের ৮১ রানের ইনিংস সত্ত্বেও বাকিদের ব্যর্থতায় ২৩৬ রানের মাঝারি মানের পুঁজি পায় লঙ্কানরা। জবাব দিতে নেমে গৌতম গম্ভীরের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে জয়ের কক্ষপথেই ছিল ভারত। ব্যক্তিগত ৯১ রানে তিনি যখন আউট হন তখন ভারতের সামনে ৫৭ বলে ৪৮ রানের সহজ সমীকরণ, হাতে ছিল পাঁচ উইকেট। কিন্তু লঙ্কান বোলারদের দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে এই সহজ সমীকরণই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

শেষ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল নয় রান, হাতে ছিল দুই উইকেট। তবে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফিনিশার ধোনী ৫১ রানে অপরাজিত থাকায় ভারতের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার হয়ে শেষ ওভার করতে আসেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ডেথ বোলার মালিঙ্গা, সবমিলিয়ে স্বপ্নের এক দ্বৈরথ। সেই দ্বৈরথে মালিঙ্গার দাপটটাই ছিল স্পষ্ট, প্রথম পাঁচটি বল ইয়র্কার জোনে আঘাত হানায় বাউন্ডারি আদায় করতে ব্যর্থ ধোনি। 

তবে বোলিংয়ে অনবদ্য মালিঙ্গা ফিল্ডিংয়ে বেশ কয়েকবার গোল পাকালেন, ফলে বাউন্ডারি আদায় না করেও ওই পাঁচ বলে ঠিকই পাঁচ রান আদায় করে নেন ধোনী। শেষ বলের লড়াই, ভারতের দরকার চার রান। কিছুটা সেফ গেম খেলতে এবার স্ট্যাম্প বরাবর ইয়র্কার না মেরে ওয়াইড ইয়র্কার মারতে চাইলেন মালিঙ্গা, তবে এবার আর ব্লকহোলে লক্ষ্যভেদ হলো না। সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক্সট্রা কাভার অঞ্চলে সজোরে ব্যাট চালালেন ধোনী। শট দেখে মনে হচ্ছিল নিশ্চিত চার, কিন্তু সেনানায়েকের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে তা আর হয়নি। তবে বল যতক্ষণে ফিরে এসেছে, ততক্ষণে তিনবার জায়গা বদল করে ফেলেছেন ধোনী। সাড়ে সাত ঘণ্টার ধুন্ধুমার লড়াই শেষ হলো অমীমাংসিতভাবে

ম্যাচশেষে দুই দলের খেলোয়াড়েরা; Photo Credit: GREG WOOD/AFP via Getty Images

জেতার দারুণ সুযোগ পেয়েও এভাবে সেই জয় হাতছাড়া হওয়ায় ম্যাচ টাইয়ের পর লঙ্কান অধিনায়ক মাহেলাকে বেশ অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল। তাই পরের ম্যাচে জয় পেতে মরিয়া লঙ্কান কাপ্তান দলে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনলেন। থারাঙ্গাকে বাদ দিয়ে নিজেই চলে গেলেন ওপেনিং পজিশনে, আর ইংল্যান্ড থেকে উড়িয়ে আনলেন অলরাউন্ডার পারভেজ মাহরুফকে। দলে পরিবর্তন আনার তাৎক্ষণিক সুফল পায় লঙ্কানরা, সিডনিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নেয় লঙ্কানরা, রানরেট ভালো থাকায় বাড়তি পাওনা হিসেবে যোগ হয় বোনাস পয়েন্ট।

লঙ্কানদের বিপক্ষে এই বড় হারের শোধ ভারতের বিপক্ষে মেটায় অজিরা, ভারতকে ১১০ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজে নিজেদের তৃতীয় জয় তুলে নেয় অজিরা। বড় ব্যবধানে ম্যাচ হারার পাশাপাশি স্লো ওভার রেটের কারণে ধোনীর ১ ম্যাচ নিষিদ্ধ হওয়া ভারতের জন্য বড় ধাক্কা নিয়ে আসে। অধিনায়ককে ছাড়া লঙ্কানদের সাথে পরের ম্যাচে পেরে ওঠেনি ভারত, শ্রীলঙ্কা ম্যাচ জিতে নেয় ৫১ রানে।

হোবার্টে আসরের নবম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। পিটার ফরেস্টের দারুণ সেঞ্চুরি ও মাইকেল ক্লার্কের ৭২ রানে ভর করে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ২৮০ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় অজিরা। লক্ষ্যমাত্রা বড় হলেও তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং চালাতে থাকে লঙ্কানরা। মাহেলার ৮১ বলে ৮৫ ও চান্দিমালের ৮০ রানে জয়ের মজবুত ভিত পেয়ে যায় লঙ্কানরা। কিন্তু দ্রুত উইকেট হারিয়ে জয়ের রাস্তা কিছুটা কঠিন হয়ে যায় লঙ্কানদের। 

জয়ের পর উল্লসিত পেরেরা ও কুলাসেকারা; Photo Credit: WILLIAM WEST/AFP via Getty Images

তবে থিসারা পেরেরার ১১ বলে ২১ রানের দারুণ এক ক্যামিওতে ৩ উইকেটে ম্যাচটি জিতে নেয় লঙ্কানরা। এই জয়ের ফলে সিরিজ শুরুর পর প্রথমবারের মতো পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে উঠে যায় শ্রীলঙ্কা, তাদের ফাইনালে যাওয়ার পথটাও বেশ সহজ হয়ে যায়। অবশ্য পরের ম্যাচে ভারতকে ৮৭ রানে হারিয়ে নিজেদের শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি প্রথম দল হিসেবে ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলে অজিরা।

অন্যদিকে এই হারের পর ভারতের ফাইনালে ওঠার সমীকরণ হয়ে যায় অনেক জটিল। আশা বাঁচিয়ে রাখতে নিজেদের শেষম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে শুধু হারালেই হবে না, জিততে হবে বোনাস পয়েন্ট সহ। এমন কঠিন ম্যাচে হোবার্টে টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ধোনী। দিলশান ও সাঙ্গাকারার জোড়া সেঞ্চুরিতে ৩২০ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ দাঁড় করায় লঙ্কানরা। ফাইনালের আশা বাঁচিয়ে রাখতে হলে ৪০ ওভারের মধ্যে এই পাহাড় টপকানো ছাড়া ভারতের সামনে অন্য কোনো উপায় ছিল না।

এই অসম্ভব লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে শুরু থেকেই মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শেওয়াগ ও শচীন। মাত্র ৯.২ ওভারে ৮৬ রান তুললেও দুজনই সাজঘরে চলে গেলে ভারতের আশা আরো ক্ষীণ হয়ে যায়। তবে মঞ্চ যখন এক নতুন মহানায়কের আবির্ভাবের জন্য প্রস্তুত, তখন এসব সম্ভাবনার সমীকরণ কি আর ধোপে টিকে? মাত্র ৮৬ বলে ১৩৩ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে ৩৬.৪ ওভারে ভারতকে সাত উইকেটের জয় এনে দেন বিরাট কোহলি। বিশেষ করে মালিঙ্গার মতো জাঁদরেল বোলারকে তিনি যেভাবে বেধড়ক পিটুনি দেন, তাতে মাঠে উপস্থিত সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। 

অবিশ্বাস্য এক জয়ের পর কোহলির উচ্ছ্বাস; Photo Credit: Scott Barbour/Getty Images

এই অবিশ্বাস্য ম্যাচের পর ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয়ের পয়েন্ট দাঁড়ায় ১৫-তে। নেট রানরেটেও এগিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কা, কিন্তু আসরের বাইলজ অনুযায়ী দু’দলের পয়েন্ট সমান হলে সবার আগে দেখা হবে হেড-টু-হেড, যেখানে লঙ্কানদের বিপক্ষে এক হারের বিপরীতে দুই জয় নিয়ে এগিয়ে ছিল ভারত। ফলে ফাইনালে যেতে হলে নিজেদের শেষ ম্যাচে অজিদের বিপক্ষে অন্ততপক্ষে হার এড়াতে হতো লঙ্কানদের। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আগে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৭ রানে মাহেলা ও দিলশানকে হারিয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় লঙ্কানরা। সাঙ্গাকারা ও চান্দিমালের দারুণ জুটিতে বেশ ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কা। তবে এই দুজনের বিদায়ের পর ড্যান ক্রিশ্চিয়ানের হ্যাটট্রিকে ২৩৮ রানে লঙ্কানদের ইনিংস থেমে যায়।

মাঝারিমানের পুঁজি পেলেও মাত্র ২৬ রানে অজিদের তিন উইকেট তুলে নিয়ে লড়াই জমিয়ে তোলে শ্রীলঙ্কা। তবে ওয়াটসন ও মাইক হাসির জুটিতে খেলায় ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। এরই মাঝে শ্রীলঙ্কার দুই অলরাউন্ডার ম্যাথিউস ও পেরেরা ইনজুরিতে পড়লে মাহেলার হাতে বোলারের সংখ্যাও কমে যায়। সেই বিপদে ঘাবড়ে না গিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগান মাহেলা, দিলশানের হাতে বল না দিয়ে বোলিংয়ে নিয়ে আসেন থিরিমান্নেকে। মাহেলার এই ঝুঁকি কাজে লেগে যায়, মাইক হাসিকে ফিরিয়ে দিয়ে জুটি ভেঙে দেন থিরিমান্নে। 

এরপর ওয়াটসনকে দারুণ এক ইয়র্কারে ফেরান মালিঙ্গা, বাকি অজি ব্যাটসম্যানরাও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। কিন্তু একা লড়াই চালিয়ে যান ডেভিড হাসি, তার দারুণ ব্যাটিংয়ে শেষ দুই ওভারে দুই উইকেট হাতে নিয়ে অজিদের প্রয়োজন ছিল ১৪ রান। তবে ৪৯ তম ওভারে ডোহার্টিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মাত্র চার দেন মালিঙ্গা, ফলে শেষ ওভারে অজিদের প্রয়োজন ছিল ১০ রান। কুলাসেকারার ওই ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা মারতে চেয়েছিলেন হাসি, ব্যাটে-বলে ঠিকভাবে না হওয়ায় বল চলে যায় লং অফে দাঁড়িয়ে থাকা দিলশানের হাতে। বহু নাটকের পর ফাইনালের টিকিট পায় শ্রীলঙ্কা।  

ফাইনাল নিশ্চিতের পর উল্লসিত লঙ্কানরা; Photo Credit: WILLIAM WEST/AFP via Getty Images

বেস্ট অফ থ্রি ফাইনালস

অন্যান্য ত্রিদেশীয় সিরিজে একটি ফাইনাল ম্যাচ হলেও অস্ট্রেলিয়ান সামারে যেসব ত্রিদেশীয় সিরিজ হতো, সেগুলোয় তিনটি ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো। এই তিন ম্যাচের মধ্যে যে দল দুটি ম্যাচে জয়লাভ করতো, তারাই সিরিজ বিজয়ীর মুকুট জিতে নিতো। বেস্ট অফ থ্রি ফাইনালসের প্রথমটিতে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। দুই অলরাউন্ডার থিসারা পেরেরা ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে হারিয়ে শ্রীলঙ্কার দলীয় ভারসাম্য অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছিল। লঙ্কানদের এই দুর্বলতা সাথে ওয়ার্নারের ১৬৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ৩২১ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ দাঁড় করায় অস্ট্রেলিয়া।

জবাব দিতে নেমে শুরু থেকে রানরেটের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে শ্রীলঙ্কা। তবে পিঞ্চ হিটার হিসেবে খেলতে নামা নুয়ান কুলাসেকারার ৪৩ বলে ৭৩ রানের টর্নেডো ইনিংসে দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসে লঙ্কানরা। কুলাসেকারা ফিরে যাওয়ার পর প্রাসাদকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান থারাঙ্গা, তবে শেষরক্ষা হয়নি। ১৫ রানে জিতে সিরিজ জয়ের দিকে এগিয়ে যায় অজিরা। 

দিলশানের সেঞ্চুরিতে ম্লান হয়ে যায় ক্লার্ক-ওয়ার্নারের জোড়া শতক; Photo Credit: Mark Kolbe/Getty Images

দ্বিতীয় ফাইনালেও সেঞ্চুরি হাঁকান ওয়ার্নার, সাথে অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কও সেঞ্চুরি করায় আবারো বিশাল সংগ্রহের পথে ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ডেথ ওভারে লাসিথ মালিঙ্গার দুর্দান্ত বোলিংয়ে শেষ ৭ ওভারে আট উইকেট হাতে থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৩৯ রান সংগ্রহ করে অজিরা। ফলে তিন শতাধিক রানের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ২৭১ রানে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষ হয়। জবাব দিতে নেমে উদ্বোধনী জুটিতেই ১৭৯ রান তোলে শ্রীলঙ্কা। মাহেলা সেঞ্চুরি মিস করলেও দিলশানের সেঞ্চুরিতে আট উইকেটে ম্যাচ জিতে নিয়ে ফাইনালে সমতা ফেরায় শ্রীলঙ্কা। 

শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে টসে জিতে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে পাঠায় শ্রীলঙ্কা। ওয়ার্নার ও ওয়েডের ব্যাটে চড়ে ২১ ওভার শেষে মাত্র ১ উইকেটে ১১৫ রান তোলে অজিরা। তবে এরপর দ্রুত উইকেট হারিয়ে ছন্দপতন, একপর্যায়ে ১৭৭/৭ স্কোরকার্ড হওয়ার পর মনে হচ্ছিল অজিরা বুঝি লড়াই করার জন্য ন্যূনতম সংগ্রহটাও পাবে না। ক্লিন্ট ম্যাককেই ও ব্রেট লির দৃঢ়তায় শ্রীলঙ্কাকে ২৩২ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। 

ফাইনালে ব্যবধান গড়ে দেন ম্যাককেই; Photo Credit: Cameron Spencer/Getty Images

আগের দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কা যেভাবে ব্যাট চালিয়েছিল, তাতে মনে হচ্ছিল খুব সহজেই তারা এই লক্ষ্যমাত্রা টপকে যাবে। কিন্তু ম্যাককেইয়ের দারুণ বোলিংয়ে শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে লঙ্কানরা। একপ্রান্তে একা লড়ে যাচ্ছিলেন থারাঙ্গা। কিন্তু ৭১ রান করে তিনি আউট হয়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কার শেষ আশাটাও নিভে যায়। ১৬ রানে ম্যাচটি জিতে নিয়ে বহু নাটকের জন্ম দেওয়া সিবি সিরিজের শিরোপা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

ব্যাট হাতে ২৮ রান ও বল হাতে সমপরিমাণ রান দিয়ে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন ক্লিন্ট ম্যাককেই। তবে ফাইনাল হারলেও পুরো সিরিজ জুড়ে উপভোগ্য ক্রিকেট উপহার দেওয়ায় প্রশংসায় ভাসতে থাকে শ্রীলঙ্কা। আসরের সর্বোচ্চ ৫০৫ রান করে সিরিজসেরার পুরস্কার জেতেন শ্রীলঙ্কার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তিলকারত্নে দিলশান। 

সিরিজের সেরা খেলোয়াড় দিলশান; Photo Credit:  Mark Kolbe/Getty Images

এখন ত্রিদেশীয় সিরিজের সংখ্যা কমে গেলেও একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রচুর পরিমাণে সিরিজ হওয়ায় গত উনিশ বছরে অনুষ্ঠেয় ত্রিদেশীয় সিরিজের সংখ্যাটি কিন্তু নেহাত কম না। তবে অধিকাংশ ত্রিদেশীয় সিরিজে তৃতীয় দলের পারফরম্যান্স নিম্নগামী হওয়ায় বাকি দুই দল খুব সহজেই ফাইনালে উঠে গেছে। সেদিক থেকে ২০১২ সালের সিবি সিরিজ ছিল আলাদা। ফাইনালে ওঠা নিয়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে শেষদিকে যে নাটকীয়তা হয়েছে, তা ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল এক ঘটনা।

তাছাড়া দীর্ঘ সময়ে ধরে যেসব ত্রিদেশীয় সিরিজ অনুষ্ঠিত হতো, তার অধিকাংশ ম্যাচের ফলাফলই বেশ একপেশে হতো। এদিক থেকেও সিবি সিরিজ অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিল। ১৫টি ম্যাচের মধ্যে অল্প কিছু ম্যাচ বাদে প্রতিটি ম্যাচই ছিল উপভোগ্য। আর এক্ষেত্রে সিংহভাগ কৃতিত্বের ভাগিদার শ্রীলঙ্কা। পুরো সিরিজে এন্টারটেইনিং ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল দলটি।

এছাড়া এই সিরিজের মাধ্যমেই কিছু নতুন তারকা ক্রিকেটার উপহার পেয়েছিল ক্রিকেটবিশ্ব। সিরিজ শুরুর আগেই বিরাট কোহলির মোটামুটি নামডাক ছিল, তবে কোহলি যে ক্রিকেট বিশ্বের একচ্ছত্র সম্রাট হতে যাচ্ছেন তা হোবার্টের ঐ ইনিংসের মাধ্যমেই সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। দিনেশ চান্দিমালের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্টও ছিল এই সিরিজ।

শুরু করেছিলাম ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আগ্রাসন নিয়ে, শেষে এসেও একই কথা বলতে হচ্ছে। আজ আইসিসির এফটিপিতে আইপিএলের জন্য আলাদা জায়গা থাকলেও ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য কোনো জায়গা তাতে বরাদ্দ থাকে না। ফলে একসময়ে অস্ট্রেলিয়ান সামারের নিয়মিত আয়োজন আজ মোটামুটি বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। যেভাবে এগোচ্ছে তাতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ব্যাপারটাই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিলুপ্ত হোক বা না হোক – সিবি সিরিজের মতো অনবদ্য সব সিরিজ ত্রিদেশীয় সিরিজকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This article is in Bangla language. It's an analysis about a historcial tri-nations cricket series named as CB series 2012. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: Cameron Spencer/Getty Images

Related Articles