
চলতি মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই সম্ভবত ব্রেক্সিট কার্যকর হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণভাবে। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চের মধ্যে ব্রেক্সিটের কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে ব্রিটেন। অর্থাৎ আগামী এপ্রিলের আগেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। সন্দেহ নেই, যুক্তরাজ্যের আর্থ-সামাজিক পর্যায়ের সর্বস্তরেই ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বে কমবেশি। এই মুহূর্তে আমাদের প্রশ্ন, যুক্তরাজ্যের ফুটবলে ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বে কতখানি? প্রিমিয়ার লিগকে কতখানি বদলে দিবে ব্রেক্সিট? খেলোয়াড়দের দলবদলে প্রভাব কতখানি থাকবে ব্রেক্সিটের? প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর জন্য কি তরুণ প্রতিভা অন্বেষণ কঠিন হয়ে পড়বে? ব্রেক্সিটের ফলে কি ক্লাবগুলো দেশীয় প্রতিভার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে?

ব্রেক্সিট ও প্রিমিয়ার লিগ
২০১৬ সালের ২৩ জুন এক ঐতিহাসিক গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার রায় দেয় যুক্তরাজ্যের জনগণ। গণভোটের আগে প্রিমিয়ার লিগের ২০টি ক্লাবই ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কেননা, কমন সেন্স থেকেই সবাই আঁচ করতে পেরেছিল এই রক্ষণশীল নীতি কখনো প্রিমিয়ার লিগের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
প্রিমিয়ার লিগ চেয়ারম্যান রিচার্ড স্যদমোর গণভোটের পূর্বে এক সাক্ষাৎকারে ব্রেক্সিটের জন্য করা ক্যাম্পেইনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং এই গণভোটের ফলাফল ব্রিটিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলেও কড়া হুশিয়ারি দিয়েছিলেন।
দুই বছর বাদে এখন স্যদমোর এবং প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে। আমরা এখনো ঠিক জানি না ব্রেক্সিট প্রিমিয়ার লিগকে কতখানি প্রভাবিত করবে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারণা করা যায়, ব্রেক্সিট প্রিমিয়ার লিগকে কতখানি বদলে দেবে।
ওয়ার্ক পারমিট: দলবদল-কেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা
ইইউ-ভুক্ত দেশগুলোর ফুটবলাররা ‘ফ্রিডম অব মুভমেন্ট’ নীতির আওতায় ইংল্যান্ডে খেলার সুযোগ পায় কোনো ঝুট ঝামেলা ছাড়াই। ইইউ বহির্ভূত দেশগুলোর ফুটবলারদের এক্ষেত্রে মেরিট নির্ভর ‘ওয়ার্ক পারমিট’ নিতে হয়। বিষয়টি অনেকটা এরকম, যুক্তরাজ্যের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ইইউ বহির্ভূত কোনো দেশ থেকে কর্মচারী নিয়োগ করতে চায়, তাহলে সেই কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হবে। তবেই মিলবে ওয়ার্ক পারমিট। ফুটবলের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার শর্ত হচ্ছে, একজন ফুটবলারের অবশ্যই জাতীয় দলের হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ম্যাচ খেলতে হবে ক্লাবে যোগ দেয়ার আগের দুই বছরে। ফুটবলারের জাতীয় দলের ফিফা র্যাংকিং যত নিচে থাকবে তার বাধ্যমূলক ম্যাচের সংখ্যা তত বাড়বে। এই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও ক্লাবগুলো ফুটবলার সাইন করাতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমলে আসবে ট্রান্সফার ফি, বেতন।

ব্রেক্সিটের পর ইইউ-ভুক্ত দেশগুলোর ফুটবলারদেরও ওয়ার্ক পারমিট লাগবে প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য। যার মানে হচ্ছে যুক্তরাজ্যের বাইরের যেকোনো ফুটবলারের জন্য প্রিমিয়ার লিগে প্রবেশ কঠিন হয়ে যাবে। এই নিয়ম থাকলে এখন হয়তো প্রিমিয়ার লিগে খেলতে পারতেন না এনগোলো কান্তে, ডেভিড ডি হেয়ার মতো ফুটবলাররা। কেননা যখন তারা প্রিমিয়ার লিগে প্রবেশ করেছেন তখন তারা বলতে গেলে জাতীয় দলের হয়ে খেলাই শুরু করেননি। এছাড়া তাদের ট্রান্সফার ফি-ও ছিল নগণ্য। ২০১৬ সালে বিবিসির প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নশিপ আর স্কটিশ প্রিমিয়ারশিপের মোট ৩৩২ জন ফুটবলার এই নীতিতে ওয়ার্ক পারমিট হারাবেন।
এই নীতি বলবত থাকলে বড় ক্লাবগুলোর সাথে ছোট ক্লাবগুলোর ব্যবধান আরও বাড়বে। কেননা, স্বয়ংক্রিয় ওয়ার্ক পারমিট না পেলে বড় ক্লাবগুলো তাদের পছন্দের প্লেয়ার আনতে অতিরিক্ত খরচ করবে, যেটা করার সামর্থ্য থাকবে না ছোট ক্লাবগুলোর।
তবে ফুটবলের ক্ষেত্রে এই ওয়ার্ক পারমিট নীতি সরকার পরিবর্তনও করতে পারে। কেননা, এই নীতি প্রিমিয়ার লিগের সৌন্দর্য চিরতরে নষ্ট করবে। সেক্ষেত্রে সরকার যা করতে পারে তা হচ্ছে ফুটবলের ক্ষেত্রে ওয়ার্ক পারমিট নীতি শিথিল করা বা একেবারে বিলোপ করে দেয়া। সেটা করলে ছোট ক্লাবগুলো অনেক লাভবান হবে। তখন তারা ইউরোপের বাইরেও ট্যালেন্ট হান্ট করতে পারবে। এখন স্টোক সিটি চাইলেই পেরুর এক উদীয়মান প্রতিভাকে দলে আনতে পারবে না। ওয়ার্ক পারমিট নীতি শিথিল করা হলে তারা তাদের স্কাউটিং রেঞ্জ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারবে।
তরুণ প্রতিভা অন্বেষণে প্রতিবন্ধকতা
ব্রেক্সিটের ফলে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো ১৮ বছরের কম বয়সী ফুটবলার কিনতে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে। অল্প বয়সীদের সুরক্ষা আইনে ফিফা শুধুমাত্র ইইউ-ভুক্ত দেশগুলোর ক্লাবদের মধ্যে ১৬-১৮ বয়সীদের দলবদল করার অনুমতি দেয়। ব্রেক্সিট কার্যকর হলে ইংল্যান্ড ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। যার মানে ক্লাবগুলো আর দেশের বাইরের ইয়ুথ একাডেমিগুলো থেকে প্লেয়ার আনতে পারবে না। ফলে পরবর্তী সেস্ক ফ্যাব্রিগাস আর বার্সার ইয়ুথ একাডেমি থেকে আর্সেনালে যোগ দিতে পারবেন না।

ইংল্যান্ড ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফুটবল এসোসিয়েশন (এফএ) অবশ্য চাচ্ছে বাইরের তরুণদের শূন্যস্থান পূরণ করুক দেশীয় প্রতিভারা। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ক্লাবের ২৫ জনের স্কোয়াডে অন্তত ৮ জন দেশী ফুটবলার থাকতে হবে। সম্প্রতি তারা এই সংখ্যাটিকে ১২-তে আনার আবেদন জানিয়েছে। সেটা করা হলে ক্লাবগুলোতে বিদেশী ফুটবলারের সংখ্যা ১৭ থেকে ১৩-তে নেমে যাবে। এই পরিকল্পনায় রাজি হলে তারা ওয়ার্ক পারমিট নীতি শিথিল করারও ঘোষণা দেয়। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ এই পরিকল্পনাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রিমিয়ার লিগে বিদেশী ফুটবলারদের উপস্থিতি কমিয়ে এনে স্থানীয়দের বেশি সুযোগ দেয়া। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ বলছে, এই পরিকল্পনা হিতে বিপরীত হতে পারে। তাদের মতে, বিদেশী তারকার সংখ্যা কমে গেলে প্রিমিয়ার লিগ তার মান হারাবে এবং তা কখনোই দেশের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক না।
অনূর্ধ্ব ১৭ ও অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ ফুটবলে ইংল্যান্ড বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। আর সদ্য শেষ হওয়া ফিফা বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ড সেমিফাইনালিস্ট, যা প্রমাণ করে চলমান সিস্টেমই ইংল্যান্ড ফুটবলকে সেরা ফলাফলটা দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
ব্রেক্সিটের অর্থনৈতিক প্রভাব ইতোমধ্যে ভালোভাবেই পড়েছে যুক্তরাজ্যজুড়ে। প্রভাব পড়েছে ফুটবলেও। পাউন্ডের দরপতনের ফলে ক্লাবগুলোর জন্য নতুন প্লেয়ার সাইন করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ট্রান্সফার ফি, প্লেয়ারদের বেতন থেকে শুরু করে সব দিক থেকেই ক্লাবগুলোর খরচ বেড়ে গিয়েছে। টটেনহাম ম্যানেজার মরিসিও পচেতিনো গত গ্রীষ্মে কোনো প্লেয়ার সাইন না করানোর একটি কারণ হিসেবে ব্রেক্সিটকে দায়ী করেছিলেন।

যুক্তরাজ্যের প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো ফুটবল ক্লাবগুলোর জন্যও ব্রেক্সিট এক দুঃস্বপ্নের নাম। এই দুঃস্বপ্নের সাথেই অভিযোজন করে নিচ্ছে যুক্তরাজ্য। অভিযোজিত হতে হবে প্রিমিয়ার লিগকেও। থেরেসা মে যখন ব্রাসেলসে ইইউ-এর সাথে বিচ্ছেদ চুক্তি করতে ব্যস্ত, তখন ফুটবল এসোসিয়েশনও সরকারের সাথে ব্রেক্সিট পরবর্তী ফুটবল পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। এটা সত্য যে, ইইউ-বিচ্ছেদ চুক্তিতে ফুটবল বিষয়ক কোনো পরিকল্পনা না থাকলে তা প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বড় ও ছোট ক্লাবগুলোর মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাবে। তারকা ফুটবলারদের প্রিমিয়ার লিগে আসাও কমে যাবে। বিশ্বের সেরা লিগের তকমাটাও হারিয়ে বসতে পারে প্রিমিয়ার লিগ।
তবে আশার কথা হচ্ছে, প্রিমিয়ার লিগ ও ফুটবল এসোসিয়েশন একসাথে মিলে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে কীভাবে প্রিমিয়ার লিগকে ব্রেক্সিটের প্রভাবমুক্ত রাখা যায়। নিজেদের স্বার্থেই তারা চায় না প্রিমিয়ার লিগের সৌন্দর্য নষ্ট হোক। সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তরাও চাইবে যেন প্রিমিয়ার লিগের সৌন্দর্য নষ্ট না হয়।