Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টিম পেইন: সিংহাসনে রূপকথার রাজা

‘ডেসিগনেটেড সারভাইভার’ নামে একটা টেলিভিশন সিরিজ আছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটা রাষ্ট্রের গল্প বলা হয়েছে। এক রাতে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণে মারা যান সেই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য সবাই। একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে বেঁচে থাকেন টম কির্কম্যান নামে এক কর্মকর্তা। তাকে ডেকে বলা হয়, কাল থেকে তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্ট!

ব্যস, শুরু হয় গল্প।

টিম পেইনকে চাইলে টম কির্কম্যানের মতো প্রেসিডেন্ট বলতে পারেন। কয়েকদিন আগেও যিনি কোনো আলোচনাতেই ছিলেন না, সেই টিম পেইন এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেট দলটির অধিনায়ক। এ যেন রূপকথার চেয়েও বেশি কিছু।

হঠাৎ করেই সিংহাসনে বসা রূপকথার এক রাজা টিম পেইন।

পাঁচ মাস আগেও জাতীয় দলের আশেপাশে ছিলেন না, ছিলেন না নিজের প্রাদেশিক দলেও। ইনজুরিতে জর্জরিত হতে হতে ক্রিকেট জীবন নিয়ে বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিলো তার। ঠিক করেছিলেন, এবার সবকিছু ছেড়ে দেবেন। ক্রিকেট ছেড়ে খেলার সরঞ্জাম তৈরির প্রতিষ্ঠান কোকাবুরাতে চাকরিও ঠিক করে ফেলেছিলেন। তারপর একবার শেষ চেষ্টা করতে এসেছিলেন মাঠে।

সেখানেও খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তখনই বিস্ময়কর ভাবে পেইনকে অ্যাশেজ দলে ডাকা হয়। আর এর পাঁচ মাস পর পেইন হয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়ক। রূপকথা নয় তো কী!

টিম পেইনের সারাটা জীবনই অবশ্য গল্পের মতো।

সদা হাস্যময় টিম পেইন; সোর্স: Sporing news

হোবার্টে এক নির্জন রাস্তার ধারে বাড়িতে জন্ম তার। বাড়ির পাশেই সমুদ্র সৈকত। চাচা রবার্ট শ ছিলেন এএফএল খেলোয়াড় ও কোচ। বাকি চাচাতো ভাইয়েরা ছিলো তার চেয়ে বড় ও শক্তিশালী। তাদের সাথে সৈকতে গিয়ে কখনো বিচ ক্রিকেট, কখনো অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল খেলতে হতো পেইনকে। সেই সাথে বাড়ির পেছনের উঠোনে পড়ে থাকা ট্রাকটাকে টানাটানি করতে হতো; কারণ ওই ট্রাকটাকে পিচ্চিরা ব্যবহার করতো উইকেট রোলার হিসেবে!

এই করতে করতে বয়স মোটামুটি দশ পার হতে না হতেই পেইন হয়ে উঠলো ১৫-১৬ বছর বয়সীদের বন্ধুস্থানীয়। কম বয়সে ‘বড়’ হয়ে যাওয়ার এই ব্যাপারটা দিয়ে পেইন রীতিমতো রেকর্ড করে ফেললেন।

বয়স ১৫ পার হতে না হতে তাসমানিয়ার অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলে ফেললেন। তাসমানিয়ার অনুর্ধ্ব-১৫ ও অনুর্ধ্ব-১৭ দলে অধিনায়কত্ব করলেন। বয়স ১৬ হতেই একটা রেকর্ড করে ফেললেন পেইন। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসেবে তাসমানিয়ার প্রাদেশিক ক্রিকেট সংস্থার সাথে চুক্তি করে ফেললেন। তাকে চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার করতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ অনুমতি লেগেছিলো।

তাসমানিয়ার প্রাদেশিক বয়সভিত্তিক দলে অধিনায়কত্ব করার এই অভিজ্ঞতা পেইনকে আরেকটু বড় স্তরে পেইনকে অধিনায়কত্ব করার সুযোগ এনে দিলো। ২০০৪ সালে তাকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক করে পাঠানো হলো।

এটা বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাকাডেমির এই সাবেক ছাত্রকে তখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ‘ভবিষ্যত অধিনায়ক’ হিসেবে দেখছিলো। সেই দেখা স্বপ্নটা এভাবে পূরণ হবে, তা অবশ্য কেউ কল্পনা করেনি।

সেই স্টিভ স্মিথেরই সাথে; Source: গেটি ইমেজ

২০০৫ সালে তাসমানিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ও লিস্ট-এ ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় পেইনের। অভিষেকটা হয়েছিলো অবশ্য বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে। স্পেশালিস্ট ওপেনার হিসেবে শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি তার। প্রথম শ্রেণীর অভিষেক ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন।

২০০৭ সালে এসে দলের স্থায়ী উইকেটরক্ষক হওয়ার আগে পেইন ছিলেন তাসমানিয়ার উইকেটরক্ষক হিসেবে দ্বিতীয় পছন্দ। তখন তাসমানিয়ায় এই দায়িত্ব পালন করতেন শেন ক্লিংগ্লেফার। ২০০৬-০৭ সালে তাসমানিয়ার হয়ে একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন পেইন।

২০০৯ সালে অ্যাশেজের পর অস্ট্রেলিয়ার নিয়মিত উইকেটরক্ষক ব্র্যাড হাডিন ইনজুরিতে পড়ে দেশে ফিরে আসেন। ওয়ানডে সিরিজের জন্য ডেকে পাঠানো হয় পেইনকে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে পেইনের ওয়ানডে অভিষেকও হয়ে যায়। এরপর ভারত সফরের দলেও ছিলেন তিনি। কিন্তু নাগপুরে অনুষ্ঠিত ওয়ানডেতে ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙুল ভেঙে যায় তার। আর এখান থেকেই শুরু পেইনের ইনজুরির সাথে বন্ধুত্ব।

ইনজুরি থেকে ফেরার পর ২০০৯-১০ মৌসুমে তাসমানিয়ার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন আবার পেইন। ২০১০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলেছিলো অস্ট্রেলিয়া। সেই টেস্টের আগে নিয়মিত উইকেটরক্ষক হাডিন সুস্থ হয়ে উঠতে না পারায় আবার ডাক পড়ে পেইনের। লর্ডসে পেইনের টেস্ট অভিষেক হয়ে যায়। এরপর ভারত সফরেও হাডিন সুস্থ হয়ে উঠতে না পারায় দায়িত্ব পালন করেন পেইন।

ব্যাট হাতে টেস্টে তেমন কিছু করতে না পারলেও উইকেটের পেছনে নিজেকে অসাধারণ বলে প্রমাণ করেন। এই সময় অস্ট্রেলিয়াতে আবার ‘ভবিষ্যত অধিনায়ক’ হিসেবে পেইনকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রিকি পন্টিং চলে গেলে মাইকেল ক্লার্ক নয়, পেইনকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত, এমন আলোচনাও জন্ম নেয়। এক্ষেত্রে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে পেইনের অভিজ্ঞতাকে অনেকে এগিয়ে রাখছিলেন।

মাঠে ব্যস্ত সময়; Source: গেটি ইমেজ

বিশেষ করে স্টিভ ওয়াহ তাকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন। স্টিভ সে সময় বলেছিলেন,

মাইকেল ক্লার্ককে এজন্য (অধিনায়কত্বের জন্য) তৈরী করা হয়েছে, এটা সত্যি। সে ভালোও করছে। কিন্তু মাইকেল ক্লার্ককে নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, দলে অন্তত আরও চারজন আছে, যারা অধিনায়কত্ব করতে পারে। তাদের সম্পর্কে লোকেরা জানে না, কারণ তাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। হাডিনেরও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু আমি যে ছেলেটার কথা ভাবছি, সে খুব রোমাঞ্চকর হতে পারে, সেটা হলো টিম পেইন। ওকে নানা কারণেই আমার পছন্দ।

পেইন নিজেও সে সময় মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন এসব কথাবার্তা। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “যোগ্য একজন মানুষের কাছ থেকে নিজের নাম শুনতে পাওয়াটা অসাধারণ একটা অনুভূতি। আমার মনে হয়, এর মানে হলো, আমি কিছুটা হলেও নেতৃত্বগুণ দেখাতে পেরেছি।

পেইনের তখন আকাশে ওড়ার সময়।

কিন্তু পৃথিবীটা এমনই জায়গা যে, আকাশ থেকে ধপ করে পড়ে যেতেও সময় লাগে না। তাই হলো। ২০১১ সালে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে গিয়ে আবার আঙুলের ইনজুরিতে পড়লেন পেইন। এবার এই আঙুলের ইনজুরি যেন শেষই করে দিলো তাকে। সাত সাতবার অপারেশন হলো। তবু কিছুতেই সেরে ওঠে না আঙুলটা। আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেলো জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন।

পেইন তখন যেকোনো স্তরে কিছু ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেলেই বাঁচেন। সীমিত ওভারের কিছু ক্রিকেট পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ততদিনে ব্রাত্য হয়ে গেছেন। জাতীয় দলের স্বপ্ন অনেক আগেই বাদ দিয়েছেন। দশ বছর হলো, জাতীয় দলে নেই। এখন প্রথম শ্রেণীর দলে ফেরার স্বপ্নটাই ছিলো তার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।

অধিনায়ক হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে; Source: Reuters

সুযোগ না পেতে পেতে হতাশ পেইন ক্রিকেট ছাড়ার চিন্তা শুরু করে দিলেন। কোকাবুরার সাথে আলাপ করে ফেললেন যে, ক্রিকেট ছেড়ে তাদের চাকরি করবেন। তারপরও একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন তাসমানিয়ার হয়ে মাঠে ফেরার।

এই সময় স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়ে এলো জাতীয় দলের ডাক!

তা-ও আবার অ্যাশেজ দলে। ম্যাথু ওয়েডের সময়টা ভালো যাচ্ছিলো না। এজন্য অ্যাশেজের দলে দশ বছর পর ডেকে পাঠানো হলো পেইনকে। তাকে নিয়ে তখন বিতর্কও কম হয়নি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রান বলতে তেমন নেই। সর্বশেষ এবং একমাত্র প্রথম শ্রেণীর সেঞ্চুরিটা করেছেন সেই ২০০৬ সালে; কোচ লেহম্যানেরও এরপর সেঞ্চুরি আছে। এই রানহীনতা ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের বাইরে থাকাকে বিরুদ্ধপক্ষ যুক্তি বানালো। কিন্তু নির্বাচকরা পেইনের ওপরই আস্থা রাখলেন। অ্যাশেজের পর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দলেও টিকে গেলেন।

এই অবধি যা হলো, সেটাকে স্বপ্নযাত্রা বলা যায়।

তারপর?

তারপর স্টিভেন স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার জড়িয়ে পড়লেন বল টেম্পারিং বিতর্কে। সেই রূপকথার মতো কেপ টাউন টেস্টের মাঝপথে পেইনকে ডেকে বলা হলো, কাল সকাল থেকে তুমি অধিনায়ক।

কে বলে, জীবন সিনেমা নয়। জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়।

Related Articles