যেখানে যখন গেছেন, সেখানে তখন ঝাঁকে ঝাঁকে তৈরি করেছেন বন্ধু। এই একটা ব্যাপারে মাশরাফির জুড়ি মেলা ভার। সব জায়গাতেই তার অনেক বন্ধু। এর মধ্যেই বাছাই করা কয়েকজন ক্রিকেটীয় বন্ধু ও সতীর্থ কথা বলেছেন মাশরাফিকে নিয়ে, করেছেন কিছু স্মৃতিচারণ। ক্রিকইনফো থেকে সেই স্মৃতি তুলে দেওয়া হলো।
তামিম ইকবাল
ওপেনার, বাংলাদেশ জাতীয় দল
২০১৫ বিশ্বকাপের সময় আমার অবস্থা সত্যিই খারাপ ছিল। আমাকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো। ওই সময় আমাকে দল থেকে বাদ দেওয়া বা আমাকে ভুলে যাওয়াটা খুব সোজা ছিল। কিন্তু উনি (মাশরাফি) যেভাবে আমার খেয়াল রেখেছেন, সেটা অবিশ্বাস্য। উনি আমাকে অনেক সময় দিয়েছেন, ক্রিকেটের বাইরে সবকিছু নিয়ে আলাপ করেছেন। উনি আমার সাথে রসিকতা করতেন। আমি বুঝতে পারতাম যে, এইসব ঝামেলা থেকে আমার মন সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সত্যিই আমি শেষ অবধি ওই সবকিছু ভুলতে পেরেছিলাম।
প্রতিটা টিম মিটিংয়ে উনি শুরু করতেন এই বলে যে, ‘তামিম আমাদের মূল খেলোয়াড় হতে যাচ্ছে।’ আমি যখন তাকে এই কথা বলতে শুনতাম, সেটা আমাকে ইতিবাচক একটা মানসিকতা দিতো। উনি টুর্নামেন্টজুড়েই এটা করে গেছেন। আমি হয়তো তার চেয়ে ভালো অধিনায়কের অধীনে খেলেছি, কিন্তু আমি খুবই সন্দেহ করি আর কেউ কখনও মাশরাফি ভাইয়ের চেয়ে আমার ভালো দেখভাল করবে কি না।
ব্রেন্ডন টেলর
সাবেক জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক
২০০৬ সালে ৫ ম্যাচ সিরিজে আমাদের দুই দলের তখন ১-১ সমতা। ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সেই ম্যাচে আমরা ২৩৭ রান তাড়া করছিলাম।
আমার মনে আছে, শাহাদাত হোসেন হ্যাটট্রিক করলো এবং আমরা প্রচণ্ড চাপে ছিলাম। ম্যাশ শুরুর দিকে এবং ডেথ ওভারে বেশ কিছু সাফল্য পেলো। আমাদের শেষ ওভারে ১৭ রান দরকার ছিল। ও যখন একটা ফুলটস করলো, আমি ছক্কা মেরে দিলাম। আমি বুঝলাম, এখন ও চাপে আছে। কিন্তু ওর চরিত্র জানতাম… আমি জানতাম, ও শক্তভাবে ফিরে আসবে।
শেষ বলে আমাদের পাঁচ রান দরকার ছিল। আমি সেই বলে ছক্কা মেরে দলের জয় নিশ্চিত করলাম। এরপর ও যে টি-শার্ট মাথার ওপর তুলে অবিশ্বাসের সাথে মুখটা ঢেকে ফেললো, সেই দৃশ্য আমি কখনও ভুলতে পারবো না।
একটা জিনিস নিশ্চিত যে, ও এই সবকিছুই পেছনে ফেলতে পেরেছিলো। এরপর আমরা যখন কয়েক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশে সফরে এলাম, ও আমাদের জীবন কঠিন করে তুলেছিলো। আর ওর মানসিক শক্তিই ওকে এরকম সফল করে তুলেছে। আমরা সবসময় পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি এবং নিজেদের মধ্যে দারুণ একটা বন্ধুত্ব রক্ষা করি।
মাহমুদউল্লাহ
বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়
মাশরাফি ভাইয়ের অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সফর, ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাওয়ার পথের ঘটনা। উনি আমার হাতে বিমানবন্দরে বসে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এটা পরে পড়িস।’
আমি বিমানে উঠলাম এবং খামটা খুললাম। ওই দিন যে চিঠিটা আমি পড়েছিলাম, ওটা আমার আজও মনে আছে। উনি আমার ব্যাপারে খুবই অনুপ্রেরণাদায়ী কিছু কথা লিখেছিলেন। পড়ে মনে হয়েছিলো, উনি এটা লিখতে অনেকটা সময় নিয়েছেন। অনেক ব্যক্তিগত ছোঁয়া দিয়ে লিখেছেন চিঠিটা।
উনি একজন অসাধারণ মানুষ, আমাদের দলকে নতুন একটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উনি একজন বড় ভাইয়ের মতো, একজন বন্ধু। আমি প্রার্থনা করি, উনি যেন বাংলাদেশকে আরও অনেক সাফল্য এনে দেন এবং বাংলাদেশের হয়ে আরও অনেক দিন খেলেন।
হাবিবুল বাশার
সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক
আমি সবসময় মাশরাফিকে ‘খ্যাপাটে’ এক প্রতিভা এবং খুব নিবেদিত একজন মানুষ হিসেবে পেয়েছি। এমন অনেক সময় এসেছে, যখন সে আনফিট ছিল। কিন্তু যেকোনো উপায়ে নিজেকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে শেষ অবধি দারুণ পারফর্ম করেছে।
অ্যান্টিগাতে এই ঘটনাটা ঘটেছিলো। আমরা যখন ২০০৭ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, পিঠের ব্যথায় ওকে বাড়ি ফেরত পাঠানো হচ্ছিলো প্রায়। ফিজিও ওকে কয়েকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু মাশরাফির ক্ষেত্রে আপনাকে শেষ দিন অবধি অপেক্ষা করতে হবে। আমরা একদিন বেড়াতে বের হলাম, মনে হলো ওর একটু উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পরেরদিন সবাই ভাবলো, ওকে আজই ফেরত যেতে হবে। আর সেই দিনই সে নেটে এসে হাজির হলো। আর আমিই সেই দুর্ভাগা লোক, যাকে ওর সেই ভয়ানক বোলিং নেটে সামলাতে হয়েছিলো। সে সত্যিই গতিসম্পন্ন ছিল সেদিন।
শেন জার্গেনসেন
সাবেক বাংলাদেশ কোচ
২০১২ সালে আমরা তখন আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলছিলাম। মাশরাফি তখন মাত্রই একটা ইনজুরি থেকে ফিরেছে। প্রথম কয়েকটা ও বল করতে একটু সংগ্রাম করছিলো। ফলে এ নিয়ে মানসিকভাবে ও একটা খারাপ অবস্থায় ছিল।
পরের ম্যাচের আগের ডিনারে আমরা অনেক কিছু নিয়ে কথা বললাম। আমার মনে আছে, ওখান থেকে বাসে ফেরার পথে ও নিজের অনেকগুলো অস্ত্রোপচার নিয়ে কথা বললো। এর অধিকাংশই হাসপাতালে কোনো সহায়তা ছাড়াই হয়েছে এবং এরপর পুনর্বাসন। আমি ওর গল্প শুনে অবাক হয়ে গেলাম। সে সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ী একজন মানুষ। আপনি তাকে বলতে পারেন গভীর চিন্তাশীল, স্মার্ট এবং মারাত্মক নিবেদিত একজন খেলোয়াড়।
পরের দিন, তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে সে কয়েকটা ছক্কা মারলো এবং চাপের মুখে খুব ভালো বোলিং করলো। ডেথ ওভারে দারুণ বোলিং করে ম্যাচ কাছে নিয়ে এলো। আর ওর সব নিজেকে নিয়ে সন্দেহ জানালা দিয়ে উড়ে গেলো। ও ড্রেসিংরুমে ফিরলো এবং আমাকে হাই ফাইভ দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
সে সবসময় বলতো, ‘বোলিং শেন।’ আমিও জবাব দিতাম, ‘বোলিং ম্যাশ।’
আমরা যা করতাম, তার একটা খণ্ডাংশমাত্র এটা।
শাহরিয়ার নাফীস
সাবেক বাংলাদেশী ওপেনার
আমি ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ থেকে ফিরে এলাম। যখন খবর এলো যে, তামিম ইকবালকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে পাওয়া যাবে না। আমাকে জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্পে ডাকা হলো। মাশরাফি ভাই তখন অধিনায়ক হিসেবে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে একদিন উনি আমাকে ড্রেসিংরুমে ডাকলেন; তখন আশেপাশে কেউ ছিল না। উনি আমাকে বললেন, উনি আমার ব্যাপারে নির্বাচকদের সাথে আলাপ করেছেন এবং আমাকে দলে চান। উনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।’
আমি এটা ব্যাখ্যা করতে পারবো না যে, এই কথাটা আমাকে কতখানি অনুপ্রাণিত করেছিলো। আমি নির্বাচিত হলাম এবং ওই সিরিজে মোটামুটি ভালোই করেছিলাম। মাশরাফি ভাই খেলোয়াড়দের সাথে এটাই করে। সে অনেক উপায়ে খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করতে পারে।
খালেদ মাহমুদ
সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক
পনেরো বছর আগে (আঠারো বছর) আমরা ভারতে গিয়েছিলাম ‘এ’ দলের সফরে। সেটা ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজের ঠিক আগে; যে সিরিজে মাশরাফির টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো।
ক্রিকেট ক্লাব অব মুম্বাইয়ের ব্যালকনিতে আমাদের রাতের খাওয়া চলছিলো। তখন ক্লাবের সভাপতি রাজ সিং দুঙ্গারপুর এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, দলের অধিনায়ক কে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওনার সাথে হাত মেলালাম। উনি বললেন, ‘প্লিজ আগামীকাল ভালো খেলো। বাজেভাবে হেরো না।’
মাশরাফি তখন একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, উনি কী বলেছেন এবং আমি বললাম। আমার মনে হয় দুঙ্গারপুরের কথা ওইদিন আমাদের খুব উপকার করেছিলো। মাশরাফি সেদিন সত্যিই খুব জোরে বল করেছিলো এবং তিন উইকেট নিয়েছিলো। আমি তাসকিনকে বল করতে দেখেছি, কিন্তু তখনকার দিনে মাশরাফি ছিল সত্যিকারের দ্রুতগতির বোলার। ওইদিনই মাশরাফি দেখিয়ে দিয়েছিলো, সে বাংলাদেশের জন্য কত ভালো হতে যাচ্ছে।
আব্দুর রাজ্জাক
মাশরাফির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক জাতীয় দলের তারকা
আমরা জীবনের লম্বা একটা সময় ধরে পরস্পরকে জানি এবং লম্বা সময় একসাথে বোলিং করেছি। তবে লোকেরা যেটা জানে না, আমাদের কিছু ৫০ রানের জুটিও আছে।
একবার কেনিয়াতে ১৮৫ রান তাড়া করতে গিয়ে আমরা খুব চাপে ছিলাম। তখনও আমাদের জয়ের জন্য আরও ৫০ রান দরকার ছিল, সেই সময় আমি উইকেটে গেলাম। দুই উইকেট হাতে ছিল আর। কেউই বিশ্বাস করেনি যে, আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। আমরা যেটা করেছি, পরস্পরকে স্রেফ বলেছি, শেষ অবধি উইকেটে থাকতে হবে। আমরা সেটা করেছি। আমরা ৫১ রানের একটা জুটি করেছি এবং বাংলাদেশ জিতেছে। আমি তেমন রান করিনি, তবে ও ৪৩ রানে অপরাজিত ছিল।
Featured Image Credit : Chris Hyde/Getty Images