জিনেদিন জিদানের অধীনে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা দল, আর বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদ দলের পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য কিন্তু তেমন নেই। রক্ষণের সেই পুরনো ৪ জনই আছেন। মাঝমাঠ এখনও মদ্রিচ, ক্রুসকে সাথে নিয়ে ক্যাসেমিরো নিয়ন্ত্রণ করেন। শুধু নেই একজন; ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। রোনালদো জুভেন্টাসে পাড়ি জমানোর পর রিয়াল মাদ্রিদ ডিফেন্ডার সার্জিও রামোস বলেছিলেন, “একমাত্র রোনালদোর না থাকার জন্য আমাদের জয়ধারা কখনোই থামবে না।” আসলে এই কথাটি হয়তো শুধুমাত্র দলকে উজ্জীবিত করার জন্যই বলা। সার্জিও রামোস নিজে খুব ভালোভাবেই জানেন, একজন রোনালদো দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
১৮টি গেম উইক পার হবার পর লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদ আছে তালিকার পঞ্চমে, প্রথমে থাকা বার্সেলোনা থেকে পাক্কা ১০ পয়েন্ট দূরে। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ১৬-তে তারা পৌঁছেছে ঠিকই, কিন্তু গ্রুপ পর্বে হেরেছে ভিক্তোরিয়া প্লজন ও সিএসকে মস্কোর বিপক্ষে। আর লিগে রিয়াল সোসিয়াদাদ, এইবারের বিপক্ষে হারের লজ্জা তো আছেই। এক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছাড়া দলে বড় কোনো পরিবর্তন নেই। থিবো কোর্তোয়াকে দিয়ে গোলবার তো আরও শক্তপোক্ত হবার কথা। কিন্তু কেন এই হতাশাজনক পারফরম্যান্স? কিসের অভাব ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের?
বর্তমানে রিয়াল মাদ্রিদের প্রথম সমস্যা… একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। যখন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ছিলেন, প্রাণভোমরারূপেই মাঠে নামতেন। শুধু তিনি গোল করে ম্যাচ জেতানোর জন্য নয়, মাঠে তার উপস্থিতিই রিয়াল মাদ্রিদকে এক ধাপ এগিয়ে রাখতো। লিগে প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষে ব্যস্ত থাকতো রোনালদোকে থামিয়ে দেবার ফাঁদ পাততে। সেটা সবসময় হতো না ঠিকই, তবে তাকে একতরফা আটকে দেবার পরিকল্পনার জন্য দলের বাকি সবাই পেয়ে যেতো অগাধ সুবিধা। যদিও রোনালদোকে থামিয়ে দেবার পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে খুব কম ম্যাচে, প্রতি ম্যাচে তিনি গোল করতেন। রক্ষণ দুর্বলতার দিনে মাদ্রিদ যখন গোল হজম করে পিছিয়ে থাকতো, সেদিনও গোল করে দলকে জয় এনে দেবার সক্ষমতা ছিল তার। তাই দলের অনেক দুর্বল দিক সম্মুখে ফুটে উঠতো না।
জিদানের অধীনে রিয়াল মাদ্রিদ দলে রোনালদো থাকার জন্য সুবিধা পেতেন মার্কো আসেনসিও। তার একটি ছোট্ট দুর্বলতা আছে, কড়া মার্কিংয়ে রাখলেই তিনি ‘অচল’ হয়ে পড়েন। একটু বেশি ফাঁকা জায়গা পেলেই তিনি তার স্বাভাবিক খেলাটা উপহার দিতে পারতেন। বিষয়টি হয়তো জিদান জানতেন, কিন্তু তখনও কোনো প্রতিপক্ষ বিষয়টি ধরতে পারেনি। তাই প্রতিপক্ষের রোনালদোকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনায় আসেনসিও পেতেন অনেক বেশি ফাঁকা জায়গা। রোনালদো নেই, জিদান নেই। আসেনসিও নামলেই কড়া মার্ক করে রাখছে তাকে প্রতিপক্ষ। এতে করে নিভে যাচ্ছেন তিনি। তার দুর্বলতাই তাকে এখন বেঞ্চে ঠেলে দিচ্ছে।
রোনালদোর চলে যাবার ফলে রিয়াল মাদ্রিদের পুরো বছরের সর্বমোট গোলসংখ্যা এক ধাক্কায় অর্ধেকে এসে নেমেছে। নতুন মৌসুমের শুরুতে তিনি জুভেন্টাসে নাম লিখিয়েছিলেন। অথচ বছরশেষে বেল বা বেনজেমাদের কেউ নন, রিয়াল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন অর্ধেক বছর খেলা ‘প্রাক্তন’ খেলোয়াড় রোনালদো।
জিদান স্বেচ্ছায় রিয়াল মাদ্রিদকে বিদায় জানালে লোপেতেগির আগমনের পর তাদের শুরুটা খারাপ হয়নি। গোল করার দায়িত্ব ছিল বেল এবং বেনজেমাদের। মাঝমাঠ থেকে বলের যোগান দিচ্ছিলেন ইসকো। আসলে হুলেন লোপেতেগি’র ট্যাকটিসে ইসকো হয়ে উঠতে পারতেন ‘ট্রাম্পকার্ড’। কিন্তু এক ইনজুরি সব শেষ করে দেয়। ইসকো’র ইনজুরির পর রিয়াল মাদ্রিদের কাছে গোল হয়ে যায় ডুমুরের ফুলের মতো। বার্সেলোনার কাছে ৫-১ গোলে বিদ্ধস্ত হবার পর লোপেতেগির সেই হতাশা যাত্রা থামে।
রিয়াল মাদ্রিদ নিয়োগ দেয় তাদের ‘কস্তিয়া’ কোচ সান্তিয়াগো সোলারিকে। তিনি এসেই রিয়ালের খেলার ধরন বদলে দেন। এতে করে রিয়াল মাদ্রিদের খেলায় যে বদল এসেছে, তা লক্ষ্যনীয়। কিন্তু আসল সমস্যা যে এখনও কাটেনি তাদের! সিএসকে মস্কো,ভিক্তোরিয়া প্লজন, রিয়াল সোসিয়াদাদের কাছে হার এবং এ মৌসুমে ফর্মের সাথে যুদ্ধ করে চলা ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে ড্র’য়ের পিছনের কারণগুলো কী?
সমস্যা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। সোলারিও বুঝতে দেরি করেননি। রিয়াল মাদ্রিদের বহুদিনের শত্রু রক্ষণ দুর্বলতার কথা তো সবার জানা। কিন্তু সোলারি বা কোনো ট্যাকটিসেই এই সমস্যা সত্বর দূর হবে না। দরকার একটি ট্রান্সফারের। তাই রিয়াল মাদ্রিদকে খুব দ্রুত কিনতে হবে একজন পুর্নাঙ্গ সেন্টার ডিফেন্ডারকে। কিন্তু দলে যে ৪ জন খেলেন, এদের তো পরিবর্তন সম্ভব নয়। মার্সেলো ও কারভাহাল তো থাকবেনই। শুধু সমস্যা রামোস ও ভারানকে নিয়ে। দলের আক্রমণের সময় তো ফুলব্যাকেরা উপরে উঠে যাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কারভাহাল বা মার্সেলো কেউ তা করতে পারেন না। অন্যদিকে রামোস ও ভারান দু’জনই রক্ষণ ছেড়ে উপরে উঠে যান। কিন্তু প্রতিপক্ষে প্রতি-আক্রমণের সময় এদের কাউকে তাদের পজিশনে পাওয়া যায় না। সেন্টারব্যাক ডিফেন্ডারের বদলি খেলোয়াড় নাচো আছেন। কিন্তু তিনি মৌসুমের অধিকাংশ সময় থাকেন মাঠের বাইরে। চতুর্থ ডিফেন্ডার ভায়েহোর উপর লোপেতেগি আস্থা রাখতে পারেননি, পারছেন না সোলারিও। তাই আপাতত পরিস্থিতি বুঝে রিয়াল মাদ্রিদ চেস্টা করছে একজন ডিফেন্ডার কেনার।
সোলারির পরামর্শে এসপানিওলের ডিফেন্ডার মারিও হারমোসাকে কিনতে চাইছে রিয়াল মাদ্রিদ। সাথে লক্ষ্য রাখছে পোর্তোর এডার মিলিতাও ও আয়াক্সের তরুণ তুর্কি মাথিজিস ডি লিটের উপর। যদিও ডি লিটকে পাওয়া সহজ হবে না রিয়ালের জন্য, বার্সেলোনা তাকে কেনার জন্য অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তাছাড়া ডি লিট নিজেও বার্সেলোনা সমর্থক। ওদিকে এডার মিলিতাওকে কিনতে হলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে যুদ্ধে নামতে হবে তাদের। তাই মারিও হারমোসাই সব থেকে সহজ সুযোগ।
রিয়ালের মাঝমাঠে তুলনামুলকভাবে সমস্যা কম। ক্রুস, ক্যাসেমিরো ও মদ্রিচ আছেন। ক্যাসেমিরোর ইনজুরিতে মার্কো লরেন্তেও ভালো খেলেছেন। তাছাড়া ইসকো ও সেবায়েস তো আছেনই। সোলারি চাইলে জিদানের সেই সাফল্যময় ফর্মেশন ৪-৪-২ ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে মধ্যমাঠে ব্যবহার করতে পারবেন ভাসকেজ ও আসেনসিওকে। তাই সান্তিয়াগো সোলারির জন্য মধ্যমাঠ তেমন চিন্তার কারণ নয়।
রক্ষণ সমস্যার পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদের আরেকটি বড় ধরনের সমস্যা হলো আক্রমণভাগ। গত তিন মৌসুমে রোনালদো যতগুলো গোল করেছেন, বেল ও বেনজেমা দু’জন মিলেও ততগুলো গোল করতে পারেননি। যদি বেল ও বেনজেমার সাথে ইসকো ও আসেনসিওকেও জুড়ে দেওয়া হয়, তবুও রোনালদোর গোল সংখ্যা স্পর্শ করতে পারার কথা নয় তাদের। রোনালদো এখন ইতালি মাতাচ্ছেন। বেনজেমা নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন অনেকদিন আগে থেকেই, বেলও অধিকাংশ সময় ধরেই থাকেন ইনজুরিতে। আর ভাসকেজ ও আসেনসিওদের অবস্থা অতিথি পাখির মতো। রোনালদোর কিংবদন্তীতুল্য সাত নম্বর জার্সি যার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো, সেই মারিয়ানো ডিয়াজের কথা এখন হয়তো অনেকের স্মরণই নেই। অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেওয়া ভিনিসিয়ুস জুনিয়র রিয়ালে হাজির হলেও মাঠে নিয়মিত হতে পারছেন না।
তাই আক্রমণ দুর্বলতা সরিয়ে ফেলার জন্য রিয়ালের করণীয় একজন লেফট উইং এবং একজন স্ট্রাইকারকে দলে ভেড়ানো। এক্ষেত্রে ভরসা করার মতো কোনো খেলোয়াড় কেনা আবশ্যক। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, যেকোনো ফ্লপ সাইনিং দলের ক্ষীণ আশাকেও শেষ করে দিতে পারে।
তাই ভরসা করার মতো স্ট্রাইকার কেনার দৌঁড়ে তেমন কেউ নেই বললেই চলে। দলবদলের গুঞ্জন আছে মাউরো ইকার্দিকে নিয়ে। কিন্তু ইকার্দি আদৌ আসবেন কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া তাকে কিনতেও ১০০ মিলিয়ন ইউরো’র বেশি অর্থ খরচ করতে হবে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে। রিয়াল মাদ্রিদের সাথে রিউমার ছড়িয়ে আছে এডেন হ্যাজার্ডের। তবে তারও রিয়াল মাদ্রিদের আসার সম্ভবনা খুবই কম। তাছাড়া রিয়াল হাঁটতে পারে তাদের পুরনো নীতিতে। কম খরচে তরুণ খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোর হাজারো নমুনা আছে তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে। অবশ্যই তেমনটাই করতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ বোর্ড, নতুন সাইনিং ব্রাহিম ডিয়াজ এমনটাই বলে। আর যদি বড় ধরণের সাইনিং খুব তাড়াতাড়ি তারা করতে না পারে তাহলে ভিনিসিয়ুস, মারিয়ানো ও জুলাইতে হাজির হতে যাওয়া রদ্রিগোকে নিয়েই ভবিষ্যৎ ভাবতে হতে পারে।
দলের এই পরিস্থিতির পাশাপাশি আরও দুটো সমস্যা হলো ইনজুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের ফর্মহীনতা। দলের ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারান ও মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ খেলেছেন বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত। বিশ্বকাপে যাবার আগেও তারা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে টানা খেলেছেন। এমনকি বিশ্বকাপ শেষে কোনো বিরতি না দিয়েই আবার খেলা শুরু করার ধকল তারা হয়তো এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আর ইনজুরির আক্রমণ তো আছে নতুন মৌসুমজুড়েই। দলে খুব কম খেলোয়াড়ই আছেন, যারা একবারও ইনজুরিতে পরেননি। মারিয়ানো ডিয়াজ, নাচো ও আসেনসিও মাঠের বাইরে বেশ কিছুদিন ধরেই। ইসকোও ইনজুরির কারণেই ফর্ম হারিয়েছেন। রিয়াল মাঝখানে পায়নি ক্যাসেমিরো ও মার্সেলোকেও। ইনজুরির কোপ থেকে বাঁচতে পারেননি নাভাস ও অদ্রিয়োজোলাও। সর্বশেষ ম্যাচে নতুন করে ইনজুরিতে পরে ২ সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেছেন টনি ক্রুস।
রিয়াল মাদ্রিদের সব থেকে বড় ভুল ছিল, দলের মহাতারকার বিদায়ের পর কী করা যেতে পারে, তা আগে থেকে ভেবে না রাখা। আবার রোনালদো বিদায়ের পর আবার তারা এমন একজনকে নিয়ে এসে তার স্থান দিয়েছে, যেটা তার একদমই প্রাপ্য নয়। দীর্ঘদিন হতাশার বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে অনেক আগেই। শুধুমাত্র পুরনো আমেজ ফিরিয়ে আনতে দরকার একটি চমকপ্রদ সাইনিং। আর সেটা না হলেও অন্তত চলতি শীতকালীন দলবদলে একজন পরীক্ষিত ডিফেন্ডার কেনাটা আবশ্যক। কারণ যে দুর্বলতাগুলো সামনে চলে এসেছে, সেগুলো না ঢাকতে পারলে রিয়াল মাদ্রিদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আপাতত নেই বললেই চলে।