গ্লাসগো, মিলান, ম্যানচেস্টার- ইউরোপের তিনটি অন্যতম স্বনামধন্য শহর। তবে ফুটবল অনুরাগীদের কাছে এগুলো শুধু শহরই নয়। কারণ বছরে যে অন্তত দুবার এই শহরগুলোই উত্তেজনার বারুদে ঠাসা থাকে। সেল্টিক-রেঞ্জার্স, ইন্টার-এসি কিংবা সিটি-ইউনাইটেডের লড়াই শহরগুলোকে সাজায় বর্ণিল রঙে। শুধু সেখানকার বাসিন্দারাই নয়, এর উত্তেজনা কিংবা শিহরণ ছড়িয়ে যায় তাবত বিশ্বে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে উৎসব, বর্ণিলতা, উত্তেজনা, বারুদ কিংবা আল্ট্রাস সমর্থক কোনো কিছুই একটি শহরকে হারাতে পারবে না। তা হলো আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স।
বলছিলাম বিখ্যাত সুপারক্লাসিকোর কথা। বোকা জুনিয়র্স বনাম রিভার প্লেটের কথা। বোকা জুনিয়র্স আর রিভার প্লেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে শহরটিতে। দুটি ক্লাবেরই গোড়াপত্তন বুয়েন্স আয়ার্সকে কেন্দ্র করে। এই দুই দলের মধ্যকার ম্যাচের উত্তেজনা এখন শুধু মাঠেই থাকে না, বরং পুরো জাতীয় একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
সেদিন যেকোনো কাজই গৌণ হয়ে পড়ে। পুরো শহরের আনাচে কানাচের প্রতিটি মানুষই বুদ হয়ে থাকে সেই দুই ঘন্টার জন্য। তবে বেশিরভাগ সময়েই এই উগ্র ভালবাসা শুধু নিজেদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। হাতাহাতি, মারামারি বলতে গেলে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারই হয়ে দাঁড়িয়েছে সমর্থকদের মাঝে। তবে শুধু দর্শকরাই নয়, মাঝে মাঝে খেলোয়াড়েরাও সংঘর্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। ২০০৪ সালে কোপালিবার্তোদোরোসে রিভার প্লেটের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে কার্লোস তেভেজ উদযাপন দিয়েই রিভার প্লেটকে ব্যঙ্গ করেছিলেন, যার জন্য দুই দলের মধ্যেও লেগে যায় দাঙ্গা। যদিও পরে তেভেজ ক্ষমা চেয়েছিলেন পুরো আর্জেন্টিনার মানুষের কাছে।
দুই দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ১৯৬৮ সালের ২৩ জুন। সেবার এল মনুমেন্টালে ০-০ গোলে ড্র শেষে বাড়ি ফেরার পথে স্টেডিয়ামের গেট ভেঙে ৭১ জন বোকা সমর্থক প্রাণ হারান। প্রায় ১৫০ জনের মতো হাসপাতালে ভর্তি হন। বলা হয়ে থাকে, ম্যাচ শেষে রিভার প্লেট সমর্থকরা প্রস্রাব ভরা পলিথিন ছুড়ে মারলে প্রচুর ধাক্কাধাক্কিতে গেট ভেঙে পড়ে বোকার সমর্থকদের উপর। আর তাতেই এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। তবে প্রায় ৩ বছর ধরে তদন্ত করে আর্জেন্টিনা সরকার কোনো দোষী খুঁজে পায়নি ঘটনার। তারপর মাঝে অনেক বছর মোটামুটি শান্ত থাকলেও গত এক দশকে আবার দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দুই দলের সমর্থকদের মাঝে।
২০১১ সালের পর থেকে দুই দলের সংঘর্ষের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এর মূল কারণ সেবারই নিজেদের ১১০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যায় রিভার প্লেট। বোকা সমর্থকরা ব্যাপারটিকে উৎসবে পরিণত করে। কফিন নিয়ে রাস্তায় রিভার প্লেট ক্লাবের লোগো আর জার্সির কুশপুত্তলিকা দাহ শুরু হয়। বুয়েন্স আয়ার্সের রাস্তায় সারাক্ষণ ধরে বোকা সমর্থকদের আনন্দ উৎসব চলে। বোকার এই উগ্র সমর্থকগোষ্ঠির ‘বারা ব্রাভাস’ নামে আলাদা একটি নামও রয়েছে ফুটবল ইতিহাসে। এল মনুমেন্টাল আর লা বম্বোনেরা এই দুই স্টেডিয়ামও ফুটবল জগতে বিখ্যাত হয়ে আছে এই দুই ক্লাবের জন্যই। শুধু এই ম্যাচের পারফরমেন্সের উপর ভিত্তি করেই বড় বড় ক্লাব কিংবা ফুটবল লিজেন্ডে রুপান্তরিত হয়েছেন অনেক আর্জেন্টাইন। দিয়েগো ম্যরাডোনা, আলফ্রেডে ডি স্টেফানো, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, জুয়ান রিকুয়েলমে প্রমুখ এদের মধ্যে অন্যতম। তবে সত্যি কথা বলতে আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতিভার বড় অংশেরই যোগান আসে এই দুই ক্লাব থেকে।
দুই ক্লাবের অনেক গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে সেরা ধরা হয় দিয়েগো ম্যারাডোনাকে। নিজের ক্যারিয়ার আর্জেন্টিনা জুনিয়র্সের হয়ে শুরু করলেও ম্যারাডনা পরবর্তীতে যোগ দিয়েছিলেন বোকা জুনিয়র্সে। ৫ বছর ধরে আর্জেন্টিনা জুনিয়র্সের হয়ে ১৮৬ ম্যাচে ১১৬ গোল করে তিনি যতটা না লাইমলাইটে এসেছেন তার চেয়ে বেশি এসেছেন মাত্র ১ বছরের বোকা জুনিয়র্স ক্যারিয়ারেই।
নিজের মাটিতে দিয়েগোর উত্থান শুরু হয়েছে বোকার লা বম্বেনোরাতেই। ম্যারাডোনা নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সুপার ক্লাসিকো খেলেছিলেন ১৯৮১ সালের ১০ এপ্রিল। মাত্র ২১ বছর বয়সী ম্যারাডোনা সেদিনই টের পেয়েছিলেন এর উত্তেজনা। ৬০,০০০ দর্শকে গমগম করা লা বম্বেনোরা সেদিন আক্ষরিক অর্থেই কাঁপছিলো। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচেই রিভার প্লেটের মুখোমুখি হয় ম্যারাডোনার বোকা। সেই ম্যাচেই ম্যারাডোনা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিলেন যে ফুটবলের নতুন রাজা আসছে। ২১ বছর বয়সী ম্যারাডোনা সব চাপ সামলে সেদিন করেছিলেন এক দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক। রিভার প্লেটকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বোকা। আর ম্যারাডোনার ক্যারিয়ার উত্থানও শুরু হয় সেই রাত থেকেই।
বোকা জুনিয়র্সের যদি থাকে ম্যারাডোনা তাহলে রিভার প্লেটের গর্বের খেলোয়াড় ছিলেন ডি স্টেফানো। নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছর ডি স্টেফানো কাটিয়েছেন রিভার প্লেটে। সেই চার বছরে ক্লাবকে দুবার লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ এনে দেন এই কিংবদন্তী ফুটবলার। যদিও ১৯৪৯ সালে আর্জেন্টিনায় ফুটবলারদের ধর্মঘটের কারণে কলম্বিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় ডি স্টেফানোকে। তবুও রিভার প্লেটের ইতিহাসে কিংবদন্তীই হয়ে আছেন ডি স্টেফানো। এখনো রিভার প্লেট একাডেমি খেলোয়াড়দের ডি স্টেফানোকে আদর্শ ধরে গড়ে তোলা হয়।
আরেক আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে খেলা শুরু করলেও রিভার প্লেটে পাড়ি জমান ক্যারিয়ারের শুরুতেই। কিন্তু তৎকালীন রিভার প্লেট কোচ ড্যানিয়েল প্যাসারেলা বাতিস্তুতাকে তেমন সুযোগই দেননি। সেই থেকে প্রতিশোধের আশায় পরের মৌসুমেই চিরশত্রু বোকাতে নাম লেখান বাতিগোল। তারপরের গল্পটা বাতিস্তুতার। অস্কার তাবারেজের অধীনে রিভার প্লেটকে একাই নাচিয়েছেন বহুবার। বোকার হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সেই ইউরোপের দরজা খুলে যায় তার জন্য। ইউরোপে গিয়েই নিজেকে নিয়ে গেছেন সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের কাতারে। ইতালিয়ান লিগেও হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলরক্ষক।
তবে বাতিস্তুতা যদি হন বোকার সম্পদ, তাতেও রিভার প্লেটের কিছু যায়-আসে না। গোলস্কোরারের দিক থেকে রিভার প্লেট খেলোয়াড়রা ঢের এগিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে। আর্জেন্টিনায় বাতিস্তুতার উত্তরসূরি হার্নান ক্রেসপো ছিলেন রিভার প্লেট একাডেমি থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়। এমনকি হার্নান ক্রেসপোর জাতীয় দলে রেখে যাওয়া ৯ নাম্বার জার্সি পরা গঞ্জালো হিগুয়াইনও উঠে এসেছেন রিভার প্লেট থেকে। সময়ের অন্যতম সেরা এই দুই গোলস্কোরার বাদেও রিভার প্লেট থেকে উঠে এসেছেন মার্সেলো সালাস, জ্যাভিয়ের স্যাভিওলা, রাদামেল ফ্যালকাওদের মতো তারকারা। তবে এদের চেয়ে সম্ভবত মারিও কেম্পেসই আর্জেন্টাইনদের মনে সবচেয়ে বড় জায়গা নিয়ে আছেন। বিশ্বকাপজয়ী এই তারকাও ছিলেন রিভার প্লেটের।
শুধু গোলস্কোরারই নয়, সব ক্ষেত্রেই একে অন্যকে টেক্কা দিতে গিয়ে অনেক কিংবদন্তী খেলোয়াড়েরই বেড়ে ওঠা এই দুই ক্লাবে। রিভার প্লেট যেমন বিশ্বকে উপহার দিয়েছে পাবলো আইমার, জাভিয়ের মাচেরানো, মাতিয়াস আলমেইদা, আরিয়েল ওর্তেগা, ড্যানিয়েল প্যাসারেলাসহ অনেক কিংবদন্তী খেলোয়াড়। তেমনি বোকা জুনিয়র্সের গর্ব করার জন্য আছেন তেভেজ, রিকুয়েলমে, ক্যানিজিয়া, এন্তনিও র্যাটিন, ওয়াল্টার স্যামুয়েলসহ আরো অনেকেই।
তবে শুধু সুপার ক্লাসিকোর পারফরম্যান্সের বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে বোকা জুনিয়র্সের জুয়ান রোমান রিকুয়েলমে। প্রকৃতপ্রদত্ত প্রতিভা ছিলো এই মিডফিল্ডারের পায়ে। মিডফিল্ডার হয়েও সুপার ক্লাসিকোতে তার করা গোলসংখ্যা ৬, যার তিনটিই এসেছে কোপা লিবার্তোদোরোস কোয়ার্টার ফাইনালে। ২০০০ সালে কোয়ার্টার ফাইনালেই এই দুই দল মুখোমুখি হয়। সেবার ফাইনালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব পালমেইরাসকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয় বোকা। মাঝে ইউরোপ ঘুরে এসে আবারো বোকাতেই নিজের ক্যারিয়ার শেষ করেন বোকা অন্তঃপ্রাণ রিকুয়েলমে, যার জন্য বোকার সমর্থকেরা দিয়েগোর মতোই ভালবাসেন রিকুয়েলমেকে।
রিভার প্লেট ও বোকা জুনিয়র্সের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবল ইতিহাসেরই একটি বড় অংশ। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঘিরেই এই দুই ক্লাব মিলে যোগান দিয়েছে অনেক কিংবদন্তীর। একেবারে আতুঁড় ঘর থেকে কিংবদন্তী তৈরি করার প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর অন্যতম সেরাও এই দুই ক্লাব। তবে দিন শেষে দাঙ্গা, ভালবাসা, উত্তেজনার উর্ধ্বে ফুটবলই যেন বড় হয়ে ওঠে সেই আশাই ফুটবল অনুরাগীদের।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/