.jpg?w=1200)
১.
সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের নাম স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। কিন্তু সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কে?
বিভিন্ন মানুষের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন রকম। এই প্রশ্নের উত্তরে এক সময় আসতো স্যার গ্যারি সোবার্সের নাম। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেটা হয়ে গেছে জ্যাক ক্যালিস। ভারতীয়দের কাছে কপিল দেবই সেরা। কেউ কেউ আবার এগিয়ে রাখেন ইমরান খান, অথবা রিচার্ড হ্যাডলিকে।
পরিসংখ্যান বলছে, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কপিল দেব। ১৪১ বছর বয়সী টেস্ট ক্রিকেটে যে দুজন পাঁচ সহস্রোর্ধ্ব রানের সাথে ৩০০+ উইকেট নিয়েছেন; সেই দু’জনের একজন কপিল দেব, আরেকজন ইয়ান বোথাম। ইয়ান বোথাম কত নম্বরে থাকবেন, সে হিসেব বরং মহাকালের হাতেই তোলা থাক। তার চেয়ে ঘুরে আসা যাক ১৯৮১ সালের অ্যাশেজ সিরিজ থেকে, যে অ্যাশেজের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বোথামের অ্যাশেজ’।

২.
ক্রিকেট খেলাটা যদি পরিকল্পনা মোতাবেক চলে, তবে এর চেয়ে সহজ আর কোন খেলা নেই। কিন্তু পরিকল্পনায় সামান্য ভুল হয়ে গেলেই খেলাটা হয়ে উঠবে বিষম কঠিন। টস জিনিসটাও ক্রিকেটে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অন্য কোনো খেলায় কিয়দংশও নয়। তারপর আছে আবার প্রকৃতির ব্যাপার। খেলার আগে বৃষ্টি হয়েছে? টসে জিতলে চোখ বন্ধ করে বোলিং নিন, তারপর আপনার দলের পেসারদের লেলিয়ে দিন। পিচ ফেটে চৌচির? স্পিনারকে ডাকুন, ঘূর্ণিবিষে নীল করে দিক সব। চমৎকার ব্যাটিং পিচ? বল দারুনভাবে ব্যাটে আসছে? হয়তো লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরি করে ফেলবেন কেউ (পড়ুন ডন ব্র্যাডম্যান)।
এরকমই একটা খেলায় ৬ টেস্টের এক সিরিজ নিজের নামে করে নিতে অন্যরকম ক্রিকেট খেলা লাগে। বোথাম সেটাই খেলেছিলেন। তিনি কী করেছিলেন, তা জানতে ফেরা যাক বোথামের অ্যাশেজে।
প্রথম টেস্ট ছিল ট্রেন্টব্রিজে। টসে জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড অলআউট হয় ১৮৫ রানে, অধিনায়ক বোথাম করেন ১। অস্ট্রেলিয়া এর জবাবে প্রথম ইনিংসে করে ১৭৯। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের অবস্থা হয় আরও নাজুক। অলআউট হয় ১২৫ রানে, বোথাম করেন ৩৩। মাত্র ১৩২ রানের টার্গেটে ৬ উইকেট হারিয়েই পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া। সিরিজ হয়ে যায় ১-০।
দ্বিতীয় টেস্টেও তথৈবচ অবস্থা। লর্ডসে টস জিতলো অস্ট্রেলিয়া, ব্যাটিংয়ে নামলো ইংল্যান্ড। গ্যাটিং আর উইলির হাফ সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ ৩১১, বোথাম করলেন ‘০’। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ দাঁড়াল ৩৪৫।
দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬৫ করে ডিক্লেয়ার করলো ইংল্যান্ড। বোথামের সংগ্রহ? আবারও ‘০’। এক টেস্টের দুই ইনিংসেই শূন্য, সহজ ভাষায় যাকে বলে ‘পেয়ার’। অস্ট্রেলিয়ার সামনে দাঁড়ালো ২৩২ রানের লক্ষ্য। কিন্তু খেলার বাকি তখন আর ৫০ ওভারের মতো। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, ড্র হলো এই টেস্ট।

৩.
ব্যাপারটা এমন না বোথাম বোলিংয়ে উইকেট পাচ্ছিলেন না। ২-৩টি করে উইকেট প্রতি ইনিংসেই পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রথমত তিনি একজন অলরাউন্ডার। ব্যাটিং এবং বোলিং দুই ক্ষেত্রেই তার কাছে প্রত্যাশায় থাকে দল। এবং দ্বিতীয়ত, তিনি দলের অধিনায়ক। অধিনায়কের পারফরম্যান্স যদি এরকম হয়, তবে সে দলের যে ভরাডুবি হবে তা বিচিত্র কিছু নয়।
প্রথম টেস্টের পরে যদি কিছুমাত্র সন্দেহ থেকেও থাকে, তবে দ্বিতীয় টেস্টের পারফরম্যান্স সেই সন্দেহ দূর করে দিল। নির্বাচকরা বুঝে গেলেন, অধিনায়কত্বের চাপে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছেন বোথাম। ‘চাপমুক্ত’ করা হলো তাকে, বোথামের জায়গায় ক্যাপ্টেন হলেন ব্রিয়ারলি। ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে। তৃতীয় টেস্টেও টসে জিতলো অস্ট্রেলিয়া, তবে এবার আর ইংল্যান্ডকে না পাঠিয়ে নিজেরাই নেমে পড়লো ব্যাটিংয়ে, করলো ৪০১ রানের মোটাসোটা স্কোর। অস্ট্রেলিয়ার ৬ উইকেট বোথামের পকেটে!
ব্যাটিংয়ে নামলো ইংল্যান্ড, নেমেই বিপর্যয়ে পড়ল। ১৭৪ রানে অলআউট হয়ে ফলোঅন করতে বাধ্য হলো তারা। বোথাম যে চাপমুক্ত হয়ে ফুরফুরে মেজাজে খেলা শুরু করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রথম ইনিংসের হাফ সেঞ্চুরিতে। ফলোঅনে পড়ে যখন ব্যাট করতে নামলেন, তখন ইনিংস পরাজয় এড়াতেই লাগে ১২২। সেই ইনিংসে বোথামের যে কী হলো, তা লিখে বোঝানো অসম্ভব। এই ইনিংস চোখে না দেখলে কোনোমতেই বোঝা সম্ভব নয়। প্রথম দুই টেস্টে রান পাননি, সেই চাপা বুনো ক্ষোভ স্রোতের মতো বের হয়ে এলো হেডিংলিতে। ১৪৮ বলে ১৪৯ রান, ২৭ চার ১ ছয়। একের পর এক বাউন্ডারির পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। অন্য প্রান্তে সব ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাওয়ায় থামতে বাধ্য হন, নইলে সেদিন কত করতেন কে জানে! ইংল্যান্ড থামল ৩৫৬ রানে। চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য দাঁড়াল ১৩০।

বোথামের শক্তিতে জ্বলে উঠলেন বব উইলিস, ১৩০ রানের ‘মামুলি’ লক্ষ্যকেও ‘বিশাল’ বানিয়ে দিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়াকে ১ উইকেটে ৫৬ থেকে বানিয়ে দিলেন ৮ উইকেটে ৭৫। ৪৩ রানে ৮ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে যখন অলআউট করলেন, জয় তখনও ১৯ রান দূরে।
সিরিজ হয়ে গেল ১-১। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ? সন্দেহাতীতভাবেই ইয়ান বোথাম।
একটা ছোট্ট গল্প বলা যাক। তৃতীয় টেস্ট শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে বাজির দর উঠলো ৪-১, মানে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ১ পাউন্ড বাজি ধরলে পাওয়া যাবে ৪ পাউন্ড। ড্রয়ের পক্ষে বাজি উঠলো ৫-২, আর ইংল্যান্ডের পক্ষে উঠলো ৫০০-১। অর্থাৎ, ইংল্যান্ডের পক্ষে ১ পাউন্ডের বিপরীতে পাওয়া যাবে ৫০০ পাউন্ড!
কেউ কি বাজি ধরেছিলো?

৪.
ফলোঅনে পড়েও ম্যাচ জেতার পর ইংল্যান্ডের মনোবল হয়ে গেলো দ্বিগুণ। সেই মনোবল তারা টেনে নিয়ে গেল চতুর্থ টেস্টেও। এজবাস্টনের সেই টেস্টে ব্যাটিংয়ে নেমে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ করল ১৮৯। জবাবে অস্ট্রেলিয়া করলো ২৫৮, পেলো ৬৯ রানের লিড। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড অলআউট হলো ২১৯ রানে। জিততে হলে অস্ট্রেলিয়াকে করতে হবে ১৫১।
এই টেস্টের দুই ইনিংসে ব্যাট এবং এক ইনিংস বল করে তেমন কিছু করতে পারেননি বোথাম। তবে সবটুকু বোধহয় জমিয়ে রেখেছিলেন, উগড়ে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার শেষ ইনিংসের সময়। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে অস্ট্রেলিয়া যখন জয়ের বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনই মঞ্চে আবির্ভূত হলেন বোথাম।
অস্ট্রেলিয়ার স্কোর তখন ১১৪/৫, জিততে তখন লাগে ৩৭ রান। বোথাম এসেই ফেরালেন রডনি মার্শকে। স্কোরে এক রান যোগ না করেই ফিরলেন ব্রাইট। ১১৪ থেকে ১২১ এই সাত রানের মধ্যে বাকি ৩ উইকেট তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করে দিলেন। দল জিতলো ২৯ রানে, নিজে নিলেন ৫ উইকেট। এই ধরণের কীর্তি সাধারণত গল্প-উপন্যাস কিংবা সিনেমাতে বেশি দেখা যায়। সিনেমা? হ্যাঁ, সিনেমা বলাই যায়। ‘বোথামের অ্যাশেজ’ নামের সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর, প্রধান অভিনেতা ছিলেন ইয়ান বোথাম।
প্রথম ২ টেস্ট শেষে যারা ১-০ তে পিছিয়ে ছিল, ৪ টেস্ট শেষে তারাই এগিয়ে গেল ২ – ১ ব্যবধানে!

৫.
৫ম টেস্ট শুরু হলো ওল্ড ট্রাফোর্ডে। সেই ওল্ড ট্রাফোর্ড, যেখানে এক টেস্টে ১৯ উইকেট নিয়েছিলেন জিম লেকার।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিং দুর্দশা যেন কাটছিলোই না। এবারও প্রথমে ব্যাটিং, আবারও বিপর্যয়। ১৩৭ রানে চলে গেল ৮ উইকেট। নয় নম্বরে নামা পল অ্যালটের হাফ সেঞ্চুরিতে আপাতত বিপর্যয় সামাল দেয়া গেলো, দল থামলো ২৩১ রানে। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের সময় উইলিস আর বোথামের মিলিত ধ্বংসযজ্ঞে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে গেল মাত্র ১৩০ রানে। মাত্র ২৩১ করেও ১০১ রানের লিড পেলো ইংল্যান্ড।
দ্বিতীয় ইনিংসেও একই অবস্থা। ১০৪ রানের মধ্যে ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারের ৫ জন ফিরে গেলেন সাজঘরে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন কিম হিউজ ১৫০ রানের মধ্যে ইংল্যান্ডকে আটকে ফেলার পাঁয়তারা করছেন, এই অবস্থায় ক্রিজে এলেন বোথাম। হেডিংলির সেই ফর্ম নিয়ে এলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডেও, ওপেনার ট্যাভারের সাথে গড়লেন ১৪৯ রানের জুটি। সেই জুটিতে বোথামের অবদান ১৩ বাউন্ডারির সাথে ৬ ছক্কায় ১০২ বলে ১১৮। বোথাম আর ট্যাভারে কিছুক্ষণের ব্যবধানে আউট হয়ে গেলেও কিম হিউজকে হতাশার সাগরে ভাসিয়ে অ্যালান নট আর জন এমবুরির হাফ সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ালো ৪০৪।
এরপর এই ম্যাচে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটেনি। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের লিডের কল্যাণে অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়ালো ৫০৬। অসম্ভব একটা লক্ষ্য রীতিমতো। ইয়ালপ আর বোর্ডারের সেঞ্চুরিতেও ম্যাচ বাঁচাতে পারলো না অস্ট্রেলিয়া, হারলো ১০৩ রানে। হেডিংলি এবং এজবাস্টনের পরে ওল্ড ট্রাফোর্ডেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ ইয়ান বোথাম। থ্রি ইন আ রো, পরপর তিন ম্যাচের অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে সোজা ইতিহাসের পাতায় বোথাম।
এর পরের টেস্ট ছিল ওভালে। সেই টেস্ট ড্র হলো। ৩-১ এ সিরিজ জিতে ‘ছাইদানি’ থেকে গেল ইংল্যান্ডেই।

প্রিয় পাঠক, কেউ যদি আপনাদের সামনে কখনও বোথামের সামর্থ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ফেলেন, অথবা বোথামের সমালোচনা করে বসেন, তবে তাকে বোথামের অ্যাশেজের গল্প শুনিয়ে দিতে একদম ভুল করবেন না কিন্তু!