
অথচ, এমন কিছু কিন্তু হবার কথা ছিল না। সাড়ে তিন দিনে ম্যাচ শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু শেষ দৃশ্যে এমন কান্নার রোল তো ওঠার কথা ছিল না। চিরকালের ‘ফাইটার’ সুজন মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন চোখের জলে বাঁধ দেয়ার বৃথা চেষ্টাতে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের হল অব ফেমে এমন কোনো ছবির ঠাঁই পাবার কথা ছিল না!
মুলতান কথা রাখেনি। বাংলাদেশকে শোকসাগরে ভাসাতে তার কোনো কষ্ট হয়নি।
কিছু ম্যাচ থাকে, খেলা শুরুর আগেই ‘কে জিতবে’ জিজ্ঞাসা ছাপিয়ে ‘অমুক দল কত ব্যবধানে জিতবে’ জাতীয় প্রশ্ন ওঠে। এই ম্যাচেরও তেমন পরিণতি বরণ করবারই কথা ছিল। আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রতিপক্ষের সম্বল মোটে তিন বছরের অভিজ্ঞতা; সে তিন বছরে খেলা ২৩ টেস্টের ২২টিতেই তারা হয়েছে পরাজিত, এর ভেতরে ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল ১৫ ম্যাচে।
মুলতানে পৌঁছাবার আগেই সিরিজ খুঁইয়ে বসে আছে ২-০ ব্যবধানে, টেস্ট ক্রিকেটের ১৬৫৮ নম্বর টেস্টে পাকিস্তানের জয় নিয়ে তাই অনিশ্চয়তায় ভোগার কোনো কারণ ছিল না। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ বরং প্রাপ্তি খুঁজে নিচ্ছিল পেশোয়ারে প্রথম ইনিংসে নেয়া লিডে, কিংবা টানা দুই টেস্টে করা হাবিবুল বাশারের অর্ধশতকে। মুলতান টেস্টেও বাংলাদেশের লক্ষ্যও তেমনই ছিল; ব্যাটে-বলে কিছু উজ্জ্বল ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স, দল হিসেবে ভালো খেলা, এই তো!
বছর সতেরো বাদে এই লেখা লিখতে গিয়ে তো দেখা যাচ্ছে, তেমন হলেই বেশ হতো। তাহলে কি হৃদয়ে আর এমন করে দহন বয়ে যেত? এতদিন বাদেও সেই টেস্ট নিয়ে বিরহগাঁথা কি লেখা হতো?

***
চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের চাহিদার পুরো বিপরীতভাবেই। উইকেটে ঘাস থাকা নিয়ে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের ভীতি চিরন্তন, আর মুলতানের উইকেটে তার মজুদ ছিল পর্যাপ্ত। এবং তা এতটাই যে, পেশোয়ারে ফিল্ডিং করবার সময় ইউসুফ ইয়োহানা (মোহাম্মদ ইউসুফ নামেই যাকে চেনা সহজ হবে) স্লেজিং করবার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন এই বাক্য,
‘মুলতান মে ঘাস হ্যায়!’
অমন উইকেটে বাংলাদেশ ব্যাট করেছিল প্রথম ইনিংসে। অবাক করা ব্যাপারটি হলো, সিদ্ধান্তটি এসেছিল টস জিতে। তিন নম্বরে নামতে যাওয়া হাবিবুল বাশার তাই তৈরিই ছিলেন। উদ্বোধনী জুটি টিকে যাবে, ওই উইকেটে এই ভরসা করবার কোনো কারণ ছিল না। বাশারের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে হান্নান সরকার সাজঘরে ফিরেছিলেন টেস্টের প্রথম ঘণ্টাতেই, জাভেদ ওমরের সঙ্গে ২৮ রানের জুটি ভেঙে।
সে সিরিজে বাশার বেশ ভালোই খেলছিলেন। শতক-অর্ধশতকের দেখা পেয়েছিলেন করাচিতে, ৯৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন পেশোয়ারে। মুলতানে তার ৭২ রানের ইনিংসটি তাই ধারণার বাইরের কিছু ছিল না। পেশোয়ারে আগের টেস্টেই শতক হাঁকিয়েছিলেন জাভেদ, দু’জনকে ঘিরে আশা দেখতে কষ্ট হয়নি।
সেই আশার পালে তারা দোল লাগিয়েছিলেন ১০২ রান অব্দি। বাশার তার স্বভাবমতোই খেলেছিলেন একের পর এক চোখ ধাঁধানো ড্রাইভ আর পুল, বেলিম তো বরাবরই ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি। এক উমর গুল বাদে পাকিস্তানের বোলাররা এলেবেলে বলও করছিলেন প্রচুর।
জুটি ভেঙেছিলেন সেই উমর গুলই। এমন এক বলে, যে বলে বেলিমের করার ছিল সামান্যই। আশরাফুল আরও বহুবারের মতোই আশার ফুল ফুটিয়ে মিইয়ে গিয়েছিলেন হুট করে। বাংলাদেশ তখন ৩ উইকেট ১৩৩।
রাজিন সালেহ অভিষিক্ত হয়েছিলেন সে সিরিজেই। আগের চার ইনিংসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অমিত সম্ভাবনার। সে সম্ভাবনার আরেক প্রস্থ উদাহরণ দেখিয়েছিলেন মুলতানে। ১৮৪ মিনিট স্থায়ীত্বের ১২৪ বলের ওই ইনিংসে তিনি রান করেছিলেন ৪৯, খালেদ মাসুদ পাইলটকে নিয়ে বাংলাদেশকে পার করিয়েছিলেন ২৪০ রানের কোটা। শেষ বিকেলে ইয়াসির আলীর হাতে অমন দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানআউট না হলে যে সংগ্রহ বড় হতে পারতো আরও।
মাঝে অবশ্য খেলার ধারার বিপরীতে আউট হয়েছিলেন হাবিবুল বাশার, তার আগে ইতিহাসের সিরিজে চতুর্থবারের মতো খেলেছিলেন পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংস, অলক কাপালিও ফিরেছিলেন তার পিছু পিছু। বাংলাদেশ প্রথম দিন শেষ করেছিল পাইলট আর সুজনের জুটিতে, স্কোর: ২৪৮-৬!

***
ক্রিকইনফোর প্রথম দিনশেষের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল,
”Khaled Mahmud and Mashud, the current and former captains of Bangladesh, must bat with considerable determination if their side is to apply the kind of pressure they managed for brief moments earlier in this series.”
নিবেদনে নিশ্চিত করেই কোনো ঘাটতি ছিল না, তবে শাব্বির আহমেদের এক্সপ্রেস গতির সামনে টিকে থাকবার জন্যে তা যথেষ্ট ছিল না। বাংলাদেশের লেজের চার উইকেট তুলে নিতে পাকিস্তানকে দ্বিতীয় দিনে ফিল্ডিং করতে হয়নি দশ ওভারও, বাংলাদেশ গুটিয়ে গিয়েছিল ২৮১ রানে। চিত্রনাট্যে আকস্মিক মোচড় তখনই।
খালেদ মাহমুদ সুজন সে সিরিজে গিয়েছিলেন অধিনায়ক হয়ে। তৎকালীন বোর্ডের প্রতি যে কারণে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারবেন না, তাতে যে নিশ্চিত হয়েছিল বোলার সুজনের আড়ালে চলে যাওয়া। পাকিস্তানে যাবার আগে তার বোলিং গড় দেখাচ্ছিল ৪০৬!
সেখান থেকে করাচিতে কমিয়েছিলেন কিছু, পেশোয়ারেও খানিকটা। তবে মুলতানে যা করলেন, তা হয়ে গেল ধারণারও অতীত। বোলিং গড় নেমে এলো ৫৫-র ঘরে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চার উইকেট তুললেন প্রথম এবং শেষবারের মতো, ৩৭ রানে। আর তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে ততদিনে বাংলাদেশের বোলিংয়ের সমার্থক হয়ে যাওয়া মোহাম্মদ রফিক তো ছিলেনই। পাকিস্তানের ইনিংসের এক-তৃতীয়াংশ বলই ছুড়েছিলেন তিনি, ততদিন অব্দি ছয় ম্যাচের ক্যারিয়ারেই পাঁচ উইকেট তুলেছিলেন তৃতীয়বারের মতো।
সুজন-রফিকের ওই বোলিংয়ে যা হয়েছিল, পাকিস্তানের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানই পৌঁছেছিলেন দুই অঙ্কের ঘরে, তবে কেউই পাননি পঞ্চাশের দেখা। অভিষিক্ত সালমান বাট, দারুণ খেলতে থাকা মোহাম্মদ হাফিজ কিংবা ইনজামাম-উল হক, প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছিলেন দলীয় ৫১ রানের ভেতরেই। ইয়াসির হামিদ-ইউনিস খান ৭১ রানের জুটি গড়লেও ধ্বস নেমেছিল তাদের বিদায়ের পরই। পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস থেমেছিল ৫৪.৪ ওভারে, ১৭৫ রানে। টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিপক্ষকে ২০০ রানের নিচে গুটিয়ে দেবার অনুভূতি কেমন হয়, বাংলাদেশ তা জানতে পেরেছিল সেবারই প্রথম। সে অনুভূতি এরপরও পাওয়া হয়নি খুব বেশি।

দু’দলের প্রথম ইনিংস শেষে বাংলাদেশ তাই এগিয়ে ছিল ১০৬ রানে, মুলতানের পিচ বিবেচনায় নিলে সোনা-রূপা-প্লাটিনাম ছাপিয়ে যাকে রোডিয়াম মনে হতে বাধ্য!
কিন্তু ওই লিডকে কাজে লাগানো গিয়েছিল কই! হান্নান সরকার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দ্বিতীয় ইনিংসেও ড্রেসিংরুমে ফিরেছিলেন দ্রুতই, এবার দলীয় চার রানে। পুরো সিরিজে আশার মশাল বয়ে চলা হাবিবুল বাশারও ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রথমবারের মতো। সেদিন করেছিলেন মাত্র ৩, যা তাকে দগ্ধ যন্ত্রণা দেয় আজও। জাভেদ ওমর ফিরেছিলেন ‘সংগ্রামী’ ১৬ রান করে। আর আশরাফুলও তো রান করবার কোনো কথা দিয়ে যাননি, বাংলাদেশের টপ-অর্ডারও তাই ভেঙে পড়েছিল হুড়মুড়িয়ে। ৪১ রান তুলতেই প্রথম চার ব্যাটসম্যান ফিরেছিলেন প্যাভিলিয়নে।
কাপালি-রাজিন মিলে প্রতিরোধ গড়েছিলেন খানিকটা, যে প্রতিরোধ ভেঙে গিয়েছিল দিনের খেলা শেষ হবার আট বল আগে। শাব্বির আহমেদের বাউন্সারে কাপালি সাজঘরে ফিরেছিলেন আহত হয়ে। রাজিন সালেহ অবশ্য আরও একবার প্রতিরোধ গড়েছিলেন ব্যাট হাতে। দিনের শেষভাগে তাকে সঙ্গ দিয়ে যান খালেদ মাহমুদ। দ্বিতীয় দিনশেষের স্কোর লেখা হয়: বাংলাদেশ ৭৭-৪।
ধুলিঝড়ের জন্যে তৃতীয় দিনে খেলা শুরু হতে দেরি হয়েছিল কিছুটা, বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার পরে দিনের খেলা শুরু করেছিলেন রাজিন-খালেদ, অবশ্য খালেদ মাহমুদ মাত্র এক বলের জন্যেই। শাব্বির রহমানের করা দিনের প্রথম বলেই এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি।

***
এমনিতে ২৮ গড়ের এক উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানকে মনে রাখবার কোনো কারণ নেই, যদি না ৩৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে অবিশ্বাস্য কোনো কীর্তি গড়ে বসেন। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে (ওটাই ছিল তার শেষ টেস্ট) বোধহয় রশিদ লতিফের স্বাদ জেগেছিল ক্রিকেট-সমর্থকদের মনে জায়গা করে নেবার। রশিদ লতিফ সফল হয়েছিলেন, তাকে ভুলে যাওয়াটা সম্ভব নয়!
আগের দিনের রক্তঝরা স্মৃতি ভুলে অলক কাপালি ক্রিজে নেমেছিলেন সুজন আউট হবার পরই। পাকিস্তানি পেসারদের সামলাচ্ছিলেন ভালোই, ৪০ বল অব্দি। ৪১তম বলটি ডিফেন্সমতো করতে চাইলেন, ব্যাটের কানায় লেগে বল গেল উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে, রশিদ লতিফ বুঝে গিয়েছিলেন বল তার গ্লাভস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে, যা তিনি পরবর্তীতে স্বীকারও করে নিয়েছেন একাধিক সাক্ষাৎকারে।
তবে তার আগেই অবশ্য প্রতারণা যা করবার করে ফেলেছেন। বারদুয়েক গড়াগড়ি খেয়ে পড়িমড়ি চেষ্টায় রশিদ লতিফ বোঝাতে চাইলেন, বল তার গ্লাভসেই আটকেছে। আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা বুঝ মানলেন, দিবালোকের মতো পরিষ্কার এক ড্রপ ক্যাচে অলক কাপালি আউট হলেন। বাংলাদেশের লিড তখন ১৯৭।
অশোকা ডি সিলভার ওই ভুলকে ‘মানবীয়’ বলে এড়িয়ে যাবার সুযোগ ছিল, তবে মোহাম্মদ রফিকের আউটের বেলায় তো ইচ্ছাকৃত ভুল বললেও কম বলা হচ্ছে। লেগ স্ট্যাম্পের হাতখানেক বাইরে পিচ করা বলে তিনি যেভাবে আঙুল তুলে দিলেন, তাতে উমর গুলের বদলে উইকেটটি আদতে ডি সিলভারই প্রাপ্য।
শুরুতে ব্যাটিং বিপর্যয়, শেষভাগে কিপার-আম্পায়ারের ওই কার্যকলাপের পরে ইনিংস নিয়ে বলার খুব বেশি কিছু থাকে না। রাজিন সালেহ’র ৪২ রানকে উল্লেখ করা যায়, তবে কাব্যের চেয়ে ওই ইনিংসকে প্রতিরোধ বলেই চালাতে হয়। খালেদ মাসুদ-তাপস বৈশ্য শেষদিকে যোগ করেন আরও কিছু। বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে বিপর্যস্ত হয় আরও একবার, থামে ১৫৪ রানে।

তবে পাকিস্তানের সামনে লক্ষ্যমাত্রা তো দাঁড়িয়েছিল ২৬১ রানের; যে সংখ্যাটি আরও বড় কেন হয়নি, তা নিয়ে হা-হুতাশ করা যায়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে হতাশার চাইতে আত্মবিশ্বাসটাই খেলা করে যায় মনে। মুলতানের ওই উইকেটে ২৫০-য়ের বেশি হলেই আটকে রাখা সম্ভব, এমন একটি বার্তা যে কোচ-অধিনায়ক মিলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে।
***
সে টেস্টে মাশরাফি খেলেননি। খালেদ মাহমুদ সুজন মাশরাফিকে চেয়েছিলেন, পেশোয়ারে দ্বিতীয় টেস্ট খেলবার আগে মাশরাফিকে বলেছিলেন, ‘এটায় (পেশোয়ার টেস্ট) না, পরেরটায় (মুলতান টেস্ট) খেল’, মাশরাফি সুজনকে শোনেননি। উইকেটে ঘাস দেখেও ডেভ হোয়াটমোরকে পরিকল্পনা থেকে নড়ানো যায়নি, মাশরাফিকে সেবারের পাকিস্তান সফরে টানা তিন টেস্টে খেলানো হয়নি। খালেদ মাহমুদ সুজন তাই আক্ষেপে পোড়েন আজও। মাশরাফি থাকলে হয়তো ‘কিছু একটা হতো!’

হয়তো বা তখন সালমান বাটকে ফেরানোর জন্যে বায়ান্ন বল অপেক্ষা করতে হতো না। কোনো উইকেট পতনের আগেই পাকিস্তানের স্কোরবোর্ডে ৪৫ রান জমা পড়ত না। অভিষিক্ত এক ব্যাটসম্যান অমন অবলীলায় ড্রাইভ আর পুল খেলে তাক লাগিয়ে দিতে পারতেন না।
অবশ্য বাটকে ফেরানো তো মাশরাফি ছাড়াও সম্ভব ছিল। বাট তো সুযোগও দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত দশ রানে। হান্নান সরকার পারেননি ক্যাচ জমাতে। শেষ অব্দি বাটকে ফেরাবার জন্যে তাই মাশরাফির সাহায্যই লেগেছিল। বদলি ফিল্ডার হিসেবে মাশরাফি নেমেছিলেন ফিল্ডিংয়ে। স্লিপে ওই ক্যাচ দেবার আগেই অবশ্য বাট মাত্র ৩৪ বলেই করে গিয়েছিলেন ৩৭ রান।

মাশরাফি এরপর ক্যাচ ধরেছিলেন আরও দু’টি। তাপস বৈশ্য আর মানজারুল ইসলামকে সরিয়ে রফিক আর সুজন বোলিংয়ে আসতেই লাগাম পড়েছিল রানের চাকায়। তৃতীয় দিনের চা বিরতির পর থেকেই উইকেট পড়তে শুরু করেছিল নিয়মিত বিরতিতে। মোহাম্মদ হাফিজ আউট হয়েছিলেন গালিতে ক্যাচ দিয়ে, ইয়াসির হামিদ, ফারহান আদিলও পারেননি বেশিক্ষণ টিকতে। আর ইউনিস খান পড়েছিলেন রানআউটের ফাঁদে। ৮১ রানে ৫ উইকেট হারানো পাকিস্তান দিন শেষ করেছিল ৬ উইকেটে ১৩২ রানে। পাকিস্তানের টপ-অর্ডারের সব ব্যাটসম্যানই দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছিলেন ওই টেস্টের জন্য, একজন বাদে। নাম তার ইনজামাম-উল হক।
***
হান্নান সরকার সে রাতে ঘুমোতে পারেননি। রাতভর ছটফট করে ভোরবেলায় টেলিফোন করেছিলেন দেশে, ম্যাচজয়ের জন্যে দোয়া চাইতে। এই মুহূর্তের অপেক্ষা তো কেবল ওই এগারোজনের ছিল না, ছিল পুরো এক দেশের।
বাংলাদেশ আর জয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইনজামাম-উল হক। সে বছরেরই বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ১৯ রান করার দরুন যিনি বাদ পড়েছিলেন দল থেকে, অবসরও নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন পাকিস্তান দল থেকে ওই সিরিজের আগে। রশিদ লতিফের বারবার করা আর্জিতে যে সিদ্ধান্ত পরে আর নেননি। পাকিস্তানের নির্বাচকেরাও তাকে ছেড়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে দল ঘোষণা করতে পারেননি।

‘কামব্যাক’ করেও ফর্ম ফিরে পেয়েছিলেন কই! মুলতানের দ্বিতীয় ইনিংসের আগ পর্যন্ত করেছিলেন সাকুল্যে ৮৮ রান। তবে নিজেকে নতুন করে চেনাবার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন ওই দ্বিতীয় ইনিংসকেই। পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন তৃতীয় দিনেই। প্রতিপক্ষের সেরা বোলার মোহাম্মদ রফিককে স্টেপডাউন করে চার মেরে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বড় কিছুর। পাকিস্তানকে শেষ অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই।
রশিদ লতিফ সুজনের ইয়র্কারে পরাস্ত হয়েছিলেন তৃতীয় দিনের পড়ন্ত বিকেলে। সাকলাইন মুশতাক নেমেছিলেন অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে। ততদিনে টেস্ট ক্রিকেটে শতক হাঁকিয়েছিলেন যদিও, তবুও তাকে ‘ব্যাটসম্যান’ বললে বিশেষণটির একটু অবমূল্যায়নই হয় বৈকি। উইকেটের মূল্য অবশ্য রাখতে পারেননি সেদিনও, ইনজামামকে ৬১ রানে রেখে খালেদ মাহমুদের বলে খালেদ মাসুদের হাতে ক্যাচ দিলেন তিনি। পাইলট কোনো ভুল করেননি।
ভুল হলো অবশ্য আরেকটু পরে। শাব্বির আহমেদ নেমেছিলেন নয়ে, ২৫ বল পরে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে প্যাভিলিয়নে ফেরার আগে পাকিস্তানকে এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ২০৫ রান অবধি। উমর গুলও ফিরতে পারতেন খুব তাড়াতাড়িই, কিন্তু খালেদ মাসুদেদ করা থ্রো উইকেটে আঘাত হানার আগেই হাত দিয়ে বেল ফেলে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক। উমর গুল রানআউট হননি। ওখান থেকেই ম্যাচের লাগাম হাতছাড়া!
খানিক আগে উমর গুলের দেয়া সুযোগটি কাজে না লাগানোকে অবশ্য ভুল বলতে মন সায় দিচ্ছে না। রফিক বল ছুঁড়বার আগেই গুল বেরিয়ে গিয়েছিলেন ক্রিজ ছেড়ে, ম্যানকাডিং করবার জন্যে রফিকের হাতে সময়ও ছিল যথেষ্ট, কিন্তু বরাবরই ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী মনে হওয়া এ সুযোগটি রফিক নেননি। ম্যাচজয়কে তার কাছে দেশের সম্মান রক্ষার চাইতে বড় মনে হয়নি।

উমর গুল করেছিলেন মোটে পাঁচ রান। তবে অপরপ্রান্তের ইনজামামকে দিয়ে বাকিটুকু করিয়ে নেবার জন্যে তা-ই ছিল যথেষ্ট। দু’জনে মিলে গড়েছিলেন ৫২ রানের জোট, ইনজামাম সতীর্থকে রানআউট করেছিলেন আরও একবার, তবে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ইয়াসির আলী নামার সময়ে পাকিস্তানের দরকার ছিল মাত্র চার রান।
খালেদ মাহমুদের শেষ বলগুলো খেলতে ইয়াসির আলীর তেমন কষ্ট হয়নি। মুখোমুখি হওয়া চতুর্থ বলে সিঙ্গেল নিয়ে ব্যাটিং প্রান্তে নিয়ে এসেছিলেন ইনজামামকে। রান তাড়ার এক মাস্টারক্লাসে এতটাই নান্দনিক ব্যাটিং করেছিলেন, সে পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ম্যাচ হেরে গেলেও যার ম্যাচসেরার পুরষ্কার প্রাপ্তি আটকাতো না। তবে ইনজামাম ‘ট্র্যাজিক হিরো’ হতে চাননি। তখন অব্দি ১৯ চার আর এক ছক্কায় ১৩৪ রানে অপরাজিত থাকা ইনজামাম মেরেছিলেন মিড উইকেট দিয়ে মেরেছিলেন ২০তম চার। ম্যাচের সমাপ্তিও ওখানেই।
তবে শেষ হয়েও শেষ হলো কোথায়? সে ম্যাচের পরে বাংলাদেশ খেলে ফেলেছে আরও ৯৫ টেস্ট, তবুও মুলতান এখনো দুঃখই জাগায়। কথা পেয়েও কথা না রাখার দুঃখ কি অত সহজে ভোলা যায়!