ক্রিকেটের বাইবেলখ্যাত ‘উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাক’ কর্তৃক প্রতি বছরের ন্যায় এইবারও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ক্রিকেটারদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে আদি এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া শুরু ১৮৮৯ সাল থেকে। ইংলিশ মৌসুমের উপর ভিত্তি করে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। সর্বপ্রথম এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল ছয়জন বর্ষসেরা বোলারকে। এরপরের দুই বছরে যথাক্রমে সেরা নয়জন ব্যাটসম্যান এবং সেরা পাঁচ উইকেটরক্ষককে উইজডেন পুরস্কৃত করে।
উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাক ২০১৮ সালের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল। ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি আইসিসির বর্ষসেরা অ্যাওয়ার্ডের মতো এখানেও রাজত্ব করেছেন। তিনি উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার কিংবা উইজডেন লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার পুরস্কার জেতার পাশাপাশি বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছেন। এছাড়া তার স্বদেশী স্মৃতি মান্দানা উইজডেন বর্ষসেরা প্রমীলা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন রশিদ খান।
উইজডেন লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার
টানা তৃতীয়বারের মতো উইজডেন লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড জিতলেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। এছাড়া রোরি বার্ন্স, স্যাম কারেন, জস বাটলার, ট্যামি বিউমন্টের সাথে সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন নির্বাচিত হয়েছেন বিরাট কোহলি। তিনি ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের পর ২০১৮ সালেও উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। তার চেয়ে বেশি এই অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন শুধুমাত্র ডন ব্র্যাডম্যান (১০ বার) এবং গ্যারি সোবার্স (আটবার)। এছাড়া শেন ওয়ার্ন, ভিভ রিচার্ডস এবং জ্যাক হবস তিনবার করে উইজডেনের সর্বোচ্চ সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন।
বিরাট কোহলি ২০১৮ সালে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। বেশিরভাগ ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে খেললেও তার ব্যাটে রানের ফোয়ারা ছুটেছে। ২০১৮ সালে তিনি সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৭ ম্যাচে ১১টি শতক এবং নয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৮.৩৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৭৩৫ রান সংগ্রহ করেছেন। তার ১১টি শতকের মধ্যে সাতটি শতক এসেছে ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। গত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জো রুট ৪০ ম্যাচে ১,৯৩৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন। কোহলি প্রায় আট’শ রান বেশি করেছেন রুটের চেয়ে।
বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক সিরিজ কাটানোর সুবাদে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তিনি ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বশেষ টেস্ট সিরিজে পাঁচ ম্যাচে মাত্র ১৩৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন, সেখানে ২০১৮ সালের টেস্ট সিরিজের দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার পরও দু’টি শতক এবং তিনটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫৯.৩০ ব্যাটিং গড়ে ৫৯৩ রান সংগ্রহ করেছেন।
উইজডেন লিডিং উইমেন্স ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার
বিরাট কোহলির মতো স্মৃতি মান্দানাও আইসিসির বর্ষসেরা অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে আইসিসির বর্ষসেরা প্রমীলা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। স্মৃতি মান্দানা ২০১৮ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটেও দুর্দান্ত ছন্দে ছিলেন। উইমেন্স বিগ ব্যাশেও রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন তিনি।
ভারত প্রমীলা ক্রিকেট দলের এই বাঁহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ১,২৯১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে ১২টি ওয়ানডেতে একটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৬.৯০ ব্যাটিং গড়ে ৬৬৯ রান করেছিলেন। টি-টোয়েন্টিতেও রানের মধ্যে ছিলেন স্মৃতি। ২৫ ম্যাচের ২৩ ইনিংসে ব্যাট করে পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৮.২৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৩০.৬৭ স্ট্রাইকরেটে ৬২২ রান তুলেছিলেন তিনি, যার সুবাদে ২০১৮ সালে উইজডেনের ‘উইমেন্স ক্রিকেটার অব ইয়ার’ পুরস্কার জিতেছেন।
উইজডেন লিডিং টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার
বর্তমানের সীমিত ওভারের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বোলার আফগানিস্তানের রশিদ খান। এই লেগ স্পিনার বিশ্বের নানা প্রান্তে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। ছন্দে থাকা এই লেগ স্পিনার ২০১৭ সালের পর ২০১৮ সালেও ‘উইজডেন লিডিং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন।
২০১৮ সালে আইপিএল, বিগ ব্যাশ, সিপিএল এবং ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টসহ বেশ কয়েক জায়গায় খেলেছিলেন রশিদ খান। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারের রেকর্ড গড়েছিলেন ২০১৮তে। ৬১ ম্যাচ খেলে ১৫.৪৬ বোলিং গড়ে এবং মাত্র ৬.৩৬ ইকোনমি রেটে তিনি ৯৬ উইকেট শিকার করেছিলেন। টি-টোয়েন্টিতে অসাধারণ বোলিং করার সুবাদে তিনি উইজডেনের বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন।
উইজডেন’স ফাইভ ক্রিকেটার্স অব দ্য ইয়ার
২০১৮ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটার হলেন: বিরাট কোহলি, ট্যামি বিউমন্ট, স্যাম কারেন, জস বাটলার এবং রোরি বার্নস।
ইংল্যান্ডের উদীয়মান অলরাউন্ডার স্যাম কারেন উইজডেনের গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী ক্রিকেটার হিসাবে সেরা পাঁচজনের একজন নির্বাচিত হলেন। ২০১৮ সালের জুনে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। এরপর ভারতের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সিরিজসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। বেশ কয়েক ম্যাচে শেষের দিকে নেমে দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দিয়েছিলেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে চার ম্যাচের সাত ইনিংসে ৩৮.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ২৭২ রান করেছিলেন তিনি।
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও কার্যকরী ছিলেন তিনি। সিরিজে নিজের প্রথম আট বলের মধ্যে তিন উইকেট শিকার করেছিলেন স্যাম কারেন। সব মিলিয়ে সিরিজে চার ম্যাচ খেলে ২৩.৫৪ বোলিং গড়ে ১১ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারফর্ম করার আগে কাউন্টি ক্রিকেটেও ছন্দে ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দল সারে’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি।
কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন দল সারির অধিনায়ক রোরি বার্নসও উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে সারের হয়ে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। রোরি বার্নস ২০১৮ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ১৪ ম্যাচে চারটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৪.৭১ ব্যাটিং গড়ে ১,৩৫৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের নিয়মিত মুখ জস বাটলার গত বছর ধারাবাহিকভাবে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছেন। লোয়ার মিডল-অর্ডারে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে বেশ সফলও ছিলেন তিনি। দশ টেস্টে একটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪৪.৭০ ব্যাটিং গড়ে ৭৬০ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
ওয়ানডে ক্রিকেটেও অসাধারণ ব্যাটিং করেছিলেন বাটলার। ১৮ ইনিংসে দু’টি শতক এবং চারটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫১.৬১ ব্যাটিং গড়ে এবং ১১৩.৫৩ স্ট্রাইক রেটে ৬৭১ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অপরাজিত ১১০ রানের ইনিংস খেলে দলকে এক উইকেটের নাটকীয় জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। জস বাটলার ২০১৮ সালে ৪২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে তিনটি শতক এবং ১২টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪৩.০০ ব্যাটিং গড়ে ১,৬৭৭ রান করেছেন। ইংলিশ মৌসুমে দুর্দান্ত ব্যাটিং করার দরুন তিনি উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন।
ইংল্যান্ড প্রমীলা ক্রিকেট দল ২০১৭ সালে উইমেনস বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা জেতে, যার ফলে ঐ বছর উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের মধ্যে তিনজনই ছিলেন ইংল্যান্ড প্রমীলা ক্রিকেট দলের সদস্য। এর মধ্যে নাম ছিল না বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ট্যামি বিউমন্টের। তিনি ২০১৭ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের তালিকায় জায়গা না পেলেও ২০১৮ সালে জায়গা করে নেন।
ইংল্যান্ডের এই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ২০১৮ সালে নয়টি ওয়ানডে ম্যাচে দু’টি শতক এবং দু’টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৬.৫০ ব্যাটিং গড়ে ৪৫২ রান সংগ্রহ করেন। টি-টোয়েন্টিতে ১৫ ম্যাচে একটি শতক এবং দু’টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩০.৭১ ব্যাটিং গড়ে ৪৩০ রান করেছেন বিউমন্ট। এতে করে ২০১৮ সালে একমাত্র প্রমীলা ক্রিকেটার হিসাবে উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন নির্বাচিত হন তিনি।
বিরাট কোহলি টানা তৃতীয়বারের মতো উইজডেন লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড জেতার পাশাপাশি উইজডেন’স ফাইভ ক্রিকেটার্স অব দ্য ইয়ারের তালিকায় জায়গা করে নেন। ২০১৮ সালে দুর্দান্ত ফর্মে থাকার কারণে তিনি আইসিসির তিনটি বড় অ্যাওয়ার্ডও জেতেন। তিনিই প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে একই বছর আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার, বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার এবং বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন।
বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র ক্রিকেটার উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন তামিম ইকবাল। তিনি ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং করার সুবাদে ইয়োন মরগান, ক্রিস রিড এবং জোনাথন ট্রটের সাথে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন তামিম ইকবাল।