Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হেক্টর কাস্ত্রো: ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ী এক হাতবিহীন মহা-তারকা

৩০ জুলাই, ১৯৩০; প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে মাঠে মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী স্বাগতিক উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। মাঠে ও মাঠের বাইরেও টান টান উত্তেজনা। প্রথমার্ধ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ১-২ গোলে এগিয়ে থাকলেও বিরতির পর স্বাগতিক দল ৩-২ গোলের লিড নিয়ে নিয়েছিল। উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে দুই দলের সমর্থকরাই। আর্জেন্টাইনরা আশায় রয়েছে, হয়তো সমতায় ফিরবে তাদের দল। কিন্তু, তাদের এই আশার আগুনে পানি ঢেলে দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের ৮৯ মিনিটে গোল করলেন উরুগুয়ের এক স্ট্রাইকার, সেই সাথে প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় উরুগুয়ের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা। অতি সাধারণ কোনো গল্পের শুরু মনে হতে পারে। কিন্তু জেনে রাখুন, এই গোলটি যিনি করেছিলেন, তার ডান হাতের কনুই থেকে বাকি অংশ ছিল না, অর্থাৎ এক হাত নিয়েই তিনি চালিয়ে গেছেন ফুটবল খেলা এবং গোল করেছিলেন প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালেও!

বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে এই উরুগুইয়ান ফুটবলারের মতো কিংবদন্তি তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো বিশ্বকাপের হাজারও সোনালী মুহূর্তের ভিড়ে হারিয়ে গেছে একজন হার না মানুষের অনুপ্রেরণার গল্প। হেক্টর কাস্ত্রো, ফুটবলের এই মহা-তারকার কিংবদন্তি নিছক কোনো গল্প নয়, এই গল্প অনুপ্রেরণার, এই গল্প হার না মেনে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার।

কাস্ত্রো, ‘এল ডিভিনো মানকো’; Image Source: provenquality.com

উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে জন্ম হেক্টর কাস্ত্রোর। এই শহরে তখন দেশটির তিন ভাগের এক ভাগ জনগণ বাস করতো। লাতিন আমেরিকার আরও অনেক কিংবদন্তির মতোই কাস্ত্রোরও জন্ম হয়েছিল অতি দরিদ্র এক পরিবারে। পরিবারের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, খেলাধুলা করে সময় কাটানোর বয়সেই কাজে নামতে হয়েছিল তাকে। মাত্র ১০ বছর বয়সী শিশু কাস্ত্রো কাজ শুরু করেছিল এমন একটি জায়গায়, যেখানে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কাজ করতে হতো তাকে। একদিন বৈদ্যুতিক করাত ব্যবহার করে কাঠ কাটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ডান কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার হাত, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর! এক হাত হারিয়ে ১৩ বছরের বালকের জীবন যুদ্ধ আরও কঠিন হয়ে পড়ে, কিন্তু হাল ছাড়েননি কাস্ত্রো।

উরুগুয়েতে হেক্টর কাস্ত্রোকে ডাকা হয় ‘এল ডিভিনো মানকো’, অর্থাৎ ‘এক হাত বিশিষ্ট ঈশ্বর’ নামে। উরুগুইয়ানরা অবশ্যই তাদের এই কিংবদন্তিকে যথার্থ সম্মান দিয়েছে। কারণ, এক হাত নিয়ে কাস্ত্রো প্রায় ১৫ বছরের যে বর্ণালী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছিলেন, তা ছিল এককথায় রূপকথার চেয়েও বেশি কিছু। উরুগুয়ের প্রথমদিকের ফুটবল কিংবদন্তিদের মধ্যে অন্যতম এই তারকা ক্যারিয়ারে উরুগুয়ের লিগ শিরোপা থেকে শুরু করে জিতেছেন বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, এমনকি অলিম্পিক স্বর্ণ পদকও।

১৭ বছর বয়সে তিনি যোগ দিয়েছিলেন অ্যাটলেটিক ক্লাব লিটোতে। সুযোগ পেয়েই নিজের প্রতিভার ঝলক দেখাতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি তিনি। পরিশ্রম ও প্রতিভার অনন্য মিশেলে গড়া অদম্য কাস্ত্রো ১৯ বছর বয়সেই ডাক পেয়ে যান উরুগুয়ের সেরা দুই ক্লাবের একটি, নাসিওনালে। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯২৩ সালে নাসিওনালে যোগ দিয়েই জেতেন ঐ মৌসুমের লিগ শিরোপা। জাতীয় দলেও তার অভিষেক হয় একই বছরে। অবশ্য পরের বছরের অলিম্পিক দলে জায়গা হয়নি তরুণ এই খেলোয়াড়ের। তবে পরবর্তী অলিম্পিক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এই এক হাতবিহীন ফুটবলার, যিনি জন্ম দিতে চলেছিলেন বিস্ময়ের। ১৯২৮ সালে উরুগুয়ে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নেয় স্বর্ণপদক, একই সাথে এটিই ছিল কাস্ত্রোর প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা।

বিশ্বকাপ জয়ী প্রথম উরুগুয়ে দল; Image Source: conmebol.com

ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আসরের মঞ্চায়ন শুরু হয়েছিল লাতিন আমেরিকার উরুগুয়েতে এবং এই আসরই ছিল কাস্ত্রোকে ইতিহাসের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে মোক্ষম মঞ্চ। জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে এত দূর আসা কাস্ত্রো খুব কম সুযোগই হাতা ছাড়া করেছেন। তাই বিশ্বকাপ মঞ্চেও তিনি ছিলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাওয়া এক যোদ্ধা।

প্রথম বিশ্বকাপে স্বাগতিক উরুগুয়ের হয়ে পেরুর বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন হেক্টর। পেরুর বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ের ম্যাচটিতে একমাত্র গোল ও বিশ্বকাপে উরুগুয়ের প্রথম গোল করেছিলেন তিনিই। কিন্তু পরবর্তী ম্যাচেই একাদশ থেকে বাদ পড়েন তিনি। তার জায়গায় নামানো হয় আরেক স্ট্রাইকার আনসেলমোকে। আলসেলমোও সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলে ও গোল করে দলে নিজের জায়গা অনেকটা শক্ত করে নিয়েছিলেন। অবশ্য সেমিফাইনালে ইনজুরিতে আক্রান্ত হলে ফাইনাল ম্যাচে কাস্ত্রো ছিলেন উরুগুয়ের অন্যতম পরীক্ষিত সৈনিক। ফাইনালে আর্জেন্টিনার কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকেছিলেন উরুগুয়ের ফুটবলের ‘এক হাত বিশিষ্ট ঈশ্বর’, সেই সাথে বিশ্ব ফুটবলে উরুগুয়ে জায়গা করে নেয় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী দল হিসেবে।

প্রতিকূলতা সত্বেও মাঠে কাস্ত্রো ছিল অপ্রতিরোধ্য; Image Source: bluradio.com

বিশ্বকাপে কাস্ত্রোর কিংবদন্তির সবচেয়ে বড় মঞ্চায়ন হলেও তিনি তার অদম্য মনোভাব ও প্রতিভার ঝলক দেখানো শুরু করেছিলেন ১৯২৬ সালের কোপা আমেরিকার আসরে। এই আসরে উরুগুয়ের হয়ে ৪ ম্যাচে ৬ গোল করে দলের শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। উরুগুয়ের হয়ে ২৫ ম্যাচে ১৮ গোল করা এই কিংবদন্তি ছিলেন তার সময়ে দেশটির অন্যতম শীর্ষ গোলদাতা। মাত্র একটি বিশ্বকাপ খেলারই সুযোগ হয়েছিল কাস্ত্রোর। ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপে উরুগুয়ে অংশগ্রহণ না করায় এই আসরে আর দেখা যায়নি তাকে। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের আগে, ১৯৩৫ সালে উরুগুয়ের হয়ে দ্বিতীয় কোপা আমেরিকা শিরোপা জিতেছিলেন তিনি এবং এই আসরে পেরু ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোলও করেছিলেন। একটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক, দুটি কোপা আমেরিকা ও একটি বিশ্বকাপ শিরোপা! আন্তর্জাতিক ফুটবলে হেক্টর কাস্ত্রো জিতেছিলেন তার সময়ের সম্ভাব্য সব শিরোপাই, তা-ও মাত্র এক হাত নিয়ে।

 উরুগুয়ের এক হাতবিহীন ফুটবল ঈশ্বর; Image Source: elpais.com

কাস্ত্রোর ক্লাব ক্যারিয়ার অবশ্য দুই ভাগে বিভক্ত- খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে। খেলোয়াড় কাস্ত্রো তিনবার উরুগুয়ের জাতীয় লিগ শিরোপা জিতেছিলেন। তিনি ছিলেন দারুণ পরিশ্রমী, শক্তিশালী ও কার্যকর একজন ফুটবলার। লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে বলার মতো কৌশল ও সৌন্দর্য তার খেলায় দেখা না গেলেও গোল করায় তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। ১৯৩৬ সালে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে ফুটবলের বুট জোড়া তুলে রাখার সময়ে উরুগুয়ের প্রিমেরা ডিভিশনের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি, ১৮১ ম্যাচে করেছিলেন ১০৭ গোল। অবসর নেওয়ার মাত্র কয়েক বছর পরই কোচ হিসেবে শুরু করেন নতুন ক্যারিয়ার, শুরু হয় কাস্ত্রোর কিংবদন্তির আরেকটি ভিন্ন মাত্রা।

ফুটবলের এক মহা-তারকা; Image Source: uni-watch.com

নাসিওনালের কোচের দায়িত্ব নিয়ে কাস্ত্রো দেখিয়েছিলেন অসামান্য এক চমক। যে কয়টি বছর এই ক্লাবের দায়িত্বে তিনি ছিলেন, প্রত্যেক বছরই নাসিওনাল জিতেছিল লিগ শিরোপা। দুই দফা দায়িত্ব পালনের সময় তিনি জিতেছিলেন পাঁচটি লিগ শিরোপা, প্রথম দফায় ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ সাল, টানা চারটি শিরোপা জিতে নেয় তার অধীনে থাকা ক্লাবটি। পরবর্তীতে আবারও ১৯৫২ সালে ক্লাবের দায়িত্ব নিলে সে বছরও লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ের জনপ্রিয় এই ক্লাবটি। উরুগুয়ের কোচ হিসেবে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি পদত্যাগও করেছিলেন।

১৯৬০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদাসীন কাস্ত্রো। নাসিওনাল, উরুগুয়ে এবং সর্বোপরি ফুটবলের অবিসংবাদিত কিংবদন্তি তিনি। দুর্ঘটনায় এক হাত হারানোর পরও দমে না গিয়ে চালিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবল খেলা, অদম্য ও প্রত্যয়ী এ মানুষটি জয় করেছিলেন ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রায় সব শিরোপা। তিনি দেখিয়েছিলেন, ইচ্ছা ও প্রবল মানসিক শক্তির কাছে কোনো কিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তার এই কিংবদন্তি শুধুমাত্র ফুটবল নয়, সাধারণ জীবনেও অনুপ্রেরণা অপার উৎস।

ফিচার ইমেজ- transfermarkt.com

Related Articles